Abosar

কাঞ্চনজঙ্ঘা

বন্দনা মিত্র

তাপসী ভূত বিশ্বাস করে না ঠিকই, কিন্তু সেটা খাস কলকাতায় বসে। এখন উত্তর সিকিমের এই প্রত্যন্ত গ্রাম— একে গ্রাম বলাও ভুল হবে, পাহাড়তলির ওপর ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কয়েকটা কাঠের বাড়ি— যেখানে সাঁঝবেলাতেই নিঝুম রাত নেমে এসেছে, এখানে ওর কেমন একটা ভয়-ভয় করছে। তার ওপর বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।

এই অঞ্চলে এই একটাই হোম-স্টে সদ্য খুলেছে। সাকুল্যে চারটি ঘর। এখন এই ভরা বর্ষায় কেউ আসে না সাধারণত। যদি হঠাৎ রঞ্জনের অ্যাডভোকেট বন্ধু তমালের ফোন না পেত, তা হলে তাপসীও আসত না। অফিসে একটা জরুরি মিটিং চলছিল, তখনই আসে ফোনটা। মিটিং চলাকালীন খুব জরুরি না হলে ও কোনও ব্যক্তিগত ফোন ধরে না, তাই ‘মিটিংয়ে আছি, পরে ফোন করছি’ মেসেজ দিয়ে কেটে দিয়েছিল। পরে ফোন করতে তমাল কোনও ভণিতা না করে ওকে জানায় যে, রঞ্জন এখন অফিসের ট্যুরে দিল্লিতে নেই, মণিকার সঙ্গে গোয়ায় ছুটি কাটাতে গেছে। ওরা ফিরে এসে বিয়ে করতে চায়। তমালকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে ডিভোর্সের শর্তাবলি তাপসীর সঙ্গে ফাইনাল করে রাখতে। রঞ্জন উদার ভাবে বলেছে, তাপসীর সব ন্যায্য দাবি ও মেনে নেবে, প্রকৃত ভদ্রলোকের মতো। তমাল কথা বলছিল পারিবারিক বন্ধু হিসেবে নয়, এক জন ল’ইয়ার হিসেবে। এতই নৈর্ব্যক্তিক ওর বাচনভঙ্গি, যেন অস্থায়ী কর্মচারীকে ছাঁটাই নোটিস ধরিয়ে দিচ্ছে।
তাপসীর মাথায় চড়াক করে উঠেছিল খেপাটে রাগ। আধঘণ্টার মধ্যে ছুটির দরখাস্ত দিয়ে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে, প্যাক করে, এসপ্ল্যানেড থেকে সন্ধের এসি বাস ধরে সকালে শিলিগুড়ি। সেখানে চা খেতে গিয়ে আলাপ হল বিবেক লিম্বু-র সঙ্গে, পাহাড়ি রাস্তায় জিপ চালায়। ওর কাছেই খবর পেল এই জায়গাটার। ওর নিজেরই হোম-স্টে, বাবা আর বৌ চালায়। বলেছিল, যত দিন খুশি থাকুন, অফ সিজ়ন, যা খুশি দেবেন। তবে কোনও ট্যুরিস্ট নেই, তাই ব্যবস্থাপনা খুব সাধারণ হবে, একেবারে ঘরোয়া।

আদ্যিকালের ল্যান্ডরোভারে প্রায় ছ’ঘণ্টা লাগল চুলের কাঁটার মতো বিপজ্জনক কিন্তু সুন্দর পাহাড়ি পথ ধরে এখানে পৌঁছতে। গা ছমছমে অপার্থিব জনমানবহীন জায়গা, পাহাড়ের ভাঁজে লুকোনো এক খণ্ড সবুজ রুমাল যেন। এক দিকে ধার বরাবর সুঠাম উন্নতশির গাছের সারি। অন্য দিকে আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া রাজকীয় পর্বতমালা। এরা দু’দিক থেকে যেন সতর্ক নজর রাখছে এই ছোট্ট গ্রামটির ওপর। আহত পশুর মতো লোকচক্ষুর আড়ালে নিজের ক্ষতস্থান চেটে চেটে রক্তপাত বন্ধ করার আদর্শ জায়গা।

