Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla/2021-01/1d75151c-eff9-4e9f-ac28-aebc4618d00f/palo_bangla_og.png />

সন্ধ্যার অরিগ্যামি

সাদাত হোসাইন



অ্যারোপ্লেনকে সোহান লিখত পাখি। অণুকেও। ছাদের কার্নিশে এক পা তুলে সে যখন দাঁড়াত, তখন তার চোখ থাকত বন্ধ। অণুরও। অণু অবশ্য ঠিক পাশের ছাদটাতে। মাঝখানে খানিক দূরত্ব। ওই দূরত্বটুকু দরকারি। সোহান লিখত আর অণু বলত। সোহান লিখত, ‘দূরত্ব না থাকলে কাছে আসবে কী করে?’

অণু মুখোমুখি ছাদ থেকে চিৎকার করে বলত, ‘কিন্তু দূরত্ব যদি ডিঙানো না যায়?’

সোহান হাসত। অণুর চিৎকার সে শুনতে পেত কি না, অণু জানে না। তবে তার হাসি দেখে মনে হতো, সে বলছে, ‘যাবে না কেন?’

এই প্রশ্নের উত্তর অণু জানত না। সে কেবল ওই দূরত্বের ভয়টুকু জানত। সন্ধ্যার আকাশে মুখভার মেঘ। ডুবে যেতে থাকা সূর্য। লালচে আলো। বুকের ভেতর কুয়াশা। সেসব ডিঙিয়ে মাঝখানের দূরত্বটুকু পেরিয়ে সোহানের হাত গলে পাখির মতো রোজ উড়ে আসত কাগজের অ্যারোপ্লেন। অণু হাত বাড়িয়ে ধরত। পাখিটা আসলে আস্ত এক চিঠি। তার বুকজুড়ে গল্প, কথা, কবিতা। সেখানে লেখা, ‘খুব বেশি কাছে এসে গেলে সব ঝাপসা হয়ে যায়। তখন আর কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। তাই খানিক দূরত্বই ভালো।’

