Abosar

ঘাটের কথা

গৌতম চক্রবর্তী

রাজা হরিশচন্দ্রের বংশধরেরা এই মরদেহের অন্ত্যেষ্টি সংস্কারে কোনও মতেই রাজি হলেন না। দেহটি এলাকার ডাকসাইটে সুন্দরী নর্তকীর। অহঙ্কারের শেষ ছিল না, রূপের গর্বে মটমট করে সবাইকে যা খুশি তাই বলতেন।

জীবদ্দশায় রূপসী ছিলেন কাশ্মীরীমল্ল নামে এক বণিকের রক্ষিতা। বারাণসীর বাসিন্দা এই বণিক দূরদূরান্তে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করেন। অজাত-কুজাত, অখাদ্য-কুখাদ্য কিছুই মানেন না। মন্দির সংস্কারে দান চাইতে গেলে লোককে ফিরিয়ে দেন। সেই কাশ্মীরীমল্ল আজ তাঁর রক্ষিতার মরদেহ নিয়ে হরিশচন্দ্র ঘাটের শ্মশানে! মৃতের সঙ্গে কোনও রেষারেষি থাকে না, কিন্তু সারা শ্মশানঘাট সে দিন এক বাক্যে জানিয়ে দিল, এখানে এই দাহকাজ করা যাবে না। করতে গেলে সাধারণের তিন গুণ অর্থ লাগবে। বণিক অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু ভবি ভোলবার নয়।

এ বার বণিকের জেদও চেপে বসল। রক্ষিতার মরদেহ নিয়ে তিনি গঙ্গা ধরে আরও এগিয়ে এলেন মণিকর্ণিকা ঘাটে। এমনিতে মণিকর্ণিকা পবিত্র তীর্থ, হরপার্বতী এখানে স্নান করেছিলেন। তখন পার্বতীর কানের মণিরত্নখচিত কুণ্ডলটি আচমকা জলে খসে পড়ে। বিষ্ণু সেটি খুঁজে দেন, ওই জলস্রোতে তাই চক্রপুষ্করিণী তীর্থ। স্কন্দপুরাণ পরিষ্কার জানিয়েছে, সব পবিত্র তীর্থে স্নানের চেয়েও মণিকর্ণিকায় স্নানের পুণ্য বেশি, এখানে স্নান সেরে বিশ্বেশ্বরকে দর্শন বিধেয়। কাশ্মীরীমল্ল ঠিক করলেন, এই পবিত্র ঘাটেই তিনি প্রেয়সীর অন্তিম সংস্কার করবেন। লোকে কী বলবে, তা নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। মুঘল রাজত্ব শেষ, এখন মরাঠাদের প্রবল প্রতাপ। দুর্বল বাদশাহের কাছে মরাঠা পেশোয়ারা বারংবার দূত পাঠিয়ে জানিয়েছেন, কাশীতে মরাঠারাই বেশি তীর্থে যায়। তাদের থেকে তীর্থযাত্রার জিজিয়া কর মরাঠারাই আদায় করবে, দিল্লি নয়। ১৭১৯ সালে পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ এ নিয়ে দিল্লিতে এসেছিলেন, রাজধানী সাতারায় ফেরার আগে তিনি বারাণসী ঘুরে গিয়েছেন। উত্তর ভারতের সেই শহরে এই প্রথম মরাঠা শাসকের পদক্ষেপ। বালাজি বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা স্ত্রী রাধাবাইও তীর্থ সন্দর্শনে আসেন, স্থানীয় আমির-ওমরাহদের প্রচুর ভেট দিয়ে যান। ঘাটের ডোমরাজা যাই বলুন, তাঁর কোনও ক্ষমতা নেই। আসল ক্ষমতা মরাঠাদের।

বুদ্ধিমান কাশ্মীরীমল্ল জানেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা যার হাতে, সে-ই কাশীর এই পুণ্যভূমে সংস্কৃতির আসল রক্ষক। রাজা হরিশচন্দ্রের গপ্পো আওড়ানো পুরুতরা নন। মরাঠা পণ্ডিত ভট্টোজী দীক্ষিত, নারায়ণ দীক্ষিত পটঙ্করেরা বহু দিন বিভিন্ন পুঁথিতে লিখছেন, মণিকর্ণিকাই কাশীর শ্রেষ্ঠ তীর্থ। উত্তরবাহিনী গঙ্গায় এই ঘাট প্রায় মধ্যবিন্দুতে। দক্ষিণে অসিঘাট, উত্তরে রাজঘাটকে ধরলে মণিকর্ণিকাই মাঝামাঝি অবস্থানে। এখানেই তারকেশ্বর শিবের মন্দির। কাশীতে প্রতিটি মৃত্যুপথযাত্রীর কানে শিব স্বয়ং তারকব্রহ্ম নাম জপেন, তাই তারকেশ্বর। দক্ষিণালোভীরা জানে না, এই ঘাটেই অম্তিম সংস্কার শ্রেয়।

আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ মাধুরী দেশাই বারাণসীর এই লোককথাটি জানিয়েছেন তাঁর সাম্প্রতিক ‘বেনারস রিকনস্ট্রাক্টেড’ বইতে। পড়তে পড়তে ঘোর লাগে। অষ্টাদশ শতকে ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল কাশীবাসী হয়েছিলেন, কাশীতেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস। ‘কাশী-পরিক্রমা’ বইয়ে তিনি ঘাটগুলির পরিচয় দিতে গিয়ে লিখছেন, ‘জলাশয়ীঘাট রাজবল্লভসান/ মণিকর্ণী বীরেশ্বর সঙ্কটাবাখান।’ মানে, মণিকর্ণিকার পাশের জলাশয়ীঘাট, সঙ্কটাঘাট তাঁর কাছে গুরুত্বের। শ্মশান বলতে ললিতাদেবীর মন্দিরের কাছে অধুনালুপ্ত রাজবল্লভ শ্মশান।

বারাণসীর ঘাট তাই চলমান ইতিহাস। রাজবল্লভ শ্মশান এখন অস্তিত্বহীন। জলাশয়ী বা জলসই ঘাট বিখ্যাত ছিল জলশায়ী বিষ্ণুমন্দিরের জন্য। এখন সেই ঘাট মণিকর্ণিকার সম্প্রসারণ মাত্র। নৌকোয় বসেই দেখা যায়, ওই ঘাটে পর পর সাজানো চিতাকাঠ। আর মণিকর্ণিকায় তারকেশ্বর শিবের মন্দির অনেকটাই হেলে পড়েছে। মন্দিরের গায়ের কাজ অবশ্য অটুট। ইনদওরের রানি অহল্যাবাই হোলকার আজকের বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা মন্দিরের পাশাপাশি এই তারকেশ্বর মন্দিরটিও তৈরি করিয়েছিলেন। কেউ মনে রাখেনি।

লোকে কী-ই বা মনে রাখে? মণিকর্ণিকার আগে বাঙালির চেনা ঘাট দশাশ্বমেধ। ব্রহ্মা এই ঘাটে দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন বলে লোকের বিশ্বাস। ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ এই ঘাটকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি, ‘অহল্যা দশাশ্বমেধ রামানন্দ পরে/ প্রয়াগ শ্রীমানসিংহ দুই ঘাট করে’ বলে এক লাইনে সেরে দিয়েছেন।



তাঁর কাছে দশাশ্বমেধ, প্রয়াগঘাট ও মানমন্দিরঘাট একই গুরুত্বের, ইতরবিশেষ নেই। দশাশ্বমেধ বাঙালির কাছে গুরুত্ব পেল আরও পরে, ইংরেজের নগরায়ণের সময়। স্টেশন থেকে যানজট-আক্রান্ত যে গোধুলিয়া মোড় থেকে আমরা দশাশ্বমেধে যাই, সেখানে গোদাবরী নামে একটি ছোট্ট নদী ছিল। সেই নদীই লোকের মুখে মুখে হয়েছিল গোধুলিয়া।

ইংরেজ আমলে এই নদী বুজিয়ে রাস্তা তৈরি হয়, রাস্তার নামে রয়ে গেল সেই নদীর স্মৃতি। বর্ষার জলে নদী ফুলেফেঁপে উঠত, এঁকেবেঁকে বেনিয়া তালাও নামে এক ছোট্ট হ্রদে গিয়ে মিশত। নগরায়ণের জন্য সেই হ্রদ বুজিয়ে তৈরি হয় পার্ক, বাগান সমন্বিত বেনিয়াবাগ। এখন কাশীর ব্যস্ত বাজার এলাকা। গোদাবরী বা গোধুলিয়া নালা দশাশ্বমেধের পিছনে যে অঞ্চল দিয়ে বইতে বইতে বেনিয়া তালাওতে মিশত, সেখানেই আজকের ব্যস্ত দশাশ্বমেধ বাজার। ফেলুদা চাইলে শুধু মগনলাল মেঘরাজের পিছনে ধাওয়া না করে এই দশাশ্বমেধ এলাকা নিয়েই ঐতিহাসিক গোয়েন্দাগিরি সেরে ফেলতে পারত।

