বাড়িটা পেতে মোটেই অসুবিধে হল না। নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিল সুপ্রিয়া। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়লাম এখানেই। সময়ের কিছু বাড়তি ধুলো ও মালিন্যটুকু বাদ দিলে সুপ্রিয়ার বর্ণনার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায় আজকের বসুবাড়ি। যদিও আমার এ শহরে আসার উদ্দেশ্য সুপ্রাচীন এই বসুবাড়ি দর্শন নয়। এই বাড়ির কথা কেবল ল্যান্ডমার্ক হিসেবে জানিয়েছিল সুপ্রিয়া। এর ঠিক ডান পাশের দ্বিতীয় বাড়িটাই আমার গন্তব্য।
সে দিকেই পা বাড়ালাম। বসুদের সীমানা ঘেঁষে প্রথম বাড়িটার পরে হলুদ রঙের মধ্যবিত্তসুলভ দোতলা বাড়িটার গেটে পৌঁছে ডোরবেল বাজালাম। উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ি এটা হলেও বাসিন্দারা একই আছেন কি না, এ নিয়ে সংশয় একটা আছেই। কেননা সুপ্রিয়া যা-ই বলেছে সবই পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার স্মৃতি হাতড়ে। তখনকার এক নেহাতই কিশোরীর স্মৃতি ভিত্তি করে আমার এই ছুটে আসা বালকসুলভ আচরণ মনে হবে হয়তো। সুপ্রিয়া নিজেই আমাকে পাগল ঠাওরেছে প্রায়। কিন্তু এটুকু পাগলামি না থাকলে যে কাজে হাত দিয়েছি সেটা সম্পূর্ণ করা কঠিন। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো রসদ খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি। যেখানেই সামান্য সম্ভাবনা দেখছি, এ ভাবেই ছুটে যাচ্ছি।
ছেলেবেলায় বেশ ক’বছর চন্দ্রপুরে কাটিয়েছিল সুপ্রিয়ারা। এই বসুবাড়ির আশেপাশেই কোথাও ভাড়া থাকত ওরা। এখন যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে থাকত ওর বাল্যসখী বিমলা। ওরা চন্দ্রপুর ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বন্ধুত্বে চিরকালের মতো ছেদ পড়ে। কিন্তু সুপ্রিয়া এখনও ফেলে যাওয়া দিনগুলো ভোলেনি। বিমলার সঙ্গে অহরহ এই বাড়িতে এসেছে সে। সেই স্মৃতির ঝাঁপিতে হঠাৎ মণিমুক্তোর হদিশ পেয়ে আমাকে জানায়। আর আমিও সে সম্ভাবনা লুফে নিলাম। কিন্তু মুশকিল হল, বিমলার নামটি ছাড়া এ বাড়ির কারও নামই আর মনে নেই সুপ্রিয়ার। এমনকী বান্ধবীর প্রাক্বৈবাহিক পদবিটুকুও বিস্মৃত সে। শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের পদবি নিয়ে কে-ই বা কখন মাথা ঘামিয়েছে? কাজেই, গুপ্তধনের সূত্রস্বরূপ এই ‘বিমলা’ নামটুকুই আমার একমাত্র ভরসা।
‘‘কাকে চাই?’’
আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। খেয়াল করিনি, সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ। প্রশ্নটা তিনিই করেছেন। জিজ্ঞেস করি, ‘‘আজ্ঞে, এটা কি বিমলা... মানে বিমলাদেবীর বাড়ি?’’
‘‘বিমলা! ঠিক কাকে চাইছেন বলুন তো?’’ বলিরেখার নকশাকাটা মুখমণ্ডলে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সম্মিলিত অভিব্যক্তি।
নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললাম, ‘‘আজ্ঞে, এটা যদি বিমলাদেবীর বাড়ি হয়, তবে একটু ভিতরে আসতে পারি?’’
বৃদ্ধ একটুক্ষণ যেন কিছু ভাবলেন। তার পর আমাকে ভিতরে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বলুন, কী ব্যাপারে এসেছেন? আমি বিমলার বাবা।’’
আমি তাঁকে নমস্কার জানিয়ে বলি, ‘‘আজ্ঞে, বিমলাদেবী আমার স্ত্রীর কৈশোরের অন্তরঙ্গ বান্ধবী।’’
‘‘আপনার স্ত্রীর নাম? তাঁর পিতৃপরিচয়?’’
