Abosar

অপদার্থ

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

কাল সকালে পর পর চারটে অপারেশন। বাকি তিনটে মাইনর হলেও এই সাত নম্বর কেবিনের কেসটা মেজর। সন্ধেবেলা রাউন্ডে বেরিয়ে সবার শেষে এই ঘরটায় ঢোকেন ডাক্তার ভাস্করবিকাশ পাল। চেক-আপ সেরে নার্সকে প্রি-অপারেটিভ ডিরেকশন, অ্যান্টিসেপটিক ড্রেসিং, অপারেশনের ছ’ঘণ্টা আগে থেকে মুখ দিয়ে কিছু না খাওয়া ইত্যাদি নিয়মমাফিক কিছু কথা লিখে, প্রণবেশ সমাদ্দার নামের বছর চল্লিশের পেশেন্টটির দিকে ফিরে একটা প্রাণবন্ত হাসি হাসেন।

করুণ চোখে তাকায় লোকটি। ডাক্তার বলেন, “কী হল, খুব নার্ভাস লাগছে না কি?”

“না, মানে ইয়ে... বলছিলাম আর কী, লাইফ রিস্ক আছে?”

“অপারেশনে তো রিস্ক ফ্যাক্টর একটা থাকেই, কিন্তু সে নিয়ে আপনি ভাববেন কেন? ও সব চিন্তা আমার ওপর ছেড়ে দিন। ডোন্ট প্যানিক ব্রাদার, কাল আপনার শরীরের বড়সড় ধকল আছে, তাই আজ রাতটা ভাল করে ঘুমনো দরকার। একটা ভাল ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়ে গেলাম, খেয়ে দারুণ একটা ঘুম দিন। দেরি করবেন না,” আত্মবিশ্বাসী গলায় বলেন ডাক্তার পাল।

“হুম,” ঢোঁক গিলল লোকটা। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজিটা ধরে আস্তে আস্তে ঘোরাতে লাগল।

তার অবস্থা দেখে ডাক্তার মনে-মনে কী যেন একটা চিন্তা করলেন। তার পর আবার বললেন, “ঈশ্বরে ভরসা আছে?”

“না, মানে ঠিক সে ভাবে নেই।”

“তা হলে আর কী করবেন, আমাকেই বিশ্বাস করুন,” ঠোঁটের কোণ মুচড়ে হাসেন ডাক্তার, নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই টো-এর উপরে লাফিয়ে ওঠেন। এখনই তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। একটা জরুরি মিটিংয়ের জন্য। বেরিয়ে যাওয়ার আগে লোকটার পিঠে হাত দিয়ে আরও এক বার বলে গেলেন ডাক্তার পাল, ‘‘চিন্তা করবেন না। ভাল করে একটা ঘুম দিন।’’

চিন্তা না করার কথা লোকটাকে বললেও নিজে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে নামতে ওই লোকটার কথাই ভাবছিলেন ডাক্তার। রোগ যদিও বয়স বিচার করে না, তবু এই বয়সেই কিনা এই মারণ রোগটা ধরতে হল! অস্টিওসারকোমা, হাড়ের ক্যানসার। ডান হাতের অস্থিসন্ধিতে হয়েছে। ভয়ানক হেমাটোজেনাস অর্থাৎ রক্তের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়। তাই আর কিছু করার নেই, এলবো জয়েন্ট থেকে হাতটা কেটে বাদ দিতে হবে। সচল সবল ডান হাত, সদাব্যস্ত কর্মক্ষম এমন একটা অপরিহার্য অঙ্গ বাদ পড়া মানে কী হতে পারে, তা যার হয়েছে সেই জানে।

কী করেন, প্রশ্ন করায় লোকটা বলেছিল, টিউশুন দিই। ভর্তি হওয়ার সময় সঙ্গে ষাটোর্ধ্ব এক জন বুড়ি এসেছিল। পেশেন্টের মা। সে ছাড়া তার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কিছু শোনা হয়নি। বড্ড বেশিই চুপচাপ, জিজ্ঞেস না করলে রা কাটে না, তাই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ওঠেনি। প্রফেশনাল ডিলিং-এ সে সব কথা না ওঠাই দস্তুর, এ সব নিয়ে এত ভাবার কী আছে?

