Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2023-03%2F51f0396d-5383-41e9-90b4-5533a0695861%2Fgolpo.jpg?rect=0%2C147%2C3508%2C1842&w=1200&ar=40%3A21&auto=format%2Ccompress&ogImage=true&mode=crop&overlay=&overlay_position=bottom&overlay_width_pct=1 />

যুদ্ধদিনে

মিজানুর রহমান নাসিম



দেখতে ঠিক একটা যুদ্ধের শহর। পায়ে দলা অঙ্কুরের মতো এই শহর আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আকাশের মুখোমুখি বেশ লাগছে দেখতে। আবার জীবনের ছন্দ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিবার আমার কাছে শহরটাকে তা–ই মনে হয়। আর মনে পড়ে, আমি তখন যুদ্ধদিনের কিশোরী। তারও আগে আমার সোনালু ফুলের মতো দোলানো বেণী ছিল। কলাবেণী। মা রোজ হাঁস মার্কা গন্ধরাজ তেল মেখে বিনুনি করে দিতেন। আমার মাথা থেকে ভুরভুরে মিষ্টি গন্ধ বের হতো। ছেড়ে দেওয়া চুলগুলো ছিল রেশমি সুতার মতো পেলব। আয়নায় দেখতাম রেশমি চুলে ছাউনি দেওয়া একটি চাঁদমুখ। মুনতাহার মতো। আমি কল্পনায় উড়ে উড়ে পাখা ঝাপটে ফুলে ফুলে গিয়ে বসতাম। নীল আকাশে উড়ত আমার বিশাল ধবল পাখা। এরপর নেমে এল যুদ্ধের নামে মানুষের নিষ্ঠুরতা!

আমি থাকতাম শহর থেকে বেশ ভেতরে। অজপাড়াগাঁয়ে। পাখিডাকা নিভৃত গ্রাম। সত্যিই ফুলপরিদের ওড়াউড়ি ছিল বেশ। ওখানে যুদ্ধের ঝনঝনানি ছিল না। কিন্তু শহরে হাঁটু গেড়ে বসা যুদ্ধ আমাদেরও ধীরে ধীরে জানান দিতে থাকে। অল্প কদিনেই যুদ্ধ আমাদের শহরের ওপর দিয়ে ভয়ানক একটা সুনামি বইয়ে দিয়েছিল। আর তার সিসাভারী বাতাসে আমার দুই বেণীও দিনে দিনে খড়ের দড়ির মতো পিঙ্গল ও খসখসে হয়ে উঠল। ঠিক যেন আকাদির রোদে পোড়া খসখসে খেজুরের পাতার মতো। আমার সামনে ছিল সীমাহীন ক্ষুধার দুঃস্বপ্নভরা একেকটা দিন–রাত্রি, যা নেকড়ের মতো আমাকে দিনরাত তাড়া করত। সাফা থেকে মারওয়া—কী ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছোটাছুটি! কোথাও একটুকরো মান্না সালওয়া নেই।

এখন আমি যখনই এ শহরে আসি, সোনার কাঠি রুপার কাঠি বদল করে সেই সব ঘুমন্ত দিনকে জাগিয়ে তুলি। যুদ্ধের দিনগুলো আমাদের মা-মেয়ের কাছে ছিল বিষম দুঃস্বপ্নের দিন।

এখন শহরে আসতে আমাকে নৌকা থেকে ডাঙায় উঠতে হয়। বিস্তীর্ণ নীল জলের ওপারে শহর। বারবার ভাবি, পৃথিবীর সব কটা শহর নদী-সাগরের পাড়ে বলেই এত সুন্দর! আহা, পৃথিবীর বিখ্যাত সব নদীর নাম বইপুস্তকে পড়তে পড়তে কল্পনায় বুঁদ হয়ে যেতাম। এখনো তা–ই। শিশুকাল সত্যিই আমাকে খুব তাড়া করে।

এই ব্রহ্মপুত্রের ওপার থেকে শহরটা দেখতে কীই-না অপরূপ! অথচ যুদ্ধের দিনগুলোয় সবার কাছে ওটা ছিল স্রেফ মৃত্যুপুরী। নদীর ওপার থেকে তাকিয়েই হয়তো সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। শহরের সবচেয়ে উঁচু পানির ট্যাংকের দিকে তাকিয়ে লোকজনের নাকি বুক ধড়ফড় করত।

