আমার ধারণা, খোদাদাদ শাহবাজ খান এ দেশের সবচেয়ে মেধাবী গোয়েন্দা। তাঁকে আপনারা চিনবেন না, তবে আমাদের জগতে তিনি একজন আইডল। আমি তাঁকে গুরু হিসেবেই মানি। যদিও তাঁর সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি কখনো। আমি ডিবিতে যোগ দেওয়ার কয়েক মাস আগেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে অকালে অবসর নেন তিনি। কয়েক বছর আগে জটিল একটি কেসের ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় এবং সখ্য গড়ে ওঠে। এরপর থেকে কোনো কেসে সুবিধা করতে না পারলেই তাঁর দ্বারস্থ হই।
তিনি সাদামাটা মানুষ। গল্প-উপন্যাস-সিনেমার গোয়েন্দাদের মতো নন, কথা বলেন ঢাকার চল ভাষায়। নিজের মান্ধাতা আমলের নামটা ভীষণ অপছন্দ, তাই কে এস খান হিসেবেই পরিচয় দেন সব সময়। তিনি একজন ডেক্সট্রোকার্ডিয়া—অন্য সবার মতো তাঁর হৃৎপিণ্ড বাঁ দিকে নয়, ডান দিকে অবস্থিত। সে কারণে কি না কে জানে, বারো মাসই অসুস্থ থাকেন ভদ্রলোক। তাঁর স্ত্রী যে তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছেন, তার কারণ সম্ভবত এটাই। তবে মজার ব্যাপার হলো, মহিলা প্রতিদিন ফোন করে সাবেক স্বামীর খোঁজখবর নেন।
পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের পৈতৃক বাড়িটার দু-তিনটা ফ্লোর ভাড়া দিয়ে ভালোই চলে যায় তাঁর। তা ছাড়া ডিবির নবীন সদস্যদের ট্রেনিংয়ের কাজটা করেও কিছু উপার্জন করেন। পথ থেকে কুড়িয়ে ১২-১৩ বছরের যে ছেলেটাকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাকে আইনস্টাইন নামে ডাকেন তিনি। সারা দিন বইয়ের রাজ্যে ডুবে থাকাটাই তাঁর একমাত্র নেশা। কাজ ছাড়াও মাঝেমধ্যে তাঁর বাড়িতে আড্ডা দিতে যাই, কিন্তু দীর্ঘ এই লকডাউনে সেটা বন্ধ হয়ে গেলে অগত্যা ভিডিও কলে আড্ডা দিলাম একদিন।
ডিবিতে একটা কথা প্রচলিত আছে, কে এস খান কখনো কোনো কেসে ব্যর্থ হননি—মিথ্যে বলব না, এ নিয়ে আমার মনে সন্দেহ ছিল। ভিডিও আড্ডায় কথাটা তুলতেই বিনয়ী হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ব্যর্থতা ছাড়া কোনো মানুষ নেই এ জগতে। এরপরই নিজের কর্মজীবনের শেষ দিককার একটি ব্যর্থ কেসের গল্প বললেন আমাকে। সেটা যেমন অদ্ভুত, তেমনি অভিনব।
উত্তরায় এক জাঁদরেল ব্যবসায়ী নিজের বাড়ির মেইন গেটের বাইরে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হয়েছিলেন, সিসিক্যামে দেখা গিয়েছিল খুনির চেহারাটা। কিন্তু বিপত্তি বাধে পুলিশ যখন ছবি দেখে খুনিকে চিহ্নিত করে, তখন খুন হওয়ার সময় ওই লোক চট্টগ্রামে ছিল! ভালো করে খতিয়ে দেখার পর অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হয় এটা, হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পুলিশ। এক্সপার্টরা পরীক্ষা করে দেখেছে, সিসিক্যাম ফুটেজটা একেবারেই ‘জেনুইন’। সেই ফুটেজে খুনির চেহারা এতটাই পরিষ্কার যে সন্দেহভাজনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার কোনো অবকাশই ছিল না। একটা সময় কেসটা ডিবিতে স্থানান্তর করা হলে কে এস খানের ওপরে তদন্তের ভার এসে পড়ে।
