Abosar

কুশলগিন্নির বিশল্যকরণী

উল্লাস মল্লিক

কুশলবাবু বিপদে পড়েছেন। একটু সাহিত্য ফলিয়ে বলা যেতে পারে, কুশলবাবু কুশলে নেই।

কুশলবাবু কুশলে নেই কারণ গিন্নি সূর্যমুখীর পতন হয়েছে। না না, যা ভাবছেন তা নয়; পতন চারিত্রিক কিছু না; ষোলো আনাই শারীরিক। গোদা বাংলায় যাকে বলে আছাড় খাওয়া। সূর্যমুখী দেবী বাথরুমে পা পিছলে আছাড় খেয়ে কোমরে চোট পেয়েছেন।

সূর্যমুখীর চোট মারাত্মক না হলেও, মামুলিও নয়। ব্যথা আছে, চলতে ফিরতে সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, নিয়ম করে ওষুধ খেতে আর রেস্টে থাকতে।

রেস্টে থাকা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। বেশ একটা দমদার চাকরি করেন কুশলবাবু।  মাসিক মাইনে মন্দ নয়, এমনিতেই গিন্নির সুসারার্থে বাড়িতে তাঁর একাধিক কাজের লোক। প্রাক পতন পিরিয়ডেও সূর্যমুখীদেবীকে সংসারের কুটোটা নাড়তে হত না। দিব্যি শুয়ে বসে হাই তুলে সিরিয়াল দেখে সময় কাটাতেন। সুতরাং, সাধারণ রেস্ট নয়, প্রয়োজনে সূর্যমুখীকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকী বছরের পর বছর বেডরেস্টে রাখারও ধক আছে কুশলবাবুর।

তা হলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা ওই ওষুধগুলো নিয়ম করে খাওয়া নিয়ে।

গোড়া থেকেই বলা যাক। কুশলবাবুর নিবাস কলকাতা শহর থেকে কুড়ি বাইশ মাইল দূরে কুসুমপুর নামে এক মফস্সল। সূর্যমুখীর পতন হয়েছিল কোনও এক শনিবারের বারবেলায়। কুসুমপুরে সম্প্রতি ‘সিওরকিওর’ নামে একটা পলিক্লিনিক হয়েছে। কলকাতা থেকে লম্বা ডিগ্রিওলা ডাক্তাররা পরিযায়ী পাখির মতো এখানে খেপ মারেন। এঁদের মধ্যে অস্থি বিশেষজ্ঞ ডাঃ এন ডি দেবও আছেন। এন ডি দেব অর্থাৎ নন্দদুলাল দেব প্রতি রবিবার সন্ধে সাতটা থেকে রুগি দেখেন সিওরকিওরে।

সূর্যমুখীর পতনের পর বরফ জল, গরম সেঁক, ব্যথাহরা বাম ইত্যাদি ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ করেছিলেন। সেই সঙ্গে কুশলবাবু, সিওরকিওরে ফোন করে নামটা বুক করে দিয়েছিলেন।

পরদিন, অর্থাৎ রবিবার সন্ধেবেলা গাড়িতে করে গিন্নিকে নিয়ে গেলেন সিওরকিওরে। প্রথম সমস্যা হল, রুগিকে ক্লিনিকে তোলা। ক্লিনিক দোতলায়। এদিকে মধ্যবয়সি সূর্যমুখী বেশ পৃথুলা। ওজনদার গিন্নিকে সিঁড়ি দিয়ে তুলতে তুলতে কুশলবাবু অনুভব করলেন, গাড়ির গ্যারেজের মতো হাড়ের ডাক্তারখানাও একতলাতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

শনিপুজোর দিন শনিমন্দিরে যেমন ভিড় হয় দোতলার ঘরটায় তেমনই গাদাগাদি ভিড়। চেয়ারগুলো সব ভর্তি, ফাঁক ফোকরে লোক দাঁড়িয়ে। সৌভাগ্যবশত ভিতরে জায়গা জুটল সূর্যমুখীদেবীর। পাড়ার ছেলে অমিতাভ বসেছিল একটা চেয়ারে; পাড়াতুতো বউদিকে সে স্যাক্রিফাইস করল চেয়ারটা। অমিতাভর মায়ের বাতের সমস্যা, বেশ কিছুদিন ডাঃ দেবের চিকিৎসায় আছেন। কুশলবাবু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, রেজাল্ট কেমন? অমিতাভ জানাল, সন্তোষজনক; আগে হাঁটুতে যন্ত্রণা হত, এখন পায়ের ডিমিতে হচ্ছে।

কুশলবাবু বিস্মিত হলেন-তাহলে আর ভালো কোথায়!

