Abosar

চিরন্তন

বর্ষা পূততুণ্ড

দক্ষিণ খোলা আমার প্রিয় বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে নিজের কথাই ভাবছিলাম। ভাল লাগাগুলো কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। চিরকাল আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। এখন বিবির ঘরে যখন হিন্দি গান বেজে ওঠে, মন্দ লাগে না। বেজ রঙের শাড়ির বদলে কালচে লাল রঙের শাড়ি পরতে ইচ্ছে করে। মা-র মতো চওড়াপাড় ধনেখালি পরি না। পরি কলমকারি, বোমকাই। পতিদেবতা পরেন টি-শার্ট আর প্যান্ট। বিয়েবাড়ি থাকলে পাজামা-পাঞ্জাবি। দুজনেই চুলে রংটংও করে ফেলেছি।

কিন্তু বিবি, মানে আমার মেয়ে যখন কুচকুচে চুলের মাঝে মাঝে ব্রাউন ছোপ লাগাল, মনটা যেন কেমন করে উঠল। বিবিকে ডেকে বলতে গেলাম, “হ্যাঁ রে, এটা কী করলি বল তো? তোর এত সুন্দর চুল! ছোটবেলায় কত যত্ন করেছি!”

আমার কথা কানেই নিল না। শুনবে কী করে? কানে তো সব সময় ইয়ারফোন গোঁজা!

তবে মেজাজটা মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। খেতে ভালবাসি। ওজনটা বেশ বেড়ে গেছে। বাবা আর মেয়ে পরামর্শ করে নিয়ে এল ট্রেডমিল। হেঁটে হেঁটে দম ফুরিয়ে যায়। ছোটপিসিমার মোটাসোটা, গোলগাল চেহারাটা মনে পড়ে। নিশ্চিন্ত মনে টপাটপ রসগোল্লা খেতেন। পিসেমশাই  হাসিমুখে প্রশ্রয় দিতেন, “মান্তু, মিষ্টিটা খুব ভালবাসে। তাই কিনে নিয়ে এলাম।” বড্ড ভালবাসতেন ছোট পিসিমাকে।

সে যা-ই হোক, এখন মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি। বাপকে দিব্যি পটিয়ে নিয়েছে। মেয়ের কোনও দোষ দেখতে পান না তিনি। আমি একটু কথা বলতে ভালবাসি। মেয়ের কি সময় আছে আমার সঙ্গে কথা বলার? খাবার টেবিলে বাপ-বেটি দুজনেই  মাথা নিচু করে মোবাইলের বোতাম টিপে যায়। কথা বললে উত্তর পাওয়া যায় না। মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। তাই আমিও নির্বিকার মুখে একটা ম্যাগাজ়িন হাতে নিয়ে খেতে বসে যাই। সাধের কাঁচকলার কোপ্তা কেমন হয়েছে, জানতেও চাই না।

তবে মন ভাল করে দেয় মেয়ের বয়ফ্রেন্ডটি। নামটাও বেশ। নীলেন্দু। নীল বলেই ডাকা হয় তাকে। মেয়ে তো আমার ময়লা। মুখ-চোখের ছিরি অবশ্য ভাল। রোগা, পাতলা আর একঢাল চুল। দেখতে ভালই লাগে। তবে ডানাকাটা পরি নয়। ও দিকে নীল রীতিমতো হ্যান্ডসাম। নম্র, ভদ্র, বাধ্য। বাড়িতে প্রায়ই আসে। ভালমন্দ খাবার করে রাখি ওর জন্য। এখন দুগ্গা দুগ্গা করে চার হাত এক হলে হয়।

মেয়ের বাবাটিও সেই রকম। পরামর্শ করতে গেলেই থামিয়ে দেন।

“অত বিয়ে-বিয়ে কোরো না তো! ওরা নিজেরাই ঠিক করে নেবে। একটু সময় দাও।”

“ও মা! সে কী কথা! বিয়ে তো দিতেই হবে বাপু।”

“অত ভেবো না তো। দেখো না কী হয়!”