মিটিং থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেলেও কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাড়ে দশটায় পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে সব কটা ফ্লোরের করিডর বরাবর রাউন্ড দেওয়া রোজকার রুটিন। প্রত্যেকটা ঘর, বারান্দা, আনাচ-কানাচ ঘুরে সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর নজরদারির জন্য এটুকু না করলেই না। হেলথ স্টাফ, সিস্টার আয়ারা ঠিক মতো ডিউটি দিচ্ছে তো, পরিষেবায় কোথাও কোনও ফাঁক নেই তো, সাড়ে-ন’টা বাজতে সব রুমের আলো নিভে গিয়েছে তো? এই সময় ছোটখাটো সব ব্যাপারেই ডাক্তার খুবই কড়া, রুক্ষ ও ক্ষমাহীন।

কিন্তু সাত নম্বর কেবিনের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান তিনি। ঘরের দরজাটা টানা থাকায় প্রথমে বুঝতে পারেননি, কিন্তু স্কাইলাইটের কাচের মধ্যে দিয়ে আসা আলো চোখে পড়ায় ভুরু কুঁচকে গেল। সাত নম্বরে এখনও আলো জ্বলছে কেন? জানতে চাইলে ফ্লোর সিস্টার বলেন, “কী বলব স্যর, বারবার করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়তে বলেছি, কিন্তু লোকটা কোনও কথাই শুনল না। আমি আপনার স্ট্রিক্ট অর্ডারের কথা বললাম, লোকটা হাতজোড় করে আমাকে অনুরোধ করল। এমন ভাবে বলল যে না করতে পারলাম না।”

“না না, ওকে অ্যালাও করে ঠিক করেননি, কাল সকালে অত বড় অপারেশন। কেন ওকে ঘুমের বড়িটা দেননি?”

“হ্যাঁ স্যর দিয়েছি, কিন্তু লোকটা ঘুমোয়নি। বলল কী একটা জরুরি কাজ আছে, করেই শুয়ে পড়ব, কিন্তু এখনও শোয়নি।”

“জরুরি কাজ! কী করছে?”

“কী সব আঁকছে! এই পাঁচ মিনিট আগেও আমি শেষ বার ওয়ার্নিং দিয়ে এসেছি, বলল আর পাঁচ মিনিট।”

“ছবি আঁকছে, মানে?” দরজাটায় হালকা ঠেলা দিয়ে ভিতরে মাথা গলান ডাক্তার।

এ কী! লোকটা বেড থেকে নেমে মেঝেতে বসে আছে কেন? সামনে ঝুঁকে পড়েছে একটা ড্রয়িং শিটের উপর। হাতে পেনসিল, দক্ষ হাতে রেখা টেনে চলেছে।

ভিতরে ঢুকে আসেন ডাক্তার পাল, “কী হল, আপনি ঘুমোননি? এ সব কী করছেন, ক’টা বাজে দেখেছেন? ক’ঘণ্টা পরে সিরিয়াস অপারেশন আর এখন আপনি...”

চারপাশে চোখ বোলান ডাক্তার। কিছু না হলেও আট-দশটা ড্রয়িং শিট পাতা রয়েছে মেঝেতে, বেডের উপরে। হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে তাই সিলিং ফ্যান বন্ধ। 

থমথমে ঘর্মাক্ত মুখ, অপরাধীর মতো তাকাল লোকটা। কাঁচুমাচু মুখে কাঁপা-কাঁপা দু’হাত জড়ো করে বলে “মাপ করবেন স্যর, আপনার নার্সিং হোমের নিয়ম জানি, কিন্তু কিছু করার ছিল না স্যর। এই রাতটাই তো শেষ। আর কয়েক ঘণ্টা পর তো চিরকালের মতো
সব শেষ।”

“শেষ মানে, কী শেষ?”

