যেন কোনও কথা বাকি রয়ে গিয়েছে এই ভাবে অনুপম ডাকে, “ঋতি...’’ ঋতি পিছন ফিরে তাকায়। তার দুই চোখে বিস্ময়। কয়েক পা ফিরে এসে বলে, “কী হল?” অনুপম অপ্রতিভ ভাবে হেসে বলে, “একটা কথা ছিল।” কপালের উপর এসে পড়া এক গোছা চুল কানের পিছনে ঠেলে দিয়ে ঋতি বলে, “বলো, কী কথা।” অনুপম আস্তে আস্তে বলে, “আচ্ছা ঋতি, খুব ব্যস্ততার সময় অথবা খুব ভিড়ে তোমার কি কখনও আমার কথা মনে হয়?” স্পষ্টতই ঋতি অবাক হয়েছে, কিন্তু সে প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় না। মৃদু স্বরে বলে, “অত ভেবে রাখিনি। তবে খুব ব্যস্ত মুহূর্তেও আমার তোমার কথা মনে হয়।” অনুপম যেন ধরে রাখা একটা শ্বাস ছাড়ে, বলে, “কাল কলেজ যাওয়ার সময়, বাস স্টপের ভিড়ে আমার হঠাৎ তোমার কথা মনে হল।” ঋতি অল্প হাসল, “কী মনে হল?” অনুপম বলল, “ঠিক বলতে পারব না, মনে হল, তুমি এখন কোথায়, কোনও অসুবিধের মধ্যে নেই তো?”
ঋতি এ বার তার ফর্সা, লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে অনুপমের বাহু ছুঁয়ে বলল, “আমি এখন যাই, না হলে স্কুলে দেরি হয়ে যাবে। আমার ফার্স্ট পিরিয়ড আছে।” ঋতি চলে গেল আর অনুপম হাঁটতে লাগল তার নিজস্ব বাস স্টপের দিকে।
ঋতিকে একটা কথা বলা হয়নি অনুপমের। তার যখন ঋতিকে মনে পড়ছিল, তখন তার পাশে ছিল শ্রেয়া। শ্রেয়া আগের দিন অনুপমের পড়ানো একটা কবিতার কথা বলছিল আর তখনই হঠাৎ তার মনে পড়েছিল ঋতির কথা। যেন ভিড়ের মধ্যে থেকে ঋতি তার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে ক্লান্ত বিষণ্ণতা। অন্যমনস্কতার মধ্যেই অনুপম শুনতে পায় শ্রেয়া বলছে, “আপনি আমার কথা শুনছেন না।”
দক্ষিণ কলকাতার এই নামী কো-এড কলেজের সামনে বাসটা থামতেই অনুপম নেমে ফুটপাতে উঠে একটা পান-সিগারেটের দোকানের সামনে এগিয়ে যায়। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে তার থেকে একটা বার করে ধরিয়ে একটু সময় নষ্ট করে। বাস থেকে নামা ছাত্রের দল হইহই করতে করতে কলেজে ঢুকে যায়। অনুপম কোনও দিন ছাত্রদের সঙ্গে এক সঙ্গে কলেজে ঢোকে না। নানান অছিলায় দেরি করে।
গেটের ভিতর এ দিক-ও দিকে ছাত্রছাত্রীদের জটলা। অনুপম খুব সতর্ক চোখে চারিদিকে তাকায়। না, এখানে শ্রেয়া কোথাও নেই। অবশ্য খুব কম দিনই অনুপম শ্রেয়ার দেখা পায়। হয়তো কোনও দিন দোতলার লম্বা বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে অনুপম দেখতে পায় শ্রেয়া দাঁড়িয়ে আছে আরও দু-তিন জন বান্ধবীর সঙ্গে। অনুপমকে দেখেই হেসে বলে, “গুড মর্নিং স্যর।” তখন থেমে যায় পৃথিবীর আহ্নিক গতি। অনুপম অস্ফুটে বলে, “গুড মর্নিং।”