তাই আমিও ছেড়ে দিয়েছি। যা হয় হোক।

কত্তা-গিন্নি দুজনে মিলে লাফিং ক্লাবে ভর্তি হয়েছি। মেয়েই জোর করে ঢোকাল। প্রথমে আমি না বলে দিয়েছিলাম। হাসতে হয় তো নিজেরা বাড়িতে বসে হাসি গল্প করি না কেন? তার জন্য আবার লাফিং ক্লাবের কী দরকার? মেয়ে ঝেঁঝে উঠল, “বাড়িতে হাসার সময় কোথায় তোমাদের? বাবি খবরের কাগজটা মুখস্থ করে। আর তুমি পচা সিরিয়ালগুলো হজম করো। তা ছাড়া এটা এখন ইন থিং। নীল বলছিল, ওর মা-ও স্টার্ট করেছে।”

তাই বল বাপু! এটা নীলই মাথায় ঢুকিয়েছে। তা হলে তো আর কথাই নেই। যেতেই হবে।

কাজের মেয়ে বিন্তিও বলে উঠল, “হ্যাঁ গো মাসিমা, ভোরবেলা কাজে বেরোবার সময় পাশের পার্ক থেকে আওয়াজ শুনতে পাই। যাও না গো। মেয়ে এত করে বলছে।”

তা লাফিং ক্লাবটি মন্দ নয়। একটু গল্পগুজবও হয়। সময়টা ভালই কাটে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে-থা, পড়াশোনা, চাকরিবাকরি এই সব নিয়ে আলোচনা হয়। আমিও খোলা মনে বিবির কথা, নীলের কথা বলি। সবাই জানতে চায় বিয়েটা কবে হবে। উত্তর খুঁজে পাই না। শাশ্বতীদির সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগে। আমার দুশ্চিন্তার কথা ওঁকে খুলে বলেছি। শাশ্বতীদি ডিভোর্সি। চাকরি করতেন। কাঁধ অবধি চুলে বাহারি কাট, চোখে সোনালি ফ্রেমের রিমলেস। মিষ্টি হেসে বলেন, “অত তাড়াহুড়ো করছ কেন? একটু ঘুরে-টুরে বেড়াচ্ছে, বেড়াতে দাও না। ওদের বয়সটা ভুললে চলবে কেন। নিজের কম বয়সটা মনে পড়ে?”

মনে পড়ে বইকি! ভাল লেগেছিল রুদ্রকে। মাসির দেওরের ছেলে। মাসির বাড়িতেই দেখা হত। গান শোনা, গল্প করা, দু’-এক বার সিনেমাতেও গেছি। মাসির উৎসাহেই ব্যাপারটা এগিয়েছিল। কিন্তু রুদ্র ভাল চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। বাড়ির অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। বাবা বিয়ের সম্বন্ধ খুঁজছিলেন। মাসির কথা কানেই তুললেন না।

খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সময়মতো নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। পাত্রের দারুণ চাকরি, শ্বশুরবাড়ির জমকালো অবস্থা সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। বাবা বিয়েতে খুব ঘটা করেছিলেন। শাড়ি-গয়নার ছড়াছড়ি। কিন্তু মাঝে মাঝেই রুদ্রকে মনে পড়ত। ওর সেই একহারা লম্বা, শ্যামলা চেহারা, দরাজ গলার রবীন্দ্রসঙ্গীত, প্রাণখোলা হাসিটা! কম বয়সে বরের সঙ্গে মন কষাকষি হলে অন্ধকার বারান্দায় বসে রুদ্রর কথা ভেবে চোখে জল টলমল করে উঠত। বুক হু হু করত। যাক গে, সে সব কথা ভেবে আর কী হবে! আমার উনি মানুষটি মন্দ নন। হইহুল্লোড়, খাওয়াদাওয়া, বেড়ানো খুব ভালবাসেন। তবে ঠিক মেলে না। গভীর রাতে বাইরে যখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ত, কালো মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ উঁকি মারত, আমার ঘুম আসত না। মনে হত, জানলায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখি। আমার বর তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোত। জাগালে বলত, “জানলা বন্ধ করে দাও। ওই জোলো হাওয়ায় আমার নাকটা সড়সড় করছে। ঠান্ডা লেগে যাবে।”

মনের জানলা বন্ধই হয়ে গেল। আর বৃষ্টি দেখতে চাইনি কোনও দিন। মনখারাপ নিয়ে অন্ধকার বারান্দায় বসেও থাকিনি। অনেক জল বয়ে গেল নদীতে। অনেক বদলে গেলাম।

 

