Abosar

কুসুমপুরের রূপকথা

কমলেশ কুমার

চিকেন, খাবি না, চিকেন, খাবি না…” বলে চিৎকার করতে লাগল তনু।

এই আমার এক দোষ। চোখের সামনে ভাল খাবার জিনিস দেখলেই খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে।

আর আমি এমন একটা বাড়িতে কাজ করি, যেখানে খাবার খাওয়ার থেকে ফেলা যায় বেশি। আসলে জনুকাকুরা হল বনেদি বড়লোক। জনুকাকু, মানে তনুর বাবা, প্রায়ই আমাকে তাঁর পূর্বপুরুষদের গল্প করেন। বলেন, ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকেই নাকি তাঁরা এই অঞ্চলের বিখ্যাত জমিদার ছিলেন। ইতিহাসের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী জনুকাকুর পূর্বপুরুষেরা। তার কিছু নিদর্শন আমি এই বিরাট বাড়িটার কয়েকশো অয়েল পেন্টিংয়েও দেখতে পাই। তাই নিয়ে জনুকাকুর অহঙ্কারও খুব।

এখন জমিদারি না থাকলেও এই বিশাল লাল মসৃণ মেঝের বারান্দা, কুড়ি ইঞ্চির দেওয়াল, বিরাট বিরাট কড়ি বরগা, শাল কাঠের প্রমাণ মাপের জানলা, ডাইনিং রুমের ঝকঝকে বৃহৎ ঝাড়বাতি, বেলজিয়ান কাচের আয়না, সবেতেই ইতিহাসের গন্ধ লেগে আছে।

জনুকাকুর মেজাজটাও জমিদারি। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তবে মনটা একেবারে কাচের মতো স্বচ্ছ। দানধ্যানে দরাজ হাত। কেউ খালি হাতে আমাদের বাড়ি থেকে ফেরত যায় না।

এই বাড়িটাকে আমি আমাদের বাড়ি বলেই ভাবি মনেপ্রাণে। আসলে আমার নিজের কোনও বাড়ি নেই। বাড়ি তো কোন ছার, মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই আমার। শুনেছি, আমাকে নাকি একটা ড্রেন থেকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন জনুকাকু। তখন আমার মাসছয়েক বয়স। কথাটা শুনে প্রথমে খুব চমকে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার আসল বাবা-মা তা হলে কে! কথাটা জনুকাকুকে বলতেই এমন ধমক দিয়েছিলেন যে, জীবনে ও সব কথা আর তুলি না। এখানে আমি নিজের বাড়ির মতোই থাকি। খাইদাই, টুকটাক কাজ করি, গাড়ি করে তনুকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিই।

এ বাড়িতে আমাকে খুব ভালবাসতেন আর এক জন। কাবেরীকাকিমা, মানে তনুর মা। ঠিক দু’বছর আগে, এ রকম এক ডিসেম্বরেই সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন উনি। সেই থেকে এ বাড়ির যত আনন্দ, আহ্লাদ, আলো সব যেন নিভে গিয়েছে। নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরেছে জনুকাকুকে। তনু অনেকটাই শোক কাটিয়ে উঠেছে লেখাপড়া, ইউনিভার্সিটি, বন্ধুবান্ধবের ভিড়ে।

আজকের দিনটা একটু অন্য রকম। আজ তনুকে দেখতে আসার কথা। সেই উপলক্ষে প্রচুর রান্নাবান্নার আয়োজন হয়েছে বাড়িতে। আর বিড়ালকে দিয়েছে মাছ সামলাতে! মানে আজকের রান্নাঘরের খাবার পাহারার দায়িত্ব আমার কাঁধে। সামলেই ছিলাম, কিন্তু জাম্বো সাইজ়ের নলেন গুড়ের রসগোল্লা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। রসগোল্লার অর্ধেকটা মুখে পুরেছি, আর হঠাৎ তনু এসে হাজির। ‘চিকেন, খাবি না, চিকেন, খাবি না…’ বলে এমন চিৎকার জুড়ল যে, রামুদা, বেণুপিসি, নিতাইমেসো, জনুকাকুরা এসে হাজির!

