Abosar

অবোধ স্নেহ

রিমা বিশ্বাস

কানে মোবাইল চেপে জোরে জোরে কথা বলছেন প্রভা। সুদীপ্ত বিছানায় শুয়ে চেয়ে রয়েছেন প্রভার দিকে। প্রভা কথার ফাঁকে মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছেন সুদীপ্তর দিকে। ফোন রেখে বললেন, ‘‘পনুর ফোন। বলছিল পিসের হঠাৎ শরীর খারাপ করল, দাদাভাইকে বলোনি? আমি বলি, কী দরকার বলে? সে কি আর আমার ছেলে আছে? এখন বৌ যা বলবে, বাবু সেইটিই শুনবে! বৌ যদি বলে আসতে হবে না, তিনিও মুখ বুজে মেনে নেবেন। সাত বছর ধরে দেখছি। এই তো হয়ে আসছে!’’

সুদীপ্ত ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘‘বাবাইকে কিছু বলবে না তা হলে?’’

প্রভা ঠোঁট টিপে দেখলেন স্বামীর মুখটা। বাবাইকে জানানো হয়নি, উনি বাথরুমে যেতে গিয়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়েছেন। তার জন্য বাবু যেন মন থেকে ভেঙে পড়লেন! কিন্তু প্রভাকে যে একা সব সামলাতে কত টেনশন নিতে হচ্ছে, তা কি মুখ ফুটে বলছেন?

হঠাৎ ঘরে ঢুকলেন প্রীতি। 

‘‘নীচের দরজা খোলা ছিল?’’ প্রীতিকে আচমকা ঢুকতে দেখে বললেন প্রভা।

‘‘তোদের কাজের লোকটা বেরল, আমি তখনই ঢুকে পড়লাম।’’

‘‘কী বেয়াক্কেলে মেয়েমানুষ দেখেছিস! কাজ হয়ে গিয়েছে, এক বার বলে গেল না!’’

প্রীতি মোড়া টেনে বসলেন, ‘‘কেমন আছে জামাইবাবু? বাবাইকে খবর দিলি?’’

‘‘কী হবে দিয়ে! ছেলেটা আমার শুধু-শুধু কষ্ট পাবে! আসতে চাইবে তখনই, তাতেই হয়তো অশান্তি বাধবে! ওর মন কী চায় আমি কি জানি না? শ্রুতি অশান্তি করলে ও কী করবে! শ্রুতি এক দিন বুঝবে মায়ের কোল থেকে ছেলেকে আলাদা করার ফল। ছেলেটা আমার অশান্তি করতে ভয় পায় বলেই না শ্রুতির এত বাড়!’’

প্রীতি শুনছিলেন বড়দির কথা। বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে বললেন, ‘‘ঠিক কী হয়েছিল জামাইবাবুর?’’

প্রভার মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল। বললেন, ‘‘গত পরশু রাত্তিরে আমার সে কী আতান্তর! কখন বাথরুমে যাওয়ার জন্য উনি উঠেছেন আমি জানি! হঠাৎ দেখি লোকটা পাশে নেই! পায়ে-পায়ে গিয়ে দেখি বাথরুমে কেমন হয়ে পড়ে আছেন! অত রাত্তিরে কাকে ডাকব, কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলুম না... শেষে জলটল দিতে চৈতন্য ফেরে। সক্কাল হতেই পাশের বাড়ির দিলীপকে বলি, ও-ই ডাক্তার ডেকে আনে।’’

‘‘তোরা বুড়ো-বুড়ি এ ভাবে একা-একা দিনের পর দিন চন্দননগরে পড়ে থাকবি, আর ছেলে থাকতেও কোনও সুযোগ-সুবিধে পাবি না, এ কেমন কথা! তুই বাবাইকে আজই ফোন করবি। বৌ অশান্তি করে করুক! তা বলে বাপ-মা’র দায়িত্ব নেবে না? কী এমন দূরে থাকে? থাকে তো সল্ট লেকে!’’ প্রীতির গলায় অসন্তোষ। 

প্রভা অন্য দিকে তাকিয়ে রইলেন। কী করে বোনকে বোঝান, বাবাইয়ের মতো ছেলে সত্যিই হয় না, কিন্তু বেচারা নিরুপায়। বৌটা খুব দজ্জাল! মোবাইল বাজতে ফোন হাতে তুলে চোখ কুঁচকে তাকালেন প্রভা, ‘‘এই দেখ বাবাইয়ের ফোন। নিশ্চয়ই পনু বলেছে, পিসেমশাই অসুস্থ!’’

