Abosar

আবর্ত

রীতা বড়ুয়া

ও বড়বাবু, তিনটে বেজে গেল। টাইমকলের জল আসার টাইম হয়ে এল,” হেমলতা অফিসের বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে অনুনয় মেশানো গলায় বলে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রইলেন। যার উদ্দেশে বলা হল, তিনি হলেন রথীন রায়, অর্থকরী সংস্থার বড়বাবু। 

খুব মনোযোগ সহকারে ক্যালকুলেটরে হিসেব করছিলেন, সেখান থেকে চোখ না সরিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, “চাকরিটা ছেড়েই দিন না। একটা নিডি ছেলে চান্স পাক। রোজ তিনটের সময় চলে যাওয়া। এলেনই তো একটার সময়।’’ একটু অবাক হয়ে চোখ কপালে তুলে হেমলতা বললেন, “না না বড়বাবু ১১টা ৪৯-এ এসেছি দেখুন। অ্যাটেনডেন্সে সময় দিয়ে সই করতে বলেছিলেন তাইই করেছি।’’ 

“যান যান জল তুলুন গিয়ে”, রথীন রায় বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন। অফিসের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হেমলতা এই কথাটা শোনার জন্য মুখিয়ে ছিলেন, তাড়াতাড়ি ব্যাগ, টিফিন বাক্স, ছাতা গুছিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

বড়বাবুর কী যেন মনে পড়তেই বলে উঠলেন, “দিদিমণি, আপনি তো রিসিভিংয়ের মতো ভাইটাল কাজ করেন। এই যে চলে যাচ্ছেন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমাকেই সব চিঠি রিসিভ করতে হবে।’’ হেমলতা অথই জলে পড়ে যাওয়া মানুষের মতো মুখ করে রথীনবাবুর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো হজম করলেন। উনি হেসে ফেললেন। মুখের ভিতরে পান ছিল সেটা আর একটু চিবিয়ে নিয়ে বললেন, “দিদিমণি এখন তো তালের সিজ়ন চলছে, কাল তালের বড়া করে আনবেন তো’, হেমলতা খুব খুশি হলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘‘আচ্ছা আনব।’’ 

কয়েক মাস হল আপার ডিভিশন ক্লার্ক সন্দীপ রায় চাকরিটা পেয়েছেন। দূর থেকে হেমলতা আর রথীনবাবুর কথোপোকথন আর মুখভঙ্গি দেখে হেসেই চলেছেন। হেমলতা চলে যেতেই বলে উঠলেন, “বড়বাবু আপনি পারেন বটে।’’

হেমলতা স্টপে এসেই বাগুইআটির বাস পেয়ে গেলেন। লেডিজ় সিট প্রায় ফাঁকা তবু এমন ভাবে বসার জন্য ছুটে গেলেন যেন পিছন থেকে অন্য মহিলা আগে বসে পড়বে। কন্ডাকটর বিরক্ত হয়ে বললেন, “আস্তে দিদি এত হুড়মুড় করছেন কেন? সিট তো ফাঁকা!” হেমলতা মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। মাথার মধ্যে চিন্তারা পাক খাচ্ছে। জল ধরতে হবে, শাশুড়ির আলাদা রান্না, মেজ দেওরের মেয়ের স্কুলের জন্য রুমালে হানিকম্ব সেলাই, বাড়ি ফিরেই আগে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে পড়াতে বসাতে হবে। সামনেই মাধ্যমিক। সারারাত জেগে পড়ে, ছেলেটা খুব মেধাবী। ছেলেই তার স্বপ্ন, অফিস গৌণ, ছেলেকে ছেলের বাবার মতো টিচার নয়, বড় ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। স্কুলের স্যররা ছেলের জন্য হেমলতাকে সমীহ করে কথা বলেন। কিন্তু অফিসে বড়বাবু সবার সামনে এমন ভাবে বলেন মাঝেমাঝে গায়ে লাগে। তবে বড়বাবু যে ভুল বলেন তা-ও না। সত্যিই তো! এত বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রোজ তিনটেয় ছেড়ে দেন। বড়বাবু মানুষটা উপরে রাগী হলেও ভিতরে একটা দরদি মন আছে। বাস থেকে নেমেই মিষ্টি দেখে লালচে তাল কিনতে হবে। নিজের হাতে খাবার বানিয়ে খাওয়াতে খুব ভাল লাগে তাঁর। 

