Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2023-04%2F0bddec01-a5f7-4d7c-b516-25a65d66512f%2Flove_detector.jpg?rect=0%2C136%2C1500%2C788&w=1200&ar=40%3A21&auto=format%2Ccompress&ogImage=true&mode=crop&overlay=&overlay_position=bottom&overlay_width_pct=1 />

লাভ ডিটেক্টর

মোস্তফা তানিম



নওশাদের ঘুমটা ফোনের শব্দে ভেঙে গেল। অন্ধকারের মধ্যেও ঘড়ির কাঁটা দুটি জ্বলজ্বল করছে। রাত বাজে সাড়ে চারটা। ফোন করেছে রাফি। নওশাদ ধরল না। রিঙ্গার অফ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ যেতেই আবার ঘুমটা ভেঙে গেল। মেজাজ খারাপ। ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। ছয়টার আগে সে তো ওঠে না! এবার কলবেলের শব্দ। রাফি নয় তো?

চোখ প্রায় বন্ধ রেখেই নওশাদ উঠল। স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছে না। একটা জামা যে গায়ে দেবে, সেটাও যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। ওদিকে অসহিষ্ণু কলবেল বেজেই চলেছে।

দরজা খুলতেই নওশাদের চক্ষু চড়কগাছ। রাফি সত্যিই সামনে দাঁড়িয়ে! উদ্‌ভ্রান্তের মতো দেখা যাচ্ছে। এই কয় মাসে অনেক শুকিয়েও গেছে। তবে মুখে খুশির উত্তেজনা। নওশাদকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে নিয়ে এল। নিজেই ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেল। পাগল বন্ধু থাকলে অনেক সমস্যা। এদের রাখাও যায় না, ছাড়াও যায় না।

রাফি বলল, সে নাকি সাংঘাতিক একটা আইডিয়া পেয়ে গেছে। সে হয়তো জাকারবার্গের সমান হয়ে যাবে। যা–ই হোক, এই পাগল কখন কী বের করে ফেলে, ঠিক নেই। আইডিয়াটা বলার আগে রাফি এদিক-ওদিক দেখে নিল। এমনকি জানালার কাছে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিল। তারপর সোফায় বসে ফিসফিস করে বলল, ‘সাংঘাতিক! সিম্পলি সাংঘাতিক!’

ঘুমে-বিরক্তে নওশাদ চুপ করেই থাকল। এই কয়েক মাস কোনো খবর নেই, ফোন পর্যন্ত ধরে না, এখন ভোররাতে এসেছে সাংঘাতিক শোনাতে! তো সাংঘাতিকটা তাড়াতাড়ি বলে ফেললেই হয়? আর না বললে ঘুমাতে দে না বাবা, আমি কি শুনতে চেয়েছি? এসব অবশ্য নওশাদকে বলতে হলো না। তার আধবোজা নির্বিকার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। 

‘আচ্ছা আচ্ছা, বলছি।’ আরেক ধাপ গলা নামিয়ে বলল, “লাভ ডিটেক্টর” আবিষ্কার করেছি!’

নওশাদ সামান্য নড়েচড়ে, চোখ খুলে বলল, ‘মানে? “লাভ ডিটেক্টর” কী?’

‘এইটাই তো ব্যাপার! “লাভ ডিটেক্টর” তো নেই! কেউ চিন্তাই করেনি! কম্পাসের মতো বা মনে কর মেটাল ডিটেক্টরের মতো, কিন্তু এটা “লাভ” ডিটেক্ট করবে। ধর, তোর পকেটে এটা আছে। দূরে একটা মেয়ে যাচ্ছে। তোকে দেখে তার ভেতর তোর জন্য হালকা ভালোবাসা জন্ম নিল। ডিটেক্টরের কাঁটাটা তার দিকে ঘুরে যাবে। তারপর কাঁটাটার রং কমলা হয়ে যাবে। বেশি প্রেম সৃষ্টি হলে রং লাল হয়ে যাবে।’

‘হুম…, এইটা কীভাবে করা সম্ভব?’

 ‘সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। ব্রেন ওয়েভ অ্যানালাইজ করব। আর গেশ্চার, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন—এসব থেকে সব জানা যাবে।’

নওশাদ বিশ্বাস করবে কি না বুঝতে পারছে না। সবাই রাফিকে বড় প্রতিভাই বলে। তাই বলে এও সম্ভব?

 ‘বুঝতে পারছিস কী সাংঘাতিক?’

 ব্যাপারটা নওশাদের কাছে সাংঘাতিক মনে না হলেও, ইন্টারেস্টিং মনে হলো। কিন্তু এটা কীভাবে কাজ করবে তার মাথামুণ্ডু সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

‘লাই ডিটেক্টরের মতো?’