আমি স্ত্রীর পরিচয় জানালাম। চিনতে পারলেন না তিনি। অবশ্য এটাই অভিপ্রেত। সময়ের এতটা ব্যবধানে কিশোর সন্তানের বন্ধুকে মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। বললাম, ‘‘সে প্রায় আধশতক আগের কথা। আমার স্ত্রীর যখন পনেরো বছর বয়স, তখনই ওরা চন্দ্রপুর ছেড়ে চলে যায়। আর তাঁর এখন ষাট পেরিয়েছে। চন্দ্রপুর ছাড়ার পরে বিমলাদেবীর সঙ্গে আর তাঁর যোগাযোগ হয়নি।’’
‘‘বিমলা আর নেই,’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন বৃদ্ধ।
আঁতকে উঠলাম আমি। এমন একটা সংবাদের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
‘‘প্রথম সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময়ই বিমলা চলে যায়। নাতিটি আমাদের কাছেই মানুষ। সে কাজ করে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক-এ। দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবসময়। এখন সে আলাস্কার সমুদ্র উপকূলে মেরিন লাইফ নিয়ে গবেষণারত একটা টিমের সঙ্গে রয়েছে। বাড়িতে থাকার মধ্যে আছি কেবল আমি ও নাতবৌ। সেও আবার অন্তঃসত্ত্বা।’’
শুনে মনে মনে ভাবলাম, এটাই হয়ে উঠেছে আধুনিক জীবন। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, অথচ তাকে একলা রেখে দিব্যি সামুদ্রিক জীবদের নিয়ে মেতে আছেন স্বামী! সত্যি, স্বামী-স্ত্রীর বাঁধনটাও কেমন ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছে আজকাল!
বললাম, ‘‘আমি একটা গবেষণাধর্মী লেখা লিখছি, বাঙালির ব্যক্তিগত, সামাজিক ও বৌদ্ধিক জীবনে চিঠির ভূমিকা।’’
‘‘চিঠি?’’ কৌতূহলী দৃষ্টি বৃদ্ধের।
‘‘হ্যাঁ, চিঠি। আমার গবেষণার সময়কাল বিশ শতকের অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং পরিবর্তনশীল জনজীবনের শতাব্দীব্যাপী সময়টা। হয়ত লক্ষ করেছেন, বরেণ্য ব্যক্তিদের চিঠিপত্র প্রায়ই পত্রিকা বা জার্নালে প্রকাশিত হয়। সাহিত্যমূল্য ছাড়াও সেই সব চিঠি যেমন লেখকের চরিত্রের বিভিন্ন দিকে আলো ফেলে, তেমনই তৎকালীন সমাজ, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, দেশ ও বহির্বিশ্বের নানা অজানা তথ্যও উঠে আসে সেগুলো থেকে। অর্থাৎ চিঠি যতই ব্যক্তিগত হোক, সমাজবিদ্যায় এর গুরুত্ব অসীম।’’
সহমত সূচক মাথা দোলালেন তিনি। আমি বলে চললাম, ‘‘কিন্তু আমার বিষয় বরেণ্যদের চিঠিপত্র নয়। খ্যাতির আলোর বাইরে ভিড়ে মিশে থাকা আপামর সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, চাওয়া-পাওয়া, প্রেম-ঘৃণায় ভরে থাকা একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিগুলোই আমার বিষয়। আমার বিশ্বাস, বাংলার ঘরে ঘরে এমন অজস্র চিঠিপত্র পড়ে আছে।’’
‘‘বিষয়টি নিঃসন্দেহে মনোগ্রাহী। কিন্তু কাজটা কি সহজ হবে?’’ বললেন বৃদ্ধ, ‘‘প্রথমত, একথা ঠিক যে, এক সময় চিঠিই দূরের স্বজন-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল। কিন্তু সে সব চিঠি ক’জন যত্ন করে সংরক্ষণ করেছে? দ্বিতীয়ত, এ দেশে গত নয়ের দশকের শুরু থেকে চিঠি লেখার অভ্যাসে সামগ্রিক ভাবেই যে ভাটা পড়েছে, এ তো মানবেন? টেলিকমিউনিকেশনের যে বিপ্লব ঘটল, এর ফল হল সুদূরপ্রসারী। ঘরে ঘরে টেলিফোন, পাবলিক বুথ, আমাদের এক ধাক্কায় আধুনিক করে দিল অনেকটা। খোঁজখবর দেওয়া-নেওয়ায় ফোনই হয়ে উঠল মাধ্যম। বিজয়া ও পয়লা বোশেখের প্রণাম-প্রীতি-শুভেচ্ছা জানাতে বছরে মাত্র দু’বার ছাড়া বাঙালি চিঠি লেখার পাট প্রায় তুলেই দিল। আর, হালের অবস্থা তো আরও করুণ। তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল সাফল্যের সৌজন্যে এবং মোবাইল, ইন্টারনেটের প্রতাপে আজকের প্রজন্ম চিঠি লেখা তো দূর, ‘চিঠি’ শব্দটার সঙ্গেই পরিচিত নয়।’’
