Abosar

আকাশকুসুম

জনা মজুমদার

বিন্তির ছুটির ঠিক আগেই পার্থর মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোন তুলতেই কানে এল চড়া নারীকণ্ঠ, ‘‘আপনি কি বিদিশা মুখার্জির বাবা? ছুটির সময় একটু বড়দির ঘরে আসবেন।’’ 

কথা শুনে একটু ঘাবড়াল পার্থ। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছতে বা নিতে আসে, এই পর্যন্তই। মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে তার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। বিদিশা মানে বিন্তি, কখন যে ক্লাস এইটে উঠে গেল টের পায়নি সে। এ ব্যাপারে যত ভাবনা ইতির। সন্ধ্যা হতেই ইতি যে ভাবে মাজাঘষা করতে বসে মেয়েকে, তাতে মা সরস্বতীরও দয়া হতে বাধ্য। 

পার্থ ঘরে ঢুকতেই এক দিদিমণি চড়া গলায় বললেন, ‘‘আসুন ভিতরে। বড়দি, উনি এসে গেছেন।’’ ঘরে বেশ ভিড়, দিদিমণিরা উত্তেজিত ভাবে কী যেন বলাবলি করছেন। বিন্তিকে একটা চেয়ারে বসিয়েছে। ওর পাশে ওরই বয়সি দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পার্থকে দেখেই সবাই চুপ করে গেল। বড়দি ভারিক্কি গলায় বললেন, ‘‘আপনিই বিদিশা মুখার্জির বাবা?’’

পার্থ ঘাড় নেড়ে সায় দিল। 

‘‘বসুন।’’ 

অপরাধীর মতো বসল পার্থ। 

‘‘মেয়েকে এই ভাবে মারধর করেন কেন?’’

‘‘মারধর? আমি তো মারি না! ওর মা অবশ্য পড়াতে গেলে একটু মাথা গরম করে ফেলে।’’ 

‘‘একটু মাথা গরম? কী হাল করেছেন মেয়ের! ঠোঁট ফেটে রক্ত জমে আছে! গায়ে কালশিটে। হাতেও... ছিছি! জানেন এখনই যদি থানায় জানানো হয় অ্যারেস্ট করবে ওর মাকে!’’ 

পার্থ ভাবে, কয়েক দিনের জন্য ইতিকে অ্যারেস্ট করলে মন্দ হয় না। ইদানীং এত মারমুখী হয়ে গিয়েছে ইতি। ওর কথার তোড়ে পার্থ তো খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। পাড়ায় তো আজকাল ওকে পাগলিবৌদি নামে ডাকে। যখন তখন ঝনঝন করে বাসনপত্র ছোড়ে। মেয়েকে পেটায়। নিজে দেওয়ালে মাথা ঠোকে। কী রোগ কে জানে। 

পার্থ মিনমিন করে বলে, ‘‘এ বার থেকে দেখব যাতে না মারে। তবে আমার কথা তো শোনে না।’’ 

‘‘শোনে না বললে হবে না। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। বড়দি ভুরু কুঁচকে বললেন। ওর মাকে নিয়ে কাল এগারোটা নাগাদ এক বার আসুন।’’ 

পার্থ বাড়ি ফিরে ইতিকে বেশ এক হাত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘‘বলেছিলাম না অত পিটিও না! স্কুলে আজ হইচই কাণ্ড। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কাল তোমাকে যেতে বলেছে।’’ 

ইতি ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘‘ওরা জানল কী করে?’’

‘‘জানবে না? মেরে মেয়েটার চেহারার যা হাল করেছ!’’

বিন্তি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘‘আমি কিছু বলিনি মা। সত্যি বলছি। তরীদি রিডিং পড়তে বলেছিলেন। আমি পড়ছিলাম। দিদি হঠাৎ বললেন, ‘তোমার ঠোঁটটা অমনি হয়ে আছে কেন?’ তখন ক্লাসের মেয়েরাই বলতে লাগল।’’ 

‘‘তা তারা জানল কোত্থেকে?’’

