Abosar

উন্মোচন

রিমা বিশ্বাস

ভিড় বাসে হঠাৎই চোখ পড়ল অফহোয়াইট শার্ট-পরা ছেলেটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে গেল মাথার ভিতর। আর সে-ও এমনই বেহায়া ছেলে, হাঁ করে তাকিয়েই আছে উপাসনার দিকে! বেহায়া, না কি নিষ্ঠুর?

মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল উপাসনা। শরীর জুড়ে একটা কাঁপুনি। কান গরম হয়ে আসছে। সে দিনও এমনই হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ওরই দোষ, ওরা সবাই ঠিক। মনে হচ্ছিল, উঠে পড়তে পারলে বা ওরা চলে গেলেই যেন বাঁচে ও। পাত্রপক্ষের সামনে বসা ওই প্রথমবার। উপাসনা জানত, ও ডানাকাটা পরি না হলেও কুচ্ছিত নয়। উপাসনা বেঁটে বলে সবাই পিছনে লাগত। বলত লিলিপুট। কবে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে ও? তার পর ক্লাস এইটে চশমা হল। তা নিয়েও কখনও ভাবেনি সে। কিন্তু ভাবতে হল, যখন এই অফহোয়াইট শার্ট ছেলেটা, মানে আকাশ, ওর মা আর জেঠতুতো দিদি-জামাইবাবুকে নিয়ে দেখতে এল উপাসনাকে। উপাসনাকে আপাদমস্তক দেখে সেই জেঠতুতো দিদির প্রথম প্রশ্ন, “চশমার পাওয়ার কত?”

এ কি উপাসনার কোনও অপরাধের কারণ জানতে চাইছিল আকাশের দিদি সুরঞ্জনা? কিন্তু তা না হলেও, নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল উপাসনার। তাই ঢোক গিলে বলেছিল, “মাইনাস সেভেন।”

“ওরেব্বাবা! কী সর্বনাশ! তা হলে চশমা ছাড়া তো পুরো অন্ধ!”

উপাসনা এ কথায় হাসল বোকার মতো। তার পর দ্বিতীয় বুলেট আকাশের জামাইবাবুর তরফ থেকে, “তোমার কি ছোটবেলা থেকে খেলাধুলো করার অভ্যেস ছিল না?”

এর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধের কোনও সংযোগ খুঁজে না পেয়ে একই রকম বোকার মতো মুখ করে উপাসনা বলল, “তেমন আগ্রহ ছিল না।”

বাড়িতে আসা অতিথির সব প্রশ্নের উত্তর মাধুর্যের সঙ্গে দেওয়াই ভদ্রতা, উপাসনাও তা-ই করেছিল। কিন্তু সে ভদ্রতার মান রাখলেন না আকাশের জামাইবাবু। বলে ফেললেন, “বাঙালি বাড়ির মেয়েদের চেহারা এই কারণে এ রকম। প্রস্থে বাড়লেও দৈর্ঘ্যে বাড়ে না… হে হে…”

ওটা মশকরা না অসভ্যতা, তা বোঝার শক্তি উপাসনার লোপ পেয়েছিল সেই সময়। তখন চোখের সামনেটা ঝাপসা লাগছিল। কানের লতি গরম হয়ে আসছিল। পায়ের তলা ঘামছিল। মনে হচ্ছিল তখনই উঠে পড়ে। ওখান থেকে ছুটে পালায়। মনে হচ্ছিল সে-ই দোষী। দৈর্ঘ্য নেই অথচ চশমা আছে, তা হলে আর উপাসনা কেন মিছিমিছি বিয়ের শখ করতে গেল? এখন লোকে তো এ সব বলবেই। তখন রাগ হয়নি, অকারণ একটা অনুশোচনা ঘিরে ধরেছিল। ওরা চলে যেতে উপাসনা তপ্ত হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল মানুষ কেন এত নির্দয়? সমাজ কেন এখনও এত পিছিয়ে? রাগ হচ্ছিল মা-র উপর। কারণ মা তখনও আক্ষেপ করছিল, “ওদের মনে হয় উপাসনাকে পছন্দ হয়নি…” দুঃখ হচ্ছিল বাবার মুখের অসহায়তার রেখাগুলো প্রত্যক্ষ করে। ক্ষোভ আর অভিমান উথলে উঠছিল অদৃষ্টের উপরে। মনে হয়েছিল, সব অপমান, কষ্ট, লাঞ্ছনা বুঝি ওরই প্রাপ্য। কারণ উপাসনা দীর্ঘ দেহের অধিকারিণী নয়, তার চোখের জ্যোতি নিয়ন্ত্রণ করে এক জোড়া পুরু কাচ। 

