Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2021-12%2Fc5925bac-c48d-4033-bec9-420c7f37471c%2FUntitled_6.jpg?rect=0%2C0%2C1265%2C664&w=1200&ar=40%3A21&auto=format%2Ccompress&ogImage=true&mode=crop&overlay=&overlay_position=bottom&overlay_width_pct=1 />

রবিবার

নুসরৎ নওরিন



প্রতি রবিবার আব্বা আম্মাকে খুব ভালো করে গোসল করিয়ে দেন, যেন আমাদের আম্মা একটা ছোট বাচ্চা। কলঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় আম্মার লম্বা, শীর্ণ হাতে আব্বা সাবান লাগিয়ে দিচ্ছেন ধীরে ধীরে। বাধ্য মেয়ের মতো আম্মা বসে থাকেন। সাবান ঘষে, ময়লা পরিষ্কার করে, পানি ঢেলে আম্মাকে পরিষ্কার করার পর আব্বা তাকে মুছে দেন। একে একে ব্লাউজ, পেটিকোট, শাড়ি পরিয়ে দেন। গোসল করা, ভেজা কাপড়গুলো ধুয়ে যত্নে দড়িতে শুকাতে দেন। কাপড়গুলো টানানো হয় সাবধানে। মিহি সুতির গোলাপি, নীল ও বেগুনি ছাপা শাড়িগুলোতে শুকিয়ে যাওয়ার পর কোঁচকানো দাগ পড়ে না।

স্মৃতি যত দূর পেছনে যায়, তত পেছন থেকেই এমন দেখে আসছি। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের আত্মীয়স্বজনও। আমি বেশ বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি, আমাদের পরিবারটা আর সবার মতো নয়। আমার আব্বাই সংসারের হাল সবটুকু ধরে আছেন। বিরক্তি নেই। ভারবাহী বলদের কথা বাগধারায় পড়েছি, আব্বাকে মাঝেমধ্যে আমার অমন মনে হয়।

আম্মার সব দায়িত্ব পালন করতে করতে আব্বাই আমাদের আম্মা হয়ে উঠেছেন। উঠোন ঝাঁট দেন, আম্বিয়ার মায়ের বাটা মসলা মাখিয়ে তরকারি বসিয়ে দেন, মেপে ভাতের চাল বসান। আমাদের জামাকাপড় আমরা ধুই। আব্বা মাঝেমধ্যে নিজ হাতে ধুয়ে নীল দেন, মাড় মেশান। পেয়ারাগাছ, আমগাছগুলোরও যত্ন নেন। আমাদের কাঠের ব্যবসাটা দেখেন রুহুল ভাই। জায়গা-জমি, দোকান আছে। নগদ টাকা তেমন না থাকলেও খেতের ফসল, গাছের ফল, দাদার সূত্রে আরও নানা সম্পদ দিয়ে চলে যায়। আব্বাকে দেখলে মনে হয়, পৃথিবীর সব বোঝা তার কাঁধে চাপিয়ে দিলেও সমস্যা নেই। তিনি একটা একটা করে আস্তে ধীরে গুছিয়ে সব করে উঠতে পারবেন।

আমার আম্মা অবশ্য এ জগতের মানুষ নন। তাকে চিরদিন দেখেছি বেদনার্ত। সব বোধ আচ্ছন্ন হয়ে অন্য কোথাও রয়েছে তার মন। আমার ছোট ভাই অনি আর আমি হাত ধরে স্কুলে যেতাম। কখনো কখনো জানালায় দেখতাম একটা অপেক্ষারত মুখ। আম্মা গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু আমাদের যাওয়ার দিকে সেই দৃষ্টি নয়। তার দৃষ্টি রাস্তার ওপাশের জামগাছ, ধানের খেত কিংবা সেসব পেরিয়ে মজুমদারদের ঘন সবুজঘেরা বাড়িটায়। আসলে সেসবও দেখেন না তিনি। দেখেন অন্য কিছু।

আম্মা বেশির ভাগ সময়ই চুপচাপ। কখনো কথা বললেও শরীরের মতোই ক্ষীণকণ্ঠ সেসব। মাসে একবার আম্মার ইনিয়ে–বিনিয়ে কান্নার কয়েকটা দিন থাকে। চিকন, অনুচ্চ গলায় দীর্ঘ সময় কাঁদেন। বিরতি দিয়ে দিয়ে। মনে হয়, চুলা থেকে একটা জ্বলন্ত লাকড়ি এইমাত্র নেভানো হয়েছে, কিন্তু একটা অংশ থেকে ফিনফিনে সাদা সুতার মতো ধোঁয়ার রেখা বের হচ্ছে।