এখানে বলে রাখা দরকার, আমার নাম চিকেন। কেন ‘চিকেন’, তা আমি জানি না। জনুকাকুর মুখে এক বার শুনেছিলাম, ছোট থেকে চিকেন খেতে খুব ভালবাসতাম বলে, ওটাই আমার নাম হয়ে যায়। পাড়ায়, দোকানে বাজারে তো বটেই, তনুর ইউনিভার্সিটির বন্ধুরাও আমাকে বলে, ‘‘হাই চিকেন!’’

যদিও আমার একটা ভাল নাম আছে। ত্রিদিবেশ রায়। মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডে ওই নামটাই ছাপা আছে। মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড শুনে আবার আমাকে পণ্ডিত ভেবে বসবেন না, আমি তিন বার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিলাম, তিন বারই ইংরেজিতে সাত, বিজ্ঞানে নয়, ভূগোলে এগারো। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল অঙ্ক। পঁচানব্বইয়ের কম কোনও দিন পাইনি। সারা দিন অঙ্ক নিয়ে বসে থাকতাম। অঙ্কে কেউ কখনও ঘায়েল করতে পারেনি আমায়। এখনও কোনও কোনও দিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে চকখড়ি নিয়ে লাল মেঝের উপর অঙ্ক কষতে বসে যাই আমি। তনু ইংরেজিতে খুব ভাল। ইংরেজিতেই মাস্টার্স করছে ও, মাধ্যমিক পর্যন্ত অঙ্কের অনেক কিছু আমি ওকে শেখাতাম। তবে লেখাপড়া হয়নি বলে দুঃখ নেই আমার। সাতাশ বছর বয়সে এসে এটা বুঝেছি যে, লেখাপড়া সবার জন্য নয়। আর যা সহজে আসে না, তার পিছনে বেশি তেল পুড়িয়ে লাভও নেই।

এই বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে, বাগান, হাটবাজার, গাড়ি চালানো, গান শোনা, টিভি দেখা এই সব নিয়ে আমার দিন বেশ কেটে যায়।

তনু আমার থেকে চার বছর এগারো মাসের ছোট। যদিও দাদা-টাদা ও বলে না। শুধু চিকেন। দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমার সঙ্গে ঝগড়া করে। বাইরের যত ঝাল আমার কাছে এসে ঝাড়ে। আমি সহ্য করি। আসলে আমাকে পিটিয়ে ছাল-চামড়া তুলে নিলেও আমি বিশেষ রাগ করতে পারি না। মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করি। যদিও তনু বলে, আমি হাসলে নাকি আমাকে ভূতের মতো লাগে।

তনু, মানে তনুশ্রী মুখোপাধ্যায় গোটা কুসুমপুরের অহঙ্কার। শুধু লেখাপড়াতেই নয়, আচার-আচরণ, চালচলন, কথাবার্তা এবং দেখতে—সব মিলিয়ে ওর অনুগামীর সংখ্যা কয়েকশো। লাইনে-বেলাইনে, পাড়া-বেপাড়ার বহু ছেলে তনুর জন্য হাপিত্যেশ করে মরে। কেউ তনুর হাসিতে মজেছে, তো কেউ তাকানোয়! কেউ গানের গলায়, তো কেউ দুধে-আলতা রঙে। এই সব কারণেই আমাকে নিরাপত্তা বলয়টাও আঁটোসাঁটো রাখতে হয় সব সময়।

দানধ্যানে তনু ওর বাবাকেও ছাড়িয়ে যায়। গাড়িতে যেতে যেতে কোনও ভিখিরি দেখলেই হল, পাঁচ-দশ তো কোন ছার, একশো টাকার কড়কড়ে নোট তুলে দেবে তাদের হাতে। আমাদের গাড়িটাকে বোধহয় চিনে রেখেছে রাস্তার ধূপওয়ালারাও, সিগন্যালে গাড়িটা থামলেই কোথা থেকে তিন-চার জন ধূপের প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। তাদের কাউকেই তনু নিরাশ করে না।

আমি এক দিন মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলাম। তনু বলেছিল, ‘‘চিকেন, তোর স্যালারি থেকে কেটে নিয়ে কি টাকা বিলোচ্ছি আমি?’’

