Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla/2021-01/1d75151c-eff9-4e9f-ac28-aebc4618d00f/palo_bangla_og.png />

লোকটা

শিবব্রত বর্মন



আষাঢ় মাসে আজগুবি সব গপ্পগাথা বলা বাঙালির ঐতিহ্য। এই সংখ্যায় থাকল সমকালীন তিন লেখকের লেখা কল্পনার রঙে রঞ্জিত তিনটি উদ্ভট আষাঢ়ে গল্প

‘একটা লোক—দুনিয়ার সাত শ কোটি লোকের মধ্যে একটা লোকের জন্য এত কিছু। সেই লোকটা কে, কেউ জানে না। সে লম্বা না খাটো, মোটা না শুকনা, জানার উপায় নাই। এমনকি লোকটা নারী না পুরুষ, সেটাও বোঝা মুশকিল। তবে লোকটাকে খুঁজে বের করা জরুরি। দুনিয়াটাকে বাঁচানোর জন্যই জরুরি। আমি লোকটাকে খুঁজছি। বোঝার চেষ্টা করছি তার অবস্থান।

‘লোকটা শুরুতে ছিল ইউরোপের একটা দেশে। পশ্চিম ইউরোপের কোনো শহরে। পরে অবস্থান বদলেছে। দ্রুত বদলেছে। আরও পশ্চিমে সরে গেছে। সম্ভবত ফ্রান্সে। কিন্তু তারপর সে কি প্লেনে চেপে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আরও পশ্চিমে আমেরিকার দিকে চলে গেছে, নাকি এশিয়ার দিকে এসেছে, বোঝা শক্ত। তবে আমি বলে দিতে পারি, কোন কোন জায়গায় লোকটার থাকার কোনো সম্ভাবনা নাই। এটা আপনি লিখে রাখতে পারেন যে সে নিউজিল্যান্ডে নাই। নর্থ কোরিয়াতে নাই। তুর্কমেনিস্তানে নাই। প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশগুলা, যেমন ধরেন কিরিবাতি, সলোমন আইল্যান্ড, নাউরু—এই সব জায়গায় নাই। আফ্রিকার দেশগুলাতেও তার থাকার সম্ভাবনা কম।

‘লোকটাকে আমি খুঁজছি, কারণ আরেকটা সত্তা লোকটাকে খুঁজছে। বেপরোয়াভাবে খুঁজছে। দুনিয়া তোলপাড় করে খুঁজছে। সেই সত্তাটার নামধাম আমি জানি না, কিন্তু তার কর্মকাণ্ড জানি। আমরা সবাই তার কর্মকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি। শুধু দেখতে পাচ্ছিই না, হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। তার কর্মকাণ্ডের কারণে সবার নাভিশ্বাস উঠে গেছে।’

এটুকু বলে অরুণ সরকার চুলায় ডাল চাপিয়ে দিলেন। আমি তার সংকীর্ণ ঘরের এক কোনায় চৌকির ওপর বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছি। পাশে একটা ছোট জানালা দিয়ে দুপুরবেলার নাজিমুদ্দীন রোডের একটা অংশ দেখা যায়। রাস্তা ফাঁকা। কারফিউয়ের মতো। সারা ঢাকা শহরই ফাঁকা। কোভিডের কারণে।

আমি বললাম, ‘কী সেই কর্মকাণ্ড?’

‘দেখতেই পাচ্ছেন, দুনিয়াজুড়ে কেমন কেয়ামত নেমে এসেছে।’

‘কেয়ামত নেমেছে একটা লোকের জন্য?’

‘একটা লোকের জন্য।’

‘কে খুঁজছে লোকটাকে?’

‘ওই যে বললাম, একটা সত্তা।’

‘সেই সত্তা কি চায় লোকটার কাছে?’

‘লোকটাকে আক্রান্ত করতে চায়।’

‘কী দিয়ে?’