“শেষ মানে সব শেষ, সারা জীবনের যত আঁকাআকি সব শেষ। ছবি আঁকা যা আমার সর্বনাশ... যা আমার যথাসর্বস্ব! সব শেষ।”

থতমত খেয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার। সদ্য হয়ে ওঠা পেনসিল স্কেচটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাল লোকটা, “কাল থেকে আর আঁকতে পারব না, এ জীবনের মতো আর আঁকতে পারব না। তাই আজ আমাকে আঁকতেই হত। যে করেই হোক, যে কোনও ছলছুতোতেই হোক এই ছবিগুলো আঁকতেই হত।”

“কিন্তু আপনি যে শিল্পী বলেননি তো? বলেছিলেন টিউশন দেন।”

“ছবি আঁকি, তাই বলে শিল্পী বলা যায় না কি?”

“কিন্তু আপনি তো অসাধারণ আঁকেন দেখছি! দুর্দান্ত পেনসিল স্ট্রোক, কনফিডেন্ট লাইনস!”

বোর্ডটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটা। ক্লিপে আটকানো ছবি, ঘরে ইতস্তত পেতে রাখা সব ক’টা ছবিই একটি মেয়ের মুখ। ডাক্তার তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সিস্টারকে ইশারা করে বাইরে যেতে বলেন। বেডের উপর থেকে একটা ছবি তুলে নিয়ে বলেন “সব ছবিই তো এক জনের মনে হচ্ছে। এই ভদ্রমহিলা কে, আপনার পরিচিত?”

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মেঝের ছবিগুলো একটা একটা করে কুড়িয়ে নিতে নিতে লোকটা বলল “ওই ছিল এক জন।”

“ছিল মানে? তিনি বেঁচে আছেন তো, না কি নেই?”

“না না, বালাই ষাট! বেঁচে থাকবে না কেন? আমি বলতে চাইছিলাম এক সময় আমার সঙ্গে এক রকম...”

“বুঝতে পেরেছি, আপনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল, তাই তো?”

“হ্যাঁ সেই রকমই এক প্রকার।”

“সম্পর্কটা টেকেনি। আপনাদের বিয়ে হয়নি। আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাই তো?”

“না... না সে যায়নি, আমিই যেতে বলেছিলাম। আমিই চেয়েছিলাম ও যেন কিছুতেই না থাকে, এই ভুলটা না করে বসে?”

“মানে, বুঝলাম না! আপনাদের সম্পর্কটা কি একপাক্ষিক ছিল?”

“না না, ভীষণ ভাবেই দ্বিপাক্ষিক। বারো বছরের দীর্ঘ সম্পর্ক। ও শেষ অবধি প্রাণপণ চেয়েছিল আমার বাড়ি চলে আসতে। এ দিকে এক ধনী স্বর্ণকারের পরিবারে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বুঝে পালিয়ে এসেছিল আমার কাছে। আমি সাহস পাইনি। দায়িত্ব জিনিসটায় আমার খুব ভয়। খুব খারাপ ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ও আমায় হাড়ে হাড়ে চিনত, যাওয়ার সময় আমার মুখের ওপর একটা শব্দ ছুড়ে মেরে গিয়েছিল।”

“কী শব্দ?”

“অ-প-দা-র্থ।” প্রতিটা বর্ণে চাপ দিয়ে উচ্চারণ করে মাথা নেড়ে হাসল লোকটা।

উদাসীন শুকনো ঠোঁট নড়ে ওঠে লোকটার, “আসলে এক সময় আমার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা হয়তো ছিল কিন্তু সেই তুলনায় তো কিছুই করতে পারিনি। আর্ট কলেজ থেকে পাস করেছিলাম। কিন্তু টিউশন দেওয়া পাতি মাস্টার ছাড়া কিছু হয়ে উঠতে পারিনি। রোজগারের ঠিক নেই, আমার মতিগতির ঠিক নেই, সামাজিক মর্যাদা বলে কিছু নেই। মায়ের পেনশন তো আর চিরকাল থাকবে না, তখন কী করব, জেনেশুনে মেয়েটাকে এই জীবনে আনা কী ঠিক হবে, অনেক ভেবেছি। শুরুর রোমাঞ্চ কেটে গেলে নিশ্চয়ই খুব পস্তাবে, তখন ওর চোখে আমার চেয়ে বড় অপরাধী আর কেউ থাকবে না। সাত-সতেরো নানা কথা চিন্তা করে মাথায় সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ও যখন আমার কাছে চলে এল, তখন ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইনি।”

“এই ব্যাপারটা নিয়ে আজও কি আপনি আপশোস করেন?”