অমিতাভ ব্যাখ্যা করল, হাঁটুর ব্যথা ডিমিতে নেমেছে; এর পর পায়ের গাঁটে নামবে, তারপর গোড়ালিতে, শেষে ইলেকট্রিকের মতো মিশে যাবে মাটিতে। একে নাকি বলে ব্যথা নামানো থেরাপি।

কুশলবাবু ভাবলেন, গিন্নির ব্যথা যদি ওই কায়দায় নামান, বেশ সময় লাগবে। হাঁটুর অনেকটা ওপরে কোমর যে। তখনই পাশের রুগির দিকে চোখ গেল তাঁর। গলায় কলার আঁটা একজন স্ট্যাচুর মতো নট নড়ন চড়ন হয়ে বসে। কুশলবাবুর মনে হল, এর তাহলে তো আরও বেশি লাগবে।

যাই হোক, ডাক্তার দেখলেন সূর্যমুখীকে। গম্ভীর ধরনের মানুষ। দুটো মাত্র প্রশ্ন করলেন, ‘‘বসতে গেলে বেশি লাগে, না উঠতে গেলে?’’ ব্যস! খসখস করে দুর্বোধ্য লিপিতে প্রেসক্রিপশন লিখলেন। কটা ওষুধ দিলেন, সেই সঙ্গে এক্স-রে আর বিধিনিষেধ, নরম জায়গায় বসবেন, গরম সেঁক দেবেন, মলম লাগাবেন আলতো করে। বলেই বেল টিপলেন, মানে, উঠে পড়ুন, পরের জন আসবে।

কুশলবাবু পরদিন সকালবেলা গেলেন ওষুধ কিনতে। প্রথমে কালীমাতা মেডিকেল স্টোর্স। এটাই কুসুমপুরের সবচেয়ে পুরনো ওষুধের দোকান। মালিক ছাড়াও চার জন কর্মচারী। তাদের মধ্যে এক জন কুশলবাবুর পরিচিত। পাড়ার ছেলে নাম মিঠুন। এক সময় মুরগির মাংসের দোকান ছিল। এলাকায় তিনটে মিঠুন। এ তাই মুরগি মিঠুন নামে খ্যাত। আগে যখনই কালীমাতা থেকে ওষুধ কিনতে গিয়েছেন কুশলবাবু মিঠুনের হাতে কখনও প্রেসক্রিপশন দেননি। কী জানি, কিছুদিন আগেও তো মুরগি কাটত।  কী দিতে কী দেবে। চেষ্টা করেছেন মিঠুনকে এড়িয়ে অন্য কর্মচারীর কাছ থেকে ওষুধ নিতে। এবারও তাই করলেন, বয়স্ক একজন, চশমা পরা ধীরস্থির, দেখে মনে হয় কিছু বিদ্যে পেটে আছে, তাঁকেই প্রেসক্রিপশন দিলেন। দ্রুত প্রেসক্রিপশনে চোখ বোলালেন ভদ্রলোক, তার পর দোকানের আলমারি, যেগুলোর ভিতরে থরেথরে ওষুধ সাজানো, সেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করলেন। কিছুক্ষণ পর কাউন্টারের কাছে এসে কুশলবাবুকে বললেন, ‘‘প্রথম তিনটে ওষুধ হবে কিন্তু তার পরেরটা নেই।’’ একটু দোটানায় পড়ে গেলেন কুশলবাবু। সব ওষুধ এক দোকান থেকে না নিলে একটু সমস্যা হয়। একটা ওষুধের জন্য অন্য দোকান যেন তেমন পাত্তা দেয় না। ভাবখানা এমন, তুমি তো বাপু নেহাত ঠেকায় পড়ে এসেছ।