আজ তিন বছর হল এই কলেজে পড়াচ্ছে অনুপম। তার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা অনার্সের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস। সেই ক্লাসে অনুপম পড়ায় শ্রেয়া এবং আরও ঊনচল্লিশ জন ছাত্রছাত্রীকে। ফার্স্ট বেঞ্চের এক কোণে বসে শ্রেয়া, কিন্তু অনুপম কখনও সে দিকে তাকায় না। পিছনের বেঞ্চের দিকে চোখ রেখে পড়িয়ে যায়। কিন্তু না তাকিয়েও সে বুঝতে পারে, দুটো উজ্জ্বল চোখ একাগ্র হয়ে শুনছে তার কবিতার ব্যাখ্যা।
আজ কলেজে শ্রেয়াদের ক্লাসে পড়াতে পড়াতে কী করে যেন উঠল নির্বাসন প্রসঙ্গ। কয়েকটা বিখ্যাত উপন্যাস, নির্বাসিত মানুষ যার মুখ্য বিষয়। হঠাৎ ক্লাসের সবচেয়ে সপ্রতিভ ছাত্র কৌশিক, যে আবার নিজেও কবিতা লেখে, সে বলে উঠল, “স্যর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘যদি নির্বাসন দাও’ কবিতাটা নিয়ে একটু কিছু বলবেন?” কৌশিক ভাল ছাত্র, তাই সে বরাবরই একটু প্রশ্রয় পায়। অনুপম হেসে বলল, “ঠিক আছে, উপন্যাসের আলোচনা শুকনো হয়ে যাচ্ছে, একটু কবিতাই হোক।”
কিন্তু একটু পরেই কবিতার ব্যাখ্যা থামিয়ে অনুপম বলল, “আলোচনা থাক, আমি বরং কবিতাটা পড়ি, তোমরা শোনো। অনুপম পড়তে শুরু করল। বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি, সমস্ত ক্লাস নিশ্চুপ হয়ে শুনতে লাগল তার কণ্ঠস্বরের প্রক্ষেপ, ওঠানামা, কম্পন। মেঘের ফাঁক দিয়ে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে ফার্স্ট বেঞ্চে। তাই কবিতা শেষ করার সময় অনুপম দেখতে পেল, শ্রেয়ার দু’চোখে মুক্তোর মতো জল টলটল করছে।
কবিতা পড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সমস্ত ক্লাস চুপচাপ। কৌশিক একটা প্রশ্ন করল, অন্যমনস্ক ভাবে তার উত্তর দিল অনুপম। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ে গেল।
কলেজ বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে অনুপম দেখতে পায়, জারুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়া। কাছে যেতেই এগিয়ে আসে অনুপমের দিকে। এখন তার মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত, ঠিক যেন এক পশলা বৃষ্টির পর রোদ-ঝলমলে বিকেল।
আলতো করে অনুপমের একটা হাত ছুঁয়ে শ্রেয়া বলল, “আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম স্যর। আজকে আপনার মুখে কবিতাটা শুনে আবার নতুন করে বুঝতে পারলাম।’’ অনুপম শুধু হাসল, কিছু বলল না। কিন্তু খেয়াল করল, বিকেলের মায়াবী আলো এসে পড়েছে তার উপর। গেট পেরিয়ে তারা হাঁটতে লাগল রাস্তা ধরে, শ্রেয়া কলকল করে কথা বলে চলেছে। অনুপম শ্রেয়ার পাশে হাঁটতে থাকে, শ্রেয়ার অনেক কথাই তার কানে যায় না। তার রাস্তার পাশে এখন বিশাল দিঘি, দিঘির পাড় ধরে হাঁটছে তিরিশ বছরের অধ্যাপক অনুপম আর তার চেয়ে দশ বছরের ছোট বাংলা অনার্সের ছাত্রী। অনুপমের মনে হল সূর্যকে বলে, ‘আজ একটু দেরি করো / দিগন্তরেখা আবছা হয়ে যেও না ...’