বিন্তি ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘‘মারের দাগ দেখে ওরা জিজ্ঞেস করল যে...’’

‘‘আর তুইও সাতকাহন গাইতে বসলি!’’ 

ইতির মুখ থমথমে। বিন্তি সিঁটিয়ে গিয়ে পরবর্তী মারের জন্য অপেক্ষা করে। পার্থ বলে, ‘‘যাই, আমার আবার দোকানে কাজ আছে।’’ 

ইতি বিন্তিকে খেতে দেয়। শাশুড়িকে চা মুড়ি দেয়, নিজেও অন্যমনস্ক ভাবে চা খায়। প্রতিদিনের মতো বিন্তিকে পৌঁছে দেয় অঙ্কের কোচিংয়ে। ফেরার পথে গলির মুখটায় দাঁড়াল। সূর্যের তেজ কমে আকাশে গোলাপি আভা ধরেছে। কোথা থেকে এক ঝলক হাওয়া ছুটে এসে চোখেমুখে বুলিয়ে দিল। কত অফিস-ফেরত মানুষ এই রাস্তা ধরে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে যায়। কেউ চায়ের দোকানটায় চা খায়, কেউ চপ-মুড়ি। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ভ্যানওয়ালারা সুখদুঃখের কথা বলছে মৃদুস্বরে। একরাশ জুঁই-বেলের মালা ঝুলিয়ে মালাওয়ালা চলে গেল গলির ভিতর, যেখানে পার্থর ভাষায় ‘খারাপ পাড়ার মেয়েরা’ দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের কারও পরনে সিল্কের শাড়ি, কারও খাটো জামা, মুখে চড়া মেকআপ। পার্থদের হিসাবে মেয়েরা বিয়ে করে এক পুরুষের কাছে থাকলে ভাল, আর বিয়ে না করে অনেক পুরুষের সঙ্গে মিশলে খারাপ। ইতি ভাবে, এই খারাপ মেয়েগুলো তো তবু নিজে রোজগার করে। 

দোকানে এসে শখের জিনিস কেনে। তার মতো বিনেপয়সার দাসি তো নয়। 

বাবার ছোট মেয়ে ইতি। তিনটে কালো বোন। মার বিলাপ, পাড়া প্রতিবেশীদের করুণা, এ সবের মধ্যেই বড় হয়েছিল তারা। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই দিদি বাস ড্রাইভার ভজুদাকে বিয়ে করল। মেজদির বিয়ে দিয়েছিল দেখেশুনে। মোটা পণ দিয়ে। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই অশান্তিতে গলায় দড়ি দিল মেজদি। ইতির বারো ক্লাসের পরীক্ষার পরেই গোপাল ঘটক এই সম্বন্ধটা নিয়ে এল। পাত্রের বিধবা মা রোগে ভুগে জেরবার। তাই গৃহকর্মনিপুণা পাত্রী খুঁজছেন। পাত্রের এক পাগল দিদি থাকলেও সে তেমন ঝামেলা করে না। বৌবাজারে ছেলের বাড়ি। হলই বা সাত শরিকের। বাবার পাইপের ব্যবসা সে-ই দেখে। ইতির মা তো হাতে স্বর্গ পেলেন। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় কান ঘেঁষে পাস করল ইতি। বন্ধুরা কলেজে ভর্তি হল। আর ইতিকে বসতে হল বিয়ের পিঁড়িতে। বৌভাতের পরের দিনই শাশুড়ি বললেন, ‘‘নিজের ঘরসংসার বুঝে নাও বৌমা, আমার তো বিছানা থেকে নামলেই হাঁপ ধরে।’’ 

ইতি সাধ্যমতো বুঝে নিল। প্রথম প্রথম টুকটাক শখের জিনিস কিনে ঘর সাজাত। রান্নাঘরের কালো মিশমিশে বাসনগুলোকে সরিয়ে, দু’চারটে নতুন বাসনও কিনে আনত। শাশুড়ি বললেন, ‘‘তোমার দেখছি বড্ড খরচের হাত। কত কষ্ট করে খোকা রোজগার করে। ইচ্ছে হলে পুরনো কাপড় দিয়ে বাসন রেখো। এতগুলো টাকা খরচ করে...’’ 

কথাটা ছেলের কানেও তুললেন। পার্থ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘‘বাপের জমিদারি ছিল তো। কী করে বুঝবে গরিব মানুষের রক্ত জল করা রোজগারের মর্ম?’’

ইতি বলল, ‘‘অমন পোড়া কড়াইতে রান্না করলে শরীর খারাপ হবে না?’’ 

‘‘কই আমাদের তো এত দিন কিচ্ছু হয়নি!’’ কর্কশ গলায় পার্থ বলেছিল, ‘‘শোনো, মাকে না জিজ্ঞেস করে কিছু কিনতে যাবে না। তোমার হাতে টাকা এলই বা কী করে? আমার ব্যাগ থেকে সরাও নাকি?’’

অপমানে চোখে জল এসেছিল। কোনওমতে বলেছিল, ‘‘এখানে আসার সময় মা কিছু টাকা দিয়েছিল।’’ 

‘‘হুঃ! টাকার গুমোর দেখাচ্ছে।’ 

তার পর থেকেই ইতি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যন্ত্রের মতো সংসার সামলাত। ঘুম থেকে উঠেই শাশুড়ির নানা বাতিক মেনে অজস্র কাজ। এ দিক থেকে ও দিক হলেই অশান্তি। পার্থ রাত করে মদ গিলে বাড়ি ফিরলেও কিছু বলা যেত না। পার্থ সাঁড়াশির মতো আঙুল দিয়ে চেপে ধরত গাল, চিবুক। যন্ত্রণায় তিন দিন খেতে পারত না ইতি। 

পাগল ননদের পাগলামি মাঝে মাঝে বাড়ত। সে তখন বায়না করে ইতির বিয়ের বেনারসি পরে পাড়া ঘুরতে বার হত। রাত হয়ে যেত। পাড়াটা ভাল নয়, রাস্তায় এ দিক-ও দিক মড়ার মতো পড়ে থাকত মাতালরা। বেনারসির আঁচল লুটোতে লুটোতে আঁকাবাঁকা পায়ে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তো ইতির ননদ আকাশমণি। 

ইতি বাপের বাড়িতে গেলে বিরক্ত হতেন শাশুড়ি। পার্থকে বলতেন, ‘‘মেয়েমানুষের এত হুটহাট করে একা বেরোনো কি ভাল?’’ পার্থ বাঁকা হাসি হেসে বলত, ‘‘যা রূপের ডালি তোমার বৌ! একা বেরোলেও কেউ ছোঁবে না।’’ 

এই ইতির সংসার। দু-বছর না কাটতেই ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল ইতি। আরও হতো, যদি না বিন্তি আসতো। ছোট্ট ফুটফুটে বিন্তি। অবশ্য ওকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ঘরে ঢুকতেই শাশুড়ি বলেছিলেন, ‘‘একে মেয়ে তায় কালো। এর চেয়ে যদি একটু বিষ এনে দিত খোকা!’’

পার্থ ফিসফিস করে ইতিকে বলেছিল, ‘‘মা বলছিল তোমাদের বাপের বাড়িতে দিয়ে আসতে। দিয়ে এলে আর আনতেই দিত না।’’ 

‘‘তবে আনলে কেন?’’

‘‘আরে বাবা আমারই তো মেয়ে-বৌ। তবে মার মনটা খুব খারাপ। মেয়ে হয়েছে বলে দু’দিন খায়নি।’’ 

ইতি জীবনবিজ্ঞানে পড়েছে, মানুষের শরীরে একটা বিশেষ ক্রোমোজ়োম আসে বাবার কাছ থেকে। ওটা এক্স হলে মেয়ে হবে, ওয়াই হলে ছেলে। 

পার্থকে এ কথা বলতেই হেসে বলল, ‘‘বাপ রে কী জ্ঞান! মাকে এক বার বুঝিয়ে বলো।’’ 

মেয়ে হওয়ার অপরাধে ক্লিষ্ট ইতিকে শুনিয়ে শাশুড়ি বলেন, ‘‘সবই আমার ভাগ্য! নইলে আমার ছোটবোনের বৌমার দুটো সোনার বরন ছেলে হল। আর আমার বেলায়... খোকার রঙটাও যদি পেত!’’ 

পার্থ ইতিকে বলে, ‘‘সত্যি তোমার কার্বনকপি হয়েছে মেয়েটা।’’ 

‘‘অমন মেয়ে বিয়ে করলে কেন?’’ 

ওই যে মা বলল, ‘‘বৌ যদি খাটতে না পারে তবে বিয়ে করিস না। তোর বিয়ে হলে আমি নড়ে বসব না।’’ 

‘‘সুন্দরী বৌ কি খাটত না?’’ 

‘‘খাটত না আরও কিছু। সে কেবল স্নো-পাউডার চাইত। আমি পথে বসতাম। তার চেয়ে এই ভাল। কেমন গোলগাল, ঠিক যেন শ্যাম ময়রার দোকানের কালোজাম।’’ 

‘‘আমার সাজার খরচ নেই। সেই টাকায় মেয়েটাকে ভাল ইংরিজি ইস্কুলে পড়িও।’’ 

‘‘খেপেছ? তার খরচ কত জানো? আরে মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে।’’ 

পার্থ কথা রেখেছিল। ইতির কান্নাকাটিকে পাত্তা না দিয়ে পাড়ার স্কুলে ভর্তি করাল বিন্তিকে। 

ইতির জেঠতুতো দিদির মেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যায়। দিদি ফ্ল্যাটও কিনেছে। গৃহপ্রবেশে গিয়েছিল ইতি। কী সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাট! দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। 

নিজের ঘরে ড্যাম্প লাগা দেওয়াল, শেওলা-ধরা উঠোনের দিকে চেয়ে ইতি বিন্তিকে কোলে টেনে নিয়ে বলে, ‘‘ভাল করে লেখাপড়া করিস সোনা। করবি তো? একেবারে ফার্স্ট হতে হবে। তবে না বড় চাকরি পাবি।’’ 

 বিন্তি ঘাড় নেড়ে বলে, ‘‘আচ্ছা।’’ 

ইতি স্বপ্ন দেখে, একরাশ প্রাইজ় নিয়ে ঘরে ঢুকছে বিন্তি। ইতি মোবাইলে দিদিদের জানাচ্ছে, ‘‘বিন্তিটা এ বারেও ফার্স্ট হয়েছে।’’ দিদিরা বলছে, ‘‘তুই সত্যি রত্নগর্ভা।’’ 

স্বপ্নটা সত্যি হয় না। ইতির সমস্ত চেষ্টা আর স্বপ্নকে তছনছ করে বিন্তি হয়ে ওঠে নিতান্ত সাধারণ একটা মেয়ে। রোজ ঘর বন্ধ করে মেয়েকে পড়তে বসায় ইতি। খানিক পরেই শুরু হয় তর্জন গর্জন। পড়া শেষে বিন্তি যখন বার হয় ঘর থেকে, তখন কোনও দিন তার ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে, কোনও দিন গালে কালশিটে। নিঃশব্দে বোবা জন্তুর মতো মার খায় মেয়েটা। 

টিভি দেখতে দেখতে শাশুড়ি বলেন, ‘‘মেয়েটাকে মেরে ফেলবে না কি বৌমা?’’

‘‘মেরে ফেললেই বা আপনার কি? আপদ যাবে।’’ 

‘‘কী যে বলো!’’ শাশুড়ি আবার টিভিতে মগ্ন হন। 

এক-এক দিন ইস্কুলে যাওয়ার সময় পার্থ বলে, ‘‘ইস, কি চেহারা বানিয়েছিস?’’ 

বিন্তি বলে, ‘‘বোঝা যাচ্ছে বাবা?’’

‘‘বোঝা যাবে না? তোর মার মাথাটাই খারাপ হয়েছে।’’ 

দিদিমণিরা ডেকেছেন জেনে ইতি একদম চুপচাপ হয়ে গেল। সাড়ে দশটা বাজতে তিনজনে এক সঙ্গে বেরোল। ইতি নীল শিফন শাড়ি পরেছে। ঢিলে করে খোঁপা বেঁধেছে। বিন্তি মুগ্ধ গলায় বলল, ‘‘তোমাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে মা!’’

‘‘বলছিস!’’ আত্মবিশ্বাসে ঝলমল করে ওঠে ইতির মুখ,  ‘‘তোর বাবা তো কোনও দিন বলে না।’’ 

বড়দিদির ঘরে ঢুকে থমকে গেল ইতি। পার্থ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, ‘‘বিদিশার মাকে আসতে বলেছিলেন।’’ 

‘‘বসুন আপনারা। আমি ক্লাস টিচারকে ডাকি।’’

ক্লাস টিচারের সঙ্গে আরও দু’জন টিচার এলেন। সবারই এক প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে মারেন কেন? ও তো দুষ্টু নয়, লেখাপড়াতেও মোটামুটি। তবে?’’

ইতি চুপ করে চেয়ে থাকে। ওর চোখদু’টো জলে ভরে ওঠে। বলে, ‘‘আপনাদের চোখে যে ব্যাপারটা ধরা পড়েছে এতেই আমি খুশি। ওকে মারতে আমারই কি কম যন্ত্রণা হয়?’’ 

‘‘তা হলে মারেন কেন?’’ 

‘‘ওকে জাগাবার জন্য মারি। দেখছেন না কেমন শান্ত, ভীতু মেয়েটা। ছোটবেলায় আমিও ঠিক এই রকমই ছিলাম। বোকা, ভোঁদা, সাত চড়েও রা কাড়তে পারতাম না। যে মেয়ের রূপ নেই, বিদ্যে নেই, বাপের টাকা নেই, তাকে সবাই অপমান করে। বলদের মতো খাটায়। আমি মানুষ না জন্তু বুঝতে পারি না।’’ 

দিদিমণিরা তাকান পার্থর দিকে। 

ইতি বলে, ‘‘আমার মতো বেঁচে থেকে লাভ কী? তার চেয়ে যদি মার খেয়ে মরেও যায়...’’ ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। 

বড়দি বলেন, ‘‘শান্ত হোন। মেয়েকে এত মারলে ও আরও ভীতু হয়ে যাবে। ওকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করুন।’’ 

চোখ মুছে ইতি বলে, ‘‘আমি কি পারব? বেশি লেখাপড়া জানি না। ভাল মাস্টার দেওয়ারও ক্ষমতা নেই। ওর ঠাকুমা এখন থেকেই বিয়ের কথা বলে।’’ 

ক্লাস টিচার বলেন, ‘‘ওর অসুবিধে হলে আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। পেরেন্টস-টিচার্স মিটিংয়ে আসেন না কেন?’’ 

বড়দি পরামর্শ দেন, ‘‘আপনারা দু’জন বরং মেয়েকে নিয়ে মনের ডাক্তারের কাছে যান।’’ 

ইতি ম্লান হাসে, ‘‘তিনি আর নতুন কী বলবেন? ভয় হয় যদি ওর জীবনটাও আমার মতো হয়ে যায়! তাই পাগলের মতো মারি। মারতে গিয়ে নিজেরই বুক ফেটে যায়। কী নরম ওর হাত-পাগুলো। তবু ভাবি, মার খেয়ে হঠাৎ যদি জেগে ওঠে মেয়েটা! ঘুরে দাঁড়িয়ে দারুণ রেজ়াল্ট করে ফেলে! বলুন না, এমনও তো হতে পারে! হয় না বড়দি?’’ ইতি উদ্‌ভ্রান্ত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে। আর সকলেই ওর দিকে চেয়ে থাকে বাকরুদ্ধ হয়ে।