 কুশলবাবু বললেন, ‘‘আপনারা এনে দিতে পারবেন না?’’সেই সময়েই এগিয়ে এল মুরগি মিঠুন। ছোঁ মেরে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে বলল, ‘‘কোনটা?’’ তার পর বলল, ‘‘মাল তো ছিল, পিছনের ছোট আলমারিটা দেখেছেন?’’ বলে নিজেই চলে গেল পিছনের দিকে। আলমারির কাচ সরিয়ে এটা সেটা বের করে দেখল। তার পর ফিরে এসে বলল, ‘‘মাল ছিল, কালই স্টক শেষ হয়ে গিয়েছে, এখনই কলকাতায় অর্ডার পাঠিয়ে দিচ্ছি, কাকাবাবু আপনার আসার দরকার নেই, মাল এলে কালই আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেব।’’

ওষুধকে বারবার ‘মাল’ বলছিল মিঠুন। কুশলবাবুর মনে পড়ল, যখন মুরগি কাটত তখন মুরগিকে ‘পাখি’ বলত সে। ওকে বলতে শুনেছেন, ‘‘আমি সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটির পাখি রাখি, আমার পাখির টেস্ট আলাদা।’’

কুশলবাবু ভাবলেন, বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যখন দিচ্ছে, তখন এখান থেকেই নেওয়া যাক। প্রথম তিনটে ওষুধ নিয়ে চলে এলেন। মুরগি মিঠুনই শেষ পর্যন্ত দিল ওষুধগুলো। একটা মলম, বাকি দুটো ট্যাবলেট। মুরগি মিঠুন কোন ওষুধ কখন কী ভাবে খাবে, মলম কী পদ্ধতিতে লাগাবে, বিস্তারিত বুঝিয়ে বলল। মিঠুনের উপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল কুশলবাবুর। দস্যু রত্নাকর যদি বাল্মীকি হতে পারে, তাহলে মুরগিওয়ালা কেন ওষুধ দিতে পারবে না? বরং এতদিন মুরগিওয়ালা বলে যে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলেন মিঠুনকে সে জন্য মনে মনে লজ্জিত হলেন।

সে দিন থেকেই ওষুধ শুরু হয়ে গেল সূর্যমুখীদেবীর। বাকি যেটা আছে সেটা পর দিন মিঠুন পৌঁছে দিলে শুরু হবে।

কিন্তু পর দিন কোনও ওষুধ এল না কালীমাতা মেডিকেল থেকে। কুশলবাবু গেলেন দোকানে। তাকে দেখেই মিঠুন বলে উঠল, ‘‘আপনারটা পায়নি, কোম্পানি থেকে সাপ্লাই কম, কাল চলে আসবে।’’

কিন্তু পরের দিনও ওই একই কথা শোনাল মিঠুন, ‘‘সাপ্লাই কম আছে, কাল মাল চলে আসবে।’’

একটু হতাশ হলেন কুশলবাবু। গিন্নির অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এটা খেলে হয়তো আরও হত। তিনি তাই প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেলেন অন্য দোকানে। জয়চণ্ডী ফার্মেসি। এ দোকানটা কালীমাতার মতো  বড় নয়। দু’জন মাত্র কর্মচারী। এর মধ্যে এক জনকে চেনেন কুশলবাবু। বুলটন। বুলটন এলাকায় ডাক্তার নামে পরিচিত। না, মেডিকেল ডিগ্রি ডিপ্লোমা কিছু নেই তার। বাজারের মোড়ে দত্তদের যে দিশি মদের দোকান আছে, একসময় সেই দোকানে কাজ করত সে। দিশি মদের আদরের নাম টনিক। বুলটনের টনিক ছিল বিখ্যাত। এলাকার তাবৎ মাতালদের দীর্ঘদিন টনিক সাপ্লাই দিয়েছে বলে, মাতালরা তাকে ভালবেসে ডাক্তার নামে ডাকে। সেই নামই মান্যতা পায়। একসময় দত্তদের শরিকি বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়ায়, মদের দোকানে তালা পড়ে। বেকার হয়ে পড়ে বুলটন। কিছু দিন পরে ডাক্তার উপাধি নিয়েই জয়চণ্ডীতে জয়েন করে সে।