একটু থেমে রাফি বলল, ‘অনেকটা ও রকম, কিন্তু এটা দূর থেকে কাজ করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে কাজ করছে। ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন নিচ্ছে। শুধু চোখের দৃষ্টি কোন দিকে তা না, পিউপিলের এপারচার বড় হচ্ছে কি না, স্টেপিং বা অন্য গেশ্চারে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না, সব ধরে ফেলবে।’

‘হুম…, তাতেই কি “লাভ” সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়?’

 ‘গুগল এআই ব্যবহার করছি; লেটেস্ট। তিন মিলিয়ন ‘সিড ডেটা’। ইউটিউব আর স্ট্রিট ক্যামেরার পাবলিক ভিডিও থেকে নিয়েছি।’

তার মানে ব্যাটা কি এই যন্ত্র ইতিমধ্যেই আবিষ্কার করেছে?

‘আরও আছে। ব্রেন ওয়েভ—ব্রেন ওয়েভ ধরছি। তাতে দারুণ সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ওয়েভ প্যাটার্ন প্রেমের মানুষকে দেখলে হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে যায়। এমপ্লিচুড কমে যায়, একটা সাইক্লিক প্যাটার্ন চলে আসে। যত বেশি প্রেম, তত দ্রুত এই সাইক্লিক প্যাটার্ন চলে আসবে।’

এবার নওশাদকে উঠে বসতেই হলো। সে বলল, ‘তুই কি এই যন্ত্র তৈরি করে ফেলেছিস?’

‘হ্যাঁ, এবং সেটা কাজ করছে!’

‘বলিস কী!’

নওশাদের ঘুম সম্পূর্ণই ছুটে যায়। এ জন্যই পাগলকে ফোন দিয়ে পাওয়া যেত না! গত চার মাস দেখাই নেই!

রাফি তার ফোনটা বের করে দেখাল। আইফোন, সেখানে সে কী কী যেন লাগিয়েছে। সঙ্গে ছোট্ট একটা ম্যাচ বাক্সের সমান সাদা যন্ত্র জোড়া দেওয়া। সে ফোনে একটা ‘অ্যাপ’ খুলল। সেখানে কালো ডায়ালের ওপর একটা ধবধবে সাদা রঙের কম্পাসের কাঁটার মতো দেখা যাচ্ছে। কাঁটাটা এদিক-ওদিক ঘুরছে কিন্তু স্থির হচ্ছে না। এই তাহলে ‘লাভ ডিটেক্টর’ যন্ত্র!

রাফি বলল, ‘এই সাদা বক্সের মধ্যে ব্রেন ওয়েভ ডিটেক্টর আছে। এটা আমার বানানো প্রোটোটাইপ। কমার্শিয়ালি বানালে এটা ফোনের অংশ হয়ে যাবে। ফোন সামান্য পুরু হবে এই যা, তবে এমন বেঢপ দেখাবে না। দামেও বেশ কম পড়বে।’

ফোন ছেড়ে এবার পাগলের মুখের দিকে তাকাল নওশাদ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি কিছু সে বের করে ফেলেছে।

‘এটা কাজ করে? পরীক্ষা করে দেখছিস?’

 রাফির উত্তেজিত মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, করে। পলির সঙ্গে যখন সন্ধ্যায় দেখা হলো, তখন দেখলাম কাঁটাটা তার দিকে ঘুরেছে। প্রায় লাল রং হয়ে গেছে। আর আমার লাভ রিডিং চলে গেছে ২ “Me”!’

 ‘তোর লাভ রিডিং ২ “Me” মানে কী?’

‘মানে, এই যন্ত্র পলির প্রতি আমার কতটুকু ভালোবাসা হচ্ছে, সেটাও বের করতে পারে।’

‘আচ্ছা, কিন্তু “Me”টা কী?’

‘সেটা ভালোবাসার ইউনিট। ১ “Me” মানে, আমি নিজের জন্য যতটুকু করব, তার আনন্দের জন্য ততটুকু করতে প্রস্তুত।’

নওশাদের কাছে এ সম্পূর্ণ নতুন। ভালোবাসা আবার মাপা যায়? তার ইউনিট আছে? কিন্তু সেদিকে কথা না বাড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘এটার ব্যবহার কী হবে বল তো? এতে অনেক মুশকিল হয়ে যাবে না? গোপন কথা মানুষ জেনে ফেলবে।’

 ‘সেটাই তো! গোপন সত্যটা জানাই তো দরকার। তাহলে আর ভুল হবে না। মন যেটা চায়, সেটা সে যেভাবে প্রকাশ করে, অনেক সময় মানুষ নিজেই সেটা বুঝতে পারে না।’

‘আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। রাস্তায় একজন আমাকে ভালোবাসে কি না, সেটা বুঝে কী লাভ?’

