Abosar


<h1 align=center>খাদহীন</h1>

তনুজা চক্রবর্তী


পর্ণা শোরুমের সামনে দাঁড়াতেই কাচের দরজাটা খুলে গেল। ছাই-রঙের উর্দি পরা দারোয়ান সাদর সম্ভাষণ জানাল। ভিতরে ঢোকার পর এক জন স্যুট-টাই পরা লোক এগিয়ে এসে বললেন, “নমস্কার ম্যাডাম, অনেক দিন পরে এলেন। যান উপরে চলে যান।”

লোকটা এমন ভাবে কথাগুলো বলল, যেন পর্ণার জন্যই অপেক্ষা করে বসে ছিল, সে এসে তাকে ধন্য করে দিয়েছে। অথচ এই শোরুমে পর্ণা আগে কখনও আসেনি। এরই নাম ব্যবসা। কাস্টমারকে অভ্যর্থনা করার এই ধরনটাই এদের এতটা উপরে উঠতে সাহায্য করেছে।

ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলা হল তাকে। এক জন সামনে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, “কী নেবেন ম্যাডাম, ঠান্ডা না গরম?”

“শুধু এক গ্লাস জল দিন।”

ট্রে-তে কাচের গ্লাসে জল এল, পর্ণা গ্লাসটা শেষ করে ফিরিয়ে দিল ।

সেলসম্যান জানতে চাইলেন, “বলুন ম্যাডাম, কী দেখবেন?”

“বারো মাস পরার হার দেখান, আঠারো ইঞ্চির।”

প্রথমে এল একটা লাল মখমল জড়ানো ট্রে। একটার পর একটা ডিজ়াইন মেলে ধরা হল তার সামনে। এত ক্ষণ পর্ণার মনেই ছিল না, তার সঙ্গে তার বর নিখিলও আছে। এ বার সে এ দিক-ও দিক তাকিয়ে দেখল, নিখিল তার পিছনের চেয়ারে বসে নিশ্চিন্তে কফি খাচ্ছে।

“এই, এটা দেখো তো কেমন লাগছে? বেশ ইউনিক ডিজ়াইন। আর এটাও দেখো, কোনটা বেশি ভাল?” আগেও নিখিলকে এই অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সে এ সব পছন্দের ব্যাপারে নাক গলাতে চায় না, বোঝেও কম। সে বলল, “দুটোই ভাল, তোমার যেটা পছন্দ হয় নিয়ে নাও।”

যিনি হার দেখাচ্ছিলেন তিনি বললেন, “এটা কী বলছেন স্যর, আপনার পছন্দের উপর ম্যাম ভরসা করেন বলেই তো জানতে চাইছেন।”

নিখিল মনে মনে বলল, ভরসা করে না ছাই। এক বার নিখিলের কথায় একটা কানের দুল নিয়েছিল, সেটার জন্য উঠতে বসতে কম কথা শোনায়নি। সে কেন তাকে বলে দেয়নি, পর্ণার কানের পাতাটা অনেক বড়, এই দুলের আংটাটা খুব ছোট, ঠিকঠাক লাগবে না।

ব্যাপরটা নিখিলকে একটা আশ্চর্য পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। গাছের পাতার আকৃতির মধ্যে বৈচিত্র আছে। কোনওটা লম্বা, কোনওটা গোল, আবার কোনওটা চোখের পাতার মতো ঝিরঝিরে। কত রকমের রং তাদের, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তার সঙ্গে বৌয়ের কানের পাতাও যে দেখে রাখা উচিত, সেটা কোনও দিন সে ভাবেনি।

“কী গো, কোথায় হারিয়ে গেলে? আকাশ-পাতাল ভাবার মতো কিছু বলেছি কি? এই দুটোর মধ্যে কোনটা ভাল সেটাই জানতে চেয়েছি।”

“দুটোই তো ভাল লাগছে।”

“স্যরের যখন দুটোই ভাল লাগছে, দুটোই নিয়ে নিন ম্যাডাম।”

“নিয়ে নাও, ওঁরা একটার সঙ্গে একটা ফ্রি দেবেন, সেটাই বোধহয় বলতে চাইছেন।”

নিখিলের কথা শুনে সেলসম্যান মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “এটা ভাল বলছেন স্যর। বৌদি একটা কিনবেন বলে এসেছিলেন, আরও একটা পেয়ে যাচ্ছেন আপনার দুটোই পছন্দ হয়েছে বলে। ওঁর জন্য এটা বাড়তি পাওনা।”

পর্ণা বলল, “অনেক হয়েছে, আমার ফ্রি লাগবে না আর কাউকে কিছু পছন্দও করতে হবে না। এটা দিন। আমি পরব যখন, আমার পছন্দে নেওয়াই ভাল।”

নিখিল বেঁচে গেল। সে ভাল করে হারের ওজনটা দেখে নিয়ে সে দিনের দর জানতে চাইল। দর জানার পর কত টাকা দাম হবে মনে মনে হিসাবও করে ফেলল। তার পর পর্ণাকে বলল, “তুমি যেটা বদলাবে সেটা দেখাও ওদের।”