সেসব দিন চলে গেছে। এখন বদলে যাওয়া সময়ে শহর, নদী, ডাঙা, আকাশ—আবার সবকিছু যুদ্ধহীন মানুষের দখলে! আবার বেঁচে থাকার বিচিত্র আয়োজন। দুনিয়াদারির ব্যস্ত সমারোহ।

খেয়া থেকে শহরটা খানিক উঁচুতে। পৃথিবীটা যে সমতল নয়, সেটা এই খেয়াঘাটে এলেই বোঝা যায়। উত্তর–পূর্ব সীমান্তের কর্ণজোড় পাহাড়ের মতো রাস্তাটা বেশ ওপরে। পথে বড় বড় খোয়া বিছানো। তার ফাঁকে ফাঁকে পা দেবে যাওয়া ধুলা। আজ আমার মনে হলো, পাতালপুরের রাজকন্যার মতো ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ ফুঁড়ে বেরিয়ে শহরে ঢুকছি।

মাঝনদী থেকে শহরটা দেখতে কেমন যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ বলে মনে হয়েছিল! যখন জেলা রাস্তায় উঠে দাঁড়ালাম, ভুল ভাঙল। নাহ্, ঠিকই তো আছে! আসলে আমি ভেবেছিলাম সেই রুক্ষ্ম দিনগুলোর কথা। অনেক দিন আগে শহরে যা কিছু ঘটেছিল, তার কথা। দুঃস্বপ্নময় অতীত আসলে আমাদের ক্ষমা করে না। বারবার তার হাতছানি। প্রতিবার নৌকায় উঠে আমি এমন অতীত

মোহাচ্ছন্নতায় আক্রান্ত হই। কী আর করতে পারি আমি, অতীতকে তো বিলকুল উধাও করে দেওয়া যায় না! তাও আবার যুদ্ধ। যুদ্ধ মোটেই কোনো মামুলি বিষয় নয়।

নিশ্চিত বলা যায়, এই জেলা রাস্তা ধরেই তখন মিলিটারি কনভয় টহল দিত। ঘড়ঘড় করে পুঁতিওয়ালা বেল্টের ট্যাংক চলত। টার্গেট করা এলাকা বা এমনিতেও একটু সন্দেহ হলেই কামানের নল তাক করা হতো নিমেষে। মানুষ হত্যার কী যে পৈচাশিক নেশা তাদের পেয়ে বসেছিল! জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে ছারখার করার, বিকৃত যৌন উল্লাসে মত্ত থাকার একেকটা হিংস্র দানব। জলপাই রঙের জিপে চড়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে যাওয়া সেই পীত দানবেরা!

ওইখানে রাস্তার পাশে ধানখেতের চকটার মাঝখানে পুরোনো একটা ইটভাটা ছিল। এখন ভাটাটা আয়তনে অনেক বড়। স্বাধীন দেশ নিশ্চয়ই পয়মন্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে! ভাটার মাঝখানে শিবলিঙ্গের মতো গোল-উঁচু চিমনি। কালো অক্ষরে লেখা ‘এমবিএল’। আকাশে চিমনির দাহ-ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে। কয়েকটি মাটির কৃত্রিম টিলা। সেখান থেকে মাটি নিয়ে দলা পাকানো হচ্ছে। এরপর ছাঁচ। পোড়ানোর অপেক্ষায় বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে বিস্কুটের মতো থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয় ওগুলো। ঠিক যেন অন্য রকম হলোকাস্ট! বেশি না, মাত্র পঞ্চাশ বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তেরো। কিন্তু বয়সের তুলনায় বেশ পরিণত চিন্তা ছিল আমার। আর ছিল লড়াই করে টিকে থাকার ইচ্ছেশক্তি। যদিও আমি ওই মাটির দলার মতোই পুড়ে খাক হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। পূর্ব বা পশ্চিম, সাদা বা কালো—যুদ্ধের মেয়েরা অমনই হয়।