বৃদ্ধের চিন্তাশীল মতামতে সহমত জানিয়ে বলি, ‘‘ঠিক পর্যবেক্ষণ আপনার। সত্যি বলতে কী, এটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের জীবন থেকে শুধু চিঠিই হারিয়ে যায়নি, সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে আরও অনেক কিছু। চিঠি তো কেবল প্রাণহীন কয়েকটি বাক্য নয়, এর মধ্যে মিশে থাকে প্রেরকের স্পর্শ, ভাবনা, বিশ্বাস, অবস্থান, স-অ-ব। সেই চিন্তাতরঙ্গে মিলে যায় প্রাপকের ভাবনাও। কিন্তু এখনকার সেন্ড-মেসেজ, ডিলিট-মেসেজ, ফরওয়ার্ডেড-মেসেজের ডিজিটাল প্রজন্ম এ সব বোঝে না। তাদের সব কিছুই ইনস্ট্যান্ট, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক। ফলে ভঙ্গুরও। এদের প্রেম, ভালবাসা, সম্পর্ক, সবই বড় অনিত্য। এই অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে চিঠির অনুপস্থিতিকে আমি তুলে ধরতে চাইছি।’’
মৃদু হাসলেন তিনি। বললেন, ‘‘আচ্ছা, এ বার বলুন আমি আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?’’
কোনও ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে আসি, ‘‘আমার স্ত্রীর থেকে একটা তথ্য পেয়ে আমার এখানে আসা। এ বাড়িতে এসে অনেক দিন তিনি দেখেছেন, আপনার পিতৃদেব হ্যারিকেনের আলোয় খুব মন দিয়ে কিছু পুরনো চিঠি পড়ছেন।’’
চকচক করে উঠল বৃদ্ধের চোখ দু’টি। বললেন, ‘‘ঠিকই দেখেছিল সে। ওগুলো আমার মায়ের চিঠি। বাবা রোজ নিয়ম করে সে সব পড়তেন।’’
‘‘চিঠিগুলো এখনও আছে কি?’’
গর্বের সঙ্গে মাথা ঝাঁকালেন অশীতিপর বৃদ্ধ। ‘‘আছে। সবই সযত্নে রেখে দিয়েছি। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা শোকে প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদা আবার তাঁর বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। দু’বছরের দাম্পত্যসুখের স্মৃতি আঁকড়েই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটা জীবন।’’
‘‘কী গভীর ভালবাসা! প্রকৃত প্রেম এমনই হয়। আজকাল এ সব অকল্পনীয়। এখনকার প্রজন্মের কাছে এ রীতিমতো আজব রূপকথা। আচ্ছা, চিঠিগুলো কখন লিখেছিলেন আপনার মা?’’
‘‘সর্বমোট তেইশখানা চিঠি আছে। বাবার লেখা চোদ্দোটি, মায়ের ন’টি। সবগুলোই আমার জন্মের সময় মা যখন তাঁর বাবার বাড়িতে ছিলেন, তখনকার।’’
‘‘অর্থাৎ সেগুলো আপনার সমবয়সি। এখানেই দেখুন চিঠির মাহাত্ম্য। একটি চিঠির মধ্যে বন্দি থাকে একটা সময়কাল, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, কিছু মুহূর্তকথা ও সর্বোপরি প্রেরকের মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো। সে চিঠি যখন ও যত বার পড়া হয়, সেই সব কিছুই ফিরে ফিরে আসে পাঠকের মনোজগতে। আপনার বাবাও চিঠির মাধ্যমেই তাঁর হারানো প্রিয়াকে এ ভাবেই প্রতিদিন খুঁজে পেতেন। কিন্তু আজকের এই সময়ে, শতেক ইনস্ট্যান্ট ডিজিটাল মেসেজের ভিড়ে প্রেমের এমন স্থায়িত্ব সম্ভব? আপনিই বলুন?’’ জিজ্ঞেস করি আমি।
হাসলেন বৃদ্ধ, ‘‘ব্যাপারটাকে একটু অন্য রকম করে দেখলে হয় না? সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে, বদলাচ্ছে জীবনযাপনের তরিকাও।’’
‘‘চিঠিগুলো দেখতে পারি?’’
