সংসারে এমন এক-এক জন মানুষ থাকে, যাদের দুঃখবিলাসেই শান্তি। নদীর এ পারে বসে ও পারের সর্বসুখ কেমন অধরা, অপ্রাপ্ত রয়ে গেল, সেই ভেবে-ভেবেই তাদের নিজস্ব সুখের ঘড়া থেকে যায় অপূর্ণ!
গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রনাথ হালদারের জীবনেও, অন্তত তার নিজের মতে, আনন্দের চেয়ে দুঃখের পাল্লাই ভারী। লেখাপড়া শেষ করে বাপ-মায়ের ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে কিছু করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অসময়ে মাত্র এক রাতের জ্বরে ভুগে বাবা চলে গেলেন। সংসারে ক্ষেত্রনাথের সঙ্গী বলতে রইল শুধু তার মা। গঞ্জ এলাকায় ক্ষেত্রনাথের বাবার দুধ-দই-ছানার জমজমাট ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসার হাল ধরতে হল নবীন ক্ষেত্রনাথকেই।
বাড়িতে তার মায়ের কথার প্রায় সবেতেই ক্ষেত্র শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। ব্যবসার কাজের ফাঁকে মধ্যাহ্নভোজ সারতে সে বাড়ি এলে মায়ের আদর করে বেড়ে দেওয়া ভাতের থালার সামনে বসে মনে-মনে ক্ষেত্র ভাবে, আজ বাইরের বড় শহরে চাকরিবাকরি করলে রোজ এ ভাবে বাড়ির খাবার খেয়ে দিন কাটাতে হত না তাকে। বরং এক-এক দিন দিব্যি খাওয়াদাওয়া সারা যেত এক একটা বড় রেস্তরাঁয়! কোনও দিন পাতে কাতলা মাছের মুড়ো পড়লে মাছের ঘিলু চুষতে চুষতে সে আনমনে ভাবে, আহা, ছোট শহরে থেকে যাওয়ার কারণে আজ অবধি অক্টোপাস চেখে দেখা হল না তার...
মা হওয়ার সুবাদে ঊর্মিমালা বোঝেন, ছেলে তাঁর বড় দুঃখী। যদিও ক্ষেত্রর দুঃখের কোনও সম্ভাব্য কারণই অনুমান করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলত শেষমেশ একটাই নিশ্চিত সমাধানে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে তাঁর চিন্তার দৌড়— ছেলের এ বার বিয়ে দিতে হবে! নিজের একটা সংসার হলে হাসি ফুটবে তাঁর একমাত্র ছেলের মুখে, সংসারের জাঁতাকলে পেষাই হতে-হতে সে আর সময়ই পাবে না দুঃখদায়ী কোনও চিন্তাকে সময় দিতে।
সেই মতো বিয়ের কথা এক- দু’বার তিনি পেড়েছেন ক্ষেত্রনাথের কাছে। বিব্রত ক্ষেত্র প্রতিবারই জিভ কেটে উঠে পালিয়েছে। একে তো পছন্দের চাকরি করার স্বপ্ন থেকে গিয়েছে স্বপ্ন হয়েই, তায় আবার এক্ষুনি বিয়ে! সারা জীবন অন্যের পছন্দ অনুযায়ী চলতে বাধ্য হতে হয়েছে তাকে, নিজের ইচ্ছেয় কিছু করার এই তার কাছে শেষ সুযোগ। মায়ের চাপে পড়ে রাতারাতি এ সুযোগ হেলায় হারাতে চায় না ক্ষেত্রনাথ মোটেও!