দশাশ্বমেধ কি শুধুই স্নান সেরে, জর্দা, মিষ্টির দোকান আর ষাঁড়-অধ্যুষিত গলি বেয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার জন্য? ঘাটটার দুটো অংশ— রুদ্রসরোবর ও দশাশ্বমেধ। এখনও ঘাটের পুলিশচৌকির পাশে এক জায়গায় লেখা: প্রাচীন রুদ্রসরোবর ঘাট।

ঘাটের ছোট্ট মন্দিরে বিরাজিত শূলটঙ্কেশ্বর শিব। তিনি আসলে সীমা নির্দেশ করেন। প্রাচীন লোকেরা জানতেন, শূলটঙ্কেশ্বরের উত্তর দিকটা বিশ্বনাথের এলাকা, দক্ষিণ কেদারঘাটের কেদারেশ্বর শিবের। মানচিত্র নয়, শিবলিঙ্গেই নির্ধারিত শহরের বিখ্যাত দুই শিবের রাজত্ব। এ জিনিস কাশীর ঘাট ছাড়া অন্যত্র পাওয়া যাবে না। পাশেই আছেন ব্রহ্মার প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মেশ্বর শিব। আছেন দশাশ্বমেধেশ্বর শিবও। বর্ষার জলমগ্ন ঘাটে তিন শিবই প্রায় হারিয়ে যান। তবে দশাশ্বমেধেশ্বরের ভাগ্য ভাল। পাশের শীতলাঘাটে তিনি শীতলা দেবীর শিব হিসেবে আজকাল পুজো পান। এই শীতলাঘাটও পরে তৈরি। শিবের পাশে দুর্গা না এসে শীতলা কেন, সেও চমকপ্রদ কাহিনি। ইংরেজ আমলের শুরুতে কাশীতে তখন বসন্ত রোগের ছড়াছড়ি। গোবসন্তের টিকা বেরিয়েছে। হিন্দুদের সেই টিকা নেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে কাশীর আমজনতা দ্বিধাবিভক্ত। কাশীর পণ্ডিতরা তখন বিধান দিলেন, টিকা নেওয়া উচিত, তা নিয়ে কোনও সংস্কার মনে না রাখা ভাল।

তাই কাশী মানেই টুলো পণ্ডিতের আখড়া নয়। শীতলাঘাট, দারভাঙ্গা ঘাট, যে কোনও দিক দিয়ে উঠে পৌঁছে যাওয়া যাবে বাঙালিটোলার গলিতে। এখন বাড়িগুলি হাতবদল হয়ে কোথাও দোকান, কোথাও বা হোটেল। কিন্তু এই গলি বেয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় তিলভাণ্ডেশ্বর শিবের কাছে। তিনি রোজই নাকি তিলার্ধ পরিমাণ বেড়ে যান। এখানেই কেটেছে পণ্ডিত রবিশঙ্করের ছেলেবেলা। এই বাঙালিটোলার গলিতেই একদা কাশীবাসী হয়ে বাংলায় গীতার শাঙ্করভাষ্য লিখেছিলেন প্রমথনাথ তর্কভূষণ। বাঙালি পণ্ডিত পঞ্চানন তর্করত্ন এখানে বসেই লিখেছিলেন তাঁর সরূপাদ্বৈতবাদের তত্ত্ব। সরূপাদ্বৈতবাদ কী? প্রকৃতি, পুরুষ দুই হলেও তাদের কার্যস্থিত সত্তা আসলে এক। ধান বলতে যেমন তুষ আর চালকে আলাদা করে বাছা যায় না, দুটো মিলতে হয়, সে রকম। তিরিশের দশকে ফণিভূষণ তর্কবাগীশ এখানেই সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার সময় লেখেন তাঁর ন্যায়দর্শন। অবসর যাপন করছিলেন বারাণসীতেই, অতঃপর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো। কাশী তখন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’।