‘‘অবশ্যই।’’ বৃদ্ধ উঠে ভিতরে গেলেন। অদম্য আনন্দ ও উত্তেজনায় ছটফট করছি। এ যেন গুপ্তধনের সন্ধান দিয়েছে সুপ্রিয়া।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই তিনি ফিরে এলেন। সঙ্গে তাঁর নাতবৌও। আমার মেয়ের থেকে ছোটই হবে সে। আসন্ন মাতৃত্বের গৌরব ফুটে উঠেছে তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে। লাল ভেলভেটের মোড়ক খুলে খুব সাবধানে কয়েকটি চিঠি সে এগিয়ে দিল আমার দিকে।
সেগুলো হাতে নিয়ে আমি রীতিমতো শিহরিত। নির্ভেজাল প্রেমের এমন অমূল্য নথি আর ক’টি পাওয়া যাবে পৃথিবীতে? কিন্তু চিঠির ভাঁজ খুলতে গিয়ে বুঝলাম, প্রেম যতই অজর-অমর-অক্ষয় হোক, একে ধারণকারী চিঠির কাগজ কালের করাল গ্রাসে বিবর্ণ-ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে। ভাঁজে ভাঁজে আলাদা হয়ে পড়ছে।
আমি ওগুলোর ছবি তুলে নিতে চাইলাম। কিন্তু আমার সাধারণ মুঠোফোনে স্পষ্ট ছবি আসছে না দেখে সাহায্যে এগিয়ে এল বধূটি। বলল, ‘‘কাকু, ফোনে ছবি তুলে আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি।’’
হেসে বললাম, ‘‘বৌমণি, ওই সুবিধে আমার ফোনে নেই। ফোনটাও যে আমার মতোই পুরনো। মেল আইডি দিচ্ছি, ওতে পাঠিও। আমি কম্পিউটারে দেখে নেব।’’
মেয়েটি মাথা নেড়ে হাসল। তার পর যত্ন সহকারে চিঠিগুলোর ছবি নিতে লাগল। তখনই গেট খুলে কাউকে আসতে দেখে বৃদ্ধ বললেন, ‘‘আপনার একটু বসতে হবে। কম্পাউন্ডার এসেছে। দিদিভাইকে একটা ইঞ্জেকশন নিতে হবে। আমারও প্রেশার মাপা প্রয়োজন।’’
বললাম, ‘‘কোনও অসুবিধে নেই। আপনারা যান। আমি আছি।’’
বধূটি যাওয়ার আগে আমাকে তার ফোনটা দিয়ে বলল, ‘‘কাকু, ছবিগুলো দেখে নিন, কাজ চলবে কি না আপনার। তত ক্ষণে আমি ইঞ্জেকশনটা নিয়ে আসছি।’’
ওরা ভিতরে যেতেই চিঠির ছবিগুলোতে ডুব দিলাম আমি। এ যেন অমর প্রেমের অপূর্ব আখ্যান। এক ষোড়শী এবং এক বিরহকাতর তরুণের হৃদয় নিঙড়ানো প্রেম। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর জন্য স্বামীর উদ্বেগ, আসন্ন সন্তানের জন্য ভাবনা, স্বামীকে দেখার জন্যে স্ত্রীর ব্যাকুলতা, চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। প্রতিটা শব্দ-বর্ণ-যতিচিহ্ন আমাকে অমোঘ আকর্ষণে টানছে। তন্ময় হয়ে পড়ছি।
হঠাৎ একটি ‘কল’ এল ফোনটিতে। কোনও আওয়াজ হল না। কেবল স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘বি-কে কলিং’। ফোনটা সেই মুহূর্তে তার মালিকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। অগত্যা ‘কল’টি উপেক্ষা করতে বাধ্য হলাম। ‘মিসড কল’ হয়ে থাকলে বধূটি পরে তাঁকে কল করে নিতে পারবে ভেবে নিশ্চিত থাকলাম।