ওঠাপড়াহীন এ ভাবেই কেটে যাচ্ছিল ক্ষেত্রনাথের বিবর্ণ জীবন। এর মধ্যেই এক দিন তার ঠিক পাশের বাড়িতে শোনা যায় উলুধ্বনি, শোনা যায় একাধিক নারীকণ্ঠের সম্মিলিত উচ্ছ্বাস! খবর আসে, বালক ক্ষেত্রনাথ একটু বড় হয়ে নিজেকে মুখচোরামির খোলসে ঢুকিয়ে নেওয়ার আগে পাশের বাড়ির যে মেয়েটি ছিল তার আবাল্যের খেলার সঙ্গী, বিয়ে ঠিক হয়েছে তার। মেয়ের বাবা গঞ্জ এলাকার একমাত্র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। পাত্র কলকাতা শহরে মস্ত ব্যবসা সামলায়। মেয়েকে এক বার দেখামাত্রই পছন্দ হয়েছে পাত্রপক্ষের বাড়ির লোকজনের। অতএব আশু চারহাত এক করে দেওয়ার মিঠে ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছেন দুই বাড়ির লোক।
ক্ষেত্রনাথ প্রতিবেশী। মেয়ের মা-বাবা দু’জনেই তাদের বাড়ি এসে ঊর্মিমালার হাত ধরে বলে যান, বিয়েবাড়ির সমস্ত দুধ-দই-মিষ্টি-ছানার দায়িত্ব তো ক্ষেত্রনাথের বটেই, পাশাপাশি ক্ষেত্রর স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে মেয়ের বাবা অক্ষয়বাবু নিজের বাড়ির এই মহাযজ্ঞে তাঁর প্রিয় ছাত্র ক্ষেত্রর কাছ থেকে যথাসাধ্য কায়িক শ্রমেরও প্রত্যাশী।
এত দিন বিয়ের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠা ক্ষেত্রনাথ সে রাতে দুধ-রুটি খেয়ে শুতে যাওয়ার আগে অনেক দিন পর নিজের ডায়রি খুলে বসে। সময় থাকতে বিয়েতে রাজি হলে আজ তার নিজের বাড়িতেও আয়োজন হত ঠিক এই রকম, বা হয়তো এর চেয়েও বেশি, জমজমাট আয়োজনে কী ভাবে তাক লাগিয়ে দেওয়া যেত ছোট্ট গঞ্জের সমস্ত চেনা-অচেনা মানুষকে— অথচ তার নিজের দোষেই কী ভাবে তা হয়নি, এই ভেবে খুব দুঃখ হতে থাকে ক্ষেত্রনাথের। মনের কথাগুলো ডায়রিতে লিখতে-লিখতে ঘরের আলো জ্বেলে রেখেই এক সময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে সে। অলক্ষে বিধাতাও সে সময় মুচকি হেসে নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে শুতে যান। নাহ, এই ছেলে এত সহজে শোধরানোর নয়!
******
দেখতে-দেখতে বিয়েবাড়ি একটু-একটু করে সেজে উঠতে থাকে টুকরো-টুকরো হাসি-ঠাট্টা, এবড়োখেবড়ো আলোর ঝলক আর এক দল মানুষের উচ্চকিত হইহট্টগোলে। অক্ষয়বাবুর এই একমাত্র মেয়ে, সুহাস। মেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করার পর অক্ষয়বাবু আর দেরি করেননি। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, তায় আবার পাত্র হিসেবে পাওয়া গিয়েছে একেবারে কলকাতা শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র ছেলেকে। স্বাভাবিকভাবেই অক্ষয়বাবু বিয়ের আয়োজনে তিলমাত্র ত্রুটি রাখছেন না। বড় আদরের মেয়েকে দূর দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। তাই ব্যবস্থা করছেন এত আলোর, যেন তার ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে কেউ না দেখতে পায় মেয়ের চলে যাওয়ার সময় অক্ষয়বাবুর চোখের জল। ব্যবস্থা করেছেন এত বাদ্যির, যেন তার উচ্চগ্রামে ঢাকা পড়ে যায় অক্ষয়বাবুর বুকের ভিতর ভাঙনের সর্বগ্রাসী আওয়াজ! ব্যবস্থা করেছেন শেষ পাতে এত মিষ্টির, যেন তার সামনে ফিকে হয়ে যায় অক্ষয়বাবুর চোখের জলের নোনতা স্বাদ!