বিবি আর নীলকে একসঙ্গে দেখে বড় ভাল লাগে। মনটা ভরে যায়। দুজনে খুনসুটি করে, হেসে লুটিয়ে পড়ে। আবার পরস্পরের দিকে গভীর চোখে তাকায়। দূরাগত বসন্ত বাতাসে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে। এক সঙ্গে চাকরি করে বলে দিনের অনেকটা সময় এক সঙ্গে কাটায় ওরা। বাকি সময়টাও ফোনে গল্প করে, চ্যাট করে। তার পর আবার সেই ভ্যালেন্টাইন ডে-র উচ্ছ্বাস। দুজনে দুজনকে গিফ্‌ট দেয়, সুন্দর সুন্দর কার্ড কেনে। এ বার নীল বিবিকে একটা ছোট্ট হিরের পেনডেন্ট দিয়েছে। আমাদের সময়ে উপহার ছিল বই। আমরা তাতেই গলে যেতাম। সবার চোখ এড়িয়ে দুটো কথা বলতে পারাই ছিল অনেক।

তাই বিবি যখন এসে বলল যে, ও নীলের সঙ্গে দু’দিনের জন্য মন্দারমণি যাচ্ছে, আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মেয়েকে বুঝিয়ে বলতে গেলাম, “এ সব এখন থাক না, বিবি। আগে বিয়েটা হোক। চল না, এক দিন নীলের বাড়িতে যাওয়া যাক। ওদের সঙ্গে কথা বলি।”

“মা, প্লিজ় বাগড়া দিয়ো না তো। অনেক দিন ধরে এই ট্রিপটা প্ল্যান করছি আমরা। একটা নতুন ড্রেস পর্যন্ত কিনে ফেললাম আর এখন
তুমি বলছ…”

“বিয়ের আগে এটা করিসনি মা। আমার কথাটা শোন…”

শুনল না। মেয়ের বাবারও ব্যাপারটা খুব পছন্দ হয়নি বুঝতে পারলাম। কিন্তু উনি মেয়েকে কিছু বলতে চাইলেন না।

“ছেড়ে দাও। সবাইকে বলবে কোলিগদের সঙ্গে বেড়াতে গেছে।”

তাই বলতে হল সবাইকে। মন্দারমণি থেকে বিবি ফোন করেছিল। খুব খুশি। খুব এনজয় করছে। শাশ্বতীদিকে কথাটা না বলে পারলাম না। উনি একটুও অবাক হলেন না। বললেন, “আরে এ সব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না আজকাল। অযথা ফাস করছ তুমি। বিবি বুদ্ধিমতী। ভাল চাকরি করে। নিজের ভাল ঠিক বুঝবে।”

মনটা হালকা হল। মনের মধ্যে একটা বিশ্বাস জ্বলজ্বল করত। বিবিকে যখন নীলের সঙ্গে দেখতাম, খুব ভাল লাগত। সুখের পাখিটা যেন ওদের জীবনে বাসা বেঁধেছিল। বিবি নিজের ভালবাসার মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধবে ভেবে আমার রোমাঞ্চ হত। অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হাওয়ায় ভাসছিলাম। নীল আর বিবি দুজনে দুজনের বাড়িতে আসা-যাওয়া করত। নীলের বোনও এক দিন এসেছে আমাদের বাড়িতে। ভেবেচিন্তে এক দিন ওদের খেতে ডাকলাম। নীলের মা ঠিক আমার মতো নন। খুব মডার্ন। ওই যাকে বলে হাই-ফাই। খুব সাবধানেই কথা বললাম। উনি তো নীলের বাবার সঙ্গে পলিটিক্স নিয়েই গল্প করে গেলেন। বিবি নীল আর তার বোনকে নিজের ঘরে বসাল। হাসির আওয়াজ ভেসে আসছিল। রান্নার প্রশংসা করে, খেয়েদেয়ে ওঁরা চলে গেলেন।

যাওয়ার সময় নীলের মা-র কাছে আলতো করে বিয়ের কথাটা পাড়লাম। উনি বললেন, “হ্যাঁ, এ বার তো একটা দিন-টিন দেখতে হয়। আপনারা এক দিন আসুন আমাদের ওখানে। সে দিন ঠিকঠাক করা যাবে।”

মনটা লাফিয়ে উঠল। বিবির বাবাকে বললাম। ওদের বাড়ি যাওয়ার প্ল্যান করতে শুরু করলাম। আমার সব উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে উনি বললেন, “একটু ওয়েট করো। আমাকে তো নেক্সট উইক ট্যুরে বেরোতে হচ্ছে। ফিরে এসে দেখা যাবে নাহয়।”