‘হ্যালো’ বলার পর ও পাশের অভিযোগ সামলে প্রভা বললেন, ‘‘তোকে ব্যস্ত করতে চাইনি বাবু... সে তুই আয়, দেখে যা বাবাকে।’’

ফোন রাখতেই প্রীতি ধরলেন, ‘‘বাবাই আসছে?’’

প্রভার মুখে আনন্দের রেখা। বললেন, ‘‘আসছে!’’

বিকেল পাঁচটা নাগাদ বাবাই এল। সঙ্গে শ্রুতি আর লিও। নাতিকে কোলে নিয়ে প্রভা ঘরে ঢুকলেন, ‘‘দেখো কত বড় হয়ে গিয়েছে লিও!’’

ঠাকুমার কোলে চার বছরের লিও গা মোচড়াল। সুদীপ্ত উঠে বসতে যাচ্ছিলেন, বাবাই সুদীপ্তর কাঁধ চেপে ধরল, ‘‘আস্তে বাবা! কী যে করো না তোমরা! মা আমাকে পর্যন্ত বলেনি! পনু আমায় ফোন করে বলছে! কত বার বলেছি রাতে একটা আয়া রাখো। তাও শোনো না!’’

সুদীপ্ত ছেলের হাত ধরে হাসছেন খুশি-খুশি মুখে, ‘‘ভয় পাস না। কিচ্ছু হবে না আমার!’’

সুদীপ্তর পায়ের কাছে বসল শ্রুতি, ‘‘বাবাকে বেশ রোগা লাগছে...’’

‘‘ছেলের চিন্তাতেই তো শেষ হল!’’ শ্বাস ফেলে বললেন প্রভা। 

শ্রুতি এক ঝলক তাকাল শাশুড়ির দিকে।

সুদীপ্তর কাছে লিওকে বসিয়ে রাতের খাবার করতে রান্নাঘরে ঢুকেছেন প্রভা। পাশের বাড়ির দিলীপকে দিয়ে মুরগি আনিয়েছেন। বাবাই মুরগি খেতে ভালবাসে। কড়াতে মাংস কষা হচ্ছে। মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ সে এখনও ভোলেনি। ছেলে কি আর মায়ের হাতে রোজ রোজ খায়! এখন সুদীপ্তর চিন্তাটাও একটু আবছা হয়েছে। বয়স হলে কত কিছুই তো হয়। 

শ্রুতি আটা মাখছিল। বলল, ‘‘এ ক’দিন রান্নার বেশি ঝামেলা কোরো না। কোনও রকমে ঝোল ভাতে চালিয়ে দিয়ো!’’

রাগ হল প্রভার। মনে মনে বললেন, ‘তা তো তুমি চাইবেই! যাতে পরে বলতে পার, তোমাদের বাড়িতে গেলে শাশুড়িমা কী এমন খাতির করে! ওই তো ট্যালটেলে ঝোলেই কাজ সারে!’

বাবাই রান্নাঘরের দরজার কাছে এসেছে, ‘‘মা, এক দিন তোমার হাতের চিংড়ির মালাইকারি খাব!’’

শ্রুতি চোখ পাকাল, ‘‘তুমি কি খেতে এসেছ?’’

‘‘না... বাবা তো এখন মোটামুটি স্টেবল তাই...’’

ছেলের কথা থামিয়ে প্রভা বললেন, ‘‘আহা ছেলেটা মায়ের কাছে দু’টো খাবারের আবদারও করতে পারবে না? তুমি তো বারো মাসই খাওয়াও, আমি না হয় দু’দিন নিজের হাতে ছেলেটাকে খাওয়ালাম!’’

শ্রুতি হাসল। প্রভার মনটা এখন আনন্দে এত নাচানাচি শুরু করেছে যে, শরীরের শক্তি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। মনে-মনে ঠিক করছিলেন, এই ক’দিন কী-কী রান্না করবেন। 

রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরে ঢুকে প্রভা যখন জোয়ান চিবোচ্ছেন, তখন শ্রুতি ঘরে ঢুকল। হাতে একটা প্যাকেট, ‘‘মা, তোমার জন্য এই শাড়িটা কিনেছিল তোমার ছেলে। পয়লা বৈশাখে তো আসা হয়নি, তাই এখন নিয়ে এলাম।’’

প্যাকেট থেকে সি গ্রিন রঙের পিয়োর সিল্ক বার করতে প্রভার মুখটা আনন্দে ঝলমল করে উঠল। বাবাইটা সত্যি মা-পাগল! এই বুড়ির জন্য কী সুন্দর রং পছন্দ করেছে! শাড়ি হাতে প্রভা বাইরের ঘরে এসেছেন। বাবাই মোবাইলে কথা বলছিল। গায়ে শাড়িটা ফেলে ইশারায় ছেলেকে বললেন, দারুণ! বাবাই বোধহয় বুঝতে পারছিল না। কান থেকে ফোন সরিয়ে বলল, ‘‘কী?’’