আম্মার কান্নার দিনরাতগুলোতে আমরা ঘুমাতে পারি না। গুমোট একটা সময়। দুদিন পর তৃতীয় দিন সকালে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। বেহেস্তের মতো লাগে। আব্বার মুখে তৃপ্তির আভা। সকালবেলা চা বানান। আম্মার সঙ্গে বিছানায় আয়েশ করে বসে বিস্কুট দিয়ে সেই চা খান। দুজন আস্তে আস্তে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলেন। এ রকম বিরল সকালগুলোতে আম্মাকে সুস্থতার সবচেয়ে নিকটবর্তী লাগে। হলুদাভ মুখে ক্লান্ত অথচ নিখাদ একটা হাসি।

আমাদের মা এ রকম কেন, এই প্রশ্ন যত দিনে মনের ভেতরে এসেছে, তত দিনে কিছু উত্তর আমরা পেয়েও গেছি। আগে জানতাম আম্মা অসুস্থ। তারপর জানতে শুরু করলাম, অসুস্থতার একটা ইতিহাস আছে। জানলাম ফিসফাসে, এদিক-ওদিকের কথায়। তবে প্রথম স্পষ্ট করে একজন বলেছিল। সে দিনের কথা এখনো মনে আছে। তখন আমি ক্লাস সিক্সে। মামা বেড়াতে এসেছেন। মামাতো ভাই মাশরুকের সঙ্গে বাগানে আমগাছের ডালে ঝুলে আছি। মাশরুকের ওপরের পাটির একটা দাঁত কালো। ও কথা বললে কেন জানি ওর চোখের দিকে চোখ না গিয়ে ওই দাঁতের দিকেই যায়। আমরা একজন আরেকজনকে খ্যাপাচ্ছিলাম শব্দ মিলিয়ে মিলিয়ে। কে শুরু করেছিল মনে নেই। আমি বলি, ‘মাশরুক, থুক থু, খালি গায় গু…।’

মাশরুক বলে, ‘অভি রে অভি, তুই একটা গাভি।’

আমি বলি, ‘তুই একটা হাঁদা, তোর বন্ধুরা গাধা।’

এরপর মাশরুক হঠাৎ ছন্দ ছাড়াই বলে, ‘তুই খারাপ, তোর মা পলায় গেছিল।’

ওই মুহূর্তে কথাটা আমি পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না। তবে মাশরুকের কালো দাঁতের ফাঁক দিয়ে আসা ছন্দহীন কথাগুলো বলার ভঙ্গিতে যে খারাপ একটা কিছু ছিল, তা বুঝলাম।

সেই রাতে ‘পলায় যাওয়া’ ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবলাম। শুনলে মনে হয়, কাউকে আটকে রাখা হয়েছিল, সে পালিয়ে গেছে। এমন কোথাও চলে গেছে যে জায়গাটা চিরসুখের। তবু জিনিসটা স্পষ্ট বোঝার জন্য পরের কয়েক দিন খুব চেষ্টা করলাম। বোঝার পর গলার মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধে রইল।

এরপর আরও দুটি বছর গেছে। আমার কিছু অভ্যাস বদলেছে। আব্বার সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কথা কম বলি। অনির সঙ্গে আব্বার কোনো দূরত্ব না হলেও আমার হয়ে গেছে। আগে সন্ধ্যার পরপর বাড়ি ফিরতাম। চা খেতাম একসঙ্গে। আজকাল সন্ধ্যার বেশ পর আসি। শার্টের বোতাম দুটি খোলা রাখি। লুকিয়ে সিগারেট খাই। চুল নিজের পছন্দের ছাঁটে কাটাই। আব্বা বিরক্ত, কিন্তু কিছু বলেন না। একদিন একটা ঘটনা ঘটল। সকালবেলা ছন্দা খালা খাবারদাবার নিয়ে এসেছিলেন। আম্মাকে নিয়ে দুঃখ করতে করতে একপর্যায়ে বললেন, ‘এমনিতেই চলে গেছিল। আবার এমন করলে…’

আমার দিকে সটান চোখে তাকিয়ে তিনি কথাটা শেষ করেন না। আমি জানি, তিনি কী বলতে চাচ্ছেন। আমি দেখেছি, সবাই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথাটা মনে করিয়ে দেয়। সেই যে মাশরুক বলেছিল, ‘তুই খারাপ, তোর মা পলায় গেছিল’, সেটা শুধু মাশরুক নয়, সবাই-ই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। বারবার হাতুড়িপেটার মতো। যতবার বলে ততবার মনে হয়, সর্বংসহ আব্বাই এসবের জন্য দায়ী। আজ পর্যন্ত এসব কথার মানে, আম্মার অতীত তিনি আমাদের বলেননি। তার সব মনোযোগ আম্মা ও আম্মার সংসার দুই হাতে টেনে যাওয়ায়। আমি এখন জানি, আমার মা সত্যিই পালিয়ে গিয়েছিলেন। তবু অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই। কাউকে বলতে না পারার অক্ষম ক্রোধে আমি সারাক্ষণ অস্থির।

