রাত ন’টার ট্রেন থেকে রতন যখন বৈকুণ্ঠপুর স্টেশনে নামল, তখন স্টেশন মাস্টার শিবেনবাবু বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছেন। লুপ লাইনের এই ছোট্ট স্টেশনে রাতে তেমন কেউ আসে না। তার ওপর এটাই রাতের শেষ গাড়ি। এর পর আবার ডাউন গাড়ি ভোর চারটেয়। এমন সময় রতনকে অফিসঘরে দেখে অবাকই হলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? এত রাতে? কোথায় যাবে?”
রতন বলে, “এটাই বৈকুণ্ঠপুর তো? শ্রীপতি চৌধুরীর বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?”
শিবেনবাবু বললেন, “সে তো আমাদের গ্রাম খেজুরতলিতে। এখান থেকে মাইলটাক। তা চলো আমার সঙ্গে। আমার বাড়ির পাশেই। এত রাতে যাবে, উনি জানেন তো তুমি আসবে?”
“আমি তো ওঁকে চিনিই না!’’ অম্লানবদনে উত্তর দেয় রতন।
অবাক হন শিবেনবাবু। লোকটা কি ফাজলামি করছে, না পাগল, না বদমাইশ, বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। এমন সময় পয়েন্টসম্যান বলরাম এসে ওকে দেখে অবাক হয়, “আরে রতন? তুই এখানে?”
“
হ্যাঁ বলরামদা, শ্রীপতিবাবুর বাড়ি যাব। ওঁর যে বড় বিপদ। ভগবান যে ওঁর বুকের পাঁজর ভেঙে দিতে চাইছে গো বলরামদা। এ অন্যায়। খুব অন্যায়। এ হতে দেওয়া যায় না। এত ভাল মানুষ উনি…”
“তোর মাথায় আবার ভূত চাপল রতন! সাধুবাবা তোকে পইপই করে বারণ করেছিলেন খোদার ওপর খোদকারি করতে। তুই তাও শুনলি না।”
“কী করব বলরামদা? ওঁর যে বড় বিপদ! এত ভাল মানুষ উনি…”
এ বার মুখ খুললেন শিবেনবাবু, “বলরাম, তুমি একে চেনো না কি?”
“হ্যাঁ স্যর, আমাদের গাঁয়ের ছেলে তো,” বলে বলরাম।
“ও কী বলছে বলো তো! শ্রীপতিবাবুর বিপদ। আবার বলছে ও ওঁকে চেনেই না। এলই বা কী করে?”
“স্যর, আপনি ওকে পৌঁছে দিন। আমি পরে আপনাকে সব বলব।”
কিন্তু ভরসা না পেয়ে শিবেনবাবু বলরামকেও সঙ্গে নিয়ে চললেন। শিবেনবাবু আর বলরাম আগে আগে কথা বলতে বলতে চললেন, রতন চলল ওদের পিছনে-পিছনে।
***
শ্রীপতিবাবু খেজুরতলির নামজাদা পয়সাওয়ালা লোক। বিরাট দোতলা বাড়ি। পরোপকারী মানুষ হিসেবেও ওঁকে সকলে এক ডাকে চেনে। শিবেনবাবু বাড়ির সামনে থেকে ওঁকে ডাকতেই ধুতি আর ফতুয়া-পরা শ্রীপতিবাবু বেরিয়ে এলেন।
“আরে, শিবেন! বলরাম! কী ব্যাপার? এত রাতে?”
শিবেনবাবু আর বলরাম মুখ চাওয়াচাওয়ি করতেই আবার শ্রীপতিবাবু মুখ খোলেন, “বলি এই ছেলেটি কে?”
“কত্তা, এ আমার গাঁয়ের ছেলে রতন। আপনার কাছে এসেছে…” বলে বলরাম।
“তোমার গাঁয়ের ছেলে আমার কাছে? কী ব্যাপার বলো তো?” অবাকই হন শ্রীপতিবাবু।
বলরাম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শিবেনবাবুও চুপ। ধৈর্য হারান শ্রীপতিবাবু, “আরে, সবাই চুপ করে আছ! বলবে তো কী ব্যাপার!”