হোম-স্টে মানে একটা পলকা কাঠের বাড়ি, সামনে বুনো ঘাসের জমিতে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল পাতা। ও দিকে একটা পলকা রান্নাঘর ও লাগোয়া দু’টো ঘরে বিবেকের বৌ কুসুমের সংসার। বৌটা বেশ আলাপী, মনটা খুব নরম। লাঞ্চের সময় অনেক গল্প হল। তাপসী ভেতরের কষ্টটাকে ঠাট্টার মোড়কে ঢেকে বলে ফেলল রঞ্জনের কথা। হালকা চালে বললেও কুসুম বুঝতে পেরেছিল। নিজের হাত থেকে খুলে একটা পুরনো মাদুলি ওকে দিয়ে বলল, দেবী ইউমা সামাংয়ের মন্ত্রপূত কবচ, সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। তাপসী দামের কথা বলতে যাচ্ছিল, বৌটা

আগেই বলল, কোনও টাকাপয়সা লাগবে না, ওরা ঠাকুর-দেবতা নিয়ে ব্যবসা করে না। এই পবিত্র পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘার আসল নাম সেঞ্জেলুংমা, লিম্বুরা সেই নামেই ডাকে। সেই পর্বতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ইউমা সামাং, ধরিত্রীদেবী, ওদের রক্ষয়িত্রী। কুসুমের বুড়াবাবা, মানে ঠাকুরদা সাধু হয়ে গেছিল। তার পর তিব্বত, কামাখ্যা, অনেক ঘুরেছে। বুড়ো মরার আগে এক বার এসে নাতনিকে কিছু মন্ত্রপূত জড়িবুটি, তাগা-তাবিজ দিয়ে যায়।

এ সব বলার পর চোখ বড় বড় করে কুসুম বলল, “সবচেয়ে আশ্চর্য চিজ় দিয়েছে, একটা জাদু কুকরি, সাংঘাতিক খতরনাক! কোন একটা তিব্বতি গুম্ফা থেকে চুরি করে আনা। আমাকে কসম দিয়ে গেছে, যেন চাবিবন্ধ রাখি সব সময়। ও কুকরি লহু চায়, কিছু দিন বাদ বাদ। খোলা থাকলেই কেমন করে বুঝে যায় কখন কার দিমাগে খুন চেপে আছে। উনোনে আঁচ উস্কানোর মতো সে রাগ আরও খুঁচিয়ে তোলে। এক বার যদি খুনের নেশায় টং হয়ে এই কুকরি হাতে তোলে কেউ, কুকরি নিজের কাম করে নেয়। যার নামে শাপ বলবে, মুখে রক্ত উঠে তার দেহান্ত।”

এমন একটা জিনিসের কথা শুনে কি আর দেখতে না চেয়ে থাকা যায়! তাপসীর অনেক অনুরোধে কুসুম এনে দেখাল কুকরিটা। সুন্দর দেখতে আপাত-নিরীহ একটা অ্যান্টিক। পাহাড়ি দেশের এ সব ভূতুড়ে গালগল্প শুনতে ভালই লাগছিল, কিন্তু তখন তো জানা ছিল না যে, বিকেলের শেষে এমন তাণ্ডব ঝড় আসবে, সঙ্গে ছুঁচের মতো ধারালো তুষার হিম, বৃষ্টির ছাঁট, আকাশ-চেরা বিদ্যুতের ফণা— পাহাড়ি ঝড়বৃষ্টি এমন ভয়ঙ্কর কে জানত! কারেন্ট এখানে নেই, আলো বলতে মোমবাতি। সেও তুমুল হাওয়ায় নিভে যাচ্ছে। মোবাইলের সিগন্যাল তো এ তল্লাটে পা দেওয়ামাত্রই দেহ রেখেছে।

সাড়ে সাতটার মধ্যে ঝাল-ঝাল দেশি মুরগির ঝোল আর পাতলা হাতরুটি দিয়ে ডিনার সাজিয়ে রেখে গেল কুসুম। সঙ্গে দিয়ে গেল বাড়তি মোমবাতি ও গরম জলের বোতল। বলে গেল যে, পরের দিন সকাল সাতটায় বেড-টি আসবে। তাপসী রাতে যেন ঘরের বাইরে না আসে, কারণ বর্ষায় সাপখোপ বেরোয়। কোনও দরকার পড়লে বারান্দার ঘেরাটোপে একটা চৌকি ফেলে ওর শ্বশুর শুয়ে থাকে, তাকে ডাকতে পারে। তবে কি না সে বুড়ো এর মধ্যেই নেশা করে কম্বল চাপিয়ে ঘুমোচ্ছে। নেশাড়ুর ঘুম, গায়ের ওপর দিয়ে হাতি চলে গেলেও জাগবে না।

বর্ষাতিটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে ঘাসজমির ও ধারে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল বৌটা, আর ঠিক তখনই চোখ-ধাঁধানো তীব্র বিদ্যুৎ, সঙ্গে-সঙ্গে আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়ল। আর যেটুকু সাহস অবশিষ্ট ছিল, সেটুকুও মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। তাপসী মরিয়ার মতো কুসুমের হাতটা ধরে মিনতির সুরে বলল, “আমার এখানে রাতটা থেকে যাও না, গল্প করব দু’জনে। ছেলে তোমার বরের কাছে থাকবে এখন।”

বৌটা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “তা কি হয় দিদি। মরদ আজ এত দিন পর এসেছে, আমাকে ছাড়া থাকবে না রাতে, এখনই বুলাতে চলে আসবে। ভয় কী! কাছেই তো ঘর, চেঁচালেই শোনা যাবে।”

নিরুপায় তাপসী ঘরে এসে খিল আঁটল দরজায়। রাগও হচ্ছিল নিজের ওপর, কেন এমন বোকার মতো হাতে-পায়ে ধরতে গেল! মুখের ওপর না বলে দিল তো। বরসোহাগি কেন থাকবে এই দুর্যোগে নিজের বর-ছেলেকে ছেড়ে! কী অহঙ্কার! কেমন ডাঁট দেখিয়ে বলল, “এখনই বুলাতে চলে আসবে!” তাপসীর হাল দেখে ওর করুণা হচ্ছিল নিশ্চয়ই সেই সময়ে। ছি ছি! কেন যে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কথাগুলো বলতে গেল আগ বাড়িয়ে!

ঝড়ে মোমবাতিটা নিভে যাচ্ছে সমানে। টর্চ আনা উচিত ছিল, তাড়াহুড়োয় আনা হয়নি। খাওয়ার পর বাথরুম থেকে ঘুরে এসে শোওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগল। বৃষ্টি ঝড় আগের মতোই চলছে, একটুও কমেনি। বিদ্যুতের আলোয় থেকে থেকে চোখ ধাঁধিয়ে উঠছে। ঘরের ভেতর আবছা অস্থির আলো। শোঁ-শোঁ হাওয়া কাচের শার্সিতে আছড়ে পড়ছে। তাপসী আন্দাজে বাড়তি কম্বলটা বিছিয়ে নিল চৌকিতে। গরম জলের বোতলটা রাখল পায়ের কাছে। তার পর আড়ষ্ট শরীরটা বিছিয়ে দিতে গেল শয্যায়। হঠাৎ একটা লোহার ফলা যেন বিঁধল কোমরে, শরীর ঝনঝন করে উঠল ব্যথায়। মোবাইলের আলোয় ও অবাক হয়ে দেখল, সেই কুকরিটা! খাটের ওপর দাঁত বার করে যেন হাসছে। নিশ্চয়ই ভুল করে ফেলে গেছে কুসুম। মরদকে কাছে পাওয়ার আহ্লাদে বৌটার কোনও দিকে খেয়াল ছিল না। এত ক্ষণে নিশ্চয়ই হামলে পড়ে বরের আদর খাচ্ছে।

সারা দিন ধরে আটকে থাকা সমস্ত রাগ অপমান দুঃখ, হাউহাউ কান্না হয়ে দমকে দমকে বেরিয়ে এল বুকের ভেতর থেকে। কুকরিটা দু’হাতে চেপে ও হাহাকার করে কাঁদতে লাগল। আচ্ছা, রঞ্জনও কি এখন মণিকাকে… তাপসীর কী নেই? কী পায়নি ও তাপসীর কাছ থেকে?

তমাল রঞ্জনের কলেজের বন্ধু। দুই পরিবারে খুব ভাব। প্রতি বছর এক সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, নিয়মিত আড্ডা, নাটক, বইমেলা। তমালদের ও পারিবারিক বন্ধু বলে ভাবত, বিপদে-আপদে ভরসা করত। সেই তমাল কী রকম সপ্রতিভ ভাবে বলল, “ আপনার টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনগুলো একটু ঠিক করে রাখবেন ম্যাডাম। রঞ্জন কলকাতায় ফিরে ওর কোম্পানির গেস্টহাউসে উঠবে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া আছে আমায়। রঞ্জন বলেছে ব্যাপারটা জেনারাসলি হ্যান্ডেল করতে। হাজার হোক, ও এক জন জেন্টলম্যান।”

জেন্টলম্যান! নিজে না বলে আইনজীবী বন্ধুকে দিয়ে স্ত্রীকে ডিভোর্সের কথা জানাচ্ছে! যেন বিজ়নেস ডিল ফাইনাল করছে! ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটা দরাজ ভাবে মিটিয়ে দেবে বলেছে। তাপসী কি ওর ছাঁটাই করা কর্মচারী? আচ্ছা, কুসুম কি এখন তাপসীর দুর্দশার কাহিনি বরের কাছে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছে? বুকের কাছে ঘন হয়ে একে অপরের উত্তাপে গরম হতে হতে… ভাবতে ভাবতেই তাপসীর গলা থেকে বেরিয়ে আসে এক জান্তব হিংস্র আওয়াজ— সবাই, সবাই ওর বিরুদ্ধে। সবাই ওকে ঠকিয়েছে, বিদ্রুপ করেছে, করুণা করেছে, ঘেন্না করেছে! উচ্ছন্নে যাক, সবাই উচ্ছন্নে যাক। হঠাৎ যেন যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে পড়ে। তাপসী দেখে, ওর ডান হাতটা যেন আর ওর নেই! হাতের আঙুলগুলো কাঁকড়ার মতো এঁকেবেঁকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে বালিশের পাশে রাখা খাপ-মোড়া কুকরিটার দিকে। কুকরির বাঁটটা ছোরা ধরার ভঙ্গিতে মুঠোয় তুলে নেয় ও। খাপ থেকে এটাকে বার করল কে? তাপসী না কি? কই মনে পড়ছে না তো! কেমন একটা তপ্ত ওমের আরামদায়ক অনুভূতি কুকরির কনকনে ঠান্ডা ধাতুর পাত থেকে ওর শিরা-উপশিরা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যেন। আশ্চর্য, একেবারেই আর ভয় করছে না তাপসীর। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে যাচ্ছে মন, কুকরির ফলাটা যেন ঝিকিয়ে ওঠে খুশিতে, কেমন যেন চটচটে রস নিঃসরণ হচ্ছে ছোরাটার ধারালো দাঁত দিয়ে। এ সব কি আসলে কল্পনা তাপসীর? কিন্তু এত অন্ধকারে ফলাটাই বা ঝিকিয়ে উঠবে কী করে! তা হলে হাতে কী লাগল? ও চাইলেও কুকরি থেকে হাত সরাতে পারছে না তো! বরং মাথায় খেলে বেড়ানো নামগুলো যেন পাগল করে দিচ্ছে ওকে। রঞ্জন, মণিকা, তমাল, বিবেক লিম্বু, কুসুম, কুসুমের ছেলেটা— বছর দুয়েক, গোলগাল, চেরা চোখ— কী নাম যেন বাচ্চাটার! নামটা শেষমেশ মনে করতে পারলেই যেন পুরোপুরি শান্তি, মুক্তি মিলবে এই অসহ্য মাথার যন্ত্রণা থেকে, আরাম করে ঘুমোতে পারবে ও। আবার এক বার ঘরে ঝলসে ওঠে নীল বিদ্যুৎ, বাইরে পৃথিবী রসাতলে পাঠানোর আয়োজনে মত্ত তুফান ও বৃষ্টি। ঘন অন্ধকারে জানলার কাচের বাইরে আবছা দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ মহীরুহের সারি, পাগলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে তারা যেন কিছু বারণ করছে! জানলার কাচ দিয়ে বৃষ্টির ঝরোখা ভেদ করে কাঞ্চনজঙ্ঘার ঋজু আদল আবছা দেখা যাচ্ছে। কিছু মনে করাচ্ছে কি বৃদ্ধ পর্বত? কিছু কি মনে পড়ছে? কুকরি হাতে নামগুলো উচ্চারণ করলে কী যেন হবে, বৌটা বলছিল। কখন? হ্যাঁ, দুপুরে ওর ছোট্ট ছেলেটাকে খাওয়াতে খাওয়াতে। কাঞ্চনজঙ্ঘার গল্প বলে যখন কবচটা হাতে বেঁধে দিয়েছিল তাপসীর। কবচটা কোথায়? এই তো, পেয়েছে। তাপসীর মাথাটা যেন ছেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কিংবদন্তি সত্যি মিথ্যে যা-ই হোক, নামগুলো কিছুতেই মুখে বলা চলবে না, কুকরি যেন শুনতে না পায়, পেলেই…