‘শুধু রাস্তায় না, যেকোনো জায়গায়। কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে, তারপর কাজে-পার্টিতে, সবখানেই এটা কাজ করবে। বাড়িতেও করবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কতটুকু ভালোবাসা বোঝা যাবে।’

 ‘তাতে লাভ হচ্ছে কি?’

‘লাভ হচ্ছে সঙ্গী নির্বাচন। দুজনের কাঁটা যদি দুজনের দিকে নির্দেশ করে, তখন যদি প্রত্যেকের লাভ রিডিং কমপক্ষে ০.৫ “Me” হয়, তাহলে যন্ত্রটা একটা প্লেজার শক দেবে।’

‘শকও দেবে?  হুম…। আচ্ছা, একজন নায়ক বা নায়িকা, তাকে সবাই ভালোবাসে, তখন সব কাঁটা তো তার দিকে ঘুরে যাবে? তারপর, মনে কর দুই জুটির দেখা, কিন্তু কাঁটা নিজের সঙ্গীর দিকে না ঘুরে, ঘুরছে অপরের সঙ্গীর দিকে!’

‘সেটা তো হতেই পারে। ভেতরের কাঁটা যেভাবে ঘুরবে, বাইরেরটা সেভাবেই দেখাবে। ব্যাপারটার জন্য যে “লাভ ডিটেক্টর” যন্ত্রটা অনৈতিক হয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। দোষারোপ যদি করতেই হয় তো ভেতরের কাঁটাকে করতে হবে। বন্ধ করতে হলে সেটাকে করতে হবে, বাইরের যন্ত্রকে না। জ্বর মাপার যন্ত্রকে কি আমরা জ্বরের জন্য দোষ দিই?’

নওশাদ বুঝল, অনেক ভেবেচিন্তেই এসেছে রাফি। কিন্তু এত মানুষ থাকতে তার কাছে কেন এল কে জানে।

‘তাহলে কি তুই এটা নৈতিকতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে চাস? মানুষকে জোর করে নৈতিক বানানো যায়?’

‘আরে! কিসের মধ্যে কী? এর সঙ্গে নৈতিকতার কোনো সম্পর্কই নেই। কে কীভাবে ব্যবহার করবে, করবে কি না, তা তাদের মর্জি! লাই ডিটেক্টর কি সবাই ব্যবহার করছে? লাই ডিটেক্টর কি মিথ্যা কমানোর কাজে ব্যবহৃত হয়? এটা তো “লাভ” কমানোর জন্য নয়।’

কিন্তু নওশাদের কাছে এটা সবকিছু গুবলেট করে ফেলার একটা যন্ত্রই মনে হচ্ছে। মন সায় দিচ্ছে না। উপকারের উপকার সে কিছু দেখছে না। নওশাদ দুই কাপ কফি বানাল। পাগল এখনো কথা বলে যাচ্ছে। কী কী যেন থিওরি বোঝাচ্ছে। নওশাদ বিজ্ঞানের ছাত্র নয়। সে পড়েছে হোটেল ম্যানেজমেন্টে। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি নিয়ে তার কাজ। তবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি—এসব সে খুবই পছন্দ করে। রাফিকে কফি দিয়ে নওশাদ বসল তার সামনে। জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খাবি? নাকি ম্যাকডোনাল্ডসে যাব নাশতা করতে? পাঁচটা তো বেজেই গেছে।’

সে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল, যেন খাওয়াদাওয়া আবার কী? কফিও নিল না।

‘আচ্ছা, তুই এই ভোররাতে এমন যুগান্তকারী যন্ত্র¿নিয়ে আমার কাছে এসেছিস কেন?’

নওশাদকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, ‘কারণ, আমার একজন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জানতে হবে, এই যন্ত্র দিয়ে কী হতে পারে। আমি ভাবছি, সঙ্গী নির্বাচনে, ম্যারেজ কাউন্সেলিংয়ে এটা ব্যবহার হতে পারে। একজন হয়তো কিছুতেই বুঝতে পারছে না অপরপক্ষ তাকে ভালোবাসে, নাকি অভিনয় করছে। তখন এই যন্ত্র কত বড় উপকারে আসতে পারে চিন্তা করে দেখ!’

নওশাদ কঠিন বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমি সাধারণ মানুষ? আমি রাস্তার আর দশজন লোক? মোটা বুদ্ধির? আমার সম্পর্কে তোর এই ধারণা?’

