Abosar

গিরগিটি

রজত ঘোষ

নটী বিনোদিনীর সবচেয়ে হিট গান কোনটা বল তো?’ সবজান্তা মুখ করে চায়ে চুমুক দিল শশাঙ্ক।

‘সবচেয়ে হিট গান?’ দু’মিনিট ভাবল সুখেন। ‘পার করো গো আমায় শ্যামা... না না, বাস্তুদেবী প্রণাম নাও... তাই না ?’

‘হল না। হিট গান, ‘মন চলো নিজ নিকেতনে...’ আহা, কী গান!’ বেঞ্চে তাল ঠুকে সঙ্গে সঙ্গে দু’কলি গাইতে শুরু করে দিল শশাঙ্ক।

এক কালে চিৎপুরে যাতায়াত ছিল শশাঙ্কর। দু’একটা যাত্রা-নাটকে সাইড রোলে অভিনয়ও করেছে। ব্যস, সেই বিদ্যে ফলিয়েই বোদ্ধাগিরি চালিয়ে যাচ্ছে এখনও!

সন্ধের টাইমটায় কাঁদনের চায়ের দোকানে ভিড় জমে প্রতি দিন। এই সময়টা শশাঙ্ক রোজ শুরু করে ওর যাত্রা নাটকের বাতেলিং। আর সুখেনটাও হয়েছে সে রকম, কেন যে ওকে এত পাত্তা দেয়!

মনে মনে চার অক্ষরের একটা গালাগাল দিলাম শশাঙ্ককে। হিট গান কাকে বলে জানে ও? ঠিকঠাক হিট গান যদি নটী বিনোদিনীতে থাকে তা হলে সেটা হল, ‘কাদের কুলের বউ গো তুমি...’ আহা, যেমন গানের কথা, তেমনই সুর!

শশাঙ্কর মতো লোকেদের দেখলে মাথায় রক্ত চড়ে যায় আমার। মনে হয় গিয়ে চড় কষাই। কান ধরে বলি, ‘ওরে ঢ্যাঁড়স, কাঁঠাল পাকলে এমনিই গন্ধ বেরোবে। লোক ডেকে ডেকে শোঁকানোর দরকার হবে না।’

মেজাজটা খিঁচিয়ে গেল। কাঁদনের দোকান ছাড়িয়ে বাজারের দিকে না গিয়ে বেখেয়ালে ‘শান্তিনীড়’-এর দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, সকালে অফিস বেরনোর সময় কী যেন একটা আনার কথা বলেছিল মিলি! কী আনতে বলেছিল? সকালে তাড়াহুড়োর মাথায় ঠিকঠাক শোনা হয়নি!

হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। আননোন নম্বর।

 ‘হ্যালো?’

‘বাড়ি ফিরেছ?’ মহিলা কণ্ঠ। খুব চেনা।

‘না, মানে... আপনি কে বলছেন?’

‘আমার গলা চিনতে পারছ না! আমি মিলি।’

‘মিলি! কার নম্বর এটা?’

মিলি উত্তর দিল না। শান্ত গলায় শুধু বলল, ‘ফ্রিজে তরকারি রাখা আছে। ফেরার পথে বাজার থেকে চারটে রুটি কিনে নিও। তিন তলায় চাঁপাদির কাছে চাবি রেখে এসেছি।’

মনে পড়েছে। সকালে রুটি আনার কথাই বলেছিল মিলি।

মোবাইলটা কান বদল করে বললাম, ‘কার নম্বর এটা? সরোজ সরকারের?’

মিলি উত্তর দিল না।

‘বকখালিতে এখন ঠান্ডা কেমন?’

লাইনটা কেটে দিল মিলি।

আমি পা বাড়ালাম বাজারের দিকে। শুধু রুটি নয়, ‘পুষ্প হোটেল’ থেকে চার পিস মাংসও নেব। রসনাতৃপ্তি অর্থাৎ ইন্দ্রিয়কে সুখী করা মানে আত্মাকেও সুখী করা। আত্মা অসীম, অবিনশ্বর, অমর। সেই অসীমের সন্ধান করাই আমার লক্ষ্য। তা ছাড়া শীতটাও ক’দিন যা জাঁকিয়ে পড়েছে, তাতে গরম রুটি আর মাংসের চেয়ে তোফা খাবার আর কি কিছু হয়?