অণু কাগজের অ্যারোপ্লেন বানাতে পারে না। তাই সে বলতেও পারে না, ‘কাছে না গিয়েও দূরত্বটুকু ডিঙাব কী করে!’কিন্তু তার কিছুই বলা হয় না। তবে সে-ও একদিন কাগজের অ্যারোপ্লেন বানানো শিখে যাবে। কিংবা পাখি। তারপর তার আদ্যোপান্ত শরীরজুড়ে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেবে আকাশের ঠিকানায়। সোহান ঠিক লুফে নেবে। এই খেলাটা অদ্ভুত। এই দুঃসহ সময়ে রোজ সন্ধ্যার ছাদ। থমকে যাওয়া স্তব্ধ শহর। জানালার আড়ালে মানুষ। মানুষের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে কান্না। সেসব লুকিয়েও মানুষ হাসে। অণুও। তার খুব ইচ্ছে হয় খানিক কথা বলতে। সোহানের কণ্ঠ, শব্দ কিংবা হাসি শুনতে। সোহান অবশ্য নৈঃশব্দ্য ভালোবাসে। সে কথা বলতে চায় না। ওই যে একটা চড়ুই পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে এসে বসে জানালায়। একটা পাতার বুকে শব্দ তোলে দুপুরের হাওয়া। সেই হাওয়ায় ভেসে আসে মানুষের দীর্ঘশ্বাস। সেখান থেকে সোহান কেবল নিজের দীর্ঘশ্বাস কিংবা দীর্ঘশ্বাসের শব্দটুকুই আলাদা করতে পারে না। অণুও পারে না। প্রথম যেদিন সোহানকে দেখল অণু, সেদিন কেবল লক ডাউনের শুরু। এমনিতে ছাদে আসা হয় না তার। ক্লাস, টিউটোরিয়াল, অ্যাসাইনমেন্টের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা জীবন। সেখানে বিকেলের বিষণ্ন আলো আর মন কেমন করা হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার ফুরসত কোথায়? কিন্তু সেদিন ছাদে দাঁড়াতেই চার দেয়ালের দমবন্ধ অনুভব যেন একঝলক দমকা হাওয়ায় হঠাৎ ভেসে গেল। আর সেই হাওয়ায় ডানা মেলে উড়ে এল একটা কাগজের অ্যারোপ্লেন। অণু খানিক থমকাল। সে নিচু হয়ে প্লেনটা তুলে নিয়ে তাকাল। সামনে সামান্য ফাঁকা জায়গা। নতুন ভবন ওঠার অপেক্ষা। সেখানে ইট-সুরকি জড় হচ্ছে। তারপরই ধূসর রঙের বিল্ডিং। ছেলেটা তার ছাদে। সে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে। অণু বিরক্ত চোখে তাকাতেই ছেলেটা বিব্রত হাসল। তারপর সংকুচিত ভঙ্গিতে মাথার দুপাশে হাত উঁচু করে দাঁড়াল। মুখে কিছু না বললেও অণু বুঝল, কাজটা সে ইচ্ছে করে করেনি। গল্পটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হলো না। দিন দুই বাদে ছাদে আসতেই ছেলেটাকে আবার দেখল অণু। বিষণ্ন, একা। তার আনমনা দৃষ্টি মিলিয়ে গেছে দূরে কোথাও। বারকয়েক ডাকবে না ভেবেও ডাকল অণু। সোহান তাকিয়ে হাসল। তারপর ভোজবাজির মতো একটা অ্যারোপ্লেন উড়িয়ে দিল হাওয়ায়। অণু ভেবেছিল, প্লেনটা ল্যান্ডিং করবে অন্য কোথাও। কিংবা মুখ থুবড়ে পড়বে মাঝপথে।প্লেন ক্র্যাশ! কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। অণু ভয়ে ভয়ে আঁচল বাড়িয়ে দিল। বিকেলের সোনারঙা আলোয় বাসন্তীরঙা শাড়ির আঁচলে আগুনে আঁচ। সেই আগুনে আঁচের আঁচলের রানওয়েতেই ধীরে এসে নামল প্লেনটা। অণু আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখল। ভাঁজ খুলতেই কথা আর কবিতা। সোহানের হাতের লেখা সুন্দর। কাগজের শরীরজুড়ে নানান আঁকিবুকি। এক বিষণ্ন তরুণের স্কেচও। ছেলেটা হয়তো সে নিজেই। তার পাশে লেখা, ‘এই রাত্রি হলে শেষ, আমিও হব পাখির মতো হাওয়ায় নিরুদ্দেশ।’অণু বলল, ‘নিরুদ্দেশ কেন হবে?’সোহান দুষ্টুমি করত। কাগজের অ্যারোপ্লেন ওড়ানো তার শখ। সে সেই অ্যারোপ্লেনে উত্তর লিখে পাঠাত, ‘হারিয়ে যাওয়া সে-ই তো ভালো, যেমন ছিলাম রোজ থেকেও, তেমন করেই হারিয়ে যাব।’ ছেলেটা কেমন অদ্ভুত! চোখ জুড়ে বিষণ্নতার মেঘলা আকাশ। তবে কান্নাটুকু লুকানো। অণু তার উড়ে আসা চিঠিগুলো মুগ্ধ হয়ে পড়ত। আর নিজেরও খুব ইচ্ছে হতো চিঠি লিখতে। তারপর অমন করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু সে তো অ্যারোপ্লেন বানাতে জানে না। অণু অবশ্য চায়ও না। সে চায় পাখি। যদি ডানা মেলে উড়িয়ে দেওয়া যেত!সোহান অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। অণু তার চিঠি পড়ে তাকাতেই দেখত ওপারের ছাদজুড়ে শূন্যতা। সোহান কোথাও নেই!