‘‘তোর আনা শাড়িটা!’’ উজ্জ্বল মুখে হাসছেন প্রভা। 

বাবাইয়ের কপালে ভাঁজ পড়ল। তার পর প্রভার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রুতির দিকে তাকাল। শ্রুতি এগিয়ে এসে বলল, ‘‘ভুলে গেলে! পয়লা বৈশাখের জন্য শাড়ি কিনলে যে?’’

‘‘ও হো!’’ জোরে মাথা নাড়াল বাবাই, ‘‘শ্রুতিরই কাজ। ভাল মানিয়েছে তোমায়!’’ বাবাই আবার ফোনে মন দিল। 

প্রভা নিবে গেলেন। তবে মনটা খারাপ হতে গিয়েও হল না। হঠাৎ মনে হল শ্রুতি কেন, বাবাই-ই কিনেছে শাড়িটা। পাছে শ্রুতি অশান্তি করে তাই বৌকে তুষ্ট রাখার জন্য প্রসঙ্গ এড়াল ছেলে।

ছেলেটা হাতে সপ্তাহখানেক ছুটি নিয়ে এসেছে, তাই ক’দিন ধরে প্রভাও উঠে পড়ে লেগেছেন তরিবত করে রাঁধতে। এ দিকে সুদীপ্তর রিপোর্টেও তেমন কিছু মেলেনি। ডাক্তার বলছেন প্রেশার থেকে এমন হতে পারে। সে জন্য নিয়ম করে পাড়ার ওষুধের দোকানের বিষ্টু রোজ প্রেশার মেপে দিয়ে যাচ্ছে। বাবাইও বেশ খোশমেজাজে আছে। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে-মাঝেই আড্ডা দিয়ে আসছে। আর খুদে দস্যুটাকে তো সামলানো দায়! দিনরাত তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। পাকা-পাকা কথা বলছে। প্রভাকে আবার মাঝে-মাঝে বলে, ‘‘এই যে শুনছ...’’ দাদুকে নকল করা আর কী! প্রভার এখন সুখের দিন, শান্তির রাত। বুকের ভিতর কোনও ভার ভাব নেই। প্রভা যেন হাওয়ায় উড়ছেন। তবে মাঝে-মাঝে রাগ হয়ে যায় শ্রুতির আক্কেল দেখে। সে দিন কাতলা মাছের কালিয়া করতে গেল। প্রভা কত বারণ করলেন, ‘‘থাক শ্রুতি, ক’দিনের জন্য এসে আর হেঁশেল সামলাতে হবে না!’’

তা মেয়ে সে কথা শুনল? বলে, ‘‘রোজ-রোজ তোমার এত খাটুনি যায়, আজ আমিই রাঁধছি।’’

প্রভাকে সে দিন রান্নাঘরের ছায়া মাড়াতে দিল না মেয়েটা। খেতে বসে প্রভা ঠিক বুঝেছেন, এত তেল-ঝাল খেলে আর দেখতে হবে না। প্রভা শুকনো-শুকনো খেলেন, তাতেই বুক জ্বালা করছে আর সুদীপ্ত লোভীর মতো হাপুসহুপুস করে সব খেলেন। প্রভা ভাবলেন, মুড়িঘণ্ট, মাছের কালিয়া... আবার অতটা টক ডাল! অম্বল হলে তখন তো প্রভার কাছেই আসবেন। সে কথা বলতে বাবুর কিনা প্রভাকে নিয়ে হাসাহাসি, ‘‘কেন অম্বল হতে যাবে? পেটভর্তি জ্বলন নিয়ে খেলে পেটে অ্যাসিড বাড়ে। আমি তো আর শ্রুতির সঙ্গে মনে-মনে কম্পিটিশন করি না... হে-হে, তোমাদের ছেলের বৌয়ের সঙ্গে রেষারেষি আর এ জীবনে যাবে না!’’

