অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে নিলাম। খুবই দুঃখজনক, কিন্তু সত্যটা মেনে নিতে বাধ্য হলাম যে আর ছোট হতে পারব না।
২০২২-এ এসে ১৫ বছরের একটা ছেলেকে মনে পড়ে। এসএসসি পরীক্ষা সামনে তার। ছেলেটা নিঃসন্দেহে আমি। আর কে হবে? বয়স আর কত হবে তখন? ১৫ হয়তো। গায়ে–গতরে বেড়ে উঠেছি বেশ। লম্বায় প্রায় ৬ ফুট। বন্ধুরা মাথা উঁচু করে কথা বলে আমার সঙ্গে।
এরপর কী হলো কে জানে। ছোট হতে শুরু করলাম। ছোট হওয়ার ব্যাপারটা প্রথম আবিষ্কার করি প্রিটেস্ট পরীক্ষার ঠিক আগে আগে।
এমন এক মফস্বলে আমি বেড়ে উঠেছি, যে শহরে প্রেম এসেছিল কোভিডের মতো। সেই ’৯৫-সালেই। আক্রান্ত হয়নি এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। টিফিন পিরিয়ডে দল বেঁধে সবাই যেত গার্লস স্কুলের সামনে। শিস দিয়ে সোলস কিংবা এলআরবির গান তোলা তখন ছিল ফ্যাশন। দেয়ালে দেয়ালে লেখা থাকত:
কবীর+নওরিন,
প্রিতম+রুমা।
তো এই মহামারিতে একদিন আমিও আক্রান্ত হলাম। ইংরেজি পড়তাম সুজয় স্যারের কাছে। আমাদের ব্যাচে মেয়ে ছিল সাতটা। তাদের মধ্যে একজনের নাম ইভা। দেখতে ভারি মিষ্টি। চুলে দুবেণি বাঁধত। চোখগুলো হরিণের মতো। ভয় ছিল সে চোখে, কিন্তু ছটফটানিও টের পাওয়া যেত।
ইভা আমাকে ওর নোট খাতা ধার দিয়েছিল। সেই খাতা ফেরত দেওয়ার সময় কী মনে করে ভেতরে একটা কবিতা ভরে দিয়েছিলাম। ঠিক কবিতাও ছিল না সেটা। তখন এলআরবির নতুন এক অ্যালবাম মাত্র বাজারে এসেছে। সাউন্ডটেক থেকে বের হওয়া ফিতার ক্যাসেট। কাভারে লেখা ছিল:
এ শহরে আমার কোনো বন্ধু ছিল না,
ছিল উন্মাতাল পদ্মায় ছিপ নৌকার মতো—
এক বিষণ্ন কিশোরী।
সেই কথাগুলো চিরকুটে হুবহু টুকে দিয়েছিলাম। পরদিন থেকে ইভা আর সুজয় স্যারের বাসায় আসেনি। সেই আমার ছোট হওয়ার শুরু।
এরপর থেকে নানাভাবে একটু একটু করে ছোট হয়েছি। প্রতিবার পায়ের ওপর ভর দিয়ে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছি। লাভ হয়নি।
আমার প্রেমে পড়ার অনুপাতটা একটু বেশি। ৪: ১ অর্থাৎ প্রতি চারজন মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলে অন্তত একজনের প্রেমে পড়ে যাই। দুর্ভাগ্য যে মেয়েরা এখনো আলু, পটোলের মতো সস্তা হয়ে যায়নি। তারা আমার প্রেমে পড়ে না। আমি একাই পড়ি। আর ছটফটিয়ে ছোট হই।
এরপর প্রপোজ করি টুম্পাকে। কলেজে এক বছর পার করে ফেলেছি তত দিনে। সেখানে একটা নিয়ম ছিল। সবাইকে কোনো না কোনো এক ক্লাবের সদস্য হতে হবে। কী মনে করে আমি যোগ দিলাম ড্রামা ক্লাবে। মার্শাল ভাই ড্রামা ক্লাবের সভাপতি। নবীনবরণ উপলক্ষে তিনি নিজেই একটা নাটক লিখলেন। সেই নাটক মঞ্চস্থ হবে। এবার পাত্র–পাত্রী নির্বাচনের পালা। ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়েকে করা হলো সেই নাটকের নায়িকা। মেয়েটার নাম টুম্পা।
