আচ্ছা, কথা বললে কি আপনাদের কোনো ঝামেলা হয়? ইদানীং খেয়াল করছি, কথা বললেই বেশ ঝামেলা হচ্ছে। তবে আমার নয়, অন্যদের। মানে, আমি কথা বললেই কীভাবে কীভাবে যেন ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। কয়েক দিন আগে আমি খেতে গিয়েছি রেস্তোরাঁয়। গিয়ে দেখি সেখানে খেতে এসেছে আমারই বন্ধু মকবুল। সঙ্গে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। হুট করে প্রিয় বন্ধুকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম আমি। হাসিমুখে মকবুলের কাছে গিয়ে বললাম, ‘কিরে, কেমন আছিস?’
‘আরে তুই! কী খবর তোর? বস বস।’
চেয়ার টেনে বসেই বন্ধুর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, ‘কী অবস্থা ভাবি?’
‘এই তো ভাইয়া, ভালো। হা হা…আপনি কেমন আছেন?’
‘আমি তো সব সময় ভালো।’
‘কী খাবি অর্ডার কর।’ মেনুটা এগিয়ে দিয়ে বলল মকবুল, ‘আমরা সালাদ বোল আর ফ্রেঞ্চফ্রাই অর্ডার দিয়েছি।’
‘সেকি! তুই না সালাদ জিনিসটা সহ্যই করতে পারিস না?’
‘তুই কিন্তু রাইস বোল নিতে পারিস। এদের রাইস বোলটা ভালো।’ মকবুলকে কেমন একটু চিন্তিত মনে হলো।
‘আরে দাঁড়া, দেখি আগে কী কী আছে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখ।’
আমি মেনুর দিকে তাকাতেই সালাদের অংশে চোখ চলে গেল। তখন আবার বললাম, ‘আচ্ছা, তুই হঠাৎ সালাদ অর্ডার করলি কেন বল তো? তুই তো বলিস, সালাদা খাওয়া আর টাকা দিয়ে ঘাসপাতা খাওয়া একই কথা…’
‘এক্সকিউজ মি…’ ওয়েটারকে ডাকল মকবুল। দ্রুত আমাদের টেবিলে ছুটে এল ওয়েটার। ‘ওর অর্ডারটা অ্যাড হবে।’ বলেই আমার দিকে তাকাল মকবুল, ‘অর্ডার দে তাড়াতাড়ি।’
মকবুল এত অস্থির হয়ে গেল কেন বুঝতে পারলাম না। তাড়াহুড়ায় পুরো মেনুটাও পড়তে পারলাম না আমি। সাধারণত পুরো মেনু পড়ে যেটা আগে ঠিক করে এসেছি, সেটাই অর্ডার করি আমি। থাক, পড়েছি বন্ধুর হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে। রাইস বোলই দিতে বললাম। সঙ্গে জুস।
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেল। আমি খেয়াল করলাম, ভাবির মুখটা একটু গম্ভীর। ব্যাপার কী? খাবার কি বেশি অর্ডার দিয়ে ফেললাম? তা তো হওয়ার কথা না। নাকি আমি ওদের মাঝখানে ঢুকে পড়ায় বিরক্ত বোধ করছেন? পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কী করব, তাই ভাবছি। সামনে রাখা সসের বোতলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গেলাম। হাতে সস লেগে গেল। বক্স থেকে টিস্যু নিতে টান দিলাম, একবারে বেরিয়ে এল সব টিস্যু৷ মকবুল অন্য দিকে তাকাল। টিভিতে আইপিএল চলছে, খেলা দেখতে লাগল চুপচাপ। ওর স্ত্রী মোবাইল স্ক্রল করেই যাচ্ছে, অন্য কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠল পরিস্থিতি। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে মকবুলকে বললাম, ‘তোর অফিসের কী অবস্থা?’
‘উঁ? ও হ্যাঁ। ভালোই তো।’
‘ও। আচ্ছা, সেদিন যে মোতালেব প্লাজায় ফোন ঠিক করতে দিলি, সব ঠিকঠাক ছিল? আজকাল দুই নম্বর দোকান এত বেড়ে গেছে, সব নকল পার্টস দিয়ে দেয়।’
মকবুল কোনো কথা না বলে খেলা দেখতে লাগল। স্ক্রল থামিয়ে ফোন থেকে মাথা তুলে ভাবি বললেন, ‘তুমি মোতালেব প্লাজায় গিয়েছিলে?’
‘ওই আরকি… অফিসের ফাঁকে একটু…’ মকবুলের কথায় একটু জড়তা লক্ষ করলাম। গাধাটা সব সময় এ রকম। স্কুলে স্যার পড়া ধরলে ঠিকভাবে বলতে পারত না।
‘কবে গেলা?’ ফোনটা টেবিলে রেখে বললেন ভাবি, ‘আমাকে তো বলো নাই।’
‘আরে এই তো গেলাম কদিন আগে। এক্সেক্ট ডেটটা ভুলে গেছি।’
‘শনিবার বিকেলে গিয়েছিলি। ১৫ তারিখ।’ মনে করিয়ে দিলাম আমি।
‘আচ্ছা।’ টেবিলে টোকা দিতে দিতে মাথা নাড়লেন ভাবি।
‘খাবার দিতে এত দেরি করছে কেন? এক্সকিউজ মি, আমাদের অর্ডারটা কত দূর?’ রেগে গেল মকবুল।
‘তোমার না শনিবার ডে লং মিটিং ছিল অফিসে?’ মকবুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভাবি।
‘ও হ্যাঁ, ছিল তো।’ সসের বোতলটা হাতে নিয়ে বলল মকবুল। ওর হাতেও সস লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বোতলটা রেখে দিল আবার, ‘মিটিংয়ে একটু ব্রেক পেলাম বিকেলে। তখনই মোবাইলটা ঠিক করতে দিয়ে আসলাম। বেশিক্ষণ লাগেনি।’
‘তুমি গুলশান থেকে সেই মোতালেব প্লাজায় যেতে পারলে, আর আমার ছোট বোনের জন্মদিনে আসতে পারলে না?’