সন্ধ্যার দশাশ্বমেধ আজকাল রীতিমতো স্পেক্ট্যাকল! সকালে যেখানে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা স্নানার্থীদের কপালে টিকা লাগাচ্ছিলেন এখন সেই চৌকির অন্য রূপ। তিন-চার থাকের বড় বড় পিতলের ঘণ্টা ও প্রদীপ নিয়ে এক ধাঁচের গেরুয়া-হলুদ ও দুধসাদা পোশাকে পূজারিরা। মাইকে গঙ্গা নিয়ে গান বাজে, পূজারিদের আরতিতে, হাতের সমবেত মুদ্রায় প্রদীপের আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। স্বচক্ষে দেখা, ১৯৯৯ সালে দশাশ্বমেধে শুরু হয়েছিল এই গঙ্গারতি, এখন দশাশ্বমেধ ছাড়িয়ে সে ট্যুরিস্ট-অধ্যুষিত কেদার এবং অসিঘাটেও! ঘাটে ঘাটে সময়ের নোঙর বাঁধা। দশাশ্বমেধে যদি সন্ধ্যা ৫টা, কেদারঘাটে সাড়ে ৫টা, দক্ষিণের অসিঘাটে ৬টা। মানে, পর্যটকরা সকলেই নৌকো বা ঘাট থেকে আরতি দেখতে পাবেন, ইচ্ছা হলে একাধিক বার। যে বালকেরা বড় পিলসুজে প্রদীপ জ্বালিয়ে সেটি বড় পূজারিদের হাতে তুলে দেয়, তারা অনেকে স্থানীয় সংস্কৃত বিদ্যালয়ের ছাত্র। পর্যটকের ভিড়াক্রান্ত গঙ্গারতিতেও তখন দেখতে পাই নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে কাশীতে আসা দরিদ্র পরিবারের সেই বালককে। ওই তো, ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আসছে তার কথকঠাকুর বাবা, হাজার ওয়াটের আলো আর মোবাইলের মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশ সত্ত্বেও আমার চোখে অন্ধকার নেমে আসে, কালে বর্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী…

আসা যাক দক্ষিণ প্রান্তের অসিঘাটে। এখন বইয়ের দোকান, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঝাঁ-চকচকে হোটেল, কফি শপ, বিদেশি টুরিস্ট নিয়ে কাশীর সবচেয়ে ‘হ্যাপেনিং’ জায়গা। সকালে এই ঘাটেই যোগব্যায়াম চর্চা, সেতারবাদন শিক্ষা। সপ্তাহান্তের বিকেলে গাড়ির ছড়াছড়ি। আমাদের গড়ের মাঠের মতো বিকেলে স্থানীয় লোকেরা এখানেই বেড়াতে আসেন। এখানেই কাশীর সীমা, অসি নদী গঙ্গায় মিশেছে। দক্ষিণে অসি. উত্তরে বরুণাসঙ্গমের মাঝে পুণ্য বারাণসী। ঘটনাচক্রে এটিও মরাঠা ধারণা। ছত্রপতি শাহুর দীক্ষাগুরু ও প্রথম পেশোয়া বালাজি বাজিরাওয়ের পৃষ্ঠপোষক নারায়ণ পালুস্কর তাঁর ‘ত্রিশালীসেতু’ গ্রন্থে এই ধারণাটিই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বরুণা থেকে অসি অবধি বারাণসী। ফলে সেখানেই বাঁধানো ঘাট, মন্দির ইত্যাদি গড়ে তুলতে থাকেন সকলে। তার আগে ধারণা ছিল, উত্তরে ওঙ্কারেশ্বর মন্দির থেকে মাঝে বিশ্বনাথ মন্দির হয়ে দক্ষিণে কেদারঘাট অবধি বারাণসী। আজকের ঘাট ও মন্দির সমন্বিত বারাণসীকে ইতিহাসবিদরা তাই এক কথায় বলেন, মরাঠা শহর।

এই অসিঘাটে স্নান সেরে ঘাটের ছোট্ট মন্দিরে অসি সঙ্গমেশ্বর শিবের আরাধনা বিধেয়। কিন্তু এই ঘাটে সেই শিবকে জনপ্রিয়তায় হারিয়ে দিয়েছেন প্রভু জগন্নাথ। ঘাটের পাশে, ছায়াঘেরা, পুষ্করিণী-আদৃত সুদৃশ্য মন্দিরে গরুড়স্তম্ভ, ভিতরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও নরসিংহের মূর্তি। আষাঢ় মাসে রথের দিন এখান থেকেই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা নগরভ্রমণে বেরোন। জয়নারায়ণ ঘোষালের বইতে এই জগন্নাথ-মন্দির নিয়ে টীকা, ‘রথযাত্রার সময় এখানকার জগন্নাথ মূর্তি অসীঘাটে আনীত ও রথোপরি স্থাপিত হইয়া থাকে।’