মিষ্টির কথা মনে আসতেই অক্ষয়বাবুর মনে পড়ে গেল ক্ষেত্রনাথের কথা। মুখচোরা ছেলেটা ছোটবেলায় এ বাড়িতে খুব এলেও একটা সময়ের পর আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। সুহাস কিছু দিন মনমরা হয়ে থাকলেও সময়ের নিয়মে সে-ও খুব শিগগিরই ক্ষেত্রনাথকে ভুলিয়ে দিয়ে মেতে উঠেছিল নিজের স্কুলের নতুন বান্ধবীদের সঙ্গে। তখন কতই বা বয়স হবে ছেলে-মেয়েদুটোর! বিয়ের কথা জানাতে যে দিন ক্ষেত্রনাথের বাড়ি গিয়ে ছেলেটাকে অনুরোধ করে এসেছিলেন আপদে-বিপদে পাশে থাকতে, সে দিন আদৌ অক্ষয়বাবুর মনে প্রত্যাশা ছিল না যে তাঁর স্বভাবলাজুক ছাত্রটি সত্যি-সত্যি বিয়ের কাজে হাত লাগাবে।
অথচ ঠিক তার পরের দিন থেকেই ছেলেটা রোজ আসে। আসে নিজের কাজের ফাঁকে সময় করে। বড় একটা বেশি কথা বলে না। কিন্তু বিয়েবাড়ির হাজারটা কাজের এটা-ওটায় হাত লাগাতে থাকে নিয়মিত। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার এত বছর পরেও ছাত্র তাঁর শিক্ষককে ভোলেনি, বরং নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার— এই দেখে শত ব্যস্ততার মধ্যেও মন ভাল হয়ে যায় অক্ষয়বাবুর।
বিয়েবাড়ির মস্ত আঙিনায় মন ভাল নেই একমাত্র ক্ষেত্রনাথের। আয়োজনের খুঁটিনাটিতে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ক্রমশ তার আরও বেশি-বেশি করে মনে হতে থাকে, আগেভাগে রাজি হয়ে গেলে আজ তাদের মা-ছেলের বাড়িও এ ভাবেই সেজে উঠত আলোয়। ভরে উঠত লোকজনে। বিয়ের মণ্ডপ ফুলে-ফুলে সাজিয়ে তোলার ফাঁকে ফাঁকে মনটা দুঃখে ভরে ওঠে ক্ষেত্রনাথের। দুঃখবিলাসের সেই টানেই সে কাজের ফাঁকে ফিরে ফিরে আসে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে।
দেখতে দেখতেই বিয়ের দিন এগিয়ে এসে নিশ্বাস ফেলে কন্যাপক্ষের লোকজনের ঘাড়ে। বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, সন্ধে পেরিয়ে নামে রাত, পাত্রপক্ষের আর দেখা নেই! সন্ধে থেকেই ফোনের পাশে ঠায় বসে থেকে কলকাতায় ছেলের বাড়িতে বারবার ফোন করতে থাকেন অক্ষয়বাবু। আত্মীয়রা এসে আশ্বস্ত করেন, নিশ্চয়ই ছেলের বাড়ির সবাই ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে বাড়ি থেকে। কলকাতা থেকে গোপালগঞ্জ তো নেহাত কম রাস্তা নয়। রাত ক্রমশ বাড়তে থাকলে অবশ্য ফিকে হয়ে আসে সেই সব আশ্বাসবাণী। আশপাশে শুরু হয় ফিসফাস কানাঘুষো।
অবশেষে রাত দশটা নাগাদ বেজে ওঠে বাড়ির ফোন। উদগ্রীব অক্ষয়বাবু ফোনটা রিসিভ করে ও পাশের কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান ঘরের মেঝেয়। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে জানা যায়, পাত্রের নাকি প্রথম থেকেই এই বিয়েতে মত ছিল না। তা সত্ত্বেও সে বিয়েতে রাজি হয়েছিল স্রেফ নিজের বাড়ির লোকের চাপে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে বেঁকে বসেছে অবাধ্য, জেদি, দামাল হাওয়ার মতো। গোপালগঞ্জে অক্ষয়বাবুর বাড়ির অন্দরমহলে রোল ওঠে কান্নার। তবে কি শেষে লগ্নভ্রষ্টা হবে বাড়ির একমাত্র মেয়ে সুহাস?