রাফি ‘আরে নাহ, কী যে বলিস…’ বলে প্রবল একটা উত্তর দিতে গিয়ে কথা খুঁজে পেল না। কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে হাতের ফোনের দিকে তাকাল। মুহূর্তে তার চোখে বিস্ময়। কিছু একটা বুঝতে পারছে না এমন দৃষ্টিতে নওশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কি আমাকে এই মুহূর্তে ঘৃণা করছিস?’

সে ফোনটা এগিয়ে ধরল। সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কাঁটাটা এখন নওশাদের দিকে স্থির। সেটার রং সাদা থেকে ধূসর হয়েছে। রাফি জানাল, ধূসর নাকি ঘৃণার রং। ভালোবাসার উল্টোটা।

হ্যাঁ, এ মুহূর্তে নওশাদের রাগ হচ্ছে। ঘৃণাও বলা যায়। সামনে বসে থাকা তার বন্ধু রাফি তাকে ভাবে কী? সাধারণ মানুষ? সে নিজে অসাধারণ বলে সবাই সাধারণ? তাচ্ছিল্যের একটা সীমা আছে! ব্যাটা একটা ইগোর ডিব্বা। তখন সে বুঝতে পারল, তার ভেতরে সামান্য হলেও ঘৃণা এসেছিল। সেটা চলে যাচ্ছে। কাঁটার রংটাও ফিকে হয়ে সাদার দিকে যাচ্ছে।

যন্ত্রটা তাহলে সত্যি কাজ করছে! রাফির মতো একজন তুখোড় বুদ্ধিমান মানুষ যে কিছু বের করে ফেলবে, সেটা মোটেও অসম্ভব নয়। গুগলে সে ফেস রিকগনিশনের একটা অত্যাধুনিক পদ্ধতি বের করেছে।

তবে মাত্র ছয় মাসে এমন সাংঘাতিক যন্ত্র উদ্ভাবন করে ফেলা বিস্ময়কর ব্যাপার। এমন যন্ত্র, যা কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি।

নওশাদের রাগ তবুও পড়ল না। সে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিল। আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে। একটু পরেই প্রভাত আলো ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। দূরে দেখা যায় ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। তার চূড়ায় গিয়ে লাগবে প্রথম আলো। প্রভাত সূর্যের প্রথম আলো ধরার জন্যই প্রাচীন মিসরীয়রা তাদের মন্দির চত্বরে এমন উঁচু উঁচু মনুমেন্ট বানিয়ে রাখত, যাকে তারা বলত তেখেনু। গ্রিকরা এর নাম দিয়েছে ওবেলিস্ক। তারা সূর্যদেবতা ‘রা’–এর উপাসনা করত। কাজেই সূর্যরশ্মি তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এমন একটা অপ্রস্তুত অবস্থা, রাফি কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে শুধু বলল, ‘সরি, আমি আসলে কিছু মিন করে বলিনি।’

বেচারার জন্য নওশাদের মায়াই হলো। সে নিজের গর্বটাকে লুকাতে পারে না, আবার সেটা প্রকাশ হয়ে পড়লে লজ্জিত হয়। বড় বড় মেধার মানুষেরা হয় এই দিকে, নয় ওই দিকে, মাঝামাঝি থাকে না। হয় নিজের ঢোল নিজেই পেটায়, না হয় একেবারে মুখ বন্ধ করে থাকে। নওশাদের হাসি পেল। রাফি বললেই পারত যে নওশাদের মতো নিকট বন্ধু তার নেই। তাই তাকে দেখাতে এসেছে। এমনকি সেটা পুরোপুরি মিথ্যাও নয়।

হায় রে বিজ্ঞানী, বাস্তব জীবনে তো একটা বোকা!

 নওশাদকে আটটার ভেতর হোটেলে পৌঁছাতে হয়। এখন বাইরে ট্র্যাশ ফেলে এসে তার শাওয়ার নেওয়ার কথা। তারপর রেডি হয়ে হালকা ব্রেকফাস্ট করে সে মেট্রো ধরে রওনা হবে, পৌঁছে যাবে আটটায়। কিন্তু আজ তার নির্ঘাত দেরি হবে। রাফি সহজে যাবে না। এত বড় আবিষ্কার ফেলে তার নিজেরও কাজে যেতে ইচ্ছা করছে না। সিক কল করবে নাকি?