জগন্নাথের রথ কাশীতে এল কী ভাবে? উত্তরে আবার সেই মরাঠা ক্ষমতা। বিশ্বম্ভর পণ্ডিত ও তাঁর ভাই বেণীরাম ছিলেন নাগপুরের ভোঁসলেদের দেওয়ান। দুই ভাই-ই দেওয়ানিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, ওয়ারেন হেস্টিংস বারাণসীর রাজা চৈৎ সিংহের রাজ্য কেড়ে নেওয়ার পর বেণীরামও তাঁর দেওয়ান হয়েছিলেন। ১৭৬০ সালে কটকের রাজার অনুপ্রেরণায় দুই ভাই এই মন্দির নির্মাণ করেন। ছত্তীসগঢ়ের মরাঠা রাজাও তখন এই মন্দির নির্মাণে অর্থ দান করেন। অতঃপর ১৭৮০ সালের রথে জগন্নাথদেবরা তিন ভাইবোন বারাণসীর রাস্তা দিয়ে চললেন উত্তরে বেণীরামের বাগানের দিকে। আজকের বেণিয়াবাগ বা বেণিয়া! বারাণসী শহরের ঐতিহ্য স্থাণু, অনড় নয়। জনপরিসরে সে নানা ভাবে নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হয়।

অসিঘাটের পাশে যেমন ছিল লোলার্কঘাট। এই এলাকায় এখনও আছে সূর্যদেবতা লোলার্কের নামাঙ্কিত কুণ্ড। কার্তিক পূর্ণিমায় সেখানে আজও ভিড়। কিন্তু সূর্যদেবতা জনপ্রিয়তায় রামচরিতমানসের কবির কাছে হেরে গিয়েছেন। ওই ঘাটের নাম এখন তুলসীঘাট। তুলসীদাস বারাণসীর কোথায় থাকতেন, তা নিয়ে দুই ঘাটে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান গোছের রেষারেষিও আছে। কেউ বলেন, অসি। কেউ বলেন, তুলসীঘাটে। নথিপত্রের প্রামাণ্য ইতিহাস আর জনপরিসরে ইতিহাস কী ভাবে বদলে যায়, তার প্রমাণ কাশীর ঘাটে।

এখানে ঘাটের স্থাপত্য ও সজ্জায় লুকিয়ে থাকে স্রষ্টার পরিচয়। চৈৎ সিংহ ঘাট যেমন নদীর সামনে এক দুর্গ-প্রাসাদ। নদীর সামনে বড় দেউড়ি পেরিয়ে তার পর সিংহদুয়ার। সামনে নহবতখানা, বাগিচার শেষে অতিথিদের জন্য প্রশস্ত সভাঘর। কারুকার্যসমন্বিত থামের আড়ালে, ওপর দিকে জেনানা মহল। প্রাসাদের মহিলারা দরকারে সেখানে ঝরোখার আড়াল থেকে অনুষ্ঠান দেখতে পেতেন। এই প্রাসাদে বসেই বারাণসী দখলের চুক্তি করেছিলেন হেস্টিংস।