কিন্তু এর পরেও সেই একই নম্বর থেকে একের পর এক ‘কল’ এসে চলল। স্বস্তিতে একনাগাড়ে একটা চিঠিও পড়তে পারছি না। ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। এত অধৈর্য কেন ‘কল’-কর্তা? রেসপন্স না পেয়ে তার বোঝা উচিত যে, যাকে সে চাইছে, সে এখন কথা বলতে পারছে না, বা সে কোনও কারণে ব্যস্ত আছে। এতটুকু কমন সেন্স নেই! নাকি, ‘ফোন যখন করেছি, আমার এক্ষুনি জবাব চাই’ গোছের মনোভাব? এই প্রজন্মের এটাই দোষ। যেমন অধৈর্য, তেমনই আত্মকেন্দ্রিক। কেবল নিজের সময়টাই মূল্যবান, অন্যের সময় সুবিধের কোনও মূল্যই নেই তাদের কাছে।
অন্তত ডজন খানেক কিংবা তারও কিছু বেশি কল শেষে সে ক্ষান্ত দিল। আমিও নিশ্চিন্তে ডুব দিলাম ফোনের স্ত্রিনে ফুটে ওঠা হিরের খনিতে। গভীর মনোযোগে একটার পর একটা চিঠি পড়ে চলেছি। এমন সময় স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটা মেসেজ। এটিও সেই একই নম্বর থেকে এসেছে! যথারীতি উপেক্ষা করতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। পলকেই কয়েকটি শব্দে আটকে গেল চোখ। অনুচিত জেনেও মেসেজটা খুলে ফেললাম, “তুমি কোথায় বিন্নি? ফোন তুলছ না কেন? ঠিক আছ তো? আমি ভীষণ টেনস্ড। খুব চিন্তা হচ্ছে তোমাদের জন্য। তোমার শরীর ঠিক আছে তো? দাদুর কিছু হয়নি তো? শিগগির জানাও। প্লিজ় ফোন করো...”
আমি তড়িৎগতিতে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠি, ‘‘বৌমণি, তোমার ফোন এসেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এস।’’
বধূটি প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে ফোনটি হাতে নেয়। মিসড কলের তালিকায় প্রেরকের নাম দেখে রাঙা হয়ে উঠল তার মুখমণ্ডল। ফোন হাতে দ্রুত তফাতে যায় সে। যেতে যেতে শুধু জিজ্ঞেস করে, ‘‘ছবিগুলো ঠিক উঠেছে তো কাকু?’’
আমি হাত উঠিয়ে তাকে আশ্বস্ত করি। আমার কাজ আপাতত শেষ। চিঠিগুলো পড়ে নিয়েছি। ফিরে যাচ্ছি সারা জীবনের সম্পদ নিয়ে। না, শুধুমাত্র সেই চিঠিগুলোই নয়, মনের মণিকোঠায় সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছি সেই ছোট্ট হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটিও। চারপুরুষ আগে মাতামহের পিতৃদেব নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর জন্যে যে উদ্বেগ, প্রেম, ও ব্যাকুলতা গেঁথে গিয়েছেন দীর্ঘ শব্দমালায়, স্ত্রীর প্রতি সেই একই অনুভব ফুটে উঠেছে ছেলেটির বার্তাতেও। কলেবরে ছোট হলেও সুদীর্ঘ চিঠির থেকে আবেদনে কোনও অংশেই কম নয় হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটি। মনের থেকে একটা ভার যেন অজান্তেই নেমে গিয়েছে। সব তা হলে হারিয়ে যায়নি। প্রযুক্তি ছিনিয়ে নিতে পারেনি সব কিছু। হারায়নি চিঠিও। কেবল মাধ্যমটা পাল্টে গিয়েছে। মনের কোমল অনুভূতিগুলো আজও একই রকম আছে! ভীষণ ভাল লাগছে। আর হ্যাঁ, আমার লেখার বিষয়টাকে কিছুটা বদলে নিতে হবে। ভূর্জপত্র, তাম্রপত্রাদি হতে কাগজ হয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে চিঠির বিবর্তনে মনের আদানপ্রদান যে কোথাও একটুও ব্যাহত হয়নি, এখন এই সত্যটাই প্রমাণ করব আমি। সত্যি! কখনও নিজেকে ভুল প্রমাণিত দেখতেও যে এত ভাল লাগে, কখনও ভাবতে পেরেছিলাম?