 তখন সমস্যাটা ধরতে পারল নওশাদ। সোফায় রাফির পাশে বসে ঘুরে তার দিকে তাকাল।

‘শোন, তোর এই যন্ত্র এক মুহূর্তের রিডিং দিচ্ছে, সেটা ঠিক না। মানুষের সম্পর্ক ওঠানামা করে। কোনো কোনো মুহূর্তে তীব্র ভালোবাসা বা তীব্র ঘৃণাও এসে পড়তে পারে। সেটাকে সঠিক ভাবলে বিরাট ভুল হবে। যেমন এ মুহূর্তে যা ঘটল।’

নওশাদের ঘৃণার ব্যাপারটায় রাফি আহত হয়েছে। সেটা যে সাময়িক, সেটাও সে বুঝেছে। কারণ, এ মুহূর্তে নওশাদের মনে কোনো বিতৃষ্ণা বা রাগ নেই। তবে তার এই শেষ কথাটা শুনে রাফির ভ্রু কুঁচকে গেল। কিছুটা সন্দিহান ভাবে বলল, ‘থার্মোমিটারেও তো তাই হচ্ছে! যখন ব্যবহার করা হয়, সেই মুহূর্তের বডি টেম্পারেচার মাপা হচ্ছে। আমরা জানি, সেটা সারা দিনের বা সারা বছরের নয়।’

নওশাদ উঠে গিয়ে টেবিল থেকে কফির কাপটা এনে রাফির হাতে দিল। তারপর নিজের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘সমস্যা সেখানেই। থার্মোমিটার যা–ই দেখাক, আমরা জানি বডির স্বাভাবিক তাপমাত্রা কত। ৯৮.৬ ডিগ্রির কাছাকাছি সব সময় থাকবে, ছিল, এবং থাকার কথা, সেটা আমরা জানি। সে ক্ষেত্রে বিচ্যুতিটাকে কেউ স্বাভাবিক ধরে নেবে না। বরং রোগ হিসেবে ধরবে। কিন্তু দুটি মানুষের ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনটা স্বাভাবিক, সেটাই তো জানা নেই!

কাজেই এর মাধ্যমে চরম ভুল–বোঝাবুঝি হবে। সেই মুহূর্তের রিডিংটা সব সময়ের জন্য সত্য ধরে নিয়ে মানুষ বিরাট ভুল করে ফেলবে। বুঝতে পারছিস?’

এবার মনে হচ্ছে রাফি খানিকটা ভড়কে গেছে। তার মুখে কথা নেই। তাকে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। সে একবার কফির কাপটা হাতে নিল। এই প্রথম একবার চুমুকও দিল। তারপর দ্রুত রেখে দিল। কফি মনে হয় ঠান্ডা হয়ে গেছে। একবার ফোনটা দেখল। এদিকে নওশাদ যতই ভাবছে, ততই কনভিন্সড হচ্ছে। এ যন্ত্র বিরাট সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে!

রাফি ধীরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। ইতিমধ্যে ভোরের আলো ফুটেছে। ভালো করে তাকালে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের মাথায় সেই সোনালি আলো দেখা যায়। রাফির মুখে আবিষ্কারের জ্বলজ্বলে ভাবটা আর নেই। সেখানে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা এবং খানিকটা বেদনা।

সে জানালা থেকে ফিরে এসে সোফায় বসল। ফোনটা খুলে কিছু দেখল। তারপর নওশাদের দিকে তাকিয়ে অনিশ্চিতভাবে বলল, ‘সত্যি বলছিস? মানুষ বড় সমস্যায় পড়বে?’

 নওশাদ আশ্চর্য হলো। রাফি নিজের আবিষ্কার নিয়ে তার কাছে মতামত চাইছে! যে নিজে এত মেধাবী, তার নওশাদের মতো সাধারণ এক হোটেল ম্যানেজারের মতামত দরকার কেন? তবে বড় বড় গবেষকও বড় ভুল করে বসে। নওশাদ জোর গলায় বলল, ‘আমার তো তা–ই মনে হয়। এটা এক মুহূর্তের রিডিং।’

রাফির কথা শুনে মনে হবে নওশাদ তার প্রতিপক্ষ এবং সে নওশাদের কাছে হেরে যাওয়ার আগে শেষ চেষ্টা করছে। ‘কেন, লাভ ইন ফার্স্ট সাইট আছে না? দেখেই বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল? তারপর দেখা গেল তারা একজন আরেকজনের জন্যই আসলে তৈরি হয়েছে!’