এমন রাগ হয়েছিল প্রভার যে, মুখ দিয়ে কথা বেরচ্ছিল না। সুদীপ্ত কিনা বলে প্রভার মতো শান্ত মানুষ, ওই শ্রুতির সঙ্গে রেষারেষি করেন! আর শ্রুতি আসার পর থেকে বাবাই যে এতটা দূরে-দূরে থাকতে শুরু করল? মা-বাবার সঙ্গে এতটা দূরত্ব তৈরি করল? যে-ছেলে মা-বাবা অন্ত-প্রাণ ছিল, সে এখন ন’মাসে-ছ’মাসে বাড়ি আসে— সে কার জন্য? কী করে এমন পরিবর্তন হল ছেলের? সেগুলো বোঝেন না সুদীপ্ত? 

রাতে শোওয়ার সময় লিও বায়না জুড়েছেন, ‘‘ঠাম্মির কাছে শোব!’’

কিছু দিনেই নাতিটা প্রভার নেওটা হয়ে গিয়েছে। মশারির তলায় নাতিকে নিয়ে শুয়েছেন প্রভা। সুদীপ্ত আর প্রভার মধ্যে শুয়ে সে তো ঘুমোবেই না, পুটুর-পুটুর করেই চলেছে। একটা সময় সুদীপ্ত ঘুমিয়ে পড়লেন। প্রভা নাতির চুলে বিলি কাটছেন, ‘‘তুই 

কি নিশাচর!’’ ওর ছোট্ট গালে চুমু খেলেন প্রভা। 

লিও প্রভার গলা জড়িয়ে ধরল, ‘‘ঠাম্মি, তুমি সল্লেকে থাকলে কত মজা হত!’’

প্রভার বুকটা ফুঁপিয়ে উঠল। প্রভা কি আর তা চান না? কিন্তু এতে যে শ্রুতি অশান্তি করবে, তা বোঝেন প্রভা! এক বার প্রভা খুব করে বাবাইকে বলেছিলেন, পুজোটা চন্দননগরে কাটিয়ে যেতে। ছেলে তখন বলেছিল, পুজোর সময় ওদের প্রত্যেক বার ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান থাকে। না গেলে শ্রুতির মন খারাপ করবে। ও কী করে শ্রুতিকে চন্দননগরে আসতে বলে! এর চেয়ে আর কত পরিষ্কার করে বলতে পারত বাবাই! মানে পুজোয় অন্য কোথাও যাওয়া শ্রুতির পছন্দ নয়। আর সেটাকেই মনখারাপের মলাট পরিয়েছিল বাবাই। 

লিও ওর নরম হাত রাখল প্রভার বুকে, ‘‘বাবাটা খুব পচা!’’

‘‘এই দুত্তু! অমন বলতে নেই!’’

লিও ওর পাতলা ঠোঁট ফোলাল, ‘‘পচাই তো! মা কত বলল, তোমাদের সল্লেকের বাড়িতে নিয়ে যেতে। বাবা বলল, একদম না... আমাদের পাইবেসি চলে যাবে!’’

প্রভার কপালে ভাঁজ পড়ল। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না লিওর কথা। বললেন, ‘‘এগুলো তোর মা বলেছে, তাই না?’’

লিও দু’পাশে মাথা নাড়াল। উঠে বসেছে, ‘‘মা না, বাবা! মা  বলছিল, পুজোয় এখানে আসবে... বাবা বলল, শিমলা যাবে... এখানে বাবার ভাল লাগে না...’’

প্রভার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না! এ সব কী শুনছেন প্রভা। এত দিন যা ভেবে এসেছেন, তার সব ভুল? শ্রুতি ওদের মাঝে ব্যবধান আনেনি? এ দূরত্ব বাবাইয়েরই তৈরি!

লিও ছোট-ছোট হাতে ডাকছিল প্রভাকে, ‘‘ঠাম্মি...’’

লিওকে বুকের কাছে টেনে নিলেন প্রভা, ‘‘ঘুমিয়ে পড়ো, সোনা!’’

‘‘তুমি ঘুমোবে না?’’

হালকা শ্বাস ফেললেন প্রভা। গভীর স্নেহে লিওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘এত দিন ধরে তো ঘুমিয়েই ছিলাম সোনা!’’

লিও ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল। প্রভার ঘুম আসছিল না। বুকের ভিতর ছটফট করছিল শ্বাসযন্ত্র। দমবন্ধ লাগছিল প্রভার। ভুল ভাঙলে বুঝি এমনটাই হয়! 

বুকের ভিতরে অতি গোপনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন প্রভা। 

এই কান্নার আওয়াজ কেউ শুনতে পাবে না!