কিন্তু তার বদলে অনুপম বলল, “চলো শ্রেয়া, আজ আমরা কোথাও বসে একটু চা খাই।” শ্রেয়া এক কথায় রাজি, তার কোঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে বলল, “চলুন আমরা হাঁটতে হাঁটতে গড়িয়াহাটের মোড় পর্যন্ত যাই, তার পর কোথাও বসে চা খাওয়া যাবে। জানেন তো, বুদ্ধদেব বসু একটা লেখায় গড়িয়াহাটের মোড়ের খুব প্রশংসা করেছেন।’’
রাসবিহারী এভিনিউয়ের চওড়া ফুটপাতে শ্রেয়ার পাশে হাঁটতে হাঁটতে একটা অলীক দৃশ্য দেখতে পায় অনুপম। ঋতি আসছে। ভিড়ের থেকে একটু আলাদা, একা একা। একটা পা টেনে টেনে হাঁটছে। অনুপম তাড়াতাড়ি কয়েক পা এগিয়ে গেল।
“কী হয়েছে ঋতি?”
“কিছু হয়নি,” অপ্রতিভ ভাবে হাসল ঋতি, “এ দিকে একটা দোকানে এসেছিলাম, বেরোতে গিয়ে হোঁচট খেলাম আর চটির স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গেল।” তার পর শ্রেয়ার দিকে ইঙ্গিত করে চোখ দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘‘কে?’’
এত ক্ষণে অনুপমের খেয়াল হল, শ্রেয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হাত নেড়ে শ্রেয়াকে কাছে ডেকে ঋতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল অনুপম, “এ হল শ্রেয়া, আমার ছাত্রী।’’ শ্রেয়া নিচু হয়ে প্রণাম করতে যেতেই ঋতি ওর হাত দুটো ধরে ফেলে বলল, “আরে তুমিই শ্রেয়া, তোমার কথা আগেই শুনেছি।’’ অনুপমের মনে পড়ল না ঋতিকে ও কখনও শ্রেয়ার কথা বলেছে কি না, তাও ও মাথা নাড়ল।
রাস্তার পাশে মুচি পাওয়া গেল। ঋতি তার দিকে চটিটা এগিয়ে দিয়ে শ্রেয়ার হাত ধরে বলল, “তোমার কোন ইয়ার?”
‘‘সেকেন্ড ইয়ার।’’
“মানে সামনেই পার্ট ওয়ান ফাইনাল। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?”
শ্রেয়া লাজুক ভাবে হাসল।
অনুপম তাকিয়ে থাকে ফুটপাতে একটা শীর্ণ বকুল গাছের দিকে। আজ বিকেলটা একটু অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল। অন্যমনস্কতার মধ্যে সে দেখে, শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে ঋতির বাদামি চশমার ফ্রেমে। শ্রেয়ার কী একটা কথায় হাসছে ঋতি। হাসলে এখনও ঋতির গালে টোল পড়ে, এটা যেন সে অনেক দিন পরে দেখল।
মুচির কাছ থেকে চটিটা ফেরত নিয়ে ঋতি বলল, “তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে?”