‘সেটা একটা বয়সে হয়। খুব অল্প মানুষের মধ্যে হয়। বেশির ভাগ লাভ ইন ফার্স্ট সাইট হচ্ছে ইনফেচুয়েশন। সাময়িক মোহ। পৃথিবীতে রোমিও–জুলিয়েট হয় কয়টা? তা–ও তারা বেঁচে থাকলে যে পরিণতি কী হতো, আমরা জানি না।’

রাফি কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। চিন্তা করল। আবার কিছু বলতে গিয়ে নিজেই নিজের কাছে যেন বাধা পেল। এই আবিষ্কারের জন্য ছয় মাস হয় সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। দিনরাত খেটেছে। বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে দুই মাসের। গাড়িও যেকোনো দিন নিয়ে যাবে, পেমেন্ট দেওয়া হয়নি। ভেবেছিল অনেক নাম হবে, টাকা আসবে। একেবারে জাকারবার্গের কাছাকাছি চলে যাবে সে। কিন্তু গোড়ায় গলদ! সেটা আবার ধরল কিনা নওশাদ?

 নওশাদ সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো রাফি?’

রাফি নওশাদের দিকে তাকিয়ে খুব আবেগ নিয়ে বলল, ‘আসলে তোর মেধাটা আমার চোখে পড়েনি। কী অল্প সময়ে এই যন্ত্রের অসাড়তা প্রমাণ করে ফেললি! মানুষ তো ভয়ানক বিপদে পড়ে যেত? সম্পর্ক, ভালোবাসা, এগুলো একমুহূর্তে মাপার জিনিস নয়! প্রথম দর্শনের ভালোবাসারই–বা তেমন কী মূল্য আছে! আর এটাকেই আমি সঙ্গী নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম! আমার যে পণ্ডশ্রম হলো নওশাদ! এই ‘লাভ ডিটেক্টর’ আমি কিছুতেই বাজারে ছাড়তে পারি না। এটাকে আমার নষ্ট করে দিতে হবে। পলির সঙ্গে সম্পর্কটাও মনে হয় টিকবে না রে।’

রাফিকে প্রায় বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। রাফির এত বড় প্রতিক্রিয়া হবে, নওশাদ ভাবতেই পারেনি। সে ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন কেন? পলির সঙ্গে আবার কী হলো?’

‘পলি আমার এসব পাগলামি একদম পছন্দ করছে না। গুগলের চাকরিটা যেভাবে ছেড়েছি, তাতে আর কোনো চাকরিও হবে না। বাড়িওয়ালা এভিকশনের নোটিশ দিয়েছে। পলি এক লাখ ডলারের স্টুডেন্ট লোন শোধ করতে পারছে না। আমার কাছে টাকা চেয়েছিল, উল্টো আমি গত মাসে ওর শেষ সম্বল যা ছিল, ধার করে নিলাম। এই ছোট্ট যন্ত্রটার একেকটার পেছনে আমি ৩৭ হাজার ৯০০ ডলার খরচ করেছি!’

‘বলিস কী? কটা বানিয়েছিস?’

‘দুইটা। একটা আবার হোমরাচোমরা একজনকে পাঠিয়ে দিয়েছি। নাহ, এটা করা যায় না। আমার যা হয় হোক, এটা আমি বাজারে ছাড়ছি না। এর ডিজাইন চিরতরে মুছে ফেলব।’

এবার নওশাদের মুষড়ে যাওয়ার পালা। সে হয়তো বেশি কিছু বলে ফেলেছে! তার জন্য এখন রাফি সব নষ্ট করে দেবে?

নওশাদ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘তুই আমার কথাতেই সব নষ্ট করে দিস না। হয়তো এর ভালো প্রয়োগ আছে। ভেবে দেখ।’

‘ভালো প্রয়োগ না হয় থাকলই। কিন্তু কোনো স্বামী-স্ত্রী যদি একদিন যন্ত্রে ঘৃণা দেখে একে অপরকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে তার জন্য আমিই দায়ী হচ্ছি না? অথচ তাদের স্থিত অবস্থায় সম্পর্ক হয়তো অনেক ভালো! তারপর ভালোবাসা আসলেই আছে কি না, তা–ও তো একমুহূর্তে বলা যাবে না। প্রথম দর্শনেই যন্ত্রে ভীষণ প্রেম ধরা পড়ল। কিছুদিন পর জ্বরের মতো হঠাৎ ছেড়ে গেল, তখন?’

 ‘জ্বরের জন্য থার্মোমিটার দায়ী নয়? তুইই তো একটু আগে বললি! কোন ভালোবাসা চিরদিন থাকবে, কোনটা থাকবে না সেটা কি একটা যন্ত্র বলতে পারে? কেউ সেটা আশা করবে ভেবেছিস?’

রাফি কিছু একটা চিন্তা করে আবার মন খারাপ করে ফেলল। মুখে কিছু বলছে না।

‘কী হলো রাফি? যন্ত্রটা যে এমন অসম্ভব কাজ করছে, সেটাই তো একটা বিরাট আবিষ্কার!’