মুখে বেসন লেপে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন দোলনচাঁপা। কথাও বলছেন মেপে মেপে। রান্নাঘরে ডিমের কারি রান্না করবেন সত্যসাধন, তার রেসিপি বলছেন, ‘সরষের তেল গরম হয়েছে? এ বার ওতে পেঁয়াজকুচি দাও। খুন্তি দিয়ে নাড়তে থাকো। পারলে দু’চামচ চিনি দিও, রংটা ধরবে তাড়াতাড়ি।’

সত্যসাধন হাপুস নয়নে বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। ‘এখনও পেঁয়াজ কাটাই শেষ হয়নি। আমার কি দশটা হাত? একটা একটা করে করব তো! চায়ের জল চাপিয়েছি। আগে অনির্বাণের সঙ্গে চা খাব, তার পর ডিমের কারি।’

‘বেশ, তাই করো। বাট... দশ হাত, এগারো হাতের কথাগুলো বোলো না প্লিজ। মেয়েদেরও দশটা হাত থাকে না। তবু তারা বাড়ির কাজ সামলায়, আবার বাইরের কাজও করে।’

টেবিলে পড়ে থাকা একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিলাম। কথাটা শুনে খটকা লাগল। ভদ্রমহিলা কি শুধু সত্যসাধনকেই কথাটা বললেন? আমাকে নয়?

সত্যসাধন অত খেয়াল করেননি। ট্রে হাতে দু’কাপ চা এনে সোফায় বসছেন। ডিশে চানাচুর, নোনতা বিস্কুট।

অবসরের পর সত্যসাধন ঘর-গৃহস্থালির কাজে যে ইদানীং হাত পাকিয়েছেন, সে তথ্য ‘শান্তিনীড়’-এ কারও অজানা নয়। ক্লাব, পার্টি, রূপচর্চা, এ সব নিয়ে দোলনচাঁপা ব্যস্ত থাকেন। সত্যসাধন সংসার সামলান।

চায়ে চুমুক দিয়ে সত্যসাধনের প্রশ্ন, ‘শর্মিলির দাদার গৃহপ্রবেশে গেলে না কেন?’

বকখালি যাওয়ার ব্যাপারটা  ওর দাদার গৃহপ্রবেশ বানিয়ে দিয়েছে মিলি? মনে মনে হাসি পেল আমার।

‘ওই আর কী। অফিসে বড্ড কাজের চাপ! ছুটি পেলাম না।’

‘মিথ্যে কথা। এটা জাস্ট একটা এক্সকিউজ,’ দোলনচাঁপা ঘাড় ঘোরালেন বিছানা থেকে। ‘দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না! বুঝলে? কথাটা আমি রিয়েলাইজ করেছি তোমার আঙ্কলকে দেখে। সারা জীবন অফিস আর কাজের অজুহাত দেখিয়ে বাড়ির সব কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে। পুরুষ জাতটার ম্যাক্সিমামই দুরাত্মা। তুমিও তাই। পরিবারের প্রতি, আত্মীয়দের প্রতি সমস্ত কর্তব্য থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার একটা সস্তা অজুহাত হল অফিস।’

কী বলব, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম না।

সত্যসাধন বললেন, ‘আমাদের রাজারাম কিন্তু এ সব ব্যাপারে মারাত্মক সিরিয়াস। দেশ-বিদেশ যেখানেই থাকুক, নিয়ম করে প্রতি দিন খবর নেয় আমাদের। কলকাতায় ফিরলে হপ্তায় এক বার আসে। হানির যদিও বা কুঁড়েমি আছে, রাজারাম কিন্তু খুব সিরিয়াস।’

হানি অর্থাৎ মধু অর্থাৎ দোলনচাঁপা দত্ত ও সত্যসাধন দত্তর একমাত্র কন্যা মধুমিতার বিয়ে হয়েছে বছর দুই আগে। তার স্বামীর নাম রাজারাম। 

দোলনচাঁপা বললেন, ‘উই আর প্রাউড অব রাজারাম। একমাত্র মেয়ের জন্য ক’জনের কপালে অমন হিরের টুকরো এনআরআই জামাই জোটে বলো?’

‘তাই নাকি! হানি এখন বিদেশে?’

‘এখন মানে!’ রাজারাম ইজ আ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ওরা প্রায় দেড় বছর হল অ্যাব্রড।’ বেসনের লেই শুকিয়ে গিয়েছে। গুঁড়ো ঝরে পড়ছে দোলনচাঁপার মুখ থেকে। ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় আছে ওরা?’