চৈৎ ঘাটে চৈৎ সিংহের প্রাসাদ নিয়ে আরও কাহিনি আছে। গঙ্গার উল্টো দিকে রামনগর প্রাসাদে চৈৎ সিংহের বাবা বলবন্ত সিংহ বা ঠাকুরদা মনসারাম কোনও দিন বারাণসীর রাজা ছিলেন না। এঁরা অওধের নবাবের ‘নাজিম’ হিসেবে কর আদায় করতেন। কখনও কখনও টাকা পয়সা জমা দিতেন না, জঙ্গলে পালিয়ে যেতেন। তখন নবাবের সিপাইরা আসতেন, যুদ্ধ হত, ফের শান্তি স্থাপিত হত। অওধের মুসলমান নবাবদের পৃষ্ঠপোষণা বাদ দিয়ে হিন্দুর বারাণসীকে কখনও চেনা যাবে না। বলবন্তের সময় বারাণসীতে নবাবের প্রতিনিধি মীর রুস্তম আলি। পেশোয়া সদাশিব নায়েক জোশি বারাণসীতে তখন গঙ্গাতীরে একটি প্রাসাদ বানাতে চাইছেন। ১৭৩৫ সালের ৮ অগস্ট পেশোয়ার বারাণসী-প্রতিনিধি হতাশ হয়ে তাঁকে যা চিঠি পাঠাচ্ছেন, তার মর্মার্থ: ‘প্রাসাদ তৈরির ইট, কাঠ, চুন, সুরকি এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। মীর রুস্তম আলি নিজেই একটি প্রাসাদ বানাচ্ছেন, সেই কারণেই নির্মাণসামগ্রী আপাতত দুর্লভ।’ মীর রুস্তম আলির এই প্রাসাদটি ছিল দশাশ্বমেধ ঘাটে, তাঁর অনুপ্রেরণাতেই সেখানে দোলের পরের মঙ্গলবার হত ভূর্ভমঙ্গল উৎসব। নদীতে সে দিন ঝাঁকে ঝাঁকে বজরা, আকাশে বাজির রোশনাই। ইতিহাস কখনও মুছে যায় না, বিভিন্ন ভাবে ফিরে আসে। আজ গঙ্গার ঘাটে ঘাটে যে আলোময় উজ্জ্বল সন্ধ্যারতি, সেখানে কোথাও কি মীর রুস্তম রহিয়া গেলেন?

আগে বাঁধানো ঘাট ছিল না, স্নানার্থীরা পুণ্য সলিলে অবগাহন সেরে পুজোপাঠ করতেন। ঘাটের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা তাঁদের কপালে টিকা লাগিয়ে দিতেন। জাহাঙ্গিরের আমলে রানি এলিজাবেথের সনদ নিয়ে ভারতে বাণিজ্যের অধিকার চাইতে আসেন র‌্যালফ ফিচ। ১৫৮৪ সালে প্রয়াগ হয়ে তাঁর বজরা বারাণসীতে আসছে। ফিচের বর্ণনায়, ‘ভোরবেলায় শহরের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নদীতে নেমে পড়েছে। মাটিতে বসে জনা কয়েক বুড়ো আঙুলে খড় নিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে নিচ্ছে, কেউ কেউ তাদের সামনে বসে পড়েছে। বুড়োরা ওই বসে-থাকা লোকেদের কপালে আঙুল দিয়ে এঁকে দিচ্ছে। তারা স্নান সেরে একটা পুঁটলিতে চাল, ডাল দান করছে।’ তিলক বা এই জাতীয় ভারতীয় শব্দ ফিচ জানতেন না, লেখার কথাও নয় তাই। ঘাটের পুরোহিতদের হাতে থাকা কুশঘাসকে তাঁর মনে হয়েছে নিছক স্ট্র বা খড়। ভিনদেশি পর্যটকের চোখে এটাই মধ্যযুগে বারাণসীর ঘাটে ভোরের প্রথম বর্ণনা।

মীর রুস্তম আলি ক্ষমতা হারানোর পর কী হল? দশাশ্বমেধ ঘাটে তাঁর বিলাসবহুল প্রাসাদের পাথর ও অন্যান্য উপাদান কাজে লাগালেন বারাণসীরাজ চৈৎ সিংহ। ওই ভাবেই তৈরি হল শিবালা ঘাট ও চৈৎ ঘাট। বাগান, ঝরোখা, সভাকক্ষ নিয়ে চৈৎ সিংহ ঘাটে প্রাসাদভবনের স্থাপত্যটা মনে রাখবেন। অনেকটা একই ধাঁচে গড়া সিন্ধিয়া এবং ভোঁসলেঘাট। সুউচ্চ প্রাচীর, ভিতরে বাগিচা, সভাকক্ষ ও জেনানা মহল। নিজস্ব মন্দির। মন্দিরের সংখ্যা ক্রমে বেড়েছে। ভোঁসলেরা প্রথম ১৮০০ সালে যখন এই প্রাসাদ তৈরি করেন, ছিল লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। ১৮৪০ সালে রঘুজি ভোঁসলে ক্ষমতায় এলে লক্ষ্মীনারায়ণের পাশে তৈরি হয় রঘুরাজেশ্বর মন্দির। বহিঃপ্রাসাদের এই সব মন্দিরে আমজনতা দর্শনার্থীরও প্রবেশাধিকার ছিল। প্রতিটি প্রাসাদেই আছে ব্রাহ্মণসেবার ছত্র। কাশীতে হরিহরের মৃত্যুর পর হতদরিদ্র সর্বজয়া, অপুর কথা মনে করে দেখতে পারেন। এত দিনে তাদের অবস্থা আরও খারাপ, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর… ‘সকালে সর্বজয়া একদিন ছেলেকে বলিল, হ্যাঁ রে, ওই সাদা বাড়িটার পাশে কোন ছত্তর জানিস? উঁহু। মায়ের প্রশ্ন, তুই ছত্তরে একদিনও খাসনি এখানে এসে? কাশীতে এলে কিন্তু ছত্তরে খেতে হয়, জানিসনে বুঝি? খেয়ে আসিস না আজ, দেখেই আসিস না।’

