আর কয়েক দিন পরেই মহালয়া। চতুর্দিকে পুজো পুজো গন্ধ। শরৎকালের নিয়ম মেনেই আকাশ গভীর নীল! বেশ কিছু মাখন রঙের ছেঁড়া মেঘের নরম টুকরো শ্লথ গতিতে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাদের কোনও রকম ব্যস্ততা নেই। শুধু আপনমনে কোন নিরুদ্দেশের ঠিকানায় চলেছে কে জানে! হয়তো বা কোনও প্রেয়সীর বার্তা বয়ে নিয়ে চলেছে তার দূরপ্রবাসী প্রিয়তমের জন্য। মা আসছেন। তাই প্রবাসের মানুষদের এখন ঘরে ফেরার আমন্ত্রণ জানাতে চলেছে ওরা!
মেঘগুলো আজ যতই রোম্যান্টিক মুডে থাকুক না কেন, সূর্যদেব কিন্তু যথারীতি রুদ্রমূর্তিতে আছেন! এমনিতেই পুরাণে আছে যে এই দেবতার তেজের চোটে স্বয়ং তাঁর অর্ধাঙ্গিনী, দেবী সংজ্ঞা তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন! দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর নগণ্য প্রাণীদের সে উপায় নেই! সুতরাং চাঁদির ওপরে সূর্যের অনাবিল আশীর্বাদ গ্রহণ করতে করতে মানুষগুলোর প্রাণ ওষ্ঠাগত! তবু যাদের মাথায় চমৎকার বাবরি চুল আছে, তারা কিঞ্চিৎ ছাড় পেয়েছেন। কিন্তু যাদের ব্রহ্মতালু জুড়ে চকচকে ‘দর্পণসদৃশ ইন্দুলুপ’—তাদের অবস্থা শোচনীয়!
‘‘দাদা, ক’টা বাজে?’’
যাঁকে বলা হল, সেই ‘দাদা’ বিরক্ত হলেন। ভদ্রলোক বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল। কিন্তু বাসের পাত্তাই নেই! কপালদোষে তাঁরও গোটা মাথা জোড়া কপাল! যে ভাবে অবাধে সোলার এনার্জি গ্রহণ করে চলেছেন, তাতে আশঙ্কা হয়— রাতে চাঁদের বদলে তাঁর টাকটিই না আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! মস্তিষ্কের ভিতর ঘিলু টগবগিয়ে ফুটছে! যেটুকু ধূসর বস্তু আছে, তাও বাষ্পীভূত হওয়ার উপক্রম! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’পায়ে দুব্বো গজিয়ে গেল! আরও কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সম্ভবত হেরিটেজে পরিণত হবেন! এমন পরিস্থিতিতে কেউ যদি আহ্লাদি গলায় সময় জানতে চায়, তখন আর ধৈর্য থাকে!
দাদা এক ঝলক প্রশ্নকর্তাকে দেখে নিলেন। লোকটাকে দেখতে অবিকল একটা ভোঁদড়ের মতো! সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে আবার জানতে চাইল, ‘‘বারোটা বেজে গিয়েছে?’’
বারোটা তো তাঁর নিজেরই বেজে গিয়েছে! বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মানুষেরই বাজছে। তা সত্ত্বেও ‘দাদা’ যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললেন, ‘‘সাড়ে বারোটা।’’
‘‘বা-বা! এর মধ্যেই এত বেলা হয়ে গেল! আমি তো বুঝতেই পারিনি,’’ ভোঁদড়মার্কা লোকটা বলল। তিনি লোকটার দিকে রাগত চোখে আবার তাকালেন। লোকটার মুখে এখন কান এঁটো-করা হাসি। ফের সেই আহ্লাদি মিহি গলায় জানতে চাইল, ‘‘কদ্দূর যাবেন?’’
‘দাদা’র উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তবু নিমপাতা গেলার মতো মুখ করে একটি বিরাট শপিং মলের নাম করলেন।
লোকটার পিটপিটে চোখ নেচে উঠল। ব্যাটা নির্ঘাত পুজোর শপিং করতে যাচ্ছে! অত বড় শপিং মলে যাচ্ছে মানে মালদার পার্টি। আড়চোখে এক বার তাঁর প্যান্টের পকেটে রাখা ওয়ালেটটা দেখে নিল সে। যথেষ্ট পেটমোটা! এক ঝলকেই বুঝে নিল, শুধু ক্রেডিট কার্ড নয়, এ পাবলিক যথেষ্ট ক্যাশ নিয়েই বেরিয়েছে। এখন শুধু সুযোগ বুঝে হাত মারতে পারলেই কেল্লা ফতে। আর যে ভাবে ওয়ালেটটা অসতর্ক ভাবে আধখানা বেরিয়ে আছে, তাতে কোনও অসুবিধেই হওয়ার কথা নয়।
যখন সে মনে মনে এ সব অঙ্ক কষছিল, তত ক্ষণে বাস এসে দাঁড়িয়েছে স্টপেজে। তার হাবভাব অবিকল আস্ত হরিণ গিলে-আসা অজগরের মতো। নড়াচড়ার কোনও ইচ্ছেই নেই! সেফটিপিনের গোছার মতো যত্রতত্র মানুষ ঝুলছে! বেচারি কন্ডাক্টরেরও দাঁড়াবার জায়গা নেই। ধ্যানস্থ বকের মতো এক পায়ে কোনও মতে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলছে, ‘‘আসুন... আসুন... তাড়াতাড়ি উঠে আসুন। যাবে...যাবে...’’
বাসের মধ্যে প্রচণ্ড ভিড়! লোকগুলো একে অন্যের সঙ্গে লেপটে আছে! আহা, এরই নাম তো মহামিলন! এর হাত ওর কাঁধে! ওর ঠ্যাং আর এক জনের ঠ্যাঙের তলায়! কারও ফরাসি সুগন্ধির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে অন্য কারও ঘামের দুর্গন্ধ! কারও শখের শার্টের উপরে পিছনের লোকটির মুখের পানের রস বাটিক প্রিন্ট তৈরি করেছে! সব মিলিয়ে পুরো ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’ কেস!
এ রকম ভিড় দেখলেই ‘দিল গার্ডেন গার্ডেন’ হয়ে যায় ওস্তাদের! হ্যাঁ, ওই ভোঁদড়মুখো লোকটার নামই ওস্তাদ! এটা ওর পিতৃপ্রদত্ত নাম নয়। কিন্তু ওর হাতের কাজ এমন মাখনের মতো যে ওর লাইনের সবাই ওকে ওস্তাদ বলেই ডাকে! সবাই জানে যে, সে এ তল্লাটের মারকাটারি পিকপকেট! চ্যাম্পিয়ন সমাজসেবী বলে কথা!
কোনও মতে ভিড় ঠেলেঠুলে, একে গুঁতো মেরে, ওর পা মাড়িয়ে দিয়ে, টপাটপ গোটা দুয়েক হাত মেরে ওস্তাদ এসে দাঁড়াল ঠিক সেই ‘বাসস্ট্যান্ডতুতো দাদা’টির পিছনে। শুরুতেই ভিড়ের ধাক্কাধাক্কির সুযোগে দু’টো উইকেট তুলে নিয়েছে। তাই এই মুহূর্তে সে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে! এই তো, কয়েক ইঞ্চি সামনেই তার বহু ঈপ্সিত ওয়ালেট! একটু হাত বাড়ালেই...
‘‘আ-রে দা-দা...’’
এক প্যাসেঞ্জারের চিৎকারে সচকিত হয়ে তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিল ওস্তাদ! বাস চলতে শুরু করেছে ঠিকই। কিন্তু এত মন্থরগতিতে যে কচ্ছপও বোধ হয় ওভারটেক করে যাবে। বাসের সামনের দিকের এক অধৈর্য প্যাসেঞ্জার বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘বাসটাকে এ বার টানুন! কত ক্ষণ এ রকম ক্যাটওয়াক চালাবেন!’’
‘‘মনে হচ্ছে, এ বার নেমে ঠেলতে হবে।’’ পাশ থেকে মন্তব্য ভেসে এল।
ওস্তাদ কথাগুলো শুনে সামনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল ওকে!
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে ওঠে সে। আরে, সেই লোকটা না! একদম সামনের মুখোমুখি সিটটায় বসে আছে! তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আগের দিনেরই মতো! মুখে সেই সাংঘাতিক রহস্যময় হাসি! যেন ওস্তাদের সব রহস্য জানে ও! অপলক দেখছে তাকে। বলা ভাল, মাপছে তার গতিবিধি! ভাবটা এমন, যেন বলতে চাইছে, ‘‘আমি সব জানি।’’
সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নেয় ওস্তাদ! আবার! আবার সেই লোকটা। একেবারে মূর্তিমান শনি! দু’দিন আগেই এই রুটের বাসে দেখেছিল। একেবারে শুরু থেকেই ওর দিকে এমন ভাবে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল যে হাতটা একটু নাড়াতেও পারছিল না সে। দু-এক বার এগিয়েও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ওস্তাদ! কারণ লোকটার চোখ তো নয়, যেন এক জোড়া হ্যালোজেন লাইট! সেই দপদপে অপলক দৃষ্টির সামনে স্বয়ং কৃষ্ণও বোধহয় হাতসাফাই করে ননী খেতে পারতেন না! ওস্তাদ তো মানুষ!
সে টের পেল, বুকের ভিতরটা ঢিপ্ঢিপ্ করছে। এই লোকটার জন্যই আগের দিন বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি! হাতে যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও দামি ভ্যানিটি ব্যাগ, পেটমোটা পার্স, ওয়ালেটগুলোকে অক্ষতই ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আজও কি তবে কপালে ব্যর্থতাই নাচছে! চোখের সামনে দামি চামড়ার পেটমোটা ওয়ালেটটা তখনও ভালবেসে হাতছানি দিয়ে ডেকে চলেছে। ওটাকে আলগোছে তুলে নেওয়া ওস্তাদের কাছে প্লেট থেকে রসগোল্লা তুলে নেওয়ার মতোই সহজ কাজ। অথচ এই সামান্য কাজটা লোকটার জন্য কি সেটাও পারবে না? মরিয়া হয়ে হাতটা সন্তর্পণে বাড়িয়ে দিল সে...
‘‘আরে, পেয়েছেন কী মশাই!’’
ওস্তাদ প্রায় ব্যাগটাকে ছুঁয়েই ফেলেছিল। কিন্তু ফাঁক বুঝে তুলে নেওয়ার আগেই ব্যাগের মালিক সেই ‘দাদা’ নড়েচড়ে উঠলেন। তাঁর সামনে দাঁড়ানো লোকটির দিকে প্রায় তেড়ে গিয়ে বললেন, ‘‘তখন থেকে আপনি আমার টাকে খোঁচা মেরে চলেছেন! এটা আমার টাক! বারোয়ারি ঢাক নয়, যার যখন খুশি এসে পিটিয়ে যাবে!’’
ভিড়ের মধ্য থেকেই কোনও এক সুরসিক ফোড়ন কাটলেন, ‘‘নিজের জিনিস নিজের দায়িত্বে রাখুন! তা না পারেন তো অত কিছু নিয়ে ভিড় বাসে ওঠার দরকার কী?’’
‘‘আমি আমার টাক আগলেই রেখেছি।’’ ‘দাদা’ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন, ‘‘কিন্তু ওঁকে বলুন নিজের হাত সামলে রাখতে... উফফ!’’
তিনি হাঁউমাউ করে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ একখানা পেল্লায় লম্ফ মেরে উঠলেন। না, নিজের ইচ্ছেয় নয়। বাসটা সম্ভবত স্পিড বাম্পে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠেছে। মুহূর্তের মধ্যে বাসযাত্রীরা মহাকাশযাত্রীদের অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। অর্থাৎ শূন্যে ভাসমান হলেন। ‘দাদা’র মাথাটা আর একটু হলেই বাসের ছাদে ঠুকে যাচ্ছিল। সেই দৃশ্য দেখে আবার উড়ে এল ফোড়ন, ‘‘আহা! ফেটে গেল বুঝি?’’
‘দাদা’ তত ক্ষণে সামলে নিয়েছেন। চোখ গোল গোল করে বললেন, ‘‘কী ফাটল?’’
‘‘ইয়ে... মানে...’’ ফ্যাঁচফেঁচে হাসির সঙ্গে ভেসে এল শব্দগুলো, ‘‘কালীরামের ঢোল!’’
ভদ্রলোক প্রায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠেছেন। গোল গোল ভাঁটার মতো চোখ করে সম্ভবত ঝগড়া করার প্রস্তুতিই নিচ্ছেন। অন্য দিকে বিশেষ মন নেই। এই সুযোগ! প্যান্টের পকেটে ওয়ালেটটা...
কিন্তু না! ওস্তাদের কপালই খারাপ! এ বারও হল না। এমন নয় যে সে চেষ্টা করেনি। কিন্তু হাত বাড়াতে গিয়েই দেখল, লোকটা ফের তার দিকেই তাকিয়ে আছে! মুখে সেই রহস্যময় মিটিমিটি হাসি! নিষ্পলকে দেখছে তাকে। এমন করে দেখছে যেন ওস্তাদকে সে খুব ভাল ভাবেই চেনে।
ওস্তাদের মনে সন্দেহ ঘনায়। কে এই লোকটা? সাধারণ প্যাসেঞ্জার? কিন্তু হাবেভাবে ওকে মোটেই সাধারণ মনে হচ্ছে না! ওর পর পর দু’দিন আবির্ভাবটা কি নিতান্তই কাকতালীয়? তাই যদি হয়, তবে এ রকম ভাবে তাকিয়ে আছে কেন? মুখে স্মিত হাসিটাই বা কেন লেগে আছে? ও কি ওস্তাদের পরিচিত? আগে কখনও দেখেছে?
ভাবতে ভাবতেই ঘেমে ওঠে সে। এমনও তো হতে পারে, এই লোকটা ওর ভূতপূর্ব শিকার। কোনও দিন হয়তো ওরই পকেটসাফা করেছিল ওস্তাদ। সেই জন্যই...
ও এ বার চোখ সরু করে দেখতে থাকে লোকটাকে। দেখলে তো নিরীহ বলেই মনে হয়! নিতান্ত সাধারণ পাঞ্জাবি-পাজামা পরে আছে। কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা। শান্ত সৌম্য চেহারায় বেশ অহিংস একটা ভাব! কোনও দিক থেকেই ওকে বিপজ্জনক মনে হয় না। অথচ চাউনিটা অদ্ভুত! আশ্চর্য বরফশীতল! মনে হয় অর্ধনিমজ্জিত হিমশৈল! চোখদু’টো নেহাতই আইসবার্গের উপরের অংশ। বাকিটা লুকিয়ে রয়েছে আরও গভীরে। সে অংশটা হয়তো আরও রহস্যময়। আরও বিপজ্জনক!