‘যেটা দিয়ে, আপনারা সেটার নাম দিয়েছেন জীবাণু।’

‘তা আক্রান্ত করে মেরে ফেলতে চায়?’

‘সম্ভবত। আমি নিশ্চিত নই।’

অরুণ সরকার গোসল করতে বাথরুমে ঢুকলেন। আমি তার ছোট্ট কক্ষটা দেখছি। একপাশে কেরোসিন স্টোভে ডাল ফুটছে। লকডাউন পেরিয়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

আমি বাথরুমের বাইরে থেকে উচ্চ স্বরে বললাম, ‘কিন্তু এটা তো কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না।’

ভেতরে গায়ে পানি ঢালার শব্দ। বুদ্‌বুদের মতো আওয়াজ করে অরুণ সরকার বললেন, ‘বেশ তো, আপনারা ব্যাখ্যা করতে পারছেন? কোভিড বলেন আর করোনা—এই জীবাণুর স্বভাব-চরিত্র আপনারা আগামাথা কিছু বুঝতে পারছেন? কেউ পারছে? বিজ্ঞানীরা পারছে? একেকবার একেক কথা বলছে।’

আমি চুপ করে থাকলাম।

গোসল সেরে খালি গায়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে অরুণ সরকার একটা চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসলেন।

‘শোনেন. মহামারি পৃথিবীতে এবারই প্রথম তো না। বহুবার এসেছে। ইউরোপের কথা বাদ দেন। আমাদের ভারতবর্ষেই তো কতবার মহামারি হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের আমলে কলকাতায় প্লেগ ছড়াল। মহারাষ্ট্রে ছড়াল। মানুষ কোনোবারই এগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারে নাই। এই জীবাণুরা হঠাৎ কোথা থেকে এসে উদয় হয়, আবার কখন হুট করে বিদায় নেয়, কারও কাছে আসলে ব্যাখ্যা নাই। বিশেষ করে এদের বিদায় নেওয়ার ব্যাপারটা লক্ষ করেন। রহস্যময়। আগেকার আমলে তো আপনার এই ভ্যাকসিন-ট্যাকসিন ছিল না। ব্ল্যাক ডেথ কেন বিদায় নিল, বলেন—’

‘প্রতিবারই কি একটা কাউকে খোঁজে ওরা?’

‘একটা কাউকে। একটা সুনির্দিষ্ট মানুষকে। তাকে পেয়ে গেলে তারা বিদায় নেয়। আমি দীর্ঘদিন ধরে ঘাঁটাঘাঁটি করে এইটা বুঝেছি। আপনারা যারা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত লোকজন, যারা রোগের জীবাণু তত্ত্ব ছাড়া আর কিছুতেই বিশ্বাস করেন না, তারা বুঝবেন না। জীবাণু তত্ত্ব আমরা বের করলাম এই তো দেড় শ বছর হলো। তার আগে তো অন্য নানাভাবে ব্যাখ্যা করতাম। একটা সত্তার কথাই বলতাম। ধরুন, শীতলাদেবীর কথা। ওলাবিবির কথা। ইউরোপে ওরা অন্য কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করত। ব্যাখ্যার সেই অন্য রাস্তাগুলো আমরা বন্ধ করে দিব কেন? রোগজীবাণুকে আপনারা যারা শুধু কিছু ক্ষুদ্র অণুজীবের কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন।’

আমি আর কিছু বললাম না।

একটা কাক এসে জানালায় বসেছে।

আমরা দুজন খেতে বসলাম। ভাত, ডাল আর ডিমভাজি।

খেতে খেতে অরুণ সরকার একবার আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন। তারপর নিচুস্বরে বললেন, ‘সেই লোকটার এ মুহূর্তের অবস্থান আমি বের করে ফেলেছি। লোকটাকে আমি তার গর্ত থেকে বের করে আনতে যাচ্ছি। শিগগিরই।’