সেই থেকে এ সব নিয়ে আর মাথা ঘামাই না।

আমাদের এই মফস্সল এলাকাটা এখনও ধুলো-ধোঁয়ায় পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায়নি। শীতকালে মৃদু কুয়াশার সঙ্গে ঘাসে লেগে থাকা ভোরের শিশিরে পা ভিজে যায় এখানে। বসন্তে রাস্তার দু’পাশে পলাশ আর শিমুল গাছগুলো রক্তিম হয়ে ওঠে এখনও। ঝকঝকে পিচের রাস্তায় পলাশের জমে থাকা পাপড়ির উপর দিয়েই ছুটে চলে শয়ে শয়ে বাস, ট্রেকার, অটো। কিন্তু এখানেও আপত্তি তনুর। আমাকে কিছুতেই ফুলের পাপড়ির উপর দিয়ে গাড়ি চালাতে দেবে না ও। খুব বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাস্তার এক ধার দিয়ে আমায় গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি থামিয়ে তনু নেমে পড়ে কখনও। ঝরে পড়া শিমুল আর পলাশ মুঠো মুঠো করে গাড়িতে তোলে। আমাকেও নামতে হয় ওর সঙ্গে ফুল কুড়োতে। গত বছর এ রকমই একটা সময় আমি যখন ফুল কুড়োনোর কাজে ব্যস্ত, হঠাৎ দেখি তনু আমার খুব কাছে এগিয়ে এসেছে, আমি মাথা তুলতেই খুব মিষ্টি করে হেসে তনু বলেছিল, ‘‘এই তো, জাস্ট লাইক আ হিরো!’’

খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। একটা ঢোক গিলে বলেছিলাম, ‘‘আমি তোর হিরো, তনু?’’

কপট রাগ দেখিয়ে তনু বলেছিল, ‘‘স্বপ্নেও নয়! হিরোইক কিছু করেছিস না কি তুই আমার জন্য?’’

কথাগুলো বলে কেমন রহস্যময় হেসেছিল তনু। কেন কে জানে, আমার অ্যান্টেনা বরাবরই দুর্বল। সিগন্যাল ধরায় মোটেই সুনাম নেই।

“খেয়ে নে, চিকেন, খেয়ে নে। রসগোল্লাটা মুখে পুরেছিস যখন খেয়েই নে।”

জনুকাকুর আশ্বাসবাণীতে গোটা রসগোল্লাটা গপ করে গিলে ফেললাম। আমার কারবার দেখে হো-হো করে হেসে উঠল রামুদা, বেণুপিসিরা। আর তনু দেখলাম ঘর ছাড়ার আগে খুব মিষ্টি করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল এক বার।

আসলে এ বাড়িতে দীর্ঘ দু’বছর পর আজ এক আনন্দের দিন। কাবেরীকাকিমার চলে যাওয়ার পর আবার কোনও অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে এ বাড়িতে। তনুর সঙ্গে যার বিয়ের কথা চলছে, সেই অয়নদীপ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। প্যারিসে থাকে। তনুও মাস্টার্স কমপ্লিট করে প্যারিসে পাড়ি দেবে। আমি জানি, অয়নদীপের বাড়ির লোকজন তনুকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে। তনুর রূপ, ঐশ্বর্য দেখে মুগ্ধ হবে না এমন লোক বাংলায় আছে না কি! এক বার ওদের কলেজে খুব নামী এক জন চিত্রপরিচালক এসেছিলেন, তনুকে দেখে উনি সিনেমায় নামার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জনুকাকুর মত ছিল না বলে হয়নি। আজকে সব কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে গেলে সামনের মাসেই বিয়ে। তা ছাড়া অয়নদীপ জানুয়ারির শেষেই প্যারিস চলে যাবে।

তনুর বিয়ে মানে আমার বিরাট দায়িত্ব। হাজার দুয়েক লোক আসবে, তাদের অভ্যর্থনা, প্যান্ডেল, লাইট, মাইক, খাওয়াদাওয়া সবটাই তো আমাকে সামলাতে হবে। আমাকে তাই খুব কুল থাকতে হবে এই ক’টা দিন। এই বাড়ির মান-সম্মানের সঙ্গে আমিও তো জড়িয়ে, তাই না?