‘ঢাকা। ব্যাংলাডেশ।’

চানাচুরে আর হাত দিলাম না। নোনতা বিস্কুট সহযোগে শেষ করে ফেললাম চা। সোফা থেকে উঠে বললাম, ‘এ বার আসি কাকাবাবু। আপনাদের বড্ড ডিস্টার্ব করলাম।’

এক মুখ হাসতে গিয়েও মুখটা গম্ভীর করে ফেললেন সত্যসাধন। ‘নো কাকাবাবু। ওনলি আঙ্কল। মনে থাকবে?’ পকেট থেকে চাবির গোছাটা বের করে বললেন, ‘নাও তোমার ঘরের চাবি। শর্মিলি রেখে গিয়েছে।’

অন্য দিন ঘরে ঢুকে প্রথমে আলো জ্বালাই। আজ জ্বালালাম না। দরজা বন্ধ করে অন্ধকারেই এগোতে লাগলাম। এই ফ্ল্যাটের সব ঘর, সব জায়গা আমার নখদর্পণে। ড্রয়িংরুম বরাবর সোজা এগোলে এক ফালি গ্রিল বারান্দা। বাড়িতে বারান্দা থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোথায় যেন শুনেছিলাম, ‘বারান্দাহীন বাড়ি আর নেড়ামাথা নারী এক জিনিস।’ জীবনে এমন বহু কথা থাকে, যেগুলো প্রকৃতি ছাড়া কারও সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। বারান্দা হল সেই জায়গা, যেখান থেকে নিঃশব্দে কথোপকথন চালানো যায় প্রকৃতির সঙ্গে। মিলির কাছে বারান্দা হল জামাকাপড় শুকোতে দেওয়ার জায়গা। দিনের বেশির ভাগ সময় মোবাইলে কথা বলতে হয় ওকে। প্রকৃতি দেখার সময় নেই। সেই তুলনায় আমার ব্যস্ততা কম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেওয়ার মতো অঢেল সময় থাকে সন্ধের পর। তার উপর ইদানীং যে বিষয়টা নিয়ে চর্চা করছি, তার জন্যও একটা নিরিবিলি জায়গা দরকার। খোলা আকাশের সামনে দাঁড়ালে চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। মন স্থির হয়।

তারা-ঝলমলে আকাশ কলকাতায় লুপ্তপ্রায়। তবু উঁকিঝুঁকি দিয়ে যেটুকু দেখা যায় সেটুকুর দিকেই তাকিয়ে রইলাম। রানাঘাটে ছোটবেলায় ঠাকুমার কোলে শুয়ে চাঁদ দেখতাম আমি। ঠাকুমা আঙুল তুলে বলত, ‘ওই তারাটাকে চিনিস? ওটা তোর দাদু।’

বুঝতে পারতাম না তখন। পরে বুঝেছিলাম, দাদুর নাম ছিল ধ্রুবজ্যোতি বসু। আর ওই তারাটার নাম ধ্রুবতারা। ঠাকুরমা বলত, ‘তুই ঠিক তোর দাদুর মতো হয়েছিস। সেই চোখ নাক, গায়ের রংটাও পেয়েছিস দাদুর মতো। আমি জানি, সে আবার ফিরে এসেছে তোর রূপ ধরে।’

কথাগুলো তখন সে ভাবে নাড়া না দিলেও এখন দেয়। আমি কে? কে আমার মধ্যে আছে? সেই অসীম শক্তির উৎস কী? কী তার গ্রাফ পেপার? কোনও দিন কি খুঁজে পাওয়া যাবে তার উত্তর? ঠাকুমার কথা অনুযায়ী ধ্রুবজ্যোতি বসুর মধ্যে যে শক্তি ছিল, সেই শক্তি আবার প্রকাশ পেয়েছে আমার মধ্যে? এটা কি সত্যি?

পরশু রাতে মিলি বলেছিল, ‘সরোজ সরকার লোকটা সাংঘাতিক। পুরো বোতল শেষ করেও স্টেডি থাকে। কী করব বুঝতে পারছি না!’

‘কেন ডার্লিং? তুমি থাকতে নেশা ধরানোর জন্য মদের কী দরকার? শুধু তো একটা সই, পারবে না?’