ইটভাটার পাশের জায়গাটা মনে হচ্ছে আগে ফাঁকা ছিল। যুদ্ধ শেষে বেশ কয়েক বছর বাবার সঙ্গে রিকশায় শহরে যাওয়ার কথা মনে পড়ছে। তখন ওটার পশ্চিম পাশে দুটো পাকিস্তানি জিপ পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। চাকা বসে যাওয়া। দুমড়ানো, লন্ডভন্ড। ঠিক ভাঙা খেলনার মতো। চৌচির হওয়া উইন্ডশিটে ধুলার পুরু আস্তর। পুড়ে যাওয়া সিটকাভার। ওদের পরাজয়ের দারুণ এক প্রতীক ছিল ওটা। জিপ দুটো নাকি এখন জাদুঘর প্রাঙ্গণে প্রদর্শনীর জন্য রেখে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু অবাক কাণ্ড! যতবারই আমি খেয়াঘাট পার হয়ে জেলা রাস্তায় পা রাখি, ততবারই জিপ দুটো ওখানেই পড়ে থাকতে দেখতে পাই। মনে হয়, ভাগাড়ে পড়ে থাকা মস্ত বড় দুটো মহিষের মাথার কঙ্কাল!

যুদ্ধের পরের বছরের এক সকাল। বাবা আমাকে শহরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক ওখানেই আমার কৌতূহল দেখে বাবা রিকশা থামালেন। রিকশায় বসেই উঁকি দিয়ে আমি জিপ দুটোর ভেতর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। ডানাভাঙা মূর্তির মতো জিপ দুটোর বিবর্ণ দরজা ভাঙা। ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দুটো গাড়ির দুটো কালো পোড়া স্টিয়ারিং। পাশে, পেছনে কাভারহীন সিটের ধাতব কাঠামো। সবকিছু ছাপিয়ে স্টিয়ারিং দুটোর দিকে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। জংধরা বাঁকানো স্টিয়ারিং দুটো যেন অবনত মস্তকের দুজন বেলুচ জওয়ান। বেদম মার খাওয়া। আপাদমস্তক ভীষণ পরাজিত, ভয়ার্ত! ওরা সবাই নির্মম পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। ইতিহাস ওদের ক্ষমা করেনি। আমার মনে হয়েছিল, মরচেধরা স্টিয়ারিং দুটো, যাদের আমি বেলুচ সৈন্য নামে ডাকছি, এ দুজন ওদেরই সবার আদল। বেলুচ সৈন্য দুজন সব দানবের হয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে!

এই শহরে ঢুকলে একে একে সব মনে পড়ে। যুদ্ধের মেয়েদের সব মনে রাখতে হয়। আমার গাঁয়ের সেই দিনের কথা। সেদিন ছিল সবে সন্ধ্যা। আমাদের গ্রামজীবনের চিরাচরিত সন্ধ্যা। ঘন অন্ধকার জেঁকে বসছে। গোয়ালে মশা তাড়ানো ধোঁয়া উড়ছে বেলা থাকতে থাকতেই। ধোঁয়ায় পুরো গ্রামটাই যেন ঢেকে গেছে। রাতের একপ্রহর পার হলে একপশলা দমকা বৃষ্টি হঠাৎ গাঁয়ের মাথায় আছড়ে পড়ছিল। যেন সাত–তাড়াতাড়ি নেমে আসা অন্ধকারকে মুছে দিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার

আরও জাঁকিয়ে বসল। বৃষ্টির হালকা ছাঁটও তখন থেমে থেমে চলছে। শেষরাতে বৃষ্টি একেবারে ক্ষান্ত দিতেই বোঝা গেল নিশিপতঙ্গের ক্লান্তি নেই। আরও খানিকটা সময় বিবিধ পতঙ্গের ডাক শীত নামাল চারপাশে। যদিও কাঠচৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ।

বেশ শিরশিরে ঠান্ডা লাগছিল। আমরা তিন বোনে কাঁথা টেনে নিলাম। হয়তো বাবার চোখে আমরা তিন অপয়া, যারা তার ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে অপারগ। গাঁয়ের সব মেয়েই অবশ্য এমন অপয়াই ছিল। শেষরাতে নাটাকুড়া বিল আপাদমস্তক কুয়াশায় ঢেকে আছে। বেরোনোর আগে তাই বাবা অন্ধকারে হাতরে চাদরটা বের করলেন। এমন একটা ভঙ্গিতে চাদরটা ঘাড়ে তুলে নিলেন, যেন বলতে চাইছেন, এই আরকি!