অতঃপর ভরদুপুরে খাওয়া সেরে অপু বাড়ি ফেরে। মা বারান্দায় বসে অড়হরের ডালভেজা খাচ্ছে। মা জানতে দেয়নি, বাড়িতে সে দিন ভাত রাঁধার চালও ছিল না।

ভাগ্যের উত্থানপতন কি শুধু অপুদের সংসারেই হয়েছিল? ভোঁসলেঘাটের পাশেই নারদঘাটে আছে ১৮০৭ সালে অমৃত রাওয়ের তৈরি অমৃতেশ্বর শিব ও গণেশমন্দির। ইনদওরের হোলকারদের পৃষ্ঠপোষণায় তিনি কয়েক বছরের জন্য সাময়িকভাবে পেশোয়া হন, কিন্তু দ্বিতীয় বাজিরাও ক্ষমতায় এলে তাঁকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে হয়। ১৮০৪ সালে অমৃতরাও চলে আসেন
কাশীর গঙ্গাতীরে। তাঁর তৈরি ঘাটই আজকের নারদঘাট ও গণেশঘাট।

দুটো ঘাট আদৌ বানাননি নির্বাসিত পেশোয়া। কাশীতে বড় বড় ঘাটগুলি পরে নানা ভাবে বিভক্ত হয়েছে। দশাশ্বমেধ যেমন ছোট হতে হতে শীতলাঘাটকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে, মণিকর্ণিকার পাশে সিন্ধিয়াঘাটও সে রকম। ভোঁসলেঘাটের পাশেই ভোঁসলেদের বারাণসী-প্রতিনিধি শ্রীধর মুনশির তৈরি মুনশিঘাট। এখন মুনশিঘাট আর তার বহু পরে দারভাঙ্গার রাজার তৈরি দারভাঙ্গা ঘাট প্রায় একাকার। দারভাঙ্গার রাজারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থসাহায্যের পাশাপাশি বারাণসীতে ঘাটও তৈরি করেছিলেন। এখন সেই ঘাটের প্রাসাদে লিফটসমন্বিত বিলাসবহুল হোটেল।

ক্ষমতা কি শুধুই বিলাসবহুল প্রাসাদ, অলঙ্কৃত থাম আর বাগিচা তৈরি করে? অহল্যাবাই ঘাটে ইনদওরের রানি অহল্যাবাইয়ের তৈরি প্রাসাদটি একেবারে অন্য রকম। বিধবা অহল্যাবাই এই শহরে বিশ্বেশ্বর মন্দির থেকে অন্নপূর্ণা মন্দির, মণিকর্ণিকার তারকেশ্বর মন্দির অনেক কিছু তৈরি করেছিলেন। তাঁর প্রাসাদে সিন্ধিয়াঘাট বা ভোঁসলেঘাটের মতো আম দরবার নেই, মর্দানা ও জেনানা মহলের ভাগাভাগি বা থামে অলঙ্করণের আধিক্য নেই। দেখলে মনে হয়, দেখলে মনে হয় নদী থেকে সটান উঠে গিয়েছে দোতলা বাড়ি। ভিতরে ছিমছাম ছোট ঘর, একতলায় ব্রাহ্মণভোজনের ছত্র। কাশীর ঘাটে এও এক মডেল-স্থাপত্য। এই অহল্যাবাই ঘাটের আদলেই আজকের বিলাসবাহুল্যবর্জিত আনন্দময়ী ঘাট ও সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঘাট।