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের পরই বুঝতে পারলাম যে ঝামেলা হয়ে গেছে। আর এই ঝামেলার সূত্রপাত আমারই ছোট একটি কথায়।
ওয়েটার এসে খাবারের ট্রে রেখে গেল। ভাবি সশব্দে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ঠেলে। আমরা মুখ তুলে তাকালাম তাঁর দিকে, ‘আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।’ দুই বন্ধু একসঙ্গে মাথা নাড়লাম।
ভাবি চলে যাওয়ামাত্র টেবিলের নিচ দিয়ে আমার পায়ে কষে লাথি মারল মকবুল, ‘হারামজাদা ফাউল, তুই মোবাইলের কথা বলতে গেলি কেন?’
‘আমার কী দোষ? আমি জাস্ট বলার জন্য বললাম। কথাপ্রসঙ্গে।’
‘তোর কথা বলার দরকারটা কী? আবার সালাদের কথা বলতে গেলি কেন তুই? ওর সালাদ পছন্দ। তাই আমিও সব সময় বলেছি সালাদ আমার প্রিয়। তুই কেন আগবাড়িয়ে বলতে গেলি আমি সালাদ খাই না?’
‘আরে আশ্চর্য, আমি কী করে জানব এত কিছু? কিছু না বললে কেমন দেখায়? মনে হলো, তাই বললাম।’
‘তুই কথা বলবি না। তোর কথা বলার কোনো দরকার নাই। সালাদ, মোবাইল কেন, কোনো বিষয়েই তুই কোনো কথা বলবি না৷ তোর কথা বলা বন্ধ। আবার যদি কথা বলিস, একদম মেরে ফেলব।’
‘আচ্ছা, বলব না।’
ভাবি চলে এসেছেন। আমিও চুপচাপ আইপিএল দেখা শুরু করলাম৷ মাঝখানে মকবুল একবার বলল, ‘খাবারটা বেশ মজা হয়েছে, তাই না?’
আমি কোনো কথা বললাম না।
ভাবি একবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাইয়া, আর কিছু খান। ডেজার্ট নেন।’
আমি হাসিমুখে হাত নেড়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম, লাগবে না। পেট ভরে গেছে। কিন্তু কথা বললাম না।
খাবার শেষ প্রায়। মকবুল উঠে দাঁড়াল, ‘তোরা বস, আমি বিলটা দিয়ে আসি।’ আমি চুপচাপ কাঁটাচামচ দিয়ে প্লেটের বাটিতে গ্রামের দৃশ্য আঁকার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ ভাবি চেয়ার টেনে বললেন, ‘ভাইয়া, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?’
আমি হেসে মাথা নাড়লাম।
‘আপনি তো ওর একদম ছোটবেলার বন্ধু, তাই না?’
আবারও মাথা নাড়লাম আমি। হ্যাঁ, আমরা ছোটবেলার বন্ধু।
‘ওর কোনো অ্যাফেয়ার–ট্যাফেয়ার ছিল কি? আপনি নিশ্চয়ই জানবেন।’
আমি চুপ করে রইলাম।
‘এগুলো কিন্তু এখন খুবই নরমাল। আপনি বলতে পারেন। আমি পজিটিভ মানুষ। পজিটিভলি নেব ব্যাপারটা।’
আমি চুপ করে রইলাম।
ভাবি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম।’
আমি কিছু বোঝার আগেই ভাবি চেয়ার ছেড়ে উঠে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। তাঁকে থামাতে ব্যর্থ হয়ে আমার দিকে ছুটে এল মকবুল।
‘কী ব্যাপার? তুই আবার কী বললি ওকে? চলে গেল কেন?’
‘আমি তো কোনো কথাই বলিনি।’
‘তাহলে ও চলে গেল কেন? ও খুবই সেনসিটিভ মেয়ে। তুই নিশ্চয়ই কিছু বলেছিস।’
এতক্ষণ যা যা হয়েছে, খুলে বললাম মকবুলকে। মকবুল উত্তেজিত হয়ে গেল, ‘হারামজাদা, তুই কিছু বললি না? আমার কোনো অ্যাফেয়ার ছিল না, এটা বললি না কেন?’
‘তুই-ই তো বললি কথা না বলতে। কথা বললে মেরে ফেলবি।’
‘শালা, তোকে আজকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলব!’ বলে মকবুল আমার কলার চেপে ধরল…।
কী আশ্চর্য। কথা বললেও বিপদ। না বললেও বিপদ। আমি যাব কোথায়?