অনুপম পার্স খুলে মুচিকে পয়সা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শ্রেয়াই উত্তর দিল, “আমরা একটু কোথাও চা খাব ভাবছিলাম।” ঋতির মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “খুব ভাল হয়েছে। আজ আমি তোমাদের খাওয়াব।” তার পর অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ স্কুল থেকে বেরোনোর সময় একটা খুব ভাল খবর পেলাম। আমার থিসিসটা অ্যাকসেপ্টেড হয়েছে। আরও দু’বছরের গ্র্যান্ট পাওয়া যাবে।
অনুপম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ঋতির দিকে। তত ক্ষণে ঋতি হাত তুলে দাঁড় করিয়েছে একটা ট্যাক্সি। মুখ ঘুরিয়ে অনুপমকে বলে, “শিগগির এস।’’ তার পর শ্রেয়াকে নিয়ে দু’জনেই উঠে যায় ট্যাক্সিতে। অনুপম আস্তে আস্তে সামনের সিটে গিয়ে বসে আর শোনে, ঋতি বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে ড্রাইভারকে গন্তব্য বুঝিয়ে চলেছে।
অনেক ক্ষণ পরে একটা আলো-ঝলমল রেস্তরাঁর সামনে ট্যাক্সি থামে। অনুপম একটু অবাক হয়। এত বড় জায়গায় আসার কথা সে তো ভাবেনি! কিন্তু তত ক্ষণে শ্রেয়াকে নিয়ে রেস্তরাঁয় ঢুকে গিয়েছে ঋতি ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে। কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে অনুপম ।
রেস্তরাঁর ভেতরে নীলাভ আলো, হালকা মিউজ়িক বাজছে। কোণের দিকে একটা সোফায় পাশাপাশি বসেছে ঋতি আর শ্রেয়া। অনুপম উল্টো দিকে বসে। ওরা দু’জনে পরামর্শ করে কফি আর স্ন্যাকসের অর্ডার দেয়, তার পর নিচু গলায় গল্প করতে থাকে।
কফি শেষ করে অনুপম বলে, “আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।’’ ঋতি হাসিমুখে হাত নাড়ে। ওদের খাওয়া এখনও শেষ হয়নি। রেস্তরাঁর বাইরে এসে অনুপম একটা সিগারেট ধরায়। ব্যস্ত সন্ধের কলকাতা, নিওনের বিজ্ঞাপন। অনুপম বুঝতে পারে, অনেক আগে ঋতির সঙ্গে সে এখানে এসেছিল। কত দিন আগে এখন আর মনে পড়ে না।
শ্রেয়াকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে গেল। বাড়ি ফিরেই হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল ঋতি। চেঞ্জ করতে করতে অনুপমকে বলল, “আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে, রাত বারোটার মধ্যে অনলাইন সাবমিট করতে হবে।” তার পর স্টাডিতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল সে।
অনুপমের বুকে একটা চাপা উৎকণ্ঠা। ঋতি বিকেলের ঘটনা নিয়ে কোনও কথা বলছে না কেন? ফেরার পথে ট্যাক্সিতেও কোনও কথা বলেনি। রাতে খাওয়ার সময় অনেক কথা হলেও বিকেলের ব্যাপারটা নিয়ে কোনও কথাই হল না। ঋতির সব কথাই স্কুল আর থিসিস নিয়ে। অনুপম অন্যমনস্ক ভাবে সাড়া দিয়ে গেল।
বুকের ভিতর এক ধরনের বিপন্নতা নিয়ে অনুপম শুতে যায়। সে বুঝতে পারে, আজ বিকেল থেকে যে সব ঘটনা তার চার পাশে ঘটে চলেছে তাতে তার কোনও ভূমিকাই নেই। বিছানায় আধশোওয়া হয়ে সে ঋতির প্রতীক্ষা করে। শোওয়ার আগে স্নান করা ঋতির অনেক দিনের অভ্যাস। বাথরুম থেকে বেরিয়ে চেঞ্জ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা নিচু টুলটায় বসে চিরুনিটা হাতে তুলে নেয় ঋতি। তার পর আয়নার দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় বলে, “মেয়েটা খুব ভাল।”
এত ক্ষণ প্রতীক্ষার পর অনুপম একটু চমকে ওঠে, আর তার মুখ দিয়ে বার হয়, “অ্যাঁ...”