‘হুম। যমজ নয়, কিন্তু একই রকম চেহারার দুজন মানুষ।’‘ঠিক’, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ওই লোকের একটা ডপেলগ্যাঙ্গার আছে, ওইটারে দিয়াই ম্যাজিকটা করত।’‘আপনি বলতে চাচ্ছেন…?’মুচকি হাসি দিলেন সাবেক ডিটেক্টিভ, ‘ওই ডপেলগ্যাঙ্গারটারে দিয়াই খুনটা করছে।’
‘ইনভেস্টিগেশন কিন্তু অঙ্ক না, এইটা জ্যামিতির মতন—যুক্তি আর প্রমাণ দিয়া সলভ করা লাগে’, বলেছিলেন তিনি। ‘জ্যামিতির মতোই ইনভেস্টিগেশনের শুরুতে কিছু স্বতঃসিদ্ধ ঠিক কইরা নিতে হয়। কিছু বিষয় সত্য বইলা ধইরা নিতে হয়। এই কেসে আমার স্বতঃসিদ্ধটা ছিল: একজন মানুষ কোনোভাবেই একই সঙ্গে দুই জায়গায় থাকবার পারে না। গল্প-উপন্যাসে, সিনেমায় এইগুলা দেখবেন, কিন্তু রিয়েল ওয়ার্ল্ডে এইটা সম্ভব না।’ ‘তা ঠিক। ‘কেসটা নিয়া অনেক খাটলাম, কিন্তু এক মাস পরও কোনো সুরাহা করতে পারলাম না। ধইরা নিলাম জীবনের প্রথম ব্যর্থ কেস হইব এইটা। তারপরই একটা জিনিস মাথায় উঁকি দিল।’ ‘কী?’ উদ্গ্রীব আমি। ‘খুনিরা যমজ ভাই ছিল?’ অনুমান করার চেষ্টা করলাম। ‘না। পুলিশ খোঁজ নিয়া জানছিল, লোকটা মা-বাবার একমাত্র সন্তান।’ কথাটা শুনে দমে যাই আমি। ‘বর্তমানের শিকড় থাকে অতীতে, সেই শিকড় দেখা না গেলে আপনেরে খুঁ-খুঁ-খুঁড়ড়ড়ড়…’’ নেটওয়ার্কে সমস্যার কারণে সাময়িক বিঘ্ন ঘটল আমাদের আড্ডায়। অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। ‘কী বললেন, স্যার?’ ‘সাসপেক্টের ব্যাকগ্রাউন্ডটা চেক করলাম। জানতে পারলাম, একসময় লোকটা খুব ভালো ম্যাজিশিয়ান ছিল। এমন সব ম্যাজিক দেখাইত যা এই দেশে আগে কেউ দেখে নাই।’ ম্যাজিশিয়ান! অবাক হলাম আমি। ‘বুঝলাম, খুনটা অয়ই করছে ম্যাজিক ট্রিক ইউজ কইরা।’ ‘বলেন কী! কীভাবে?’ ‘আমি আরও খোঁজ নিয়া জানছিলাম, তার সবচায়া ফেমাস ম্যাজিক ছিল দুইটা, একটা হইল লম্বা মানুষরে বামন বানানো আর অন্যটা হইল আয়নার সামনে দাঁড়ায়া নিজেরে কপি করা।’ ‘কপি করা!’ অবিশ্বাসে বলে উঠলাম। ‘আয়নার প্রতিবিম্বের সাথে হাত মিলাইত, তারপর আয়নার ভেতর থিকা হুবহু তার মতো একজন বাইর হইয়া আসত।’ গাল চুলকালেন কে এস খান। ‘এই ম্যাজিকটা কেমনে করত, জানেন?’ ‘না।’ ম্যাজিকের কৌশল বের করার ব্যাপারে আমি বেশ আনাড়ি। তবে কে এস খান ম্যাজিকের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী। ‘ডপেলগ্যাঙ্গার শব্দটা শুনছেন তো?’ ‘হুম। যমজ নয়, কিন্তু একই রকম চেহারার দুজন মানুষ।’ ‘ঠিক’, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘ওই লোকের একটা ডপেলগ্যাঙ্গার আছে, ওইটারে দিয়াই ম্যাজিকটা করত।’ ‘আপনি বলতে চাচ্ছেন…?’ মুচকি হাসি দিলেন সাবেক ডিটেক্টিভ, ‘ওই ডপেলগ্যাঙ্গারটারে দিয়াই খুনটা করছে।’ ব্যাপারটা অবশেষে যৌক্তিক বলেই মনে হলো। ‘ওই ব্যবসায়ীর সাথে কি ম্যাজিশিয়ানের কোনো—’ ‘না, না’, আমার কথার মাঝখানে বলে উঠলেন। ‘ব্যবসায়ীর সাথে তার কোনো পূর্বশত্রুতা ছিল না।’ ‘তাহলে?’ ‘আসলে দীর্ঘদিন ধইরা ম্যাজিক শোয়ের অবস্থা খুব খারাপ, ইনকাম ছিল না, অভাবে পইড়া স্বভাব নষ্ট হয়া গেছিল…ম্যাজিশিয়ান থেইকা পেশাদার খুনি হয়া গেছিল তারা দুইজন। একজন খুন করে আর অন্যজন থাকে কয়েক শ মাইল দূরে…কঠিন একটা অ্যালিবাই।’ ‘আপনি তাহলে ধরে ফেললেন তাদের?’ ‘ম্যাজিশিয়ানরে ইন্টেরোগেট করছিলাম, কিন্তু আটকায়া রাখতে পারি নাই।’ ‘কেন?’ ‘সে কিছুই স্বীকার করে নাই। কোর্টে জামিন চাইবার সময় লোকটা জোর গলায় জজ সাহেবরে বলছে, খুনখারাবির ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। আর আমি যে ডপেলগ্যাঙ্গারের থিওরি দিছি ওইটা ভুল, ম্যাজিকটা সে অন্যভাবে করছে। ম্যাজিকের এই সিক্রেটটা বলতে সে বাধ্য না। পুলিশ তদন্ত কইরা দেখুক, পারলে তারা প্রমাণ করুক আসলেই একজন ডপেলগ্যাঙ্গার আছে কি না। এই সব প্রমাণ করার দায়িত্ব তার না।’
কথাটা মিথ্যে বলেনি ওই লোক। অভিযোগ প্রমাণের দায় সন্দেহভাজনের ওপরে নয়, অভিযোগকারী আর তদন্ত কর্মকর্তার ওপরেই বর্তায় সেটা। ‘তাহলে ওই ম্যাজিশিয়ানের কী হলো?’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কে এস খান। ‘ওই ডপেলগ্যাঙ্গারটারে যেহেতু ধরবার পারি নাই তাই ম্যাজিশিয়ানরে আদালত জামিন দিয়া দেয়।’ ‘আপনি কি নিশ্চিত, ডপেলগ্যাঙ্গার দিয়েই খুনটা করিয়েছিল?’ ‘না।’ ‘তাহলে?’’ ‘রিটায়ার্ড করার পর ওই ম্যাজিশিয়ান একদিন আমার সাথে দেখা করতে আসছিল। আমি ম্যাজিকের ট্রিকটা জানতে খুব আগ্রহী ছিলাম বইলা সে বলছে, তার মতো দেখতে সত্যি একজন ছিল, তারে দিয়াই ম্যাজিকটা দেখাইত, তয় ওই মানুষটার সাথে অনেক দিন ধইরা তার যোগাযোগ নাই।’ ‘এ কথা সে আদালতে বলল না কেন?’ মৃদু হাসলেন সাবেক ডিবি অফিসার। ‘এই কথা সে কেমনে বলব, ওইটা তো তার যমজ ভাই আছিল!’ ‘যমজ ভাই! কিন্তু একটু আগে না—’ ‘তার বাপের আরেক ঘরের সন্তান’, আবারও আমার কথায় বাধা দিয়ে বললেন তিনি। ‘বাপ মরার আগে কথাটা বইলা গেছিল তারে। ম্যাজিশিয়ানের কোনো ইচ্ছাই ছিল না ওই ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার, কিন্তু পরে যখন দেখছে দুইজনের চেহারা হুবহু একই রকম, তখন ওই ম্যাজিকটার আইডিয়া তার মাথায় আসে।’ ‘একেবারে সিনেমার কাহিনি দেখছি!’ ‘আমার ভাগ্য ভালো, বুঝলেন নুরে ছফা?’ আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ফোনের ডিসপ্লের দিকে। ‘কেসটার মাঝখানে রিটায়ার করি, আমার জায়গায় দায়িত্ব নেয় অন্য একজন। তাই এই কেসের ব্যর্থতা আমার ওপরে বর্তায় নাই। সবাই…’
এরপরই নেট কানেকশনটা দীর্ঘ সময়ের জন্য আবারও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, শেষ হয়ে যায় আমাদের লকডাউনের আড্ডাটাও।
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]