রাফিকে তবু স্বাভাবিক করতে পারা গেল না। সে বলল, ‘নাহ। ওই যে একটা কথা বললি, থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে আমরা স্থিত অবস্থাটা জানি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে জানি না। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা।  দুইটা বিষয় এক না। এ আমি কী করলাম!’

নওশাদ অনেক চেষ্টা করেও রাফিকে শান্ত করতে পারল না। সে ইতিমধ্যেই কী কী টিপে ‘অ্যাপটা’ ডিলিট করে দিয়েছে। সাদা ম্যাচ বক্সের মতো যন্ত্রটাও খুলে নিয়ে বিকল করে দিয়েছে। বেশিক্ষণ বসলও না। রাফি চলে গেলে নওশাদ মন খারাপ করে একা বসে রইল।

ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে রব উইলসনের প্রাসাদোপম বাসায় সান্ধ্য পার্টি হচ্ছে। তিনি অ্যাপ্লাইড থিওরির ভাইস প্রেসিডেন্ট। সেখানে বড় বড় কোম্পানির উঁচু পদের মানুষেরা এসেছেন। অফিসের কলিগরাও দাওয়াত পেয়েছেন। সুবেশী এবং মার্জিত পুরুষ-মহিলারা স্ন্যাকস এবং পানীয় নিয়ে এখানে–ওখানে বসেছেন। ছোট ছোট গ্রুপে জটলা হচ্ছে। থেকে থেকে হাসি শোনা যাচ্ছে। একজন গেস্ট আবার দূরের বিশাল পিয়ানোটা মৃদু লয়ে বাজাচ্ছেন, পেছনে তার সহধর্মিণী তার কাঁধে হাত রেখে উত্সাহ দিচ্ছেন।

রব উইলসন গোপনে তার ‘লাভ ডিটেক্টর’ যন্ত্রটা দেখলেন। দেখে চমকে উঠলেন। কাঁটাটা ওপাশের ডাইনিং টেবিলের দিকে ঘুরে গেছে। সেখানে অফিসের সেক্রেটারি ক্রিস্টিনা ও তার স্বামী দাঁড়িয়ে স্ন্যাকস নিচ্ছে। কাঁটার রং লাল। তখন তিনি যন্ত্রটা থেকে হালকা কিন্তু মধুর একটা শক অনুভব করলেন হাতে। ছেলেটা তাহলে ঠিক বলেছিল! এটা কাজ করছে? দারুণ যন্ত্র তো? তিনি গোপনে স্ত্রীর অবস্থান দেখে নিলেন। স্ত্রী কেন যেন আড়চোখে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। সর্বনাশ! এ তো ভয়াবহ যন্ত্র!

তিনি রিওসফে্টর মার্ক ডর্মিককে একদিকে ডেকে নিয়ে, নিচু গলায় কিছু বলে তার হাতে যন্ত্রটা দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

এবার মার্ক ডর্মিকের পরীক্ষার পালা। এদিক-ওদিক পায়চারি করে, এর তার সঙ্গে হাই-হ্যালো করে হাত মিলিয়ে মার্ক ফিরে এলেন। গোপনে যন্ত্রটার কাঁটা দেখছেন তিনি। তার মুখ কিছুটা ফ্যাকাশে। কথা না বলে দুজনে পাশের স্টাডিরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। তারপর মার্ক এবং রব একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘সাংঘাতিক!’

মার্ক বললেন, ‘মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো যন্ত্র।’

রব বললেন, ‘এটা এই শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকবে।’

মার্ক তারপর কিছুটা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, ‘কিন্তু সব যে বেরিয়ে যাবে? কতজনের জীবনে যে অশান্তি হবে!’

রব বললেন, ‘কতজন বলছেন কেন, আমার জীবনেই প্রথম অশান্তি হবে!’

মার্ক নিজের ব্যাপারটা বলতে গিয়েও বললেন না। শুধু দৃঢ় গলায় বললেন, ‘এ হতে দেওয়া যায় না।’

রাফি কটা দিন একা থাকতে চেয়েছিল। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে। সে কোনো কাজেরই না! নওশাদের পানসি নৌকার মতো সুন্দর জীবনটাকে তার হিংসা হতে থাকল। সব যে গেল এখন! পলিও তো থাকবে না। ঠিক এ সময় না বলে পলি চলে এল। তার চোখে আগুন। ‘আমি তোমাকে আর সাহায্য দিয়ে দিয়ে, আশকারা দিয়ে দিয়ে আমার জীবনটাকে নরক বানাতে পারব না। স্টুডেন্ট লোন শোধ করতে পারছি না, তিন মাস পেমেন্ট দিইনি। এটা এখন কোর্ট-কাচারিতে গিয়ে গড়িয়েছে। এই যে কোর্টের চিঠি!’