ভান করলাম, আমরা সবাই ঘুমে। দেখলাম বাবাও কাউকে জাগাতে চান না। মাকেও না। বাবা ঘরে পা টিপে টিপে হাঁটছেন। কয়েক মুহূর্ত পর টর্চ নিভিয়ে তিনি চৌকাঠ পেরোলেন। বাবা মনে হয় চা খেতে বাজারে যাচ্ছেন। পরক্ষণে আমি আঁতকে উঠলাম, অন্ধকারে কিসের চা খাওয়া বাবার!

ভোরের আভা আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মাঝরাতে একপশলা বৃষ্টি হঠাৎ নেমে এসেছিল গাঁয়ে। আমি কল্পনা করতে থাকি, গাঁয়ের ভেজা জংলা পথটার দুপাশে ভুরভুরে সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। জংলি ফুলের পাপড়িগুলোরও কী ভারি মিষ্টি ঘ্রাণ! অথচ জলা-জংলার বলে আমরা যেমন অপয়া, ঠিক তেমনই উপেক্ষিত। বাবার নিজেকে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে ভীষণ সজীব আর করিত্কর্মা। জুম্মাঘরের চৌচালাটি পেরোনোর সময় তিনি একচিলতে পেছনে ফিরে তাকালেন। তাকাবেনই তো, বাবা তো আর গজারি কাঠ নন! মুহূর্তে তাঁর প্রশস্ত শ্যামলা মুখের পেশি টান টান হলো। আর এটা আমার দৃষ্টি এড়াল না। তিনি হনহন করে এগিয়ে চললেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই দলটা নিয়ে তাঁকে মল্লিকবাড়িতে পৌঁছাতে হবে। তারপর মহকুমা সদরের নির্দেশনায় পরবর্তী কাজ বা গন্তব্য। তাঁরা কেউই জানেন না, কোথায় কত দিন থাকতে হবে। যুদ্ধ মানেই তো অনিশ্চয়তা। ছোটবেলার প্লাস্টিকের অক্ষরের মতো একটা বড় রঙিন প্রশ্নবোধক চিহ্ন! একই সঙ্গে বিস্ময় আর করুণ তামাশা!

দেড় মাইলের পথ। সেখান থেকে জেলা রাস্তাকে ডানে রেখে গ্রামের আলপথে ঢুকে পড়তে হবে। আরও চার-পাঁচ মাইল। এ সময় জেলা রাস্তা মানে মিলিটারি কনভয়ের মুখোমুখি পড়া। বাবাদের সাত-আটজনের দলটি হনহন করে হাঁটছে। বিলের মাঝখানের পথটা পার হওয়ার সময় কুয়াশামাখা বাতাসের ঝাপটা তাঁদের মুখে লাগছে। যাঁদের গা খালি, তাঁদের গায়ে শীতের কাঁপন ধরার কথা। চারপাশের গ্রাম তখনো জাগেনি।

ফাঁকা বালিশটায় হাত পড়তেই মা চমকে উঠলেন, ‘এ কেমুন মানুষ গো! ডাকটাও দিব না? মুনে চাইল আর সবেরে থুইয়া বারায়ে গেলগা! একটা বালামুন্দ কতা ত আছে! যুদ্দও কি পুলাপাইন্যা কাম! এই যাওয়া যুদি শেষ যাওয়া অয়! যুদিল যুদ্দের ময়দানে মানুষটা মইরে পইড়ে থাহে! যদি তারে টেটা গাঁতার মতো গাঁইতে ফালায়! যুদিল পানির পিপাসায় ছাতি ফাইট্টা মরে! যাবা যাও। বইলে-কয়ে যাও। এইভাবে বারান নাগব? নাস্তাপানিটেও ত মুখে পড়ল না। কেরা খাওয়াব, নাকি না খায়েই থাকা নাগব?’ বাসি মুখে একনাগাড়ে মায়ের প্রলাপ চলছিল। আমি বলে উঠি, ‘থাক না মা! চলেই তো গেছে আর বলে-কয়ে কী হবে?’