ঘাড় কাত করে কাঁধ আর কানের মধ্যে মোবাইল চেপে ধরে কথা বলছিল বুলটন। সেই অবস্থায় ইনজেকশন দিচ্ছিল এক জনকে। যাকে দিচ্ছিল চোখ মুখ কুঁচকে বসে ছিল সে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যথা লাগছে খুব। ফোনের কথা এবং ইনজেকশন একই সঙ্গে শেষ করল বুলটন। তারপর বলল, ‘‘কাল আসবেন, আর একটা ফুঁড়ে দেব। পরশু থেকে একদম ফিট।’’

কুশলবাবুর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বুলটন ওরফে ডাক্তার ভুরু কুঁচকে দেখল, শুধু চার নম্বরটা লাগবে শুনে একটু যেন বিরক্তিও ফুটে উঠল। তার পর গম্ভীর গলায় জানাল, ‘‘ডাক্তার যে ওষুধটা লিখেছেন, ঠিক সেই ওষুধটা নেই বটে, কিন্তু একই কম্পোজিশনের অন্য কোম্পানির ওষুধ আছে।’’

দোটানায় পড়ে গেলেন কুশলবাবু। একই কম্পোজিশনের অন্য ওষুধ নেওয়াই যায়। কিন্তু এই সে দিন পর্যন্ত দিশি মদের সেলস্‌ম্যান ওষুধের কম্পোজিশনের কতটা কী বুঝবে, এ ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ আছে তাঁর।

কুশলবাবুকে চুপ করে থাকতে দেখে বুলটন বেশ কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বলে উঠল, ‘‘দেখুন মেসোমশাই, ডাক্তাররা যে কোম্পানি থেকে বেশি কমিশন খায় সেই কোম্পানির ওষুধ লেখে। আসল জিনিস হল কম্পোজিশন। আমার কাছে যে ওষুধটা আছে সেই কোম্পানিটা নতুন, সেভাবে এখনও মার্কেটিং করে উঠতে পারেনি। কিন্তু আমি অনেককে দিয়ে দেখেছি, রেজাল্ট খুব ভাল। এবার দেখুন, আপনার ব্যাপার...’’

কুশলবাবু একটু মৃদু গলায় বললেন, ‘‘বাবা বুলটন, তোমরা ওটা আনিয়ে দিতে পারবে না?’’

বুলটন দুটো শর্ত চাপাল। এক, পঞ্চাশ টাকা অ্যাডভান্স করতে হবে। দুই, পুরো পাতাই নিতে হবে। কেটে দেওয়া যাবে না।

দুটো শর্তই মেনে নিলেন কুশলবাবু। পঞ্চাশ টাকা অ্যাডভান্স করে এলেন বুলটনকে।

কিন্তু পর পর দু’দিন গিয়ে ফিরে আসতে হল কুশলবাবুকে। বুলটন জানাল ওষুধ আসেনি। সেই সঙ্গে সে আবারও নতুন কোম্পানির গুণকীর্তন করল। এমনকী এটাও বলল, ‘‘আপনি ডাঃ দেবকে আমার কথা বলতে পারেন। বলবেন জয়চণ্ডীর ডাক্তার এই ওষুধটা দিয়েছে। দেখবেন উনি এটাই খাওয়াতে বলবেন।’’

না, এর পরও বুলটনের ওপর ভরসা করতে পারলেন না কুশলবাবু। ভাবলেন, এত দিন তো দেরি হয়েছে, না হয় আর একটা দুটো দিন হবে। কিন্তু ডাঃ দেবের লেখা ওষুধই খাওয়াবেন গিন্নিকে।

ফেরার পথে কালীমাতায় গেলেন একবার। তাকে দেখেই মুরগি মিঠুন লাফিয়ে উঠল। আপনার মাল এসে গিয়েছে। আজই পৌঁছে দিতাম!’’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কুশলবাবু। ‘‘যাক বাবা, পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত।’’