কথাটা শুনে রাগে জ্বলে উঠেছিল মিলি। গটগট করে ঘরে চলে গিয়েছিল।

কোনও তারাই  দেখা যাচ্ছে না আজ। শান্তিনীড়ের ফ্ল্যাটগুলোর আলো নিভে যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। বারান্দায় আরও কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছি মনস্থির করার জন্য। ধ্রুবজ্যোতি বসুর টাইম স্কেল আর আমার টাইম স্কেলের মাঝে কয়েক বছরের ফারাকটা কিছুতেই মেলাতে পারছি না। তার মধ্যে আবার সরোজ সরকারের মুখটা মনে পড়তেই সব গন্ডগোল হয়ে গেল।

লোকটা সত্যিই বড্ড ল্যাজে খেলাচ্ছে! একটা সই করলেই টেন্ডারটা পাশ হয়ে যায়। এই টেন্ডার যদি না পাশ হয়, প্রমোশন তো দূরের কথা, ইনক্রিমেন্টও বন্ধ হয়ে যাবে আমার। মিলি কি পারবে সইটা করাতে?

বাবা বলত, ‘পৃথিবীতে দুটো জিনিসকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না। এক, সময়; দুই, সত্য। এই দুটোই কারও পরোয়া করে না। টাইম স্কেল ধরে এক্স-অ্যাক্সিস বরাবর দুরন্ত ঘোড়ার মতো সময় দৌড়চ্ছে। মানুষের কীর্তিকলাপ, লীলাখেলা সব ওয়াই-অ্যাক্সিস ধরে ইসিজি রিপোর্টের মতো শুধু ওঠানামা করছে। জন্ম থেকে মৃত্যু, এই সময়টুকুতেই যত লাফালাফি। তার আগে ও পরে শুধুই স্ট্রেট লাইন।’

আমি এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘স্ট্রেট লাইনের আগে-পরে কিছু হয় না বাবা।’

ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘ডেঁপো ছেলে, যত সব ফালতু কথা!’

ফালতু নয়। ইস্কুল-কলেজে সে ভাবে কায়দা করতে না পারলেও আমার চিন্তাভাবনা চিরকালই খুব উঁচু লেভেলের। খুব ছোট বয়সেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম, পাশের বাড়ির শেফালিমাসির পঞ্চাশ বছর বয়সেও কোনও বাচ্চা না থাকার কারণ, সে বিবাহিতা নয়। খুব ছোট বয়সেই আমি ডিকশনারি উলটে শিখে নিয়েছিলাম, ‘রেড লাইট এরিয়া’ মানে বেশ্যাপাড়া।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাভাবনার পারদ চড়েছে। বাবা থেমে গিয়েছে আটাত্তরে। কিন্তু আমি তাঁর ছেলে অনির্বাণ বসু মনে করি, জন্ম-মৃত্যুই শেষ কথা নয়। শরীর, মন, প্রাণ এই তিনটে ঘোড়াকে যে পরিচালনা করছে, সে আর যে-ই হোক, আমি নয়। অন্য কেউ। সে অমর, অনন্ত, ইনফিনিট। টাইম স্কেলের গ্রাফ পেপারে তাকে ধরা কঠিন।

বিয়ের পর মিলিকে যখন কথাগুলো বলতাম, ও অবাক হয়ে শুনত। বলত, ‘কী বলছ তুমি! একটা মানুষ আর একটা মানুষকে ভালবাসে, কাছে পেতে চায়, এ সবের কোনও মূল্য নেই?’

আমি ওর গাল টিপে দিয়ে বলতাম, ‘মায়া। সবই মায়া, বুঝলে? মায়ার ফাঁসে ফেঁসে আছি আমরা। যে দিন ফাঁস খুলতে পারবে সে দিন দেখবে, তোমার মধ্যে যে, আমার মধ্যেও সে, আবার রাস্তার কুকুরটার মধ্যেও সে। আমরা সকলে এক।’

মিলি বোকা-বোকা মুখ করে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। তবে বেশি দিন নয়। হনিমুন গিয়েই ব্যাপারটা বুঝেছিল ও।

তখন খুব বেশি মাইনে পেতাম না আমি। বড়বাজারে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি। মালিকের ছোট ছেলে মুকেশ ব্যবসা দেখাশোনা করত। আমি খুব চেষ্টা করতাম মুকেশের মন জুগিয়ে চলার। পেরে উঠতাম না। পান থেকে চুন খসলেই মুকেশ বাপ-মা তুলে গালাগাল দিত। সুযোগটা এল বিয়ের রিসেপশনের দিন।

খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়ি ফেরার সময় ভুরু নাচিয়ে খুব নোংরা একটা ইঙ্গিত করেছিল মুকেশ। সুযোগটা আমি লুফে নিয়েছিলাম।

জায়গাটা মুকেশই ঠিক করেছিল। মন্দারমণি। আমি শুধু এক দিন দুপুরে মিলি যখন ঘুমোচ্ছিল, ঘরের চাবিটা পাশের ঘরে মুকেশ আর ওর দুই বন্ধুর হাতে দিয়ে বাজারে চলে গিয়েছিলাম।