সেদিন দুপুরে খাওয়া হয়নি। সারা দিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে রাতে সিগারেট টেনে ফিরলাম। সিগারেটের গন্ধ ঢাকার জন্য মুখে দিলাম পেয়ারার কচি পাতা। ঘরে ঢুকতেই দেখি, আব্বা ভাঙা হাতলের চেয়ারটায় বসা। দাদার পুরোনো কাঠের ভারী চেয়ার। আমার ঘরের সিলিং থেকে লো পাওয়ারের হলুদ লাইট জ্বালানো। সে আলো আব্বার মাথা পর্যন্ত পৌঁছালেও মুখে পৌঁছায়নি। তাকে দেখাচ্ছে বিরাট দৈত্যের মতো। মেঝেতে বিশাল ছায়া পড়েছে। ভারী গলায় বললেন, ‘এত রাতে কোথায় ছিলে, বাবু?’

আব্বা খুব রেগে গেলে ঝড়ের আগমুহূর্তের মতো শান্ত হয়ে যান। ছোটবেলার মতো আমাকে বাবু ডাকেন।

আমি বললাম, ‘পলাশ আর রফিকের সাথে ইয়াছিন মাস্টারের বাড়ি গেছিলাম।’

‘তো এত রাত হলো যে?’

‘ইয়াছিন মাস্টার খেয়ে আসতে বললেন। একটু দেরি হয়ে গেছে।’

‘সিগারেট খেয়েছ নাকি?’

চুপ করে রইলাম। রাজনীতির বই পড়া ইয়াছিন মাস্টারের প্রতি আমার খুব ভক্তি থাকলেও আব্বা তাকে সহ্য করতে পারেন না। ইয়াছিন মাস্টার নাকি প্যাঁচের লোক।

আবার বললেন, ‘সিগারেট খেয়েছ নাকি?’

আমি বললাম, ‘জি।’

কণ্ঠস্বরে তীব্র বিদ্রূপ ঢেলে বললেন, ‘বাহ, ইয়াছিন মাস্টার তোমাদের সিগারেটও খাওয়ায়।’

সেদিন দুপুরে বাড়িতে ভাত খাইনি। সারা দিন বাইরে। মেজাজটা কী যে হয়ে গেল, আমি বললাম, ‘সবাই তো আপনার মতো ভালো হবে না। আপনি যেমন পলায় যাওয়া মহিলারে নিয়ে ঘর করতেছেন। সবাই কি এত ভালো?’

আমার শেষের কথাটায় অনেক জোর। প্রস্তুত ছিলাম আরও অনেক কিছু বলার জন্য। কিন্তু এটুকু বলামাত্রই বুকের ভীষণ পাথরটা নেমে গেল আমার, অভিমানের জায়গায় অসম্ভব ভয়। হাত-পা কাঁপাকাঁপি করতে লাগল। আব্বা ঝট করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং তার হাত উঠে আসছে। আমার চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে এল। কিন্তু চড়টা এল না। চোখ খুলে দেখলাম, তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই কয়েকটা সেকেন্ড খুব দীর্ঘ। আমার ভয়ার্ত চোখের সামনে দিয়ে তিনি একটু পর ধীর পায়ে চলে গেলেন।

রাতে ঘুম নেই। আমাদের মাচায় শুয়ে আছি। আব্বার ঘরের সামনে বাড়িতে ঢোকার রাস্তা, তার ওপাশে মাচা। গরমের দিনে এখানে বসে আমরা গা জুড়াই। মাঠ থেকে প্রচুর বাতাস আসে। আমগাছের নিচে জমাট অন্ধকারে কখন যেন চোখে ঘুম নেমে এসেছে। সেই ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। জানি না কটা বেজেছে। একটা-দুটো হবে। আমপাতায় সরসর শব্দের সঙ্গে রাতের আকাশে টুকরা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। একটা অপরিচিত শব্দ—কান্নার। ‘হু উ উ, হু উ উ উ’ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ার শব্দ। আব্বার কান্না। আগে কখনো শুনিনি, তাই অদ্ভুত লাগছে। ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন। আর বলছেন, ‘আয়েশা, আয়েশা, আয়েশা…।’

অন্ধকারে বসে দীর্ঘক্ষণ আব্বার কান্না শুনি। আয়েশা আমার আম্মার নাম।

আবার সকাল আসে, দুপুর হয়। আগের মতোই চলতে থাকে সব। আম্মার শীর্ণ, লম্বা হাতে আব্বা যত্নে সাবান লাগিয়ে দেন। কলতলার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি, দড়িতে শুকনো গোলাপি শাড়ি বাতাসে সামান্য দুলছে।