ঋতি আবার বলে, “শ্রেয়া মেয়েটা খুব ভাল। বেশ সরল আর খোলামেলা।”
অনুপম সাবধানে বলে, “ও।”
ঋতি চুলের নীচের দিকের জট ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, “আজ আমার সঙ্গে অনেক গল্প হল।”
“সে তো দেখলাম।”
ঋতি আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে অনুপমের দিকে তাকিয়ে বলে, “ও খুব কবিতা ভালবাসে।” তার পর একটু থেমে বলে, “আর ভালবাসে তোমার মুখে ওর প্রিয় কবিতার ব্যাখ্যা।”
অনুপম ছদ্ম উদাসীনতায় বলে, “হতে পারে।”
ঋতি চুল আঁচড়ে দু’ভাগ করতে করতে হঠাৎ কিশোরীর মতো মুখ তুলে বলে, “তুমি জানো, শ্রেয়ার বাবা কী করেন ?”
গলায় অল্প বিরক্তি মিশিয়ে অনুপম বলে, “না জানি না।” “উনি আমেরিকায় ভারতীয় দূতাবাসে উঁচু পদে আছেন।”
“তাতে কী হল?” অনুপম স্পষ্টতই বিরক্ত।
ঋতি হেসে ফেলে, “না, তাতে কিছু নয়। বলছিল, বাবার সহকর্মীর ছেলের সঙ্গে শ্রেয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”
কে যেন জোরে ধাক্কা দেয় অনুপমকে। অনুপম একটু অবাক হয়। এ তো অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার, একটি ছেলের সঙ্গে শ্রেয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, তাতে অনুপমের কষ্ট হচ্ছে কেন? কেন তার কলেজে পড়ানোর কাজটা হঠাৎ অর্থহীন মনে হচ্ছে?
অনুপম শুনতে পায় ঋতি বলছে, “ছেলেটা আইআইটির ইঞ্জিনিয়ার, এখন একটা কোম্পানিতে ট্রেনিং নিচ্ছে। ট্রেনিং শেষ হলে কোম্পানি ওকে আমেরিকায় পাঠাবে। শ্রেয়া বিয়ের পরে আমেরিকায় চলে যাবে। তবে কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে ওর ভাল লাগে না...”
হয়তো আরও কিছু কথা বলে ঋতি, কিন্তু অনুপম মন দিয়ে শোনে না। সে বালিশে চিত হয়ে শুয়ে দেখে, কুয়াশার মধ্যে সে হেঁটে যাচ্ছে নিথর দিঘির পাড় দিয়ে। জারুল গাছের নীচে দাড়িয়ে আছে শ্রেয়া, ঢংঢং করে বাজছে সমস্ত স্কুলের ঘণ্টা।
ড্রেসিং টেবিলের টুল থেকে উঠে দেওয়ালের সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ায় ঋতি। বাঁ হাতের অনামিকা মুখের সামনে তুলে ধরে স্পষ্ট গলায় বলে, “যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো...” তার চোখে লেগে আছে এক টুকরো হাসি। অনুপম একটু অবাক হয়, ঋতির মুখে কবিতা আবৃত্তি সে তো কোনও দিন শোনেনি, সে বুঝতে পারে না শ্রেয়া কত দূর কী বলেছে তাকে।
ঋতি ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে শোয়। জ্বলে থাকে মাথার কাছে টেবিল ল্যাম্প। অনুপম অপেক্ষা করে মৃদু অথবা তীব্র আঘাতের। আস্তে আস্তে ঋতি পাশ ফেরে, অনুপমের দিকে পূর্ণ চোখে তাকায়। আবার থমকে যায়
সময়। খুব মৃদু স্বরে ঋতি বলে, “মনের মধ্যে কবিতার আলাদা ঘর থাকে, সেই তার আসল জায়গা। কবিতার সঙ্গে জীবনকে কখনওই মেশানো যায় না।” টেবিল ল্যাম্পের আলোটা নিভিয়ে এক হাতে অনুপমকে কাছে টেনে নেয় ঋতি।