টু্ম্পাকে আমরা এর আগে কখনো দেখেনি। ওর বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সে বছরই বদলি হয়ে এসেছেন আমাদের শহরে।
টুম্পা হলো এমন এক মেয়ে যে কখনো ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে পারবে না। হাজার মানুষের মধ্যেও তাকে আলাদাভাবে চোখে পড়বে। তবে সৌন্দর্য নিয়ে তার আদিখ্যেতা নেই। সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশে যেতে পারে। বলা যায়, সে যে সুন্দর এই ব্যাপারটা নিয়ে তার ন্যাকামো নেই।
টুম্পার বিপরীতে নায়ক হওয়ার সুযোগ মার্শাল ভাই হাতছাড়া করার লোক নন। স্ক্রিপ্টটা আগে ছিল কমেডি ধরনের। দুরাত জেগে তিনি ওটাকে পুরোপুরি রোমান্টিক নাটক বানিয়ে ফেললেন। লম্বা–চওড়া ছিলাম বলে আমাকে দেওয়া হলো পাড়ার মাস্তানের একটা পার্ট। আমার কাজ হলো, রাস্তাঘাটে নায়িকাকে উত্ত্যক্ত করা এবং শেষ দৃশ্যে নায়ক মানে মার্শাল ভাইয়ের হাতে আড়াই মণ ওজনের এক থাপ্পড় খাওয়া।
এ ধরনের চরিত্র করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। গুনে দেখলাম, রিহার্সালে অন্তত শ দুয়েক বার মার্শাল ভাই আমাকে চড় মারছেন। তারপর টুম্পার হাত ধরে বলছেন, ভয় নেই। আমি আছি তো।
ভাইয়ের হাতে চড় খেতে আমার আপত্তি নেই। তবে সেটা কিছুতেই টুম্পার সামনে না। আমি অভিনয় করব না জানিয়ে প্রম্পটের দায়িত্ব নিলাম। রিহার্সাল চলতে লাগল সমানে। সবাই রেডি। পোস্টারে ছেয়ে গেল শহর। বলাই বাহুল্য, পোস্টারের টাকা মার্শাল ভাই নিজের পকেট থেকে দিলেন।
নবীনবরণের ঠিক আগের দিন ভাইয়ের চিকেন পক্স হলো। এ অবস্থায় অভিনয় সম্ভব নয়। সমস্যা হলো, মার্শাল ভাই নিজেই নাটকটা লিখেছেন। তাই মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের জন্য কয়েক শ সংলাপ লেখা হয়েছে। সেই সংলাপ এক দিনে তোলা নতুন কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বিছানায় শুয়ে করুণ স্বরে ভাই বললেন, হিমেল…তুই তো প্রম্পট করছিস। পুরোটা মুখস্থ আছে তোর। তুই–ই করে ফেল। নাহলে নাটকটা ডুববে।
নাটক ডুবল না। যথাসময়ে মঞ্চস্থ হলো। প্রচুর হাততালি পেলাম আমরা।
ডুবলাম আমি। টুম্পার প্রেমে এমনভাবে ডুবলাম যে ভেসে ওঠার কোনো উপায় রইল না। মাথা খারাপের মতো অবস্থা হয়ে গেল আমার।
ইভাকে চিরকুট দিয়েছিলাম। কাজ হয়নি। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম, পুরোনো রাস্তায় হাঁটা যাবে না। কিন্তু নতুন রাস্তাটা কী? সিনেমায় দেখেছি, প্রপোজ করার সময় ফুলটুল দেয়। তারপর মাখনের মতো মোলায়েম স্বরে বলে, লাভ ইউ।
পুরো প্রক্রিয়াটা অসম্ভব বোকা বোকা। এদিকে টুম্পা বেশ স্মার্ট মেয়ে। এ ধরনের ন্যাকামো করলে হেসে ফেলতে পারে। স্মার্ট কিছু একটা করতে হবে।
সুনীলের লেখার পাঁড় ভক্ত ছিলাম তখন। আমার কাছে স্মার্টনেসের সর্বোচ্চ মাপকাঠি তখন পশ্চিম বাংলার ওই কবি। একদিন সাহস করে সুনীলের থেকে দুটো লাইন ধার করে টুম্পাকে বললাম, বুকে প্রচণ্ড অসুখ আমার। একবার তোমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরতে পারলে অসুখটা সেরে যেত।
টুম্পা বলল, অসভ্য।
‘অসভ্য’ শব্দটা শুনে পালাতে চেয়েছিলাম সভ্যতা থেকে। এমন একটা শহর পেয়ে গেলাম, যেখানে মানুষগুলো খুব একটা সভ্য নয়। সেই আদিম শহরের নাম ঢাকা। এইচএসসি পাস করার পর রাজধানী চলে এলাম। সেখানে যে যার নিজের মতো করে অসভ্য। আমার জন্য একেবারে আদর্শ শহর।
সেই অসভ্য শহর আমাকে প্রথম চুমু খেতে শেখায়। প্রথম শরীরসংক্রান্ত অভিজ্ঞতাও আমার এ শহরে। বিয়ে এবং ডিভোর্সও। মাঝখানের সময়টাতে ৬ ফুট থেকে কমতে কমতে আমি ৫ ফুটে এসে ঠেকেছি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন মাটিতে মিশে যেতাম। নিজেকে বাঁচানোর জন্য কিছু একটা আমাকে করতেই হতো।
দেখতে শুনতে আমি যে খারাপ তা কিন্তু না। আমি হিমেল। পুরো নাম হিমেল মাহমুদ। লেখালেখির টুকটাক বদভ্যাস আছে। আর সেই সুবাদে নামি একটা অ্যাড ফার্মে কপি সুপারভাইজারের চাকরি করি। বেতন কম না। কিছুদিন আগে পুরোনো টয়োটা স্টারলেটটা বিক্রি করে ঝকঝকে প্রিমিও নিয়েছি। স্বাস্থ্য ভালো, ডার্ক কমপ্লেক্সন। নাক লম্বা। বিছানায় আমার পারফরম্যান্স ম্যাড়মেড়ে নয়। যাদের সঙ্গে বিছানায় গেছি তারা অন্তত এ নিয়ে অভিযোগ করেনি। তবু হলো না। রহস্যময় কোনো কারণে মেয়েদের সঙ্গে আমার হয় না।
সিদ্ধান্ত নিলাম, জীবনটাকে এবার একটু সহজ করতে হবে। একটা টেকনিক আবিষ্কার করলাম—খুব সহজ এবং সাধারণ, কিন্তু কার্যকর টেকনিক। সিদ্ধান্তে এলাম, প্রেম বা ভালোবাসা দ্বিপক্ষীয় কোনো বিষয় নয়। পারস্পরিক সাহায্য–সহযোগিতার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। একা একা চালানো যাবে।
এরপর আমি প্রায় প্রতি মাসেই একজনের সঙ্গে প্রেম করি। যাদের সঙ্গে করি, তারা কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানে না। নিজেকে দুটো ভাগ করেছি। এক ভাগে আমি নিজে এবং অন্য ভাগে সেই মেয়ে, যাকে আমার পছন্দ হয়েছে। নিজেই প্রপোজ করেছি, নিজেই রাজি হয়েছি। বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, এই তো?
ব্যাখ্যা করছি।
গত অক্টোবরের ঘটনা। সকাল থেকে জ্বর জ্বর লাগছিল। আয়নায় তাকিয়ে দেখি চোখ দুটো লাল। এ সময়ে জ্বর হওয়াটা বেশ বিপজ্জনক। করোনা বলে সন্দেহ করে লোকে। আশার কথা হচ্ছে, গন্ধ পাচ্ছি। খাবারে রুচি আছে, শরীরে ব্যথাও নেই। সুতরাং করোনা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
অফিসে যেতেই হবে। একটা প্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা ক্লায়েন্টকে। প্রজেক্টটা শুরু থেকেই আমি ডিল করেছি। ইনস অ্যান্ড আউটস অফিসের অন্য কেউ জানে না। তাই কাউকে কাজটার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারব না।
বাধ্য হয়ে ১১টার দিকে অফিস গেলাম। প্রেজেন্টেশনের মধ্যে একবার মাথা চক্কর দিল। এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুরু করলাম।
মিটিং শেষ হলো বেলা দুটোয়। এরপর লাঞ্চ। সবাই খেতে বসলেও আমি রুমে এসে ডেস্কে মাথা দিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল কপালে একটা নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে। তাকিয়ে দেখি, কাশপিয়া। মেয়েটা অফিসে নতুন জয়েন করেছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখেও সে কপাল থেকে হাত সরাল না। বলল, আপনার তো বেশ জ্বর ভাইয়া।
বললাম, হুম।
কখন থেকে?
সকাল থেকে।
টেম্পারেচার দেখছেন?
না।
দাঁড়ান। একটা থার্মোমিটার আনানোর ব্যবস্থা করতেছি।
বললাম, বাদ দাও। লাগবে না। আমি বাসায় চলে যাই। আর তুমি যে আমার কপালে হাত রাখলা, ভয় করে না তোমার?
কিসের ভয়?
আমি তো কোভিড পজিটিভ হতে পারি। পারি না? তখন…তোমারও তো হবে।
হলে হবে, হু কেয়ারস। আমার অলরেডি একবার হইছে ভাইয়া। ডাবল ডোজ ভ্যাকসিনও নেওয়া আছে। এত ভয় পাই না।
কথাগুলো বলার সময় কাশপিয়া একবারের জন্যও আমার মাথা থেকে হাত সরায়নি। এটুকুই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য। কাশপিয়াকে ভালোবেসে ফেললাম। এখন থেকে সে আমার। আমার নিজস্ব পৃথিবীতে তাকে প্রপোজ করলাম এবং সে একবাক্যে রাজি হলো। পুরোটাই মনে মনে।
ধরা যাক, বাস্তবে আমি তাকে প্রপোজ করলাম। সে হয় ‘হ্যাঁ’ বলত অথবা ‘না’। ‘না’ বললে ছোট হতাম। আবার ‘হ্যাঁ’ বললেও বিপদ। সেই ‘হ্যাঁ’টাকে সম্মান দেওয়ার মতো ম্যাচিউরিটি আমার নেই। দায়িত্ব নিতে পারি না। অতীতে প্রমাণিত। তার চেয়ে এই ভালো।
এরপর প্রায় এক মাস আমি কাশপিয়াকে ভালোবাসলাম। ওর সঙ্গে বাতিঘরে গেলাম, বই কিনলাম। বেঙ্গল গ্যালারিতে চা-শিঙাড়া খেলাম। দুরাত সে আমার বাসায় থেকে গেল এবং আমরা পাগলের মতো আদর করলাম একে অন্যকে। কাশপিয়া কিন্তু এসবের কিছুই জানল না।
অক্টোবরে দেখা হলো সিলভির সঙ্গে। পুরোটা মাস আমি সিলভির নামে উইল করে দিলাম। সিলভিও আমাকে ভালোবাসল। কিন্তু এ কথাটা সে কখনো জানতে পারবে না।
এভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছে আমার। ভালোবাসায়—৪: ১ অনুপাতে।
এখন আর পৃথিবীতে একটা মেয়েও নেই, যাকে ভালোবেসে আমি ব্যর্থ হতে পারি!