প্রাথমিক ধাক্কাটুকু সামলে উঠে দৃঢ় গলায় নিজের প্রস্তাব সবাইকে জানান অক্ষয়বাবু। সুহাসকে তিনি লগ্নভ্রষ্টা হতে দেবেন না কিছুতেই। নিজেই বুদ্ধি দেন, হাতের কাছে সুযোগ্য পাত্র ক্ষেত্রনাথ তো আছেই! রূপে-গুণে কোনও অংশে সে সুহাসের চেয়ে কম নয়। সুহাসকে তাই ক্ষেত্রনাথের হাতে তুলে দিতে তাঁর এতটুকু আপত্তি নেই। অক্ষয়বাবুর এই আচম্বিত প্রস্তাবে ভিতরবাড়িতে ফের একবার কান্নার রোল ওঠে। অক্ষয়বাবু জ্ঞান হারানোর পর থেকে তাঁর পাশে-পাশেই ছিল ক্ষেত্রনাথ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধান শিক্ষকের এমন প্রস্তাবে সে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অক্ষয়বাবুর পাশেই।
অনতিবিলম্বে দেখা যায়, অক্ষয়বাবুর প্রস্তাবের সামনে ক্ষেত্রনাথের মৃদু আপত্তি কার্যত ঝড়ের মুখে উড়ে গিয়েছে দুর্বল খড়কুটোর মতোই। গভীর রাতে, কেঁদে-কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলা সুহাসের জীবনে চিরকালের মতো জুড়ে যায় ক্ষেত্রনাথের নাম। একটা ছোট অস্বস্তি তবু আত্মীয়স্বজনের মনে রয়েই যায়। পাত্রের মুখে হাসি নেই কেন? খোঁজখবর করে জানা যায়, ছেলে বরাবর এমনই লাজুক। হাসির অভাবটা তাই স্বভাবজাত। ও দেখে বিয়েতে ছেলের অমতের কথা ভাবার কোনও কারণ নেই জেনে আত্মীয়রা নিশ্চিন্ত হন। বিয়েবাড়ির খাওয়াদাওয়া শেষে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা মাংসের কুচির মতোই সাময়িক অস্বস্তিটাকে তাঁরা উপড়ে ফেলে দেন দূরে।
মাঝে কালরাত্রি। ক্ষেত্রনাথের কিছু বন্ধুবান্ধব, তার ব্যবসার কাজে সঙ্গীরা এসে বৌভাতের ব্যবস্থায় হাত লাগায়। দেখতে-দেখতেই দুটো দিন কেটে গিয়ে এসে পড়ে ফুলশয্যার রাত। রুদ্ধদ্বার কক্ষে শাড়ি আর গয়নায় সুসজ্জিত হয়ে ক্ষেত্রনাথের অপেক্ষায় থাকে নতুন বৌ সুহাস। ক্ষেত্রনাথের সঙ্গে খুব ছোটবেলায় তার ছিল গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। তার পর মাঝে দীর্ঘ সময় দু’জনের মধ্যে কোনও কথাই হয়নি। নিজের নিজের বাড়ি আসা-যাওয়ার মাঝে কখনও চোখ পড়ে গিয়েছে একে অন্যের উপর, ব্যস, ওইটুকুই। এই দু’দিনের হাজার ডামাডোলের মধ্যেও ক্ষেত্রনাথের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি সুহাসের। আদৌ এই বিয়েতে মত ছিল তো ক্ষেত্রনাথের? নাকি স্রেফ তার বাবার চাপে পড়ে ‘না’ বলতে না-পেরে রাজি হয়েছে সে? নিজের অসহায়তার কথা ভেবে হঠাৎই একলা ঘরে বুকটা মুচড়ে ওঠে সুহাসের। মস্ত বড় ঘরটা তাকে একা পেয়ে গিলে না খায়, সেই ভয়ে বিছানা থেকে নেমে ঘুরে-ঘুরে ঘরটা দেখতে থাকে সে। দেখতে-দেখতে এক সময় চোখ আটকে যায় ক্ষেত্রনাথের বইপত্রের টেবিলে। চোখ পড়ে টেবিলের উপর অযত্নে পড়ে থাকা একটা ডায়রির উপর। আচ্ছা, ক্ষেত্রনাথ অন্য কাউকে ভালবাসে না তো? ডায়রি লেখার অভ্যেস থাকলে সেই ডায়রির পাতায় কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই লেখা থাকবে সেই মেয়েটির নাম! কাজটা ঠিক হচ্ছে না জেনেও দুরুদুরু বুকে ডায়রির পাতা ওল্টায় সুহাস।