মা আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। আহা, মা বুঝতেই চাইছেন না যে এখন এসব অর্থহীন। মা কি জানেন না যে তাঁর হাতে কোনোকালেই বাবার চলাফেরার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না! এখনো নেই। এবার আমি বালিশে খানিক মাথা তুলে আবছা অন্ধকারে মায়ের দিকে তাকাই। তাঁর ঘুমভাঙা চোখে আতঙ্ক ধেয়ে আসছে। বাবাকে শেষ একনজর দেখাটাও বুঝি আর হবে না, এই চিন্তায় মায়ের মুখটা কালো। বুঝতে পারি, পিপাসায় তাঁর গলা খাঁ খাঁ করছে। অথচ উঠে একটু পানি এগিয়ে দেব, তারও উপায় নেই। মা লজ্জা পেয়ে যাবেন। বরং তিনি নিজেই নিয়ে খাক।

বাবার প্রস্থান নিয়ে বিদ্‌ঘুটে এক চিন্তায় মায়ের মাথা ভারী হয়ে আছে। মাথাটা কোনোমতেই তুলতে পারছেন না তিনি। অভিমানও তাঁর বুকে ডুকরে ডুকরে উঠছে। যদিও মা জানেন, শুধু যুদ্ধে যাওয়া কেন, এমনিতেও তো তাঁকে কোনো দিন গা করেনি কেউ। না স্বামী, না অন্য কেউ। বাবা নিজের খেয়াল-খুশিমতো যখন যা ইচ্ছা, তা–ই করেছেন। স্বামীর বাপ-ভাইরা এতে প্রতিবারই ফুলে-ফুঁসে উঠেছে আর বিষ ঢেলেছে তাঁর মগজে। সব দোষ যেন তাঁর। তাঁর কেমন করে দোষ থাকবে? তবু মা কখনো প্রতিবাদ করতে পারেননি। পারার সাহস তাঁর কোনো দিন ছিল না। মা শুধু চোখের পানি ঝরানোর অকামটাই করতে পারেন, আর কিছু না। তবে মায়ের জানা, তিনি হলেন ছফর মুদির ঘানির বলদ, হুকুমের দাসি। সবাই অদৃশ্য চাবুক ঘুরিয়ে হুকুম করে যাবে। তাঁকে সেই হুকুম তালিম করতে হবে কোনো বাক্যব্যয় ছাড়া। ঝড়ুর মা বা পিয়ারির সঙ্গে তাঁর কোনো পার্থক্য নেই। মাকে আমার মতো করে কে আর বুঝতে পারে?

বিছানায় থ মেরে বসে আছেন মা। পাশে তাঁর একমাত্র ছেলে ঘুমে। মায়ের; বিশেষ করে বাবার বংশের বাতি। বাবা আমাদের তিন বোনকে কখনোই বাতি হিসেবে ভাবতে চাননি। অবশ্য শুধু বাবাকে দোষ দিয়েই বা কী করি, আমরা তো আসলেই তা হতে পারতাম না। আমরা একেক বোন কবে কোথায় ছিটকে গেছি! বাতি হতে গেলে তো স্থিতি লাগে, আমাদের স্থিতি কোথায়? পঞ্চাশ বছর আগের মা আর পঞ্চাশ বছর পরের আমি; কীই–বা তেমন তফাৎ!

মা এখন কিছুতেই স্বস্তি পাবেন না। আমি যা–ই বলি, তাঁর মাথায় হড়হড় করে কীসব ঢুকে পড়ছে। একটুও থামাতে পারছেন না মা। স্বামীর শূন্যতা তাঁকে এত পোড়াচ্ছে! আহা রে, মা বাবাকে এত ভালোবাসেন! মা আমাকে বললেন, ‘বুজলা, চোখের সামনে থাকলেই শান্তি। কও ত আমারে, যুদ্দে যাওয়া কি সুজা কতা! ফিরে আওয়াও কি এতই সুজা!’ মা মিনমিন করে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। আমি মাকে সান্ত্বনা দিতেও ভয় পাই।

মা ঠিকই বলেছেন। যুদ্ধ এমনই ব্যাপার, যেখানