সোমনাথ বেলাবেলি ফিরে আসায় খুব চিন্তায় পড়ে গেল মালতী। পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল ছেলে। এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা নয়! চিন্তিত মুখে ছেলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘‘পরীক্ষা দিলে নাই, বাবা?’’
ঠিকরে উঠল ছেলে, "দিছি না দিছি, তাতে তুমার কী? যাও না, নিজের কাম-কাজ করো।’’
নিজের কাজই করছিল মালতী। সারাদিন কাজ কি কিছু কম? সেই কাকডাকা ভোরে হাঁসগুলোকে পুকুরে ছেড়ে দিয়ে ঘাটে বাসন মেজে ফেরা থেকে শুরু। রান্নাবান্না, ঘরের মানুষটার সেবা, গরুর জাব দেওয়া, কোনটা না করলে চলে? ঘরের মানুষ আজ তিনবছর হল বিছানায় শোয়া। যখন সুস্থ ছিল, তখন সামান্য জমিজিরেত চাষ করত। গরু-বাছুর, হাঁস, ছাগল নিয়ে সংসার চলে যেত। মানুষটা পড়ে যেতেই চিকিৎসার জন্য খানিকটা জমি বেচে দিতে হল। সদরে চিকিৎসার খরচ খরচা তো আছেই। হাসপাতালে থাকা-খাওয়া-ওষুধ ফ্রি হলে কী হবে, যাতায়াত, বাইরে পরীক্ষা করানো, ইঞ্জেকশন কেনা... সাধ্যের মধ্যে যতটুকু কুলিয়েছে, চিকিৎসা করিয়েছে মালতী। লাভ হয়নি কিছুই। বাঁ-অঙ্গ পড়ে গিয়ে ওঠা বসা বন্ধ তো বটেই, কথাও জড়ানো। খুব খেয়াল না করলে মালতীও বুঝতে পারে না। এখন আস্তে-আস্তে সয়ে গিয়েছে। প্রথম যখন মানুষটা পড়ে গেল, চোখে আঁধার দেখেছিল মালতী। সোমনাথের তখন সামনে মাধ্যমিক। কীভাবে ছেলেকে আগলেছে তখন মালতী! আঁচটুকু গায়ে লাগতে দেয়নি! নিজে কানাইয়ের ভ্যানে চাপিয়ে সদরে ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা করানো, সব করিয়েছে। ভেবেছে, পরীক্ষাটুকু হয়ে যাক, ছেলে জমিজমা বুঝে নেবে। সংসার ঘুরে দাঁড়াবে।
পরীক্ষা দিয়েছিল ছেলে। ভাল নম্বরও পেয়েছিল। স্কুলের মাস্টারমশাইরা বললেন, ‘‘ভাল মার্কস পেয়েছিস তুই, সোমনাথ। পড়া ছেড়ে দিবি? শেষে চাষ করবি?’’ তাই শুনে ছেলে এসে বলল, ‘‘চাষবাস আমি করব নে। মাস্টাররা বলিছে, আরও পড়তে। আরও পাশ দেব আমি। পাশ দে ভদ্দরলোকের মত চাকরি করব। চাষিগিরি করব নে।’’
কেমন একটা হিমস্রোত বয়ে গিয়েছিল মালতীর শিরদাঁড়া বরাবর। আরও পড়বে... চাকরি করবে...বাবুদের মতো! সে কত দেরি? কত কত দেরি? তা ছাড়া এখন সবাই যে বলে, চাকরির খুব আকাল! যাও বা আছে, তাও পেতে নাকি খরচখরচা প্রচুর। তাদের কি সেই ক্ষমতা! তা ছাড়া চাষবাস ছোটলোকের কাজ! তবে কি সোমনাথের বাপ ছোটলোক ছিল? মালতী কিছু বলেনি। ভাগে দিয়ে দিয়েছিল বেঁচে থাকা সামান্য জমিটুকু। তারপর ছাগল পুষে, ছাগল বেচে, হাঁস পুষে, হাঁসের ডিম বেচে, গরুর বাড়তি দুধটুকু বেচে, বাড়ির ধারের জমিতে সবজি চাষ করে প্রাণপাত করে চালাতে লাগল সংসার। মালিনী দিদিমণি বি পি এল কার্ড করে দেওয়ায় দু’টাকা কিলো চাল পাওয়া যায়। সংসার চলে যায় কোনও রকমে। সোমনাথের গায়ে আঁচ পড়ে না। মালতী ভাবে, ‘থাক, পড়তে চেয়েছে!’
সকাল সকাল ভাতে ভাত করে দেয় মালতী। সোমনাথ খেয়ে কলেজ চলে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ দিয়ে এখন কলেজে যাচ্ছে সোমনাথ। প্রথম প্রথম সাইকেলে যাচ্ছিল। পথ কম নয়। তবে সাইকেলে গেলে বাসভাড়া বা টোটোভাড়াটা লাগে না। কিন্তু কয়েকদিনের মাথায়ই ছেলে বাড়ি ফিরে কী রাগারাগি, ‘‘এই সাইকেল নে কলেজ যাওয়া যায়? আমি কাল থে কলেজ যাব নে!"
সাইকেলটা মেয়েদের। মেয়েদের ইস্কুল থেকে দিয়েছিল। মালতী যাদের বাড়ি দুধ দেয়, তাদের মেয়েকে দিয়েছিল। জংটং ধরা ছিল। গিন্নিমা সাইকেলটা মালতীকে দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘টইটই করে দুধ দিয়ে বেড়াস, সাইকেলটা শিখে নে। গতরটা বাঁচবে এট্টু।’’
মালতী সাইকেল চালাতে জানে না। মাসিমার কথায় এই বয়সে সাইকেল শেখাও পোষাবে না। পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙলে সংসার চলবে কী করে? টুকটাক সারাই করে নিয়ে সাইকেলটা সোমনাথই চালাচ্ছিল। সাইকেল সোমনাথও পেয়েছিল একটা। ইস্কুল থেকে। সোমনাথের বাবার মাথার ফটো করানোর সময় টাকার দরকার হতে বেচে দিতে হয়েছিল। দাম কি আর পাওয়া যায়! তবু ফটো করানোর সুবিধে হয়েছিল। সোমনাথ নিজেই বলেছিল, ‘‘কী হবে আমার সাইকেল দে? তুমি বিচে বাবারে চিকিচ্ছে করাও।’’ দুঃখের মধ্যেও মালতী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল! কত বুঝমান ছেলে! সেই ছেলে কি কলেজ গিয়ে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে? হালকা ভাবনা মালতীকে শীতের কুয়াশার মত জড়িয়ে রাখে। মালতী পরদিন বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসভাড়া দিয়ে সোমনাথকে কলেজে পাঠিয়েছিল। পড়াটা শেষ করতে হবে তো! মালতী এখন চালিয়ে নিচ্ছে। সত্যিই লেখাপড়া করে চাকরি পেলে কপাল খুলে যাবে। তখন পায়ের উপর পা তুলে আয়েস করবে মালতী।
ইদানীং সোমনাথ বাড়িতে তেমন পড়তও না। বললে বলত, ‘‘তোমারে অত ভাবতি হবে না। সে আমি বুজে নেব'খনে।’’ কেমন একটু শীত শীত করে উঠত মালতীর। কলেজের বাসভাড়া ছাড়াও টিফিনের পয়সা দিতে হয়, নইলে বাবুর মান থাকে না। মালতী একবার বলেছিল, ‘‘বাবা, ঘরের থে’ দুটি মুড়ি নে গেলে হয় না?’’ সোমনাথ ঠিকরে উঠে বলেছে, ‘‘মুড়ি? এমনেই আমার এস্মার্ট ফন নেই ব’লে বন্ধুরা কত কী বলে! তায় পেটকোঁচড় থে’ মুড়ি বের করে খেলে আমার সঙ্গে আর কথাই ব'লবে নে।’’ মালতীর শীতভাব বেড়ে উঠেছে। ছেলে আরও বলেছে, ‘‘বন্ধুদের সঙ্গে না থাগলি চলবে? কোনও সাহায্যই পাব নে। পরীক্ষার ব্যাপার আছে...’’ মালতী চুপ করে থেকেছে। নতুন নিয়মে নাকি তিন বছরে ছ’টা পরীক্ষা দিতে হবে। ভেবেছে পাশ দিতে পারলেই ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবে। তিনবছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
সেই প্রথম ছ’মাসের পরীক্ষা ছিল আজ। বেলাবেলি ফিরে এসেছে সোমনাথ। ফিরে এসে খায়ওনি। চুপ করে বসে থেকেছে। মালতীই বা খায় কী করে! ভাত-তরকারি ঢাকা দিয়ে রেখেছে। শীতের বেলা, ঢাকা দিয়ে রাখলে ওবেলা চলে যাবে। ঘরের মানুষকে স্নান করিয়ে খাইয়েছে মালতী। গরুর দেখভাল করে আবার একবার সাধতে গিয়েছিল ছেলেকে। ছেলে তেমনই চুপ। শীতের বেলা ঢলে এসেছে। মালতী চই চই করে হাঁসদের ঘরে ঢুকিয়েছে। দু’গাল মুড়ি নিজে খেয়েছে। খিদে সহ্য হচ্ছিল না আর। তারপর সন্ধেবাতি দেওয়ার পরও ছেলে যখন কথা বলেনি, তখন শীত যেন দশখান হয়ে মালতীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। সকাল থেকে কাজ করতে গেলে শীতের চাদর গায়ে রাখা যায় না। মালতীর মতো বৌরা আবার সোয়েটার পরে নাকি! শীতে সারাদিন ছেঁড়া শাড়ি পরেই কাজ করে মালতী। শীত করে না তেমন। শিরশিরানি ভাব তো থাকবেই। সে রাত্রিবেলা লেপের তলায় না ঢুকলে যায় নাকি! মুখে অল্প অল্প হুস হুস শব্দ করতে করতে হাতে হাত ঘষে শীত তাড়িয়ে কাজ করা মালতীর অভ্যেস আছে। সেই মালতী শীতে এত কাবু হয়ে পড়ছে কেন?
ঘরে ঢুকে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখে ছেলেও কাঁপছে ঠক ঠক করে। হাফ সোয়েটার পরা। ফুলহাতা জামা কেনা বিলাসিতা। সারাবছর তো হাফ হাতাই লাগে। ফুল সোয়েটার ছেলের ছিল একখানা। ছোট হয়ে গিয়েছে। কয়েক জায়গায় ঘর খুলে গিয়ে ফুটো ফুটো। সেটা পরে তো বাবু কলেজ যেতে পারে না! তাই হাফ সোয়েটার হাফ জামা পরেই যায়। মালতী গায়ে হাত দিয়ে বলল, ‘‘বাবু, শীত পাচ্ছ? আমাকেও বড্ড জাড়ে ধরেছে।’’
বাবু চুপ।
মালতী আর উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারল না। জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কেমন পরীক্ষা দেছ বাবু?’’
বাবু এবার চিৎকার করে উঠল, ‘‘পরীক্ষা খুব খারাপ দেছি। হয়েছে?’’ একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘‘শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতেছিলাম, জানো? একটা তো সয়েটারও নাই। এর’ম করে পরীক্ষা দেওয়া যায়!’’
মালতী রুদ্ধশ্বাসে বলে ফেলল, ‘‘পরীক্ষা দ্যাও নাই?’’
সোমনাথ চিৎকার করে বলল, ‘‘দেই নাই। বলছি তো দেই নাই। শুনতে পাও না?’’
মালতীর শীত আরও বাড়ে।
রাত বাড়ে। দুধ-ভাত চটকে ঘরের মানুষকে খাইয়ে দেয় মালতী। নিজের খেতে ইচ্ছে করে না। ছেলেকে ডাকতেও ইচ্ছে করে না। মনে হতে থাকে রাশি রাশি ঠান্ডা জল যেন ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোন সুদূরে। অনুভূতির মধ্যে শুধু হাড় জমে যাওয়া শীত। এত শীত শুধু তাদেরই! শীতের জন্য বাবুর পরীক্ষা দেওয়া হল না!
সারারাত ঘরের মানুষ ঘুনিয়ে ঘুনিয়ে কী যেন বলে চলে। বাকি সব চুপচাপ। মালতী কী ভেবে আবার ছেলেকে ডাকতে যায়। যদি দুটো খায়... সারাদিন খায়নি।
মালতী ডাকে, ‘‘বাবা, দু’গাল খাবে চলো।’’
সোমনাথ এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে, বলে, ‘‘একটা লাইনও লিখতে দেল না... একটা লাইনও না...’’
মালতী বলে, ‘‘ক্যান?’’
সোমনাথ চুপ। তারপর বলে, ‘‘স্লা নতুন মাস্টারটা চোতাটা নিয়ে নেল... একটা লাইনও টুকতে দেল না...’’
মালতী কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে, বলে, "তুমি টুকতে গিছিলা? মাস্টারকে গালি দিচ্ছ? এই গেরামের ভাল ছেলে বলে তুমার নাম
নাই? সব সুনাম চুলায় দিয়া তুমি টুকতে গিছিলা?’’
সোমনাথ কথা বলে না। মালতী মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে থাকে। সোমনাথ এবার ভয় পেয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে দেখে গা পাথরের মত ঠান্ডা। সোমনাথ আকুল হয়ে ডাকতে থাকে, ‘‘মা, মাগো...’’ হাতে পায়ে মালিশ করে পাগলের মতো। খানিক বাদে মালতী চোখ মেলে তাকায়। বলে, ‘‘কিছুই পড়ো নাই, না?’’
সোমনাথ এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে।বলে, ‘‘পড়লি কিছু বুঝতে পারি না... কিচ্ছু না... মাস্টাররা হাসে, বলে কী করে পাশ করলি, গাধা?’’
মালতী বলে, ‘‘তাইলে কিছুই শিখো নাই? ইস্কুল পাশ দিলা কীভাবে?’’ মালতী আপন মনে বলে, ‘‘মাস্টার যে বলল, ভাল পড়তিছ তুমি, চাষ কইর্যা কী করবা, আরও পড়ো... কিছুই শিখো নাই আসলে?’’
সোমনাথ কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘‘এইট অবধি পাশ-ফেল ছিলনি তো! তারপর বড় পরীক্ষাগুলায় না পারলে মাস্টাররা বলে দেত তো!’’
মালতী জিজ্ঞেস করে, ‘‘ইস্কুলের মাস্টাররা?’’
সোমনাথ বলে, ‘‘আমাদের ইস্কুলের লয়। অন্য ইস্কুলি পরীক্ষা দিতি যেতম তো! সেখানে যারা পরীক্ষাঘরে থাগত, তারা। তারা ওই ইস্কুলের মাস্টার কি মাস্টার লয়, তা কে জানে! কলেজে কেউ বলে না। অবশ্য দেবেনদের ঘরের মাস্টারটা ভাল ছেল। বলে দেচ্ছিল। দাদারা বলেছিল, চোতা সাপ্লাই দেবে, কোনও অসুবিধে হবে না। নতুন মাস্টারটা...’’ সোমনাথ ডুকরে ডুকরে কাঁদে। আপন মনে বলে, ‘‘ফিলজ়ফি বানান লিখতে পারিনি বলে নতুন মাস্টারটা এমন অপমান করলে... ইংরিজি শিখি নাই তো কিছু... খালি নিজের নামটুকু লিখতে পারি!’’
মালতীর মনে হয়, সে চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে।
বসে বসেই ঘুমে ঢুলে পড়েছিল মালতী। ভোরের দিকে ঘুম ভাঙে। দেখে সোমনাথ তাক থেকে বইগুলোকে পেড়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে। এবার সোমনাথ বলে, ‘‘মা, আমি আর পড়ব নে। চাষ করব মা। তুমার আমার মুখের খাবার ফলাব।’’
মালতী প্রথমে অবাক হয়। তারপর সোমনাথকে জড়িয়ে ধরে। মালতীর শীতবোধ কমে যেতে থাকে। মালতী দেখে সোমনাথ বইগুলো বাইরের উঠোনে এনে জড়ো করছে। মালতী জিজ্ঞাসা করে, ‘‘কী হবে বাবা এইগুলান দিয়া?’’
সোমনাথ বলে, ‘‘জ্বালাই দিব।’’
মালতী ছুটে আসে। দু’হাতে আগলায় বইগুলো। বলে, ‘‘বই কেউ পুড়ায়, পাগলা? চাষ করতে করতে যেটুক কম শিখা আছে, মাস্টারের কাছে গিয়া গরজ কইর্যা শিখবা। যে ফাঁকি দিছে দিক। উপরওয়ালা বুঝবে। তুমি আর ফাঁকি দিওনি।’’
ভোরের সূর্য উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে। মালতী আপন মনে বলে, ‘‘নিজের জমিতে চাষ কইর্যা মাথা উঁচু করে বাঁচা, টুকে পাশ কইর্যা ভদ্রলক হওয়ার থিক্যা ভাল।’’
একঝলক টাটকা রোদ্দুর মালতীর শীতবোধ মুছে দেয়।