“কত্তা, আপনাদের বড় বিপদ আজ রাতে!” দৈববাণীর মতো কথাটা বেরোয় রতনের মুখ থেকে।
তত ক্ষণে শ্রীপতিবাবুর ছেলেরা এসে দাঁড়িয়েছে। রতনের কথা শুনে সকলেই অবাক। বলরাম মনে মনে প্রমাদ গুনতে থাকে। শিবেনবাবুও ইতস্তত করছেন। শ্রীপতিবাবুর মুখ থমথমে। তিনি প্রশ্ন করেন, “বলরাম, তোমার বাড়ি কোথায়?”
“চকবাকুল কত্তা।”
“সে তো এখান থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ। ওখানে বসে ও জেনে গেল আমাদের খুব বিপদ? এত রাতে তোমরা কি রসিকতা করতে এলে আমার কাছে?” একটু বিরক্ত শোনায় শ্রীপতিবাবুর গলা।
সবাই চুপ। তার মধ্যেই আবার গলা শোনা গেল রতনের, “কত্তা, আমি মিছে কথা বলছি না। আমি সত্যি বলছি, আজ রাতে…”
শেষ হয় না রতনের কথা। বলরাম চটজলদি বলে ওঠে, “কত্তা, একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“এক বার ও কী বলছে একটু শুনে নিন না।”
শ্রীপতিবাবু এক বার সবার দিকে তাকালেন। কারও মুখে কথা নেই। কী চিন্তা করলেন মনে মনে, তার পর রতনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেশ, বলো কী বিপদ?”
এর পর রতন যে কথা বলল, তা শুনে কারও মুখে আর কথা নেই, “কত্তা, আপনার বাড়ির পশ্চিমের ঘরে আপনার ছোট ছেলে আর বৌমা রাতে থাকেন তো?”
রতন কেন, বাইরের কারও তো জানার কথা নয়, ছোট ছেলে আর বৌমা কোথায় শোয় রাতে, অবাক কাণ্ড! এ লোকটি জানল কী করে?
“তুমি জানলে কী করে?” জিজ্ঞেস করেন শ্রীপতিবাবু।
“কত্তা, আমি জানি। সব জানি। কাকের মুখের খবর যে! এ খবর তো মিথ্যে হবার নয় কত্তা।”
“তা বিপদটা কী?”
“কত্তা, আজ মধ্যরাতে ও ঘরে যে… ও ঘরে ওঁদের থাকতে দেবেন না আজ রাতে।”
“ও ঘরে কী?”
“সে জানতে চাইবেন না কত্তা। বিপদ, খুব বিপদ…”
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে এমন একটা জায়গা থাকে, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। বিশেষ করে তা যদি নিজের প্রিয়জনকে নিয়ে হয়। ছোট ছেলে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। শ্রীপতিবাবুও পড়লেন সেই দোটানার মধ্যে। তাঁর মস্তিষ্ক বলছে এ সব বুজরুকি, আর মন বলছে, যদি সত্যি কোনও বিপদ হয়! এমন সময় রতনের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, রতনের চোখ দু’টো যেন সত্যি কথা বলছে।
“বেশ, এস তোমরা,” বলে শ্রীপতিবাবু বাড়ির ভিতরে যেতে বললেন সকলকে।
শুধু বলরাম এক বার স্বগতোক্তি করল, “রতন, সাধুবাবা কিন্তু তোকে বারণ করেছিল রে।”
*
পশ্চিমের ঘরটিতে একটি বড় খাট পাতা আর কিছু আসবাবপত্র। বড় বড় জানলা। এক-দু’দিন আগেই পূর্ণিমা ছিল, তাই ঘরে আলো না জ্বাললেও চাঁদের আলোয় ঘর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রতন দরজা দিয়ে ঢুকে চার দিকে কী সব দেখল। তার পর মুখে হালকা হাসির রেশ নিয়ে বাইরে এল।
“বুঝলে বলরামদা, আর কোন চিন্তা নেই”।
এ কথা শুনে অন্যরা স্বস্তি পেলেও, ভ্রুকুটি দেখা দিল বলরামের কপালে। সে যেন কোথাও একটা সর্বনাশের আভাস পাচ্ছে। সে যেন ঠিক স্থির হতে পারছে না। কেমন যেন একটা আনচান ভাব তার মনের মধ্যে। বিষয়টা আর কেউ খেয়াল না করলেও শ্রীপতিবাবু লক্ষ করলেন।
“বলরাম, তুমি যেন কোনও কিছু চিন্তা করে চলেছ মনে হচ্ছে, কী ব্যাপার বলো তো?”