কী আশ্চর্য! যেন ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে। অণুর রাগ হতো, এমন কেউ করে? কৌতূহলও হতো। সেই কৌতূহলই হয়তো তাকে টেনে নিয়ে আসত পরদিন। তার পরদিন। তারও পরদিন। বিকেল থেকে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা থেকে রাতও। কিন্তু সোহান এক আশ্চর্য খেয়ালি মানুষ। অণু একদিন চিৎকার করে বলল, ‘ফোনে কথা বলি আমরা?’সোহান মাথা নাড়ল, উঁহু। সে ফোনে কথা বলতে চায় না।তারপর উড়িয়ে দিল অ্যারোপ্লেন। অ্যারোপ্লেনের শরীরজুড়ে লেখা, ‘কাছে গেলে মনে হয়, এত কাছে যেতে নেই, কিছুটা দূরত্বই ভালো, অথচ কাছে যাব যাব করেই রাত্রি পোহাল।’ রাত্রি অবশ্য পোহায় না। বরং সন্ধ্যা হতে থাকে। রোজ বিকেল ও সন্ধ্যার অপেক্ষায় কেটে যায় রাত্রি-দিন। অণু বলে, ‘আমাকে শেখাবে? তাহলে আমিও তোমায় লিখতে পারব! তারপর ভাসিয়ে দিতে পারব আকাশে-হাওয়ায়।’সোহান হাসে। তারপর মাথা নেড়ে জানায়, সে শেখাবে না। অণুর মন খারাপ হয়। কিন্তু রোজ রাতে জেগে জেগে সে কাগজের কারুকাজ শেখে। অণু জানত না, এটাকে অরিগ্যামি বলে। সে মুগ্ধ হয়ে শেখে। সোহানকে চমকে দেবে একদিন। কিন্তু অ্যারোপ্লেন নয়, সে বানাবে পাখি। সেই পাখির শরীরজুড়ে থাকবে আঁকিবুকি। সোহান যে বলে, ‘আমি একদিন পাখি হব, একলা আকাশ, একলা ডানায় চুপটি করে পারি দেব, সঙ্গে নেব গোপন কথা, ছোট্ট বুকের বিশাল ব্যথা, ডানায় ডানায় মেঘের ভেতর সেসব কিছু ছড়িয়ে দেব।’অণু জানে না, সোহানের ছোট্ট বুকের বিশাল ব্যথাটা কী! সোহান বলেও না। তবে তার মুখ না বললেও বিষণ্ন চোখজোড়া অনেক কিছুই বলে। অণুর কষ্ট হয়। কিন্তু ওই দূরত্বটুকু পেরোতে পারে না সে। এক সন্ধ্যায় সোহান লেখে,’আর মাত্র কটা দিন। তারপর চলে যাচ্ছি।’অণু হতভম্ব গলায় বলে, ‘কোথায়?’সোহান লেখে, ‘বাড়িতে।’‘বাড়িতে?’‘হুম, আমি তো এখানে থাকি না। মাকে নিয়ে এসে হঠাৎ আটকে পড়েছিলাম। এবার চলে যেতে হবে বাড়ি।’অণুর খুব ছটফট লাগে। সোহান নিজেকে কেন এমন গুটিয়ে রাখে, সে জানে না। কোথায় যেন একটা আড়াল। সেই আড়ালটা ধরতে পারে না অণু। তবে তার কষ্ট হয়। ফোন নম্বরটা অবধি সে দিতে চায় না। কথা তো নয়ই। অণু পাখি বানানো শিখে গেছে। পাখির শরীরজুড়ে চিঠি। উড়ে উড়ে চলে যাবে ঠিকানায়। সোহান অন্তত জানুক, তার বুকেও মেঘ জমেছে বৃষ্টি হবার লোভে।সেদিন সন্ধ্যায় ছাদে আসতেই চমকায় অণু। সোহান কোথাও নেই। কেবল অনেকগুলো অ্যারোপ্লেন পড়ে আছে ছাদে। এমন তো হয়নি কখনো! সে সব কটি কুড়ায়। প্রথমটার ভাঁজ খোলে। সোহান লিখেছে, ‘যেতে যেতেও ফিরে আসবার বাহানা কুড়াই, স্মৃতি-গন্ধা, অচেনা সন্ধ্যা, তোমাতে উড়াই।’তার পরেরটাতে লিখেছে, ‘তোমার নামে সন্ধ্যা নামা শহর জানে, রোজ কতটা আঁধার জমাই অভিমানে, রোজ কতটা কান্না জমাই বুকের কোণে, তোমার নামে রাত্রি গভীর শহর জানে।’অণুর বুকটা কেমন ভার ভার লাগে। চোখ জ্বালা করে। তার সামনের ছাদটা ফাঁকা। শূন্য। সোহান কি চলে গেছে?শেষ অ্যারোপ্লেনটা খুলতেই অণু চমকায়—একটা স্কেচ। সোহানের নিজের। কিন্তু সেখানে তার ঠোঁট দুখানা বন্ধ। ঠোঁটজুড়ে সুই-সুতোর সেলাই। পাশে বড় করে লেখা, আই ক্যান্ট টক।তার নিচে লেখা, তোমার কষ্ট হবে, আমি জানি। কিন্তু আমি যে কথা বলতে পারি না অণু।অণুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সোহান কথা বলতে পারে না! অথচ সে কখনোই তা বুঝতে পারেনি! অণু কাঁদে। জলের ফোঁটায় অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে থাকে। সেই ঝাপসা অক্ষরে সোহানের শেষ চিঠিটা আরও ঝাপসা হয়ে যায়। সোহান সেখানে লিখেছে, ‘জানি যাচ্ছি, ফেলে সন্ধ্যা, সাথে তোমাকেও, স্মৃতিগন্ধা।’অণু পাগলের মতো তার পাখিটাকে ওড়ায়। পাখিটার বুকভর্তি কত কত কথা, গল্প, কবিতা। কিন্তু অণু জানে না, কাগজের পাখি উড়তে জানে না। ডানা ভাঙা পাখির মতো সে মুখ থুবড়ে পড়ে নিচে ফাঁকা জায়গাটাতে।

ওই দূরত্বটুকু আর ডিঙানো হয় না। না অণুর, না পাখির।