 

আজ সকাল থেকেই মৃদু সুরে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। ওটা তনুরই পছন্দ। উত্তরপ্রদেশ থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে বাজনদারদের, বাড়িতে নহবত বসবে। হায়দরাবাদ থেকে এসেছে বিরিয়ানির কারিগর। গোটা কুসুমপুরে আজ উৎসব যেন। মুখার্জিবাড়ির একমাত্র মেয়ে তনুশ্রীর বিয়ে আজ। সারা দিন আমার ছোটাছুটি চলছে। মাঝে মাঝে দেখা হচ্ছে তনুর সঙ্গে। ভারী ভারী গয়নায় যেন চাপা পড়ে গিয়েছে তনু। জনুকাকুও ব্যস্ত খুব। বেশির ভাগটা আমিই সামলে দিচ্ছি। বাড়ির সামনে পাঁচশো সিটের প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে, বরের জন্য তৈরি হয়েছে সোনালি কাপড় বসানো মণ্ডপ। বিকেল থেকেই বিরিয়ানির গন্ধে ম-ম করছে চার দিক। ইলিশ, চিংড়ি, ভেটকি, মাটন— এলাহি আয়োজন! শুধু চিকেন বাদ। জনুকাকুদের কোনও উৎসবে চিকেন হয় না। তবে আমি থাকি। আমি ছাড়া জনুকাকু অচল। তনু সন্ধেবেলা সেজেগুজে আসার পর যেখানে বসবে, সেই জায়গাটা লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। কয়েক হাজার টাকার শুধু গোলাপই আনানো হয়েছে এই কারণে।

বিকেল থেকেই অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। ভরে যাচ্ছে মুখার্জি ম্যানসন। আমি পিংপং বলের মতো এ দিক-ও দিক ছোটাছুটি করছি।

তখনও বর আসেনি। এক বার জেনারেটরের তেল আনতে বাইরে বেরিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি হঠাৎ যেন সব চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। এত হইচই সব চুপ। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে তনুর বসার বারান্দাটার দিকে এগোতেই শিউরে উঠলাম আমি। দেখলাম, মুখে কাপড় বাঁধা দশ-বারো জন লোক বন্দুক নিয়ে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে ঘরে। জনুকাকু হাত তুলে আছেন এক বন্দুকধারীর সামনে। দেখলাম, জনুকাকুর পকেট থেকে চাবি নিয়ে দু’জন লোক খুলে ফেলল বন্ধ লকার। সেখান থেকে গোছা গোছা নতুন নোট নিয়ে ভরতে লাগল বস্তায়। তিনটে লোক তনুর পাশে থাকা অতিথিদের দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা লোক তনুর মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমাকে দেখে অসহায়ের মতো তাকাল তনু। ওর চোখ ভর্তি জল। এর পর একটা লোক ইশারায় তনুকে উঠতে বলল। তার পর ওর গা থেকে খুলতে লাগল ভারী ভারী সোনার গয়না। জীবনে প্রথম বারের জন্য রক্ত চলকে উঠল আমার। রাগে মাথা ফেটে বিস্ফোরণ ঘটবে বলে মনে হচ্ছে যেন। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমার ডান পা চিরকালই যে কোনও মানুষের বুক অবধি উঠে যায়। চকিতে পা-টা চালিয়ে দিলাম লোকটার ঘাড় বরাবর। হঠাৎ আক্রমণে লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল। এর পর বন্দুকধারীকে লক্ষ্য করে উড়ে গিয়ে নাক বরাবর একটা ঘুসি চালালাম। গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল ওর নাক দিয়ে। নাক চেপে বসে পড়ল লোকটা। বন্দুকটা হাত থেকে পড়ে গেল ওর। ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি তুলে নিলাম ওটা। জনুকাকুকে যে লোকটা হাতে ভোজালি নিয়ে অর্ডার করে যাচ্ছিল এত ক্ষণ, তার পায়ের দিকে তাক করে অদক্ষ হাতে টিপে দিলাম ট্রিগার। লোকটা ছিটকে পড়ে গেল। একটা লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। তীব্র গতিতে সরে এসে আমার ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা ঢুকিয়ে দিলাম লোকটার চোখে। গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল লোকটার চোখ থেকে। এক জন ছুটে এসে আমাকে ল্যাং মারতে গেল। আমার ছ’ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতা বোধহয় লোকটা খেয়াল করেনি। সামান্য সরে বাঁ হাতটা তুলে কনুই দিয়ে সজোরে লোকটার মাথায় মারলাম। দু’হাতে মাথা চেপে বারান্দা টপকে ছুটতে লাগল লোকটা। জনুকাকুকে দেখলাম মোবাইলটা বার করে কাকে যেন ফোন করছেন, সম্ভবত পুলিশকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা কী করবে বুঝতে না পেরে যে যে দিকে পারল দৌড় লাগাল। শুধু চোখ থেকে রক্ত ঝরে পড়া লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে বলল, “শালা, এই নে… তোর পিরিত বের করে দিলাম জীবনের মতো!”