 

কাচের জানলার ও পার থেকে চোখ সরাল উপাসনা। বাসের ঝাঁকুনিতে টলমলে স্মৃতি ছিটকে গেল। কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, “ফুলবাগান…” 

বাস থেকে নামল ভিড়ের আগ্রহী চোখজোড়াকে এক বারও না খুঁজে। হাঁটছে বাড়ির পথে, তখনই পিছন থেকে ডাক। ঘুরে দেখে, আকাশ। বুকটা ধক করে উঠল। হৃদ্‌ধ্বনি হয়ে উঠল লাউড মিউজ়িকের মতো। কান গরম, যেন শরীরের সব তাপ বেরোতে চাইছে কান ঠেলে। আবার কী বলতে এল ছেলেটা? রাস্তায় দাঁড় করিয়ে অপমান করবে কি? 

আকাশ সামনে এসে দাঁড়াল। দু’পকেটে দু’হাত রেখে চোখ রাস্তায় নামিয়ে। উপাসনার অস্বস্তি বাড়ছিল। 

আকাশ মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে  বলল, “আ-আমি সে দিনের জন্য বিশেষ ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।”

চোখ কুঁচকে তাকাল উপাসনা, “কেন বলুন তো?”

“না, আসলে ওদের সে দিন ও ভাবে বলা উচিত হয়নি।”

উপাসনা গম্ভীর হল। সে বুঝতে পারছে না, আকাশ নতুন কিছু কথার ভূমিকা করছে, না কি সত্যি অনুতপ্ত।

আকাশ বলল, “ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। আসলে সুরঞ্জনাদি একটু ঠোঁটকাটা আর জামাইবাবুর সঙ্গে থেকে আরও ও রকম হয়ে গেছে! কিন্তু আমার মা ও রকম নয়।”

উপাসনা কোনও কথা বলল না। আকাশও চুপ করে গেল। হয়তো কথা হাতড়াচ্ছিল। তাই ঘুরে ফিরে তাকাচ্ছিল উপাসনার দিকে। তার মাঝেই গলাটা পরিষ্কার করে বলল, “আমার খুব খারাপ লেগেছিল ব্যাপারটা, কিন্তু আমার আপনাকে…”

আকাশের কথা শেষ হওয়ার আগেই কটমটিয়ে তাকাল উপাসনা। ভয় আর সঙ্কোচেরও সহ্যের একটা সীমা থাকে। সে বলে উঠল, “অতই যদি খারাপ লেগে থাকে, তো সে দিন চুপ করে শুনছিলেন কেন?”

আকাশ থতমত খেয়ে নিজেকে সামলাতে খানিক সময় নিল। তার পর বলল, “না, মানে… আসলে ওরা বড়… আসলে আমার মা-র মতোই আমি খুবই ইন্ট্রোভার্ট কি না…”

“তা এখন আমাকে আর এ সব বলছেন কেন?” উপাসনা রূঢ় হল। 

একটু এগিয়ে এসে আকাশ বলল, “আমার আপনাকে সত্যিই পছন্দ হয়েছে। আপনি চাইলে সম্বন্ধটা…”

পুরো কথা শুনতে ইচ্ছে করল না উপাসনার। মনে হচ্ছিল ছেলেটা মজা করছে। তাই হাঁটা দিল উপাসনা। আকাশও পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করল, “আপনি কি রাগ করলেন?”

ওকে দেখে উপাসনার কপালে ভাঁজ পড়ল, “আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আপনি বাড়ির লোকের সামনে জুজু হয়ে থাকেন অথচ রাস্তায় এক জন অপরিচিত মেয়েকে মনের কথা বলতে পারেন?”

আকাশ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর হতবাক মুখের দিকে আর না তাকিয়ে সোজা হাঁটা দিল উপাসনা। আর কিছুটা যেতেই পিছন থেকে আকাশের গলা পেল। সে চেঁচিয়ে বলছে, “আমার আপনাকে কেন পছন্দ হল জানেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াল উপাসনা। এটা জানা দরকার! কেন পছন্দ করে ফেলল আকাশ নামে দীর্ঘ সুঠাম চেহারার ছেলেটা এই চশমা-পরা ছোটখাটো মেয়েটাকে? 

আকাশ সোজাসুজি তাকিয়ে উপাসনার দিকে। নিচু গলায় বলল, “কারণ আমিও আপনারই মতো।”

শুনে ভুরু ভাঁজ হল উপাসনার। 

আকাশ আবার এগিয়ে এল দু’কদম। বলল, “আমিও আপনারই মতো। প্রতিবাদ করতে পারি না। ঠিক সময় ঠিক উত্তরটা মুখে আসে না!”

ঠিক সময় ঠিক উত্তর মুখে আসে না? হ্যাঁ, এমনটা তো হয় উপাসনারও। কারও কথা খারাপ লাগলে সেই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারে না। পরে মনে হয়, এটা বললে তো হত! ওই ভাবে বললে তো ঠিক হত! কিন্তু তত ক্ষণে সময় পেরিয়ে গেছে। তাই ওর কথায় শক্ত হয়ে আসা হাত-পা একটু একটু শিথিল হচ্ছিল উপাসনার।

শীতলতার আমেজটা অবশ্য রইল না বেশি ক্ষণ। বাড়ি ফিরতেই তাল কেটে গেল সেই পুরনো প্রস্তুতিতে। আজ আবার নতুন তোড়জোড়। আর এক পক্ষ দেখতে আসছে আজ। আসার কথা জানত উপাসনা, তবু কেন যেন এই আসাটার মধ্যে আশার আলোর বদলে হতাশার আঁধার দেখতে পাচ্ছিল প্রথম বারেই ঠোক্কর-খাওয়া মেয়েটা। তবু বসতে হল সেজেগুজে। মুখে মাখতে হল চিরপরিচিত ভদ্রতার প্রলেপ, ঠোঁটে সৌজন্যের হাসি। পাত্রপক্ষ নিয়মমাফিক পর্যবেক্ষণ করার পর পাত্রের মা জিজ্ঞেস করলেন, “চশমা কি অনেক ছোট বয়স থেকে?”

মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল উপাসনা। তবে আজ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল না। চশমার জন্য সঙ্কোচে সঙ্কুচিত হচ্ছিল না মনটা।

ভদ্রমহিলা বললেন, “আমার ছেলে তো অনেকটা লম্বা। পাঁচ ফুট দশ।” হেসে ভদ্রমহিলা পাশে বসা পাত্রের বাবার দিকে তাকালেন, “দু’জনকে মানাবে?”

ঠোঁট উল্টে ভদ্রলোক বললেন, “এতটা তো বোঝা যায়নি ছবিতে!”

“সেই। আসলে আমরা প্রকৃত সুন্দরী মেয়ে চাইছিলাম। ছবিতে তো সব সময় সব বোঝা যায় না! তাই খোলাখুলিই বলছি, আমাদের একটু লম্বা মেয়ে পছন্দ। তোমারও ভাল বিয়ে হবে নিশ্চয়ই! তবে বুবুনের সঙ্গে ঠিক মানাবে… কি… না,” টেনে টেনে বক্তব্যটি পেশ করে ভদ্রমহিলা গৌরবের সঙ্গে ঘাড় বেঁকিয়ে পাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন। 

সেই সময় উপাসনার মা বলে বসল, “আমরা কিন্তু মেয়েকে বিয়েতে দু’হাত ভরে জিনিস দেব!”

শুনে যেন নড়েচড়ে বসলেন ভদ্রমহিলা। কৃপণ হাসি এ বার উদার হল, “তা তো দেবেনই, মেয়ে তো আপনার খুব মিষ্টি। আমার ছেলের আবার শর্ট হাইটই পছন্দ। আমিই চাইছিলাম একটু লম্বা মেয়ে।” পাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, “কী বলো? বুবুন তো শর্ট হাইটই পছন্দ করে, তাই না?”

ভদ্রলোক একই ভাবে ঠোঁট উল্টে বললেন, “হ্যাঁ, জুড়ি তো উপরওয়ালা ঠিক করেন!”

ওদের কথাবার্তায় বা হাবভাবে আজ উপাসনার হাত-পা শক্ত হচ্ছিল না। কান্নাও পাচ্ছিল না, আর সবচেয়ে বড় কথা, উপাসনার পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার প্রবণতাটা আজ টগবগিয়ে ফুটছিল আত্মবিশ্বাস হয়ে। কিছু একটা বলার জন্য যেন মনে মনে তৈরি হচ্ছিল উপাসনা। ক্রিজে নামার আগে ব্যাটসম্যানের ওয়ার্মআপ করার মতো গরম হচ্ছিল শীতলতায় চাপা পড়া প্রতিবাদী সত্তাটা। শক্ত চোয়ালে উপাসনা বলল, “উপরওয়ালায় বিশ্বাস রাখেন আপনারা?”

হকচিয়ে গেলেন সম্মুখের দু’জন। তাকালেন বিস্ফারিত চোখে। 

উপাসনা নরম সুরে বলল, “উপরওয়ালায় বিশ্বাস থাকলে, সেই উপরওয়ালার সৃষ্টিতে নিজের পছন্দ-অপছন্দের ট্যাগ বসিয়ে দেন কেন?”

থতমত ভদ্রলোক বললেন, “ কী? কী বলতে চাইছ তুমি?”

“বলতে চাইছিলাম, আমার চশমা বা আমার উচ্চতা আমার দুর্বলতা নয়। দুর্বল মানুষের চিন্তাধারা, সেই সব মানুষের, যারা একটা মেয়ে আর বাজারের আনাজপাতির মধ্যে ফারাক করতে জানে না!”

ফোঁস করে উঠলেন ভদ্রমহিলা, “ওরে বাপ রে! বেঁচে গেলে গো! এ মেয়ে যে সাঙ্ঘাতিক!” 

“ঠিক বলেছেন। এ রকম বাঁচার জন্য খোলাখুলি কথাটা শুধু পাত্রপক্ষের নয়, পাত্রীপক্ষেরও বলা উচিত!” উপাসনা বলল কেটে কেটে। 

আর কে কী বলবে? আর বলার বাকিই বা কী থাকে? মুখ কালো করে এক রকম ফুঁসতে ফুঁসতেই বেরিয়ে গেলেন ভদ্র বিশেষণ গায়ে আঁটা মানুষ দু’জন। মা-বাবার অভিযোগ-অনুযোগ বর্ষণের আগেই উপাসনা বলল, “আর নয় মা। নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হয়। কেউ কারও জন্য লড়ে না। কেউ কারও হয়ে কথা বলে না। এ সার আমি বুঝেছি!”

এই বুঝতে পারাটার বড় দরকার ছিল। আর এই বুঝতে পারাটা কি হয়ে উঠত আজ সকালের ওই ছেলেটার সরল স্বীকারোক্তি না শুনলে? এখনও যেন বেজে চলেছে ওই কথাটা— ‘আমিও আপনার মতো প্রতিবাদ করতে পারি না’। 

ড্রয়ার থেকে উপাসনা বার করল আকাশের বায়োডেটা। সম্বন্ধর জন্য নির্বাচিত পাত্রপক্ষের কয়েকটি বায়োডেটা উপাসনারই তত্ত্বাবধানে রাখা এই ড্রয়ারে। সেখানে দেওয়া মোবাইল নম্বরটা ট্রু-কলারে ফেলতে ফুটে উঠল আকাশের নাম। মানে পাত্রের নম্বরই দেওয়া ছিল বায়োডেটায়। নিশ্চিত হয়ে মোবাইলে নাম্বার ডায়াল করতেই রিংটোন, তার সঙ্গে ওঠানামা করছিল স্নায়ুস্পন্দন। ফোনের ও পাশে আকাশ ঠিক বুঝেছে কার ফোন। ট্রু-কলারেরই সৌজন্যে। কাঁপা গলায় বলল, “আপনি?”

ছোট্ট শ্বাস ফেলে উপাসনা বলল, “হ্যাঁ, আমি। আমি উপাসনা। আমি প্রতিবাদ করতে শিখে গেছি!”

ফোনের ও প্রান্তের নৈঃশব্দ্যও যেন কথা বলছিল। মনের আঙিনায় লুটোপুটি করা নব অনুভূতিরা ইঙ্গিত দিচ্ছিল নব সূচনার। 

উপাসনার ভাল লাগছিল। খুব ভাল লাগছিল।