কিন্তু এখানেও ফ্যাঁসাদ। ওষুধ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানের সব আলমারি তন্নতন্ন করে খুঁজছে মিঠুন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ওষুধ এসেছিল ঠিকই, মিঠুন যত্ন করে রেখেও দিয়েছিল। কিন্তু অন্য এক কর্মচারী সেই ওষুধ অন্য এক জনকে দিয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর জানা গেল জোড়াকলতলা এলাকার শশধর সাহার কাছে চলে গিয়েছে সেই ওষুধ। শশধর সাহার বউও বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন, তাঁরও ওই একই জায়গায় একই ধরনের আঘাত, তাঁকেও ডাঃ দেব ওই একই ওষুধ দিয়েছেন!

বঁড়শিতে গাঁথা মাছ ডাঙায় তোলার পর আবার জলে পড়ে গেলে যেমন আফশোস হয় তেমনই হল কুশলবাবুর। অসহায় গলায় মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হবে বাবা তাহলে মিঠুন?’’

মিঠুন যুক্তি দিল, ‘‘আপনি এক কাজ করুন কাকাবাবু। জোড়াকলতলায় চলে যান। হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটাই শশধর সাহার বাড়ি। আপনি ওঁর কাছ থেকে হাফ পাতা চেয়ে নিন। মাল একবার যখন পাওয়া গিয়েছে, আবার যাবে। আপাতত দু’জনের কাজ চলুক, মাল আবার এলে, আমি দু’জনকে ভাগাভাগি করে দেব।’’

তবে সেই সঙ্গে দুটো সতর্কবাণী শুনিয়েছিল মিঠুন। এক, শশধরের বাড়িতে বাঘা কুকুর আছে দুটো। দুই, ভদ্রলোক নিজে প্রচণ্ড মামলাবাজ। কথায় কথায় মামলা ঠুকে দেন। সুতরাং কুকুর ও শশধর উভয় হইতেই সাবধান!

শশধরের বাড়ি গেলেন কুশলবাবু। এবং গিয়ে বুঝলেন দুটো ব্যাপারে মিঠুন সাবধান করলেও তিন নম্বর একটা আছে। ভদ্রলোক কানে কম শোনেন। দরজা খোলার পর বেশ মোলায়েমভাবেই কুশলবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কুকুর কিছু করবে না তো?’’

শুনেই খুব উত্তেজিতভাবে শশধরবাবু বলে উঠলেন, ‘‘শুনুন মশাই, সাফ বলে দিচ্ছি, ওই পুকুরের ভাগ আমি কাউকে দেব না, আপনি ইচ্ছে করলে যে কোনও কোর্টে যেতে পারেন।’’

পুকুর জমি কিছু নয়, সামান্য একটা ওষুধের ভাগের জন্য এসেছেন তিনি এই কথা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হল কুশলবাবুকে।

এবার শশধরের সাফ জবাব, বহু কষ্টে তিনি এই ওষুধ জোগাড় করেছেন, কোনও ভাগই দেবেন না। তাতে কুশলবাবু হাওড়া কোর্ট, হাইকোর্ট এমন কী সুপ্রিম কোর্টে পর্যন্ত যেতে পারেন। তিনি কোর্টেই লড়ে নেবেন।

ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে এলেন কুশলবাবু। কোনও কোর্টে নয়, বাড়িতেই ফিরে এলেন। এই ক’দিন গিন্নির আরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কুশলবাবুর মনটা খিচ খিচ করছে। ওই ওষুধটা পড়লে হয়তো আরও হত।

কুসুমপুর ব্যাঙ্কের কাছে বড় একটা ওষুধের দোকান হয়েছে। বিখ্যাত এক ওষুধ কোম্পানির শাখা। প্রতিবেশী দীনবন্ধুবাবু তাঁর বহু পুরনো অর্শের একটা ওষুধ কোথাও পাচ্ছিলেন না, শেষ পর্যন্ত ওই দোকানে পেয়েছেন। আশায় বুক বেঁধে কুশলবাবু গেলেন সেখানে। বলে রাখা ভাল, এর মধ্যে মোবাইলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন বেশ ক’বার। হয় সুইচ অফ নয় রিং হয়ে গিয়েছে, কেউ রিসিভ করেনি।