সামনে এক বার শুধু দেখলাম আলোর ঝলকানি। তার পর সব শূন্য। চোখের সামনেটা কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেল মুহূর্তে। অনুভব করতে পারছি, প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে আমার। ভূমিকম্প হচ্ছে কি? একটু কি টলে গেলাম? কারা যেন সব এসে ধরে ফেলল আমাকে। বেণুপিসি, রামুদা, নিতাইমেসোরা ছুটে এল। রামুদা আর বেণুপিসি বিকট শব্দে কেঁদে উঠল শুনতে পেলাম। বুকের ডান দিকটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাত দিলাম আন্দাজে। ভিজে ভিজে ঠেকল কেমন। দেখলাম হাত আর পা দু’টো অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না আমি। মনে হল একটু জল পেলে মন্দ হত না, প্রাণপণে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করছি, পারছি না, তনুর জন্য কেন যেন মনটা খারাপ হচ্ছে খুব। কান্না পাচ্ছে হঠাৎ।

পাঁকে ভরা ড্রেন থেকে উঠে আসা একটা ছোট্ট ছেলের কথা মনে পড়ল আমার। যে কোনও দিন জানতেই পারল না তার আসল বাবা-মায়ের কথা। প্রয়োজনও হয়নি। এই রাজবাড়িতে একটু একটু করে সেও তো রাজা হয়েই উঠেছিল এত দিনে!

খুব কষ্ট করে বুঝলাম, একটা মেয়ে আমার বুকের উপর আছড়ে পড়ল। আমার মুখে মৃদু মৃদু জল ঝরিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। আলতো করে আমার গলা থেকে বেরোল একটা শব্দ, ‘‘তনু!’’

আবছা শুনতে পাচ্ছি তনুর গলার আওয়াজ, “তুই সত্যিই হিরো, চিকেন, শুধু তুই ঘুমিয়ে পড়িস না, জেগে থাক… আমাকে এ ভাবেই আগলে রাখ আজন্মকাল!”

মেয়েটার চোখের জল ভাসিয়ে নিয়ে চলল আমাকে। কুসুমপুরের শিশিরভেজা ঘাস টপকে, বেহুলা আর গাঙুর নদী পেরিয়ে, লাল

পলাশ আর শিমুলফুল মুঠোয় ভরে একটা অনাথ ছেলে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল অন্য একটা রূপকথার গল্পের সন্ধানে…