পর্ণা এ বার তার ব্যাগ থেকে কানের পাতার সঙ্গে না-মেলা দুলটা আর একটা চুড়ি বার করে সেলসম্যানের হাতে দিয়ে ওজন করতে বলল, আর সঙ্গে এটাও বলে দিল দুটো জিনিসই নামী দোকান থেকেই কেনা।

লোকটা জিনিস দুটো হাতে নিয়ে ওজন করাল। যা দাঁড়াল তার থেকে পাঁচ শতাংশ বাদ দেওয়ার কথা বলল। সেটা শোনার পর কর্পূরে আগুন লাগল। দপ করে জ্বলে উঠল পর্ণা।

“তার মানে? যখন কিনেছিলাম তখন তো এমন কথা কেউ বলেননি! হলমার্ক দেওয়া সোনা বলে দাম আর মজুরি দুটোই বেশি দিয়েছি, এখন বাদ দেব বললেই হল! তার মানে এগুলোতেও খাদ আছে, তাই তো?”

“খাদ তো আছেই, পিয়োর সোনায় গয়না হয় না ম্যাডাম।”

এত ক্ষণ ধরে চুপচাপ সব শুনছিল নিখিল। এ বার সে বলল, “তার মানে ওগুলোতে যতটুকু খাদ মেশানো ছিল কেনার সময় সেটার দাম দিতে হয়েছে আমাদের, কিন্তু বেচার সময় সেটার দাম আমরা পাব না, তাই তো?”

পর্ণা বলল, “আমি তা হলে বেশি দাম আর মজুরি দিয়ে হলমার্ক লাগানো সোনা কেন কিনব? সেটার উত্তর আগে দিন।”

সেলসম্যান হকচকিয়ে গেছে পর্ণার রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখে। সে আমতা আমতা করে বলল, “এটাই আমাদের রুল ম্যাম। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”

“বলতে পারব না মানে কী! আপনাদের এই সামনাসামনি চুরির ব্যবসা কিছুতেই চলতে পারে না। বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় তো কোথাও আপনারা, মানে বিখ্যাত সোনা ব্যবসায়ীরা এ সব লেখেন না। বাইশ ক্যারেট আর হলমার্ক থাকলে কেনার সময় যা ওজন হবে, বেচার সময়ও সবটুকুর দাম আমাদের পাওয়ার কথা। পাড়ার সোনার দোকানগুলোর সঙ্গে তা হলে আপনাদের পার্থক্য কোথায়? আপনাদের ডিজ়াইন আর কাটিং উন্নত বলে বেশি মজুরি নিচ্ছেন, সেটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করে না কেউ। তার পরও এই ভাবে হ্যারাসমেন্ট! আমি এখনই কনজ়িউমারস’ ফোরামে কমপ্লেন করব।”

“এটাই আমাদের রুল, আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন ম্যাডাম।”

“কিসের রুল?”

“আসলে গহনা বানানোর সময় সব দোকানই তাদের মতো করে খাদ মেশায়। তাই যে দোকান থেকে কিনেছেন, সেই দোকানে বেচলে কিছুই বাদ যাবে না, অন্য দোকানের জিনিস হলে আমরা বাদ দিতে বাধ্য।”

“তা হলে হলমার্ক দেওয়ার মানেটা কী? যুক্তিহীন কথা বলছেন আবার সেটাকে রুল বলছেন! এমনিতেই তো এগুলো ওয়াশ করার সময়ও মনে হয় কিছুটা ঝেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সঙ্গে যখন গলান তখন আগুনের সঙ্গে যেগুলো ছিটকে পড়ে সেখান থেকেও সম্ভবত বাছাই করা হয়। আরে মশাই, এটা তো বড়সড় ডাকাতি।”

নিখিল কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছিল না। এ বার পর্ণাকে থামতে বলে সে বলল, “তোমরাই তো এই ডাকাতদের ডাকাতি করতে দিয়ে আনন্দ পাও পর্ণা। এখন ছাড়ো, যা করার এ বার সব কনজ়িউমারস’ ফোরাম-এর মাধ্যমেই করতে হবে। দিন, আমাদের জিনিস দুটো ফেরত দিন। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।”

ঢোকার সময় যে অভ্যর্থনা তারা পেয়েছিল, বেরনোর সময় ঠিক তার উল্টোটাই ঘটল। যেন চুল্লিতে কাউকে দাহ করে ফিরছে, শোরুমের সবাই নীরবে তাদের সমবেদনা জানাচ্ছে।

ফেরার পথে গোটা রাস্তায় বকর-বকর করতে থাকল পর্ণা। নিখিল কোনও উত্তর দিচ্ছে না, একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। তাতে পর্ণার রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছিল। নিজের মনে অনর্গল বকবক করে ক্লান্ত পর্ণার রাগ কিছুটা কমতেই সে বলল, “চলো, কোথাও বসে একটু কফি খাই।”