যাই হোক, গিয়ে দেখলেন সত্যিই বড় দোকান। কাচের দরজা, ভিতরে ঠান্ডা মেশিন চলছে, কর্মচারীরা সব ইউনিফর্ম পরা। কম্পিউটারে বিল হচ্ছে। এসি, কম্পিউটার, উর্দিধারী কর্মচারী দেখে  কুশলবাবুর মনে হল, হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। এখানেই খুঁজে পাবেন গিন্নির বিশল্যকরণী।

কিন্তু না, এখানেও হতাশ হতে হল তাঁকে। এক কর্মচারী প্রেসক্রিপশন এক ঝলক দেখেই জানিয়ে দিল এই ওষুধ সরকার থেকে সম্প্রতি ব্যান করে দেওয়া হয়েছে! কোনও কোনও ডাক্তার লিখছেন ঠিকই, কোনও কোনও দোকান বিক্রিও করছে, কিন্তু তাদের কাছে নেই।

 

******

না, আর কোথাও দৌড়াদৌড়ি করেননি কুশলবাবু। পরের রবিবার, সূর্যমুখীকে নিয়ে সোজা চলে এসেছেন সিওরকিওরে। এক্স-রে টা শুধু করিয়ে নিয়েছেন এর মধ্যে।

ডাঃ দেব সূর্যমুখীদেবীর চোটের জায়গা এবং এক্স-রে দুই দেখলেন। তারপর বললেন, ফ্র্যাকচার বা ক্র্যাক হয়নি, তবে ধাক্কা ভালই লেগেছিল। যাই হোক, ওই ওষুধই চলবে।

এবার সমস্যার কথাটা পাড়লেন কুশলবাবু। বললেন, ‘‘কিন্তু ডাক্তারবাবু, চার নম্বর ওষুধটা পাওয়া যাচ্ছে না যে!’’

‘‘চার নম্বর!’’ বিস্মিত ভাবে ডাঃ দেব তাকালেন কুশলবাবুর দিকে।

কুশলবাবু প্রেসক্রিপশন মেলে ধরে দেখালেন, ‘‘এই যে এটা। প্রথম তিনটে পাচ্ছি। কিন্তু এটা কোথাও পাচ্ছি না।’’

ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল ডাক্তারবাবুর। তারপর ফিক করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘‘দুর ওটা ওষুধ নাকি, ওটা তো একটা অ্যাডভাইস। লিখেছি, সফট কুশন, মানে নরম জিনিসের ওপর বসবেন। শিরদাঁড়ার নিচের দিকের হাড়ে চোট ছিল। ওই জায়গায় চোট লাগলে আমরা এই অ্যাডভাইস দিই। ওষুধ তো তিনটেই! ধুর মশাই...আপনিও যেমন।’’

বিস্ময়ে চোখ এবং মুখের হাঁ দুই-ই গোল হয়ে গেল কুশলবাবুর। সূর্যমুখীদেবীও বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন ডাক্তারের দিকে। কুশলবাবুর চোখের সামনে ভেসে উঠছে গত এক সপ্তার ঘটনাবলী। ভেসে উঠছে মুরগি মিঠুন, ডাক্তার বুলটন আর উর্দিধারী সেই কর্মচারীর মুখ।

ডাক্তার বেল বাজিয়ে দিয়েছেন। মানে নেক্সট পেশেন্ট। কুশলবাবু দেখলেন, সস্ত্রীক শশধরবাবু ডাক্তারের খোপে ঢুকবেন বলে এগিয়ে আসছেন।

কোন এক মহাপুরুষ যেন বলেছিলেন, ‘ওরে পাগল, জীবনে যা পেলি না তার জন্য কাঁদিস কেন? হাস রে পাগল, হাস। হেসে নে।’

হ্যাঁ, কুশলবাবু হাসছিলেন। শশধরবাবুকে দেখে হাসিটা আরও খোলতাই হল তাঁর।