“না কত্তা, একটু ভয়ের কারণ আছে কত্তা।”
“কী ব্যাপার একটু বলবে? এত কেন চিন্তা তোমার? রতন যে বলল, অত ভয়ের কিছু নেই।”
“ওটাই তো ভয় কত্তা! সাধুবাবা যে ওকে সাবধান করেছিল, ও তো শোনেই না সে কথা।”
“কী কথা, বলরাম?”
“সাধুবাবা রতনকে পইপই করে বলেছিল কত্তা এ সব না করতে। এ সব করলে নাকি বংশ থাকে না। তা ও সে সব শুনলে তো! তাই চিন্তা হয় কত্তা।”
ও দিকে রতনের মুখে বিজয়ীর হাসি। ঘরের দরজার সামনে পা মুড়ে বসে বলল, “তুমি ও সব চিন্তা ছাড়ো তো বলরামদা। অকারণে ভয় পেয়ো না। কিচ্ছু হবে না। কত্তা আমার দু’টো জিনিস দরকার। একটু দেবেন?”
সবার চোখ ঘুরে গেল রতনের দিকে। কী চায় আবার এ! দেখা যাক। রতন সবার দিকে দেখল। তার পর শ্রীপতিবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “কত্তা, আমায় একটা কাঁসার থালা আর ছোট একটা লাঠি দিন তো দেখি।”
ঘড়িতে রাত এগারোটা। কাঁসার থালা আর লাঠি হাতে নিয়ে রতন বসল সেই ঘরের দরজায়। বাড়ির মহিলারা উল্টো দিকের একটি ঘরে বসে। শ্রীপতিবাবু দালানে পায়চারি করছেন। কেউ বুঝতে না পারলেও তাঁর মনের ভিতরে একটা তোলপাড় চলছে। তিনি ভাবছেন, রতন কি সত্যি বলছে? না কি ছেলেটার কোনও বদ মতলব আছে? তার পরই আবার তাঁর মনে হল, না, বলরাম তো ওই গাঁয়েরই ছেলে। সে রকম হলে নিশ্চয়ই বলরাম বলত ওঁকে।
বাড়ির অন্য সদস্যরা চুপচাপ বসে। শিবেনবাবু সারা দিন কাজের ক্লান্তিতে চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন, আবার ধড়মড় করে উঠে পড়ছেন। বলরাম কেমন একটা ভয়ার্ত মুখে বসে আছে এক পাশে। এত লোক, তবু চার দিক নিস্তব্ধ। কারও মুখে কোনও কথা নেই। একটা অজানা আতঙ্ক যেন গ্রাস করেছে সবাইকে। সময় যেন আর কাটতে চায় না। রতন কিন্তু নির্বিকার।
রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে চৌধুরীবাড়ির দেওয়ালঘড়ি মধ্যরাত্রি জানান দিল। ঠিক বারোটা। চকিতে উঠে দাঁড়াল রতন। ঘরের ছাদের কোণের দিকে কী যেন একটা দেখে তাঁর সমস্ত পেশি শক্ত হয়ে উঠল। বাইরে উপস্থিত সকলের চোখ ঘরের দিকে। হঠাৎ খাটের ওপর একটা কিছু পড়ার আওয়াজে সবার চোখ গেল সে দিকে। আতঙ্কে, বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল সবাই। ছোট ছেলে আর বৌমার খাটের ওপর দু’টি সাপ একে-অপরকে জড়িয়ে পড়েই বিদ্যুৎগতিতে ছোবল মারতে লাগল বিছানায়। তার পরেই মধ্যরাতেই দুই সাপের শঙ্খ লাগল খাটের ওপর।
কত ক্ষণ, তা আর কেউ হিসেব করে বলতে পারল না। চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে সবাই। তার পরই চমক ভাঙল কাঁসার থালার আওয়াজে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে থালা বাজিয়ে চলেছে রতন। আরও খানিক ক্ষণ। তার পর সবাই দেখল, সাপ দু’টি আসতে আসতে খাট থেকে নেমে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
শ্রীপতিবাবুর পরিবারের লোকেদের চোখে বিস্ময়-মিশ্রিত আনন্দ। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে তাদের সন্তান।
শ্রীপতিবাবু রতনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কী করে জানলে বাবা?”