ট্যুর মানে দিনসাতেকের ধাক্কা। তার পর আবার মামাতো বোনের মেয়ের বিয়ে দিল্লিতে। না গেলেই নয়। অনেক আগে থেকে বলে রেখেছে। মেয়ের ছুটি নেই। কাজের চাপ। যেতে পারবে না। স্যুটকেস গুছিয়ে রেডি হয়ে রইলাম। উনি ফিরে আসার পর দুজনে বিয়েবাড়ির দিকে রওনা দিলাম। মেয়ে রইল বলে একটু চিন্তা রয়ে গেল। কিন্তু মনটা আনন্দে ভরপুর। জানি বিয়েবাড়িতে সবাই জানতে চাইবে বিবির বিয়ের কথা। বিয়ের কনে আর বিবি প্রায় সমবয়সি কিনা! কিন্তু সুখবরটা এখন মোটেই ফাঁস করা যাবে না। বিয়ের দিনটা ঠিক হোক, তার পর।

 

ফিরে এসে দেখলাম বিবি অফিসের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। মুখটা কেমন শুকনো-শুকনো। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেনি হয়তো। অফিস থেকে ফিরল অনেক রাত করে। বিয়েবাড়ির গল্প করতে গেলাম, পাত্তাই দিল না।

পরের দিন এক বার লকারে গেলাম। কিছু গয়না বেছে নিয়ে এলাম। এগুলো বদলে ওকে হালফ্যাশনের কিছু গড়িয়ে দেব। বিবিকে বলতে হবে। নীলের মা-কেও তো ফোন করতে হবে। বাবা আর মেয়ে বাড়ি ফেরার পর খাবার টেবিলে কথাটা পাড়লাম। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাত কি একেই বলে? আমাদের দুজনকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বিবি বলে উঠল, “ও সব গয়না-ফয়না এখন ছাড়ো মা। আর নীলের বাড়িতে ফোন করার কোনও দরকার নেই।”

আমাদের দুজনেরই খাওয়া থেমে গেল। বিবির বাবা বিচলিত স্বরে বলে উঠলেন, “কী বলছ বিবি! কী হয়েছে?”

খেতে খেতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল বিবি, “বিয়ে-টিয়ে হচ্ছে না। আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”

“মানে? ব্যাপারটা কী?” বিবির বাবার গলায় উত্তেজনা। আমার মুখে ভাষা নেই। বুকটা ধড়ফড় করছে। খাওয়া শেষ করে উঠে যেতে যেতে ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল বিবি, “হ্যাঁ। আমরা ভেবে দেখলাম যে, আমাদের ঠিক অ্যাডজাস্টমেন্ট হচ্ছে না। সেই জন্য একটা মিউচুয়াল ডিসিশন নিলাম। তা ছাড়া নীলের এক্স ফিরে এসেছে লন্ডন থেকে। যা-ই হোক, অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল আবার একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। শুয়ে পড়ি। গুড নাইট গাইজ়।”

মনটা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। এমনটাও হয়? পুরনো ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। ওদের চাহনি, হাসি সবই তো আমার দেখা। বিবিকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি। ভালবাসা চিনতে ভুল হল কি আমার? একটা অসহ্য মনখারাপ আমায় ঘুমোতে দিল না।

 

মাঝরাতে বারান্দায় বসব ভেবে গিয়ে দেখি, মেয়েটা আমার মুখ কালো করে অন্ধকারে বসে আছে। এই রাত-জাগা মনখারাপটা আমার চেনা। বুঝলাম, কিছুই বদলায়নি। কিছু জিনিস বদলায় না কখনও। বাইরেটা হয়তো বদলে যায়, কিন্তু ভেতরটা একই থাকে। সময় তাকে ছুঁতে পারে না। প্রিয়জন বিহনে হৃদয়ের তারগুলো ঠিক সময়ে ঠিক সুরে বেজে ওঠে। তখন গভীর রাতের অন্ধকার বারান্দা দেখতে পায় সেই সব নিঃসঙ্গ মানুষকে। দেখে, তারা দূরের দিকে চোখ মেলে কাউকে যেন খুঁজছে। আর তার মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট মুক্তোবিন্দুর মতো গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে।