Abosar

অ্যান্টেনা

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

আজ টেম্পোদা এসেছে আমাদের বাড়ির মান্ধাতার আমলের অ্যান্টেনা খুলে ডিশ অ্যান্টেনা বসাবে বলে। প্রায় গোটা ছাদটা করোগেটেড শিট দিয়ে ঢাকা! শুধু কোণের দিকে ওই পুরনো অ্যান্টেনাটার জায়গাটাই যা এখনও ফাঁকা আছে। তাই মৌনার কথামত বড়দা সেখানে কেব্‌ল কানেকশন কেটে নতুন করে ডিশ বসাচ্ছে! কেব্‌ল-এ নাকি মৌনার মনের মতো চ্যানেল দেখা যাচ্ছে না!

মৌনার কোনটা যে মনের মতো সেটা ওর ছোটকাকা হয়ে, ওকে জন্মের সময় থেকে দেখেও আমি বুঝতে পারি না এখনও! ওর আজ লাল পছন্দ তো কাল সবুজ! আজ সিঙ্গাড়া তো কাল জিলিপিকে মাথায় নিয়ে নাচছে! ওকে দেখে মনে হয়, এখনকার ছেলেমেয়েরা কি তবে এমনই হয়!

মৌনা গত দু’দিন ঘর বন্ধ করে পড়ে রইল এই বলে যে, রাজুর সঙ্গে নাকি ও ব্রেক-আপ করে নিয়েছে! কারণ, ছেলেটা বড্ড গায়ে পড়ে! বড্ড পার্সোনাল স্পেসে ঢুকে পড়ে! ও যদি কোনও ছেলের সঙ্গে ফ্লার্ট করে তা হলে রেগে একশা হয়! মৌনার মতে, এ সব কাঁহাতক সহ্য করা যায়! প্রেম করেছে বলে এক জনের সঙ্গেই সব ইয়ে করে থাকতে হবে নাকি! তাই রাজুকে ও দিয়েছে গলাধাক্কা!

তা দিয়েছিস গলাধাক্কা, ভালই করেছিস! কিন্তু তাতে আবার মনখারাপ কেন! কারণ, রাজু তো তেলাতে আসল না! ছেলেটা নোট ভাল লিখে দিত! আপদে-বিপদে খেয়াল রাখত! সারা ক্ষণ বলত, ভালবাসে! তাও এল না কেন! গলাধাক্কা তো দিতেই পারে মৌনা। তা বলে রাজু পায়ে পায়ে ঘুরবে না! দেশে আইন-কানুন বলে সত্যি কি কিছু আর অবশিষ্ট নেই!

মেয়ের মনখারাপ হলে বড়দা এমন করে যা দেখলে মনে হয় কেন্দ্রে আর রাজ্যে একসঙ্গে সরকার পড়ে গিয়েছে! তাই এ বারেও মেয়ের মন ভাল করার জন্য অনেক সাধ্যসাধনা করার পর মৌনা এই বিধান দিয়েছে যে বাড়িতে কেব্‌ল-ফেব্‌ল আর চলবে না! ডিশ বসাতে হবে! মন ঘোরাতে ওর প্রচুর চ্যানেল চাই। আমাদের কেব্‌লওলা ওর মন ঘোরানোর-মতো চ্যানেল দেয় না!

এতে কী ভাবে রাজু নামক ছেলেটার আস্পদ্দা খণ্ডন হবে, আমি না বুঝলেও দাদা বুঝেছে! তাই বহু পুরনো অ্যান্টেনা নামিয়ে সেখানে বসছে ডিশ! আর এখন মৌনা সব ভুলে প্রচণ্ড উৎসাহে তার সামনে পোজ দিয়ে সেলফি তুলে ধড়াধ্‌ধড় পোস্টিয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়! আমার মজাই লাগছে। দেশের ডাকব্যবস্থা কেমন ডাকাডাকি করছে সেটা না বুঝলেও, দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টম্যানের ছড়াছড়ি!

আমি বললাম, ‘‘মৌনা, তোর আর মনখারাপ নেই তো?’’

মৌনা সেলফির অ্যাঙ্গল ঠিক করতে করতে বলল, ‘‘কার জন্য! ওই রাজু্? না তোমাদের এই মান্ধাতার অ্যান্টেনার জন্য! কী যে বলো কাকু! এখনকার দিনে নেকুপুশু প্রেম হল তোমাদের ডাইনোসর মার্কা অ্যান্টেনার মতো! সব স্ক্র্যাপ করে দিতে হয়!’’

আমি হাসলাম। দেখলাম জং-ধরা, ভাঙা অ্যান্টেনাটা নামিয়ে ফেলেছে টেম্পোদা। ওর সহকারি ছেলে দুটো প্লাস্টিক খুলে বের করে আনছে চকচকে ডিশ!

 

ফ্ল্যাশব্যাক - ১৯৮৬

 

হাফ টাইমের বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে হেঁচকি তুলে টিভিটা ঝিরঝির করতে আরম্ভ করল!

‘‘সর্বনাশ! এটা কী হল!’’ জেঠু তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘বাবু এখুনি টেম্পোকে ডেকে নিয়ে আয়! শিওর অ্যান্টেনাটা আবার গেছে!’’

বাবা এত রাত্তিরে আমায় একা পাঠাতে আপত্তি করছিল, কিন্তু আমি আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলাম! টিভি ঝিরঝির মানেই অ্যান্টেনাটা গিয়েছে! এক্সপেরিয়েন্স থেকে আমরা এটা জানি!

টেম্পোদার বাড়িটা আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তে! দৌড়লে আড়াই মিনিট আর হাঁটলে ছয়! আমি দৌড়লাম। এই বারো বছর বয়সে কার না কার্ল লিউস হতে ইচ্ছে করে!

টেম্পোদার বাড়িতে পৌঁছনোর সময়টুকুর মধ্যে আমি একটু গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ডটা দিয়ে নিই!

ছেয়াশির বিশ্বকাপের আজ ফাইনাল। আমাদের বাড়ি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার! কারণ ওই দলে ঈশ্বর আছেন!

হাত দিয়ে, পা দিয়ে নানা রকম গোল করে ঈশ্বর পৃথিবী মাতিয়ে ফাইনালে উঠে পড়েছেন! আর এখনও অবধি পশ্চিম জার্মানিকে ঈশ্বরের দল এক গোল ঠুসেও দিয়েছে! জানি না এর পর কী হবে। কিন্তু আর্জেন্টিনার জেতাটা আজ খুব দরকার। কারণ আমাদের বাড়িটা কিছু দিন ধরে মনখারাপ নামক এক ঘোলা পুকুরের তলায় ডুবে আছে। আর্জেন্টিনা জিতলে কিছুটা হলেও আলো-হাওয়া খেলবে আমাদের বাড়িতে!

এ বার বলি মনখারাপের কারণটা। আমার পিসতুতো দিদি বিনি!

জেঠিমা, ছাদে বিনিদির ঘর থেকে একটা লাভ লেটার পেয়েছে! সেখানে নাকি বিয়ে-সংসার ইত্যাদি নানান নিষিদ্ধ কথা লেখা আছে! বিনিদি ভুলে গিয়েছে, বাঙালি যতই উত্তম-সুচিত্রার প্রেম দেখবে বলে ছুটির দিনে দূরদর্শন খুলে বসুক না কেন, বাড়ির মেয়ে প্রেম করলে ‘কুরুক্ষেত্র টু’ আটকায় কেডা!

এ ক’দিন নানা ভাবে বিনিদিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে কে সেই কুলাঙ্গার আর সিআইএ-র চর যার সঙ্গে বিনিদি এই সব ‘নোংরামো’ করছে!

যদিও একাধিক প্রশ্নবাণে একটুও ঘায়েল করতে পারেনি বিনিদিকে। বিনিদি শুধু মিসেস সেন-এর মতো থুতনি তুলে বলেছে, ‘‘আমি বলব না!’’

পিসি থাকে অরুণাচল প্রদেশ। মেয়ের পড়াশোনার জন্য এখানে রেখেছে আমাদের কাছে। সেখানে মেয়ে যদি এমন একটা ভয়ংকর জিনিসে জড়িয়ে পড়ে তা হলে আমাদের বাংলা তথা বাঙালি জাতির ঐতিহ্যশালী মুখ কী রক্ষা হয়! তাই এ সব জানার পর থেকে বিনিদির বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে! আর জেঠু চারিদিকে বিনিদির বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য চিঠি লিখতে শুরু করেছে! এমনকী রাষ্ট্রসংঘেও চিঠি লিখবে বলে নাকি পোস্টকার্ড কিনে এনেছিল! শুধু জেঠিমার ধমকে... যাকগে।

ও দিকে কাল বিনিদিকে দেখতে আসবে। সেখানে বিনিদি আবার কী ঝামেলা করবে কে জানে। তাই আর্জেন্টিনার জয় দেখাটা আমাদের দরকার! আলো-হাওয়াটা দরকার! সেখানে কী না অ্যান্টেনাটা বাগড়া দিল!

এখন অ্যান্টেনা বাঙালিবাড়ির স্ট্যাটাস সিম্বল! তিন কাঠি আর পাঁচ কাঠির অ্যান্টেনার কৃপায় দূরদর্শন দেখা যায় কাঠের শাটারওলা টিভিতে। চিত্রমালা, চিত্রহারের সঙ্গে ফি-হপ্তায় একটা করে হিন্দি আর বাংলা ছবি আসে আমাদের চাতক জীবনে!

কেউ কেউ আবার ছোট্ট একটা অ্যান্টেনা ওই বড় অ্যান্টেনার মাথায় লাগায়! তাকে বলে বুস্টার! বাংলাদেশের চ্যানেল আঁকশি দিয়ে টেনে আনে সেই ব্যাটা! আমাদের বুস্টার নেই! আছে পাঁচ কাঠির অ্যান্টেনা। তারও মাঝে মাঝে তার খুলে যায়! আর সেটা ঠিক করতে ডাকতে হয় আমাদের মফস্‌সলের একমাত্র ইলেকট্রিশিয়ান, আঠাশ বছরের টেম্পোদাকে! ছেলেটা ভাল। কক্ষনও ‘না’ করে না।

আজও আমার ডাকে বিনা বিরক্তিতে দরজা খুলল।

বললাম, ‘‘এখুনি চল! না হলে কেলো হয়ে যাবে!’’

‘‘এই বয়সে কী ভাষা তোর!’’ টেম্পোদা ঘুমচোখে নিজের যন্ত্রপাতির বড় ব্যাগটা নিয়ে মাথায় নিজের কবচকুণ্ডলের মতো টুপিটা পরে নিল!

আমি হাসলাম। বারো কম বয়স নাকি? আমি অনেক কিছু জানি। জানি কেন দাদা লুকিয়ে দেশলাই হাতে ছাদে যায়! কেন, পাশের বাড়ির শুক্লাপিসি ওড়না-ছাড়া ম্যাক্সি পরে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ায়! জেড পাথরের কুঠিতে অরণ্যদেব ডায়ানা পামারকে নিয়ে কী করে!

আমি পথে যেতে যেতে বললাম, ‘‘তা কাল যাচ্ছই গুজরাত!’’

টেম্পোদা বলল, ‘‘হ্যাঁ রে, জানিসই তো ভাল কাজ পেয়েছি।’’

বাড়ি পৌঁছে, টেম্পোদা ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে আমাদের নীচে রেখে ছাদে উঠে গেল একা। এ বাড়ির এই ব্যাপারটা টেম্পোদার মুখস্থ! আগেও অ্যান্টেনা বহু বার ভুগিয়েছে!

ঠিক সাড়ে ছয় মিনিটের মাথায় চিড়িক করে লাফ দিয়ে ছবি এসে পড়ল টিভিতে! আর আমি কিছু বলার আগেই, জেঠু এমন করে চিৎকার করে উঠল যে মাঠে সার বেঁধে নামা আর্জেন্টিনার প্লেয়াররাও পর্যন্ত চমকে পিছনে তাকাল!

মনখারাপ করে নিজের ঘরে শুয়ে থাকা বিনিদি আর একতলায় ঘুমিয়ে থাকা ঠাম্মা ছাড়া আমরা সবাই আজ নীচে, টিভির ঘরে বসে আছি।

তার মধ্যে থেকে জেঠিমা সামান্য রাগের গলায় বলল, ‘‘ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন? মায়ের ঘুম ভেঙে যাবে না?’’

ঠাকুরদা মারা গিয়েছে দু’বছর আগে। ঠাম্মা একটু বাতিকগ্রস্ত মানুষ। তাই যত ক্ষণ ঘুমোয়, সবাই শান্তিতে থাকে!

খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে জেঠু আর সাংঘাতিক কোনও প্রতিযুক্তি দিল না! আমি দেখলাম, ছাদ থেকে নেমে এসে টেম্পোদাও দাঁড়িয়েছে ঘরের দরজার কাছে! চোখ টিভির দিকে!

জেঠু বলে উঠল, ‘‘বসে যা টেম্পো! খেলাটা শেষ করেই যাস। আবার যদি কিছু হয়!’’

টেম্পোদা কথা না বাড়িয়ে টিভির দিকে চোখ রেখে বসে পড়ল দরজার কাছে!

‘‘কী রে টেম্পো, তুই যাসনি!’’ ঠাম্মা আচমকা উদয় হল ঘরের দরজায়!

শুনলাম জেঠিমা চাপা গলায় জেঠুকে বলল, ‘‘হল তো!’’

টেম্পোদা সামান্য অবাক হল, ‘‘কোথায় যাব? খেলা দেখছি তো!’’

ঠাম্মা বলল, ‘‘ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে যেন দেখলাম...’’

‘‘আহ্‌ মা,’’ জেঠু দাবড়ে উঠল, ‘‘কী শুরু করলে! আর্জেন্টিনা যদি গোল খেয়ে যায়! তুমি ঘুমিয়ে পড়ো!’’

ঠাম্মা মাথা নেড়ে বলল, ‘‘তা ঠিক! কিন্তু... আচ্ছা যাই।’’

ঠাম্মার জন্য আর্জেন্টিনা কেন গোল খাবে সেটা যদিও বুঝলাম না! তবে দেখলাম আর্জেন্টিনা আর এক গোল দিলেও পালটা দু’গোল হ্যাংলার মতো হজম করে নিল! রাগে আমাদের পা থেকে প্লুটো অবধি জ্বলে গেল! এ তোমার কেমন টিম ঈশ্বর!

টাইট মার্কিঙে থাকা অন্তর্যামী আমার কথা শুনতে পেলেন বোধহয়! তাই চুরাশি মিনিটে এক বার ফাঁক পেয়েই তিনি বুরুচাগাকে দিয়ে পশ্চিম জার্মানিকে চিচিংফাঁক করে দিলেন!

আর সঙ্গে সঙ্গে চেগে উঠে জেঠুর কী লাফ! আমাকে জড়িয়ে, টেম্পোদাকে জড়িয়ে, বাবাকে, দাদাকে সবাইকে জড়িয়ে কী চিৎকার! শুধু জেঠিমাকে জড়াতে গেলে জেঠিমা ‘মরণ’ বলে জেঠুকে ঠেলে সরিয়ে দিল!

জিতে যাওয়ায় জেঠুর মনটা নবাব-বাদশার মতো হয়ে গেল নিমেষে! সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘এমন দিনেও বিনিটা মনখারাপ করবে! একা থাকবে! হতেই পারে না! চল সবাই ওর ঘরে যাই! ও তো আমাদের বাড়িরই মেয়ে! তাই না!’’

ছাদের এক কোণে বিনিদির ঘর। আমরা সবাই তার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম!  দরজা খোলা! আলো জ্বলছে! পরিপাটি করে গোছানো ঘর। কিন্তু বিনিদি নেই! বিছানার ওপর শুধু একটা চিঠি রাখা। তাতে লেখা, ‘‘আমি চলে গেলাম ওর সঙ্গে! আমায় খুঁজো না!’’

চিঠিটা হাতে নিয়ে জেঠু থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘‘ও? ও-টা কোন জানোয়ার? শোনো, কেউ না, বিনি আমাদের বাড়ির কেউ না! এ চক্রান্ত... গভীর চক্রান্ত!’’ (সিআইএ-র কি না সেটা আর জিজ্ঞেস করিনি!)

 

এখন

 

ডিশটা লাগিয়ে নীচে নেমে টুপিটা ঠিক করল টেম্পোদা। আজও কবচকুণ্ডল! হাসল, ‘‘হয়ে গেছে রে বাবু।’’

বিকেলের কমলা আলোয় আমি দেখলাম মানুষটাকে। স্টেশন রোডের ওপর এখন বিরাট বড় ইলেকট্রনিক্সের দোকান টেম্পোদার! বারো জন কর্মচারী! তাও আমাদের বাড়ির কাজ নিজের হাতেই করে এখনও! গুজরাত বেশি দিন সহ্য হয়নি মানুষটার!

বললাম, ‘‘ভাঙা অ্যান্টেনাটা তা হলে ফেলে...’’

‘‘না, ওটা ফেলবি না, আমি বাড়ি নিয়ে যাব।’’ পাশ থেকে বিনিদি বলল এ বার!

আর আমি হাসলাম শুধু! আর মনে পড়ে গেল একত্রিশ বছর আগের সেই রাত! বিনিদির রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যাওয়া!

আসলে ঠাম্মা সে রাতে টেম্পোদাকে নয়, দেখেছিল বিনিদিকে। টেম্পোদা নিজের বড় ব্যাগে এক জোড়া জামাপ্যান্ট এনেছিল! বাড়ির সবাই নীচে, এক ঘরে! ছাদে অ্যান্টেনা ঠিক করার আগে বিনিদিকে টেম্পোদা দিয়ে এসেছিল সেই জামাকাপড়। তার পর যাতে কেউ বুঝতে না পারে তাই গোটা ম্যাচটা বসে দেখেছিল আমাদের সঙ্গে! আর বিনিদি প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়ে লুকিয়েছিল টেম্পোদার বাড়িতেই! ঠাম্মা দেখেছিল ঠিকই, কিন্তু কেউ শুনলে তো!

পরের দিন, লুকিয়ে ওরা চলে গিয়েছিল গুজরাত! এক মাস পরে চিঠিতে সব জানিয়েছিল বিনিদি। শুধু এটা জানায়নি যে, আমিও ওদের প্ল্যানের অংশীদার ছিলাম।

বিনিদি জানত, সে রাতে সবাই নীচের ঘরে থাকবে! আর সেই সুযোগে ও অ্যান্টেনার তার খুলে দেবে হাফ টাইমে। আর বরাবরের মতো আমাকেই যেতে হবে টেম্পোদাকে ডাকতে! আরে, ভালবাসা না থাকলে অত রাতে কেউ অ্যান্টেনা ঠিক করতে আসে!

এত বছর পর আজ জেঠু নেই, বাবা নেই। আমরাও সব ভুলে গিয়েছি। টেম্পোদার জন্য আমরা এখন গর্বিত! বিনিদির কথাও বলে সবাই, ‘‘সত্যি, মেয়ে বটে বিনি! অমন অনাথ, গরিব ছেলের জন্য সব ছাড়ল! এমন প্রেম ভাবা যায়!’’

রোগা অ্যান্টেনা চলে যাচ্ছে! ডিশ অ্যান্টেনা এসে সরিয়ে দিচ্ছে তাকে! একা দূরদর্শনে মন ভরছে না মৌনাদের। তারা ভুলে যাচ্ছে, যখন কেউ ছিল না, এই একলা অ্যান্টেনাটাই সবাইকে ভরিয়ে রাখত! ঈশ্বর দর্শন করাতো!

আমি দেখলাম, ডিশের সামনে মৌনা সেলফি তুলে যাচ্ছে এখনও। আর এক পাশে বাতিল, রোগা, ভেঙে-পড়া অ্যান্টেনার গায়ে পরম মমতায় হাত বোলাচ্ছে আমার রুপোলি চুলের বিনিদি। আমার সকল বিনিদিরা!