উত্তর দিল বলরাম, “কত্তা, ও যে কাকের মুখের ভাষা বুঝতে পারে। সেই ছোটবেলা থেকেই। সেটাই তো ভয়, কত্তা।”
“কাকের ভাষা?”
“হ্যাঁ কত্তা, সেই ছোটবেলা থেকেই। অনেক জিনিস ও আগে থেকে জানতে পারে। কী করে জানে, কে জানে! জিজ্ঞেস করলেই বলে, কাকের মুখ থেকে খবর নিয়ে এলাম। অনেক ঘটনা ও ঘটিয়েছে কত্তা। তাই তো সাধুবাবা ওকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।”
“সাবধান?”
“হ্যাঁ, কত্তা। সাধুবাবা ওকে বার বার বলেছিলেন যে, ভগবান যা আগে থেকে লিখে রেখেছেন, তার বিরুদ্ধে যাস না। ভগবানের ওপর কেরামতি করিস না। কিন্তু ও…”এই বলে বলরাম আগেকার যে সব ঘটনা সকলকে বলল, সে সব শুনে তো সকলেই হতবাক।
“তুমি অত ভেবো না তো বলরামদা,” বলে রতন।
“রতন, তোমার বাড়িতে কে কে আছে?” জিজ্ঞেস করেন শ্রীপতিবাবু।
“আজ্ঞে, আমার বৌ সুমতি আর পাঁচ বছরের ছেলে মানিক,” হেসে বলে রতন।
কৃতজ্ঞতা কী ভাবে জানাবেন বুঝে পেলেন না শ্রীপতিবাবু। যাই হোক, শেষ অবধি বেশ কিছু টাকা জোর করে রতনের আপত্তি সত্ত্বেও গুঁজে দিলেন ওর জামার পকেটে।
রাত তিনটে। শিবেনবাবু, বলরাম আর রতন স্টেশনের উদ্দেশে রওয়ানা হল। চারটের ট্রেন পাস করাতে হবে। ট্রেনে তুলে দিতে হবে রতনকেও।
চারটের ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়তেই বলরাম শিবেনবাবুকে বলল, “মনটা বড় কু ডাকছে স্যর।”
***
চকবাকুলের একেবারে শেষ প্রান্তে রতনের বাড়ি। ঘড়িতে ভোর সাড়ে ছ’টা। রতন এসে পৌঁছল নিজের বাড়ির সামনে। দরজা বন্ধ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সুমতি আর মানিকের নাম ধরে ডাকল বারদুয়েক। শ্রীপতিবাবুর দৌলতে আজ তার পকেট বেশ ভারী। তাই সে ঠিক করেছে যে, বাজার থেকে একটু ভালমন্দ এনে সবাই মিলে খাবে। মনটাও বেশ ফুরফুরে। কিন্তু দু’জনের কেউই দরজা খুলছে না তো!
“আরে গেল কোথায় সব! অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়েছে, বোধহয় ঘুম ভাঙেনি এখনও।”
পেছনের ঘরের জানলার দিকে চৌকিতে শোয় সুমতি আর মানিক। রতন বুঝল যে, ও দিক দিয়ে ডাকতে হবে ওদের। নির্ঘাত শেষরাতে ঘুমিয়েছে। রতন খুব ভাল করে জানে যে সুমতি আর মানিক দু’জনেই একবার ঘুমোলে আর রক্ষে নেই। দু’টোই কুম্ভকর্ণ। আজ কেউ ডাকেইনি, এত সহজে উঠবে?
দাওয়া থেকে নামল রতন পিছনে গিয়ে ডাকবে বলে। বাড়ির পিছনের জানালার কাছে আসতেই একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ওর শিরদাঁড়া দিয়ে।
একটা হিলহিলে দিঘল শরীর খুব মসৃণ গতিতে ওর পিছনের ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে পিছন প্রান্তের জঙ্গলের দিকে। ভোরের আলো পিছলে যাচ্ছে তার গায়ের চক্রাকার চিত্রবিচিত্র নকশায়। রাতের এই অতিথিটির জাত চেনে রতন। চন্দ্রবোড়া। এর আগমন সংবাদ কাকের মুখে জানতে পারেনি সে।