পলি তার হাতের সরকারি ছাপ্পর মারা এনভেলপটা রাফির দিকে জোরে জোরে দুলিয়ে দেখাল। রাফি সেদিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। বলার মতো কোনো কথা সে খুঁজে পাচ্ছে না।

 ‘বুঝেছি, হলি গ্রেইল আবিষ্কার করতে গিয়ে এবারও সব হারিয়েছ তুমি। মানুষের প্রতিভা থাকলে কিছুই হয় না। কাণ্ডজ্ঞান থাকতে হয়। সেটা তুমি কবে বুঝবে, জানি না। জানতেও চাই না। আমি চললাম।’

পলি ঝটিতে ঘুরে চলে যাচ্ছে। তাকে যে কিছুতেই আটকানো যাবে না, সেটাও রাফি বুঝে ফেলেছে। সে চেষ্টাও সে করল না।

তখন রাফির ফোনটা বেজে উঠল। নম্বর দেখে চমকে উঠল রাফি। রিওসফে্টর মার্ক ডর্মিক! মনের কোণে হালকা একটা আফসোস উঁকি দিল। মার্ক ডর্মিক নিশ্চয়ই যন্ত্রটা চাইবে। এভাবে ডিজাইন, প্রোটোটাইপ, সব মুছে না ফেললে সে হয়তো তার নিজের প্রেমটা বাঁচাতে পারত! সব তো চিরতরে নষ্ট করে ফেলেছে, আবার করার কোনো ইচ্ছাই নেই তার। একবার ভাবল, থাক, মানুষের অপরিসীম ক্ষতি হয়ে যেত। বরং তারই ক্ষতি হোক। মার্ককে কিছুতেই দেবে না, সেই প্রতিজ্ঞা করে ফোনটা কানে ধরল সে। কিন্তু ধরে সে যা শুনল, তা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘রাফি, তোমার আবিষ্কারটা তুমি কাউকে দিয়ো না, কাউকে না। ওটা নষ্ট করে দিতে হবে। কিন্তু আমরা তোমাকে যোগ্য পুরস্কার দেব। তিন মিলিয়ন ডলার। কেউ যেন এই যন্ত্রের কথা না জানে, কেউ না। ভয়ংকর যন্ত্র, নষ্ট করে দিতে হবে, ডিজাইন মুছে ফেলতে হবে। তিন মিলিয়ন দেব, বুঝেছ?’

রাফি ফোনে হাত চাপা দিয়ে চিত্কার করে পলিকে ডাকল, ‘পলি, হয়ে গেছে, তিন মিলিয়ন!’

পলি অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল। সাবধানী পায়ে এগিয়ে এল। রাফি তখন হাত সরিয়ে মার্ক ডর্মিককে বলছে, ‘পাঁচ মিলিয়ন।’

মার্ক সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন। তারপর বললেন, ‘একটা অ্যাগ্রিমেন্ট করতে হবে। তুমি এমন যন্ত্র কখনোই তৈরি করবে না। তৈরি করলে তার পেটেন্ট হবে আমাদের। বুঝেছ?’

‘ওকে, আইএম ইরেজিং এভরিথিং রাইট নাও…’ বলে ফোনটা ছুড়ে দিয়ে রাফি লাফ দিয়ে উঠে পলিকে জড়িয়ে ধরল।

হতভম্ব পলিকে সে বলল, ‘পাঁচ মিলিয়ন দেবে! শুধু যন্ত্রটা নষ্ট করে ফেলার জন্য! আমি ইতিমধ্যেই নষ্ট করে ফেলেছি!’

খুশিতে সে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। পলি রাফির দিকে তাকিয়ে দ্রুত চোখ-মুখের রেখা পড়তে পড়তে বুঝতে পারল, এই অপদার্থ পাগলটা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলেছে! লোনের টাকা তো নস্যি, এখন সারা জীবন হয়তো তাদের টাকার চিন্তা করতে হবে না। একটু মধুর নীরবতা, অপলক তাকিয়ে থাকা, তারপর হঠাৎ দুজনে গভীর চুম্বনে আবদ্ধ হলো।

‘লাভ ডিটেক্টর’ যন্ত্রটা যদি রাফি নষ্ট না করে ফেলত, তাহলে ওটা থেকে এতক্ষণে লাল গোলাপ পাপড়ির মতো ভালোবাসার গাঢ় নির্যাস চুইয়ে চুইয়ে পড়া শুরু করত।