রাজস্থানের জয়পুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা, জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাজা সওয়াই জয়সিংহের তৈরি ১৬৯৩ সালের মানমন্দির ঘাটের প্রাসাদে আজও আছে গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি পরিমাপের ত্রিকোণমিতি হিসেবের ‘যন্ত্রসম্রাট’। আছে ভরদুপুরে সূর্যের উচ্চতা মাপার ‘ভিত্তিযন্ত্র’। দেবতারাও কি নেই? এই প্রাসাদেই আছেন প্রবল শক্তিসম্পন্ন দৈবেশ্বর শিব। তাঁর ক্ষমতাবলেই মেঘ, বৃষ্টি। আছেন রোগ থেকে মুক্তি দেওযার জন্য সোমেশ্বর বা চন্দ্র। কাশীর ঘাট এখানেই চমকপ্রদ। যে ঘাটে জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাজা মানমন্দির তৈরি করেন, সেখানেই স্থানীয় কৃষিজীবী জনতার বৃষ্টিপ্রার্থনা পূরণের জন্য তিনি তৈরি করেন দৈবেশ্বর শিবের মন্দির। বিজ্ঞান ও ঈশ্বরের মাঝে সে দিন কোনও বিভাজনরেখা দেখেনি কাশী।

এই জাতীয় প্রাসাদ অবশ্য কেদারঘাটে নেই। সেখানে গঙ্গা থেকে সটান খাড়া সিঁড়ি উঠে পৌঁছে গিয়েছে কেদারেশ্বর শিবের মন্দিরে। শিবলিঙ্গটি একদলা মণ্ডের মতো দেখতে, মাথায় আড়াআড়ি দাগ। শিবলিঙ্গ মণ্ডের মতো কেন, তা জানিয়েছে পৌরাণিক কাশীখণ্ড। রাজা মান্ধাতা খিচুড়ি খাচ্ছিলেন, সেই খিচুড়ির দলা থেকে উঠে শিব তাঁকে দর্শন দেন। মানে, শিব শুধু মন্দিরে থাকেন না। বুভুক্ষার অন্নেও অবস্থান করেন। কাশীতে থাকার সময় ঠাকুর রামকৃষ্ণ ভিড়ের চোটে মাঝে মাঝে বিশ্বনাথ সন্দর্শনে যেতেন না, মথুরবাবুর সঙ্গে নৌকোয় চেপে চলে আসতেন এই ঘাটমন্দিরে। আজও এই ঘাটের গলি বেয়ে এগোলে বেনারসী শাড়ি বোনার জন্য বিখ্যাত মদনপুরার মুসলিম মহল্লা। কোনটা মুসলিম এলাকার শিবমন্দির, কোনটা হিন্দু এলাকার, দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পুরোহিতের তাতে কিছু যায়-আসেনি।

এই সব কেদারঘাট, মণিকর্ণিকা পেরিয়ে তাই মাঝে মাঝে চলে আসি আরও উত্তরে, আমার প্রিয় পঞ্চগঙ্গা ঘাটে। সেখানে প্রাসাদ নেই। ঘাট থেকে গলি ধরে এগোলে বিন্দুমাধব মন্দির, উল্টোদিকে আওরঙ্গজেবের তৈরি ধারারা মসজিদ। কুখ্যাত মুঘল বাদশাহ কাশীর গঙ্গাতীরে মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনিও কি এই গঙ্গাতীরকে পবিত্র ভাবতেন? তাঁর পূর্বপুরুষ আকবরের জন্য আগ্রায় পানীয় জল তো যেত এই গঙ্গা থেকেই!

এই ঘাটে বিন্দুমাধব মন্দিরের আগেই ত্রৈলঙ্গস্বামীর আশ্রম। এখানেই থাকতেন, এখানকার গঙ্গাস্রোতে শবাসনে ভেসে থাকতেন তিনি। আশ্রমে আজও বিরাজিত ত্রৈলঙ্গস্বামীর প্রতিষ্ঠিত শিব। বিশ্বনাথ তো বটেই, কাশীর অন্য সব শিবলিঙ্গের থেকে আকার, আয়তনে বৃহৎ। আশ্রমের আর এক পাশে ভক্তিবাদের মরমিয়া কবি, বৈষ্ণব সাধক তুকারামের পূজিত শিবলিঙ্গ। ‘বেদ বলো, শাস্ত্র বলো, সবই ঈশ্বরের আরাধনার জন্য। ঈশ্বরের নামটাই আসল, জাত নয়,’ সেই মধ্যযুগেই বলেছিলেন এই মরাঠি সাধক-কবি।

বারাণসীর ঘাট বারংবার ঘুরিয়েফিরিয়ে এই কথাটাই শিখিয়ে দেয়। ঈশ্বরের নামটাই আসল। জাতপাত বা সাম্প্রদায়িকতা নয়।