ওস্তাদ ওকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মাপছিল। কিন্তু ঠিক মতো ওকে মেপে নেওয়ার আগেই আরও একটা বিপজ্জনক ঝাঁকুনি! এ বার ‘দাদা’টি ওস্তাদের ঘাড়ের উপরে এসে পড়েছেন! একদম লুজ বল! এই সুযোগে ছক্কা মারতেই হবে! ওয়ালেটটা এবার ওর কোমর স্পর্শ করেছে। এটা তুলে নেওয়ার জন্য কোনও যন্ত্রেরই দরকার নেই। ওস্তাদের হাতই যথেষ্ট। শুধু এক বার টুক করে তুলে নিলেই হয়।
তার সাঁড়াশির মতো আঙুলদু’টো মুহূর্তের জন্য চেপে ধরল ব্যাগটাকে। ওই মুহূর্তের ভগ্নাংশের স্পর্শেই সে বুঝতে পারল, তার আন্দাজই সঠিক। ওয়ালেটটার ভিতরে ভালই মালপত্র আছে! তুলে নিতে পারলে কয়েক দিনের ইনকাম একসঙ্গে হয়ে যাবে! এ বার মালটাকে তুলেই ছাড়বে ওস্তাদ! কিন্তু অভ্যস্ত হাতে ব্যাগটাকে টান মেরে বের করতে করতেই ফের পাথর হয়ে গেল সে! লোকটা আবার একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এ দিকেই! যথারীতি মিটমিট করে হাসছে! মুখ তুলে তাকাতেই একদম চোখে চোখ পড়ে গেল।
ওস্তাদের মনে হল, তার আঙুলগুলো বরফ হয়ে গিয়েছে। অথবা একদম অসাড়! তার মনের অবস্থা বলার মতো নয়। একটু আগেই মনে হয়েছিল, লুজ বল পেয়েছে। এখন বুঝতে পারছে, লুজ বলের ছদ্মবেশে বডিলাইন চলছে! চতুর্দিকে শিকারির মতো ছড়িয়ে আছে চতুর ফিল্ডাররা! পুরো জন্টি রোড্সের ফিল্ডিং! স্কোর করা তো দূরঅস্ত্, নড়তে-চড়তেই পারছে না!
বেশ কিছু ক্ষণ ধরে এই পর্বই চলল। সেই আগের দিনের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। যত বারই সে ওয়ালেটটাকে কবজা করার জন্য হাত বাড়ায়, ঠিক তত বারই অব্যর্থ টাইমিং লোকটার, মুন্ডু ঘুরে যায় তার দিকে! ও রকম গোল গোল চোখের সামনে কেউ পকেট মারতে পারে! বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দেয় ওস্তাদ।
‘‘দাদা কি আগে পাইলট ছিলেন না কি?’’
বাসের ড্রাইভারের দিকে কোনও এক প্যাসেঞ্জারের প্রশ্নবাণ ধেয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার এ বার খোঁচা খেয়ে এ দিকেই তাকায়। প্রশ্নকর্তা মৃদু হেসে বলে, ‘‘আসলে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে হাওয়ায় বেশি উড়ছি কিনা!’’
ড্রাইভার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাশ থেকে আর এক জন বলে উঠল, ‘‘না না, পাইলট নয়, উনি অ্যাস্ট্রোনট ছিলেন। রকেট চালাতেন। দেখছেন না, কেমন মাধ্যাকর্ষণের বাপ-ঠাকুরদা মায় চোদ্দো পুরুষের শ্রাদ্ধ করে ছাড়ছেন!’’
এ সব মন্তব্য শুনলে যে কেউ বিরক্ত হবে! বাসের ড্রাইভার কতটা বিরক্ত হল কে জানে। কিন্তু তার চেয়েও এক জন নিজের ব্যর্থতার হতাশায় ডুবে ছিল। ওস্তাদের হঠাৎই মনে পড়ে গেল কয়েক দিন আগে খবরের কাগজে পড়া খবরটা। পুজোর আগে পকেটমারি, কেপমারি, ছিনতাইয়ের প্রকোপ দূর করার জন্য কলকাতা পুলিশ সব জায়গায় সাদা পোশাকের ছদ্মবেশী পুলিশ ছড়িয়ে দিয়েছে! দ্বিগুণ উৎসাহে মাঠে নেমে পড়েছে ইনফর্মাররাও। অপরাধীদের চোখে চোখে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে। এ খবরটা আগেই তার চোখে পড়েছিল। তখন বিশেষ পাত্তা দেয়নি। বরং ভেবেছিল, এ সব নিতান্তই কলকাতা পুলিশের মিথ্যে আশ্বাস! অথচ এখন মনে হচ্ছে, খবরটা ঠিকই ছিল।
ওস্তাদ নিশ্চিত হয়। হ্যাঁ, লোকটা নির্ঘাত সাদা পোশাকের পুলিশ। অথবা ওদের ইনফর্মার। সে জন্যই তাকে এ ভাবে চোখে চোখে রাখছে। কোনও রকম বেগড়বাঁই করলেই সোজা ক্যাঁক করে ধরে পাঠিয়ে দেবে শ্রীঘরে। তার পর চলবে ‘কচুয়া ধোলাই’! সে মনে মনে বুঝতে পারছিল, আজ তার দিনটা মাটিই হতে চলেছে। আস্তে আস্তে নিরাশার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল ওস্তাদ।
‘‘কা-লী-বা-ড়ি!’’ চিৎকার করে সামনের স্টপের নাম ঘোষণা করল কন্ডাক্টর। আর তখনই ঘটল এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা!