অবশ্য পেলে কী হবে ও জানে না। হয়তো কিছুই হবে না, হয়তো এটা একটা পাহাড়ি কুসংস্কার। কিন্তু কুকরির গায়ে চটচটে আঠালো তরলের স্পর্শটা এখনও হাতে লেগে আছে, আঁষটে একটা গন্ধ এখনও বাতাসে ভাসছে। প্রাণপণ শক্তিতে সমস্ত মনের জোর একত্র করে তাপসী কুকরিটা ছুড়ে ফেলে দিল ঘরের এক কোণে। একটা হিসহিসে শব্দ উঠল যেন। ওই শব্দে কী মিশে আছে? আক্ষেপ? হতাশা?

তাপসী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। ওই কুকরির সঙ্গে এক ঘরে থাকার সাহস নেই আর। হয়তো এখনই আবার মাথায় ছোবল মারবে খুনে রাগ। বৃষ্টি থেমে গেছে। তুফানি হাওয়ায় ওর খোলা চুল, গায়ের শাল উড়ছে এলোমেলো। আকাশে কত রকম আলপনা আঁকছে নীল বিদ্যুৎশিখা। এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও একটা উষ্ণ আরামদায়ক অনুভূতি ওকে সাহস দিচ্ছে যেন। এই অতিবৃদ্ধ হিমালয়, কুসুমের বুড়োবাবার মতো যেন দু’হাত তুলে অভয় দিচ্ছে। এই অতিকায় মহীরুহের দল যেন শাখাপ্রশাখা মেলে ওকে আগলে আছে। এই অপার্থিব পরিবেশে মনে হচ্ছে রঞ্জন, মণিকা, তমাল— এরা যেন কত দূরের লোক, ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। রাগ? অপমান? ঘেন্না? দূর! ওরা কারা যে, তাপসীকে অপমান করবে! ওরা কারা যে, ওদের ঘেন্না করতে হবে!

আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। একে-একে চেনা নক্ষত্রেরা ফুটে উঠছে। তাপসী নেমে পড়ে ঘাসজমিতে, সেই প্রাচীন সপ্ত ঋষি, এক চিরন্তন প্রশ্নচিহ্নের মতো জ্বলে উঠেছে উত্তর আকাশে। তাদের সামনেই ধ্রুবতারা। সমস্ত তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে এক অমোঘ দিকনির্দেশ। যে নক্ষত্র অনাদি-অনন্ত অন্ধকার আর দিক্শূন্য সমুদ্রে নাবিকের প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়।
বুক খালি করা এক গভীর শ্বাস বেরিয়ে আসে তাপসীর অন্তর থেকে। সবই তো আছে, কিছু হারায়নি তো! তার আর নিজেকে একা লাগে না।