মন্দারমণি থেকে ফিরে এক ধাক্কায় মাইনে ডবল হয়ে গিয়েছিল। প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে কিছু দিন সময় লেগেছিল মিলির। বালিশ ভেজাত সারা ক্ষণ। খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। অমর, অবিনশ্বর আত্মা বিষয়ক তত্ত্বকথা নিয়ে তখন আবার বকবক করতে হয়েছিল। পাখি-পড়া করে বোঝাতে হয়েছিল, শরীরটা কিছুই নয়। আসল শক্তি আত্মা। অসীম সেই শক্তি যা তোমার মধ্যে আছে, আমার মধ্যে আছে আবার মুকেশের মধ্যেও। সুতরাং সামান্য এই পার্থিব শরীরের জন্য ফ্যাঁচফ্যাঁচ করার কোনও মানে হয়?

এর পর আর বেশি বোঝাতে হয়নি মিলিকে। চাকরি নিয়ে আর টেনশন করতে হয়নি আমাকেও। পদোন্নতি হয়েছে ধাপে ধাপে। মিলিও মাসে দু’তিন বার বকখালি, দিঘা, গোপালপুর ঘুরে আসতে পারত। তার পর আস্তে আস্তে শরীর মন এ সবের ঊর্ধ্বে উঠে মিলি নিজের চেষ্টাতেই এক দিন একটা এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়েছে।

মিথ্যে বলব না, আজ যদি ও না থাকত, শান্তিনীড়ের মতো আবাসনে কোনও দিন ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবতে পারতাম আমি?

ফোন বেজে উঠল ভোর চারটে নাগাদ।

‘হ্যালো’ বলতেই ও পারে পুরুষালি ধমক, ‘কী ব্যাপার, ফোন ধরছেন না কেন? আপনার নাম কী?’

ঘুম ভাঙিয়ে সকালে নাম জিজ্ঞেস করার জন্য কাঁচা একটা গালাগাল দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই নিজের পরিচয় দিল ফোনের ও পার।

‘ইন্সপেক্টর জয়ন্ত বর্মণ বলছি। ডায়মন্ড হারবার থানা।’

‘থানা!’ শব্দটা শুনে শিরশিরে একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘না মানে... কী ব্যাপার...’

‘সন্ধে সাতটা পনেরোয় এই নম্বর থেকে আপনার মোবাইলে একটা ফোন গিয়েছিল। সেই ব্যাপারেই কথা বলতে চাই। সরোজ সরকারকে চেনেন?’

‘না, মানে... ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলেন?’

বিরক্ত গলায় ভদ্রলোক বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট! ওভারড্রাঙ্ক অবস্থায় মেয়েছেলে নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে মাল বোঝাই ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ। মোবাইলটা অক্ষত ছিল বলে কল লিস্ট থেকে নম্বরটা পেলাম। যদি পরিচিত হন, প্লিজ এসে বডি আইডেন্টিফাই করে যান। জানি না চিনতে পারবেন কি না! আপনার নামটা কিন্তু...’

বহু দিন পর আজ ভোরের আকাশ দেখলাম।

মিলি এখন ডায়মন্ড হারবার থানায়। মিলি না মিলির বডি! মিলি নামের সত্যিই কি কেউ ছিল কোনও দিন? শরীর পরিবর্তনশীল। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, এক এক সময় এক এক রকম আকার নেয়। অথচ নাম একই থেকে যায়। একই নামের এত রূপ! গলার আওয়াজ ঠিক রেখে ইন্সপেক্টর জয়ন্ত বর্মণকে বলেছিলাম, ‘না স্যর, চিনি না। ওটা রং নম্বর ছিল।’

আমি লম্বা শ্বাস টানলাম আরও কয়েকটা। মনঃসংযোগ করার জন্য এর চেয়ে ভাল সময় আর পাব না ভেবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ আগেই যে রেখাটা টাইম স্কেলের এক্স-অ্যাক্সিস বরাবর স্ট্রেট লাইন হয়ে গিয়েছে, তার গতিপথের দিকে তাকিয়ে এখনই আমায় খোঁজা শুরু করতে হবে সব প্রশ্নের উত্তর। ডায়মন্ড হারবার থানায় পড়ে থাকা একটা নিথর পার্থিব দেহকে নিয়ে অকারণ দৌড়ঝাঁপ করার চেয়ে এই কাজটা কি অনেক, অনেক বেশি জরুরি নয়?