“না... না। একেবারেই না। বরং আমি খুশি যে, ওকে সে দিন সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করতে পেরেছিলাম। বিয়ের এক বছর পর বাপের বাড়ি এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী হয়েছে। গায়ের রং ফেটে পড়ছে। গা-ভর্তি গয়না পরে বেশ বনেদি গিন্নিদের মতো দেখাচ্ছিল! আমাকে স্বামীর প্রভাব-প্রতিপত্তি, ওই বাড়িতে ওর অভাবনীয় ভাল থাকার কথা বলল, শ্বশুরবাড়ির প্রাচুর্যের গল্প করল। আমাকে রীতিমত আপ্লুত ও হাসিমুখে সব শুনে যেতে দেখে সটান উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। এক রাশ আগুন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস সে দিন ভীষণ রেগে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম! না হলে আজ আমার কী দুরবস্থা হতো বুঝতে পারছ?’ বললাম, ‘সে তো বটেই’।”

“বললেন, ‘সে তো বটেই’?”

“তা ছাড়া কী বলব? ভুল তো কিছু বলিনি। কিন্তু তাতে ও আরও রেগে গেল মনে হল। বলল, ‘তাই তো বলবে, তোমার কাছ থেকে এর বেশি আর কীই বা আশা করতে পারি। দেখতে এসেছিলাম তুমি একটুও বদলেছ কি না, এসে দেখলাম বদলাওনি, এক বিন্দুও বদলাওনি। মনে আছে, যাওয়ার সময় তোমায় কী বলে গিয়েছিলাম?’ তা আর মনে থাকবে না আবার। খুব মনে আছে, বলেছিলে অপদার্থ। ঠিকই বলেছিলে, এক্কেবারে ঠিক’।”

কথাগুলো বলে লোকটা চুপ করে গেল। সেই দেখে ডাক্তার বলেন “আপনার আঁকা ছবি দেখে তো তাঁকে বেশ সুন্দরীই মনে হচ্ছে?”

“হ্যাঁ, তা বলাই যায়। তবে বিয়ের আগে এত রূপ ছিল না যতটা বিয়ের পর হয়েছে। এমন রূপ আমার কাছে থাকলে কিছুতেই ফুটত না, আমি কিছুতেই ফোটাতে পারতাম না। হাজার হোক ছবি আঁকিয়ে তো বটে, তাই রূপ বিষয়টা খুব ভালই বুঝি। সুন্দরের ভবিতব্য। যে ছবিতে তার কাঙ্খিত সৌন্দর্যে পৌঁছে দেওয়ার মুরোদ আমার নেই, সেই ছবি আমি আঁকব কেন? আমি সব সহ্য করতে পারি স্যর, সুন্দরের অপমৃত্যু যে কিছুতেই সহ্য করতে পারি না।”

বেড থেকে আরও একটা স্কেচ হাতে তুলে নিতে গেলেন ডাক্তার, লোকটা বলল, “ওইটা না স্যর, এইটা।” মেঝেতে পাতা আর একটা ছবি তুলে নিয়ে এগিয়ে ধরে, “এইটায় অনেকটা এসেছে। শেষ বার যেমন দেখেছিলাম, তার প্রায় কাছাকাছি এসেছে। তার পর আরও দশটা বছর কেটে গেছে। তবু চেনা যাবে, আশা করা যায় এই ছবিটা দেখলে দিব্যি চিনতে পারবেন।”

এক ভাবে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার পাল, ভিতু ভিতু চোখদু’টো জ্বলে ওঠে লোকটার, “একটা উপকার করবেন স্যর? এই ছবিটা আপনার কাছে রাখবেন?”

“সে রাখতেই পারি কিন্তু কেন?”

“না মানে আমার তো খুব দুর্বল হার্ট, আর আপনার নার্সিংহোমে আইসিসিইউ নেই। কাল যদি ওটিতেই ভালমন্দ কিছু হয়ে যায় তা হলে এই ছবিটা আপনি ওকে পৌঁছে দিতে পারবেন? ঠিকানা আমি লিখে দিচ্ছি, আপনি শুধু পৌঁছে দেবেন আর কিচ্ছু করতে হবে না, কিচ্ছু বলতেও হবে না।”

“কথা দিচ্ছি, পৌঁছে দেব। কিন্তু যদি আপনার কিছু না হয়, অপারেশনের পর বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকেন, তা হলে কী করবেন?”

ফুসফুস ফাঁকা করে হাওয়া বার করে দিয়ে লোকটা বলে, “আর বেঁচে থাকা! এই হাতটা, এই আঙুলগুলো ছাড়া বেঁচে থাকা মানে কী হবে আমি জানি না? বাঁচলেও আর ক’বছরই বা বাঁচব, যে রোগে ধরেছে তাতে আপনারাই তো বলেছেন, আর খুব বেশি হলে তিন-চার বছর।”

“তাতে কী, বাঁচার কী কোনও বিকল্প হয় নাকি? নার্সিং হোমে প্রতিদিন মৃত্যু দেখতে দেখতে মনে হয়, মৃত্যুর সামনে একটা বাড়তি দিনও বেঁচে থাকার মানে যাকে বলে স্বর্গ, তা হলে একটা গোটা বছরকে আপনি কী বলবেন? সামনের তিন বছরে কত কিছু হয়ে যেতে পারে, পৃথিবী অবধি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তো আমি-আপনি কোন ছার?”

“হ্যাঁ তা তো বটেই, তা তো বটেই।” মুখটা জ্বলে উঠল। নুইয়ে পড়া শরীরটা পিছন দিকে টেনে তুলল লোকটা।

“এ বার বলুন, এখান থেকে বেঁচে ফিরলে নিশ্চয়ই ছবিটা আমার কাছে রেখে যাবেন না? ওটা সঙ্গে নিয়েই ফিরবেন নিশ্চয়ই?”

“ফিরলে তো আর ওটা রেখে যাওয়ার কোনও মানে থাকবে না, তাই না?”

“সে তো বটেই,” নম্র হাসেন, টো-এর উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন ডাক্তার, “বাড়ি নিয়ে গিয়ে কী করবেন? নিশ্চয়ই নিজের ঘরের টাঙিয়ে রাখবেন?”

“হ্যাঁ ভাবছি তাই রাখব, সব সময় চোখের সামনে থাকে এমন কোনও জায়গায় টাঙিয়ে রাখব। যাতে ভোলা না যায়, এক মুহূর্তের জন্যেও ভোলা না যায়...”

“কাকে ভোলা না যায়, সেই মেয়েটিকে?”

“না না, তাকে কেন? এক্কেবারে না, ভুলেও না। তাকে মনে রাখার সব অধিকার আমি অনেক দিন আগেই হারিয়েছি।”

“তা হলে কাকে?”

“যে লোকটা এক সময়ে এমন সব রেখা টানতে পারত, তাকে ছাড়া আর কাকে? আর কিছু থাকুক না থাকুক, তার জন্য কিছুটা গর্ব তো অন্তত বেঁচে থাক! আর তার পাশাপাশি এক বুক ঘৃণা...”

“ঘৃণা! কেন?”

“কেন আবার? যে মানুষটা সাদা কাগজের ওপর এমন বলিষ্ঠ রেখা টানে অথচ বুকে সামান্যতম বল নেই, সব জেনেশুনেও যে কিছুতেই যেতে চায়নি তাকে আটকানোর মতো বলটুকুও নেই, ঘৃণা ছাড়া সে আর কী চাইতে পারে?”

ভাঙা দরজায় ঝোড়ো হাওয়ার শব্দের মতো ঝনঝনে শোনায় লোকটার গলা। লোকটা মাথা নিচু করে, পুরোপুরি ঝুলিয়ে দেয় বুকে।

লোকটার কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেন ডাক্তার, কী বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। কিছু ক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চকিতে বাঁক নেন পিছনে। পরদা সরিয়ে ঘর ছেড়ে  বেরিয়ে আসেন।