এ বার নিখিল মুখ খুলল, সে বলল, “কথায় আছে, স্যাঁকরা তার মায়ের গয়না করার সময়েও চুরি করে, আর খদ্দেররা তো সেখানে বাইরের লোক। তা ছাড়া ওরা জানে, তোমরা গয়না না কিনে থাকতে পারবে না, সে তুমি যতই রাগ দেখাও না কেন।”

পর্ণা চুপচাপ শুনছে, কোনও উত্তর দিচ্ছে না। সত্যিই তো শাড়ি আর সোনার গয়নার উপর সব সময়ই একটা আলাদা আকর্ষণ আছে তার। যখনই তার কিছু টাকা জমে, মনটা ছোঁকছোঁক করে ওঠে শাড়ি নয়তো গয়না কেনার জন্য। কিন্তু না, আর নয়— এ বার যদি তাকে গয়না কিনতেই হয় ছোট দোকান থেকেই কিনবে, কোনও নামকরা দোকানে সে আর যাবে না।

আবহাওয়াটা বদলাতে একটা কাফের সামনে গাড়ি থামিয়ে দুটো কফির অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি বসল দু’জনে। নিখিল বলল, “যাক, অনেক দিন পর এই ভাবে মুখোমুখি বসে কিন্তু আমার বেশ লাগছে পর্ণা। কলেজের ক্যান্টিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তোমাকে তো সব সময়ই বেরোতে বলি, কিছুতেই রাজি হও না। আর কিছু খাবে?”

“ফিশফ্রাই খেতে পারি।”

নিখিল ওয়েটারকে ডেকে ফিশফ্রাই অর্ডার দিল।

কফি খেতে খেতে পুরনো দিনের অনেক কথাই উঠে এল। সঙ্গে যে সব বন্ধুদের সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ নেই তাদের নিয়েও অনেক কথা হল। হু-হু করে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। আস্তে আস্তে ওদের অজান্তেই হালকা হয়ে গেল বিরক্তির রেশ।

কাফের বিল মিটিয়ে দু’জনে আবার গাড়িতে উঠে বসল। কিছুটা পথ গল্পের রেশ ধরে রেখে হাবিজাবি বকে যেতে লাগল নিখিল-পর্ণা। হঠাৎই দূর থেকে দেখতে পেল চেনা ফুলের নার্সারি। গাড়ি থামিয়ে দু’জনেই নেমে পড়ল। ফেরার পথে এই নার্সারিটাই পড়ে তার সামনে।

অনেক দিনের শখ পর্ণার, বাড়ির বারান্দার এক পাশে কনকচাঁপা ফুলের গাছ লাগানোর। কী অপূর্ব গন্ধ ফুলটার, প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আজ সেই গাছ নার্সারিটার সামনেই বেশ কয়েকটা রাখা। পর্ণার বাপের বাড়িতে ছিল কনকচাঁপার গাছ। যখন ফুল ফুটত, তখন সে সকালে-বিকেলে বেশ কিছুটা সময় ওই গাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে সারা শরীরে তার গন্ধ মেখে নিত। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, সে সময় যখনই তার নিখিলের সঙ্গে দেখা হত, সে নাকি সেই ফুলের গন্ধ পেত পর্ণার গা থেকে। মাঝে মাঝেই কিছু ফুল কুড়িয়েও নিয়ে যেত তার জন্য। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই গাছটার গায়ে হাত বোলাচ্ছিল পর্ণা।

নিখিল পলক না ফেলে তাকিয়ে ছিল পর্ণার মুখের দিকে। একটা অল্পবয়সি ছেলে এসে জানতে চাইল, “কী লাগবে স্যর?”

সংবিৎ ফিরল তার, “এই গাছটার কত দাম?”

“দু’শো টাকা স্যর। খুব ভাল গাছ। সবে ফুল ধরছে।”

“দামটা একটু বেশি বলছ না?”

“না স্যর, একটুও বেশি বলিনি। ঠকবেন না।”

পর্ণা তখন হঠাৎই যেন একটু অন্যমনস্ক। সে তার মাথায় কনকচাঁপা শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কনক মানে সোনা। কনকচাঁপা মানে সোনার চাঁপা। আচমকা পর্ণার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “এতে কতটাখাদ আছে?”

নিখিল প্রশ্নটা শুনে অবাক হল। ছেলেটা ভাবল, অনেকে মনে করে, আসলে গাছ নয়, কয়েকটা ফুল-সহ ডালই মাটিতে পুঁতে গাছ বলে চালায় ব্যবসায়ীরা, তলায় শেকড় নেই। তাই কেনার সময়কার ফুলগুলো ঝরে গেলেই গাছ শেষ। কিন্তু না, এই নার্সারি সে রকম লোক-ঠকানো কারবার করে না। তাদের বারো মাসের দোকান।

গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে বলল, “কোনও খাদ নেই ম্যাডাম, পুরোটাই খাঁটি।”