হেমলতার স্বামী খুবই শিক্ষিত বইপাগল মানুষ। উঁচু ক্লাসের ছেলেদের পড়ান। হেমলতা যাই মুখের সামনে ধরে দেন তাই খুশিমনে খেয়ে নেন, ভাল-খারাপ বলেন না। তার জন্য বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট আছে হেমলতার। পাশে একজন জোরালো সেন্টের গন্ধওয়ালা মহিলা বসতেই চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেল। আরও দুটো স্টপের পরে পোস্টঅফিস মোড়ে নামবেন। আবার অফিসের কথা মনে পড়ল। সত্যি বলতে কী, হেমলতার চাকরি করার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। বাবা অবসর নেওয়ার বছর চারেক আগে মারা যেতেই কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে হেমলতার চাকরিটা হল। মা বোঝালেন, এমন চাকরি তায় নামকরা অফিস, ভাল জায়গায় পাত্রস্থ করা যাবে। সেই সময় মা বাবার উপর খুব রাগ হচ্ছিল। একটা ভাই থাকলে সে চাকরিটা নিতে পারত। হেমলতার নিত্যনতুন রান্না আর সেলাইয়ের খুব নেশা। এখন এই রোজ অফিসের কারণে নেশাটা উবে যেতে বসেছে। 

পরদিন প্রায় একটা নাগাদ অফিসে ঢুকে বিজয়িনীর হাসি হেসে বড়বাবুর সামনে প্লাস্টিকমোড়া ঢাউস প্যাকেট টেবিলে রাখতেই রথীনবাবু আড়চোখে দেখে হাজিরা খাতাটা এগিয়ে দিলেন সই করার জন্য। হেমলতা ঝটপট সই করে বললেন, “বড়বাবু তাড়াতাড়ি খাবেন। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভাল লাগবে না।’’ রথীনবাবু বললেন, “দিন... দিন সবাইকে দিন আমি তার পর নিচ্ছি।’’ সেকশনে সাকুল্যে ন’জন স্টাফ, সবাইকে দুটো করে বড়া দিল। সার্ভিসবুক এন্ট্রি করে অণিমাদি বললেন, “স্যরকে প্লেটে করে চারটে বড়া দিয়ে এসো।’’ রথীনবাবু আলমারি থেকে একটা চিনামাটির প্লেট বার করে বললেন, “এটাতে করে নিয়ে যান।’’ হেমলতা কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, “ও বড়বাবু আপনিও চলুন উনি বাংলা কথা তো বোঝেন না, আমিও হিন্দি একবর্ণ বুঝি না, বলতেও পারি না।’’ রথীনবাবু বললেন, “আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। সামনে ধরে দিয়ে খাওয়ার ভঙ্গি করবেন তাতেই হবে।’’ অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও হেমলতা প্লেট হাতে চললেন। অফিসারের ঘরে টোকা দিয়ে ঢুকল। অফিসার মানুষটি উত্তরপ্রদেশীয়, সদ্য কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন। বাংলা ভাষা রপ্ত করতে পারেননি। হেমলতার এগিয়ে দেওয়া প্লেটে লালচে চারটে বড়া দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম কেয়া হ্যায় ইয়ে?” হেমলতা হড়বড়িয়ে বলল, “খাইয়ে স্যর, তাল কা বড়া। নিজ হাত মে বানায়া।’’ উনি অবাক হয়ে বললেন, “তা-ল? ও কেয়া চিজ?” হেমলতা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘‘স্যর ইয়া বড় বড় পের, উসমে গোল গোল তাল ঝুলতা হ্যায়। উসসে রস নিকাল কর চিনি দে কর বড়া বানায়া।’’ উনি আর কথা না বাড়িয়ে চারটে বড়াই উদরস্থ করলেন। খুশি হয়ে হেসে বললেন, “বহুত আচ্ছা।’’

হেমলতা যেন হাওয়ায় উড়ে সেকশনে ফিরলেন। সহকর্মীরা বড়ার খুব প্রশংসা করলেন। ভীষণ খুশি। এই রকম আনন্দ বহুদিন পাননি। 

 

এরপর সময় গড়িয়ে গিয়েছে। একদিন সন্দীপ অফিসের কাজ নিয়ে রিপন স্ট্রিট ব্রাঞ্চ অফিসে গিয়েছিলেন। হঠাৎ দূর থেকে হেমলতাকে দেখতে পেলেন। চুলে অনেকটা পাক ধরেছে, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, মোটাও হয়েছেন অনেকটা, আগের মতো গুছিয়ে শাড়ি পরা নেই। কেমন যেন এলোমেলো ভাব। তবে মিষ্টি হাসিটি অম্লান। কাছে গিয়ে সন্দীপ বললেন, “কি দিদিমণি চিনতে পারছেন?” চশমাটা ঠিকভাবে নাকের উপর তুলে কিছুক্ষণ দেখল, তার পর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে বলে উঠলেন, “আরে সন্দীপ না? বসো বসো,” বলে পাশের চেয়ার দেখিয়ে ইঙ্গিত করলেন। সন্দীপ আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলেন, “কী খবর দিদিমণি?” হেমলতা একগাল হেসে বললেন, “এখন আমি এই সেকশনের বড়দি।’’ রতন নাম ধরে একটি ছেলেকে ডাক দিতেই, সে এসে চা দিয়ে গেল। সন্দীপ প্রবল মাথা নেড়ে বললেন, “আরে না না আবার চা কেন?” হেমলতা স্নেহপূর্ণ স্বরে হুকুম করল, “খাও ভাই।’’ ব্যাগ থেকে একটা ছোট বিস্কুটের প্যাকেট বার করে বললেন, “নাও। শুধু চা খেও না। এটা দিয়ে খাও।’’ মায়াময় স্বরে বললেন, “সন্দীপ, তোমাকে দেখে আমার যে কী আপন লাগছে! তোমার খবর বলো। সবাই ভাল তো?’’ সন্দীপ বৌ আর ছেলের কথা বললেন, তার পর জানতে চাইলেন হেমলতার ছেলের কথা। একটু চুপ থেকে পরক্ষণেই দ্বিগুণ উৎসাহে হেমলতা বললেন, “ছেলে এই তো শিকাগোয়। ভাল চাকরি করে।’’ সন্দীপ খুব খুশি হয়ে বললেন, “যাক দিদিমণি, আপনার স্বপ্ন সফল হয়েছে।’’ তার পর দুজনে মিলে কিছু ক্ষণ পুরনো দিনের গুণগান আর নতুন দিনের মুন্ডুপাতের পরে, সন্দীপ উঠে পড়লেন।

লিফটে দেখা  হল কেয়ারটেকিং স্টাফ প্রশান্তের সঙ্গে। কুশল বিনিময়ের পরে প্রশান্ত তাঁকে জানাল, হেমলতাদির ছেলে এখন বিদেশে সেটেল্ড। আর ফিরবে না বলে বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে। সাতটার সময় জোর করে ফাঁকা অফিস থেকে হেমলতাকে বার করে প্রশান্ত ফ্লোরে তালা মারে। সব শুনে, সন্দীপের খুশিয়াল মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল।

বাস বেশ গতিতে চলছে, ঠান্ডা বাতাস চোখেমুখে ঝাপটা দিতে আরাম বোধ করছেন সন্দীপ। হেমলতার কথাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, বেচারা ছেলের জন্য, মরিয়া হয়ে তিনটের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে যেত তাকে আজ সাতটাতেও জোর করে বার করতে হয়। হায় রে বিধাতা! হঠাৎ নিজের ছেলে রণর কথা মনে পড়ে শিউরে উঠলেন। সামনের বছর হায়ার সেকেন্ডারি তার পর? মনের মধ্যে অদ্ভুত দোটানা স্রোত টের পেল। বিদেশে চাকরিরত ছেলের গর্ব নাকি  দিনের শেষে সন্তানের বাড়ি ফেরা, সন্দীপ কোনটা বাছবেন? বাসের জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় সেই আরামটা এখন আর টের পাচ্ছেন না তিনি।