******
বৌভাতের পর্ব মিটিয়ে বাড়ির বাগানে বসে ক্ষেত্রনাথ ভাবছিল, কী ভাবে গত দু’দিনে হঠাৎ করেই পালটে গেল তার জীবনটা। এই বিয়েতে তার খুব একটা অমত না থাকলেও প্রত্যক্ষ ভূমিকাও যে খুব একটা রইল না, এই ভেবে খানিক ক্ষণ শোকতাপ করার পর অবশেষে সে পা বাড়াল শোওয়ার ঘরের দিকে।
সুহাস এত ক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে ঘরের ভেজানো দরজাটা সন্তর্পণে ফাঁক করে ঘরের মধ্যে উঁকি দিল ক্ষেত্রনাথ। সুহাস ঘুমিয়ে পড়লে এক দিকে যেমন সে খানিকটা স্বস্তি পেত, আবার অন্য দিকে খানিকটা দুঃখও হত, ফুলশয্যার রাতে নতুন বৌয়ের সঙ্গে কথা হল না বলে। কিন্তু এ কী! ঘরের দরজার দিকে পিঠ করে বসে সুহাস অমন ফুলে-ফুলে উঠছে কেন? আহা রে, মেয়েটাকে তো এক রকম জোর করেই তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন অক্ষয়বাবু। মনটা দুম করে খারাপ হয়ে যায় ক্ষেত্রনাথের। চোরের মতো যেমন চুপিসারে সে ঢুকেছিল ঘরের মধ্যে, সে ভাবেই সে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় ঘর থেকে। আর ঠিক তখনই পিছন থেকে গর্জন করে ওঠে সুহাস, “কোথায় যাচ্ছ?”
ধরা পড়ে গিয়ে সুহাসের মুখোমুখি হয়ে মাথা নিচু করে জবাব দেয় ক্ষেত্রনাথ, “না, মানে, ঘরে ঢুকে মনে হল তোমাকে একা থাকতে দেওয়া উচিত, তাই আর কী...”
সুহাস ফের কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠে, “আমাকে এক বারও বলোনি কেন?”
ক্ষেত্রনাথ বুঝে উঠতে পারে না কী বলার কথা বলছে সুহাস। আন্দাজে সে আমতা-আমতা স্বরে ঢিল ছোঁড়ে, “তোমার বাবাই তো এমন করে বললেন... আমি আর কী বলতাম, বলো...”
ক্ষেত্রনাথকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সুহাস এ বার ডায়রিটা খুলে মেলে ধরে ক্ষেত্রনাথের চোখের সামনে আর ভেজা চোখে হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করে, “আর
কবে বলতে আমাকে এ সব? তুমি এ রকম কেন?”
আরও আধ ঘণ্টা পরে দেখা যায়, ফুলে ঢাকা বিছানার এক পাশে পা ঝুলিয়ে অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছে ক্ষেত্রনাথ। আর পিছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে সুহাস। ফিসফিস করে সে তার স্বামীকে বলছে, “এতই যদি পছন্দ ছিল তো এক বারও সে কথা নিজে থেকে বলতে পারোনি? অন্তত বাবা যখন প্রস্তাবটা দিল, তখন তো একটু হাসতে পারতে, বোকা কোথাকার!”
ক্ষেত্রনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সবই বুঝলাম সুহাস। কিন্তু আমার অনুপস্থিতিতে আমার ডায়রিটা পড়ে কি তুমি ঠিক করলে? আমাকে কেউ ভয় পায় না, কোনও একটা কাজে, এমনকি আমার নিজের বিয়েতে অবধি কেউ আমার মত নেয় না বলেই তো আমার এত দুঃখ, তা কি জানো তুমি?”
সুহাস এ কথার উত্তরে ক্ষেত্রনাথের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে হাসতে-হাসতে বলে, “বেশ করেছি। ডায়রির পাতায় এত দিন যাকে লুকিয়ে রেখেছিলে, এ বার থেকে তার কাছে আর কিছু লুকোনো চলবে না, বুঝেছ মশাই?”
অলক্ষে বিধাতা মুচকি হেসে নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে শুতে যান। ক্ষেত্রনাথ কখন তার নিজের ঘরের আলো নেভাবে, সেই আশায় বসে থাকলে আজ রাত কাবার হয়ে যাবে, বিলক্ষণ জানেন তিনি। গোড়া থেকেই তিনি জানেন, এ ছেলে এত সহজে শোধরানোর নয়!