লোকটা ওস্তাদকে অবাক করে দিয়ে আচমকা সটান উঠে দাঁড়াল! তার পর ঝোলার ভিতর থেকে বের করে আনল একটা ফোল্ডিং ওয়াকিং স্টিক! লাঠি ঠুকঠুকিয়ে আন্দাজে এগিয়ে এল তার দিকেই। সম্ভবত পিছনের দরজা দিয়ে নেমে যাবে পরের স্টপে। তার হাঁটাচলাতেই স্পষ্ট যে মানুষটি দৃষ্টিহীন!
ওস্তাদের মনে হল, বহু বছর দ্বীপান্তরে থাকার পরে সে বুঝি এত দিনে দেশের মাটিতে পা রাখল! লোকটা অন্ধ! তার মানে ও কিছুই দেখছিল না। স্রেফ শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিল। অথচ সে কিনা এতক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে মরছিল...
লোকটা এগিয়ে আসতে আসতেই বাসের ঝাঁকুনিতে একটু বেসামাল হয়ে উলটে পড়ল ওস্তাদের ঘাড়ের উপরে! পরক্ষণেই সামলে নিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘‘সরি!’’
‘‘কোনও ব্যাপার না দাদা!’’ ভীষণ আনন্দে ও শান্তিতে ওস্তাদ তখন করুণার সাগর। ‘‘আসুন, আপনাকে নামিয়ে দিই।’’
‘‘থ্যাঙ্কস ভাই... মেনি মেনি থ্যাঙ্কস! ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’’
অন্ধ লোকটাকে হাত ধরে বাস স্টপে নামিয়ে দিল সে। তার পর ফুরফুরে মনে এসে দাঁড়াল নিজের জায়গায়। এখন আর কোনও বাধা নেই। ওই পেটমোটা ওয়ালেটটা এখন তার। শুধু তারই। আর কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।
‘‘আমার ও-য়া-লে-ট!’’
এত ক্ষণ বাসস্ট্যান্ডের ‘টাকদাদা’টি চুপচাপই দাঁড়িয়েছিলেন। নীরবে দাঁড়িয়ে বাসের ঝাঁকুনি সহ্য করছিলেন। কিন্তু বাস কন্ডাক্টর তার কাছে ভাড়া চাইতেই বিপত্তিটা ঘটল! পকেটে হাত ঢুকিয়েই চরম হাঁক পাড়লেন, ‘‘আমার ওয়ালেট নেই!’’
ওস্তাদ এ বার যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খায়! ওয়ালেট নেই! মানে কী! এই তো, একটু আগেই ছিল। সে স্বচক্ষে দেখেছে। ওটার উপর থেকে এক বারের জন্যও চোখ সরায়নি সে। শুধু যখন সেই লোকটা ওর ঘাড়ে এসে পড়ল...
মুহূর্তটা মনে পড়তেই তার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। কী এক কুটিল সন্দেহে ওর হাতদু’টো বিদ্যুৎবেগে নিজের দু’পকেটে ঢুকে গেল! নেই! সেখানে কিছু নেই! ওর নিজের পার্সটা তো বটেই, এমনকী শুরুতেই যে দু’টো ব্যাগ তুলেছিল, সেগুলো সব হাওয়া! ওর খালি পকেটদু’টো যেন সজোরে ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠল!
ওস্তাদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মানে লোকটা অন্ধ ছিল না!
সে ওস্তাদ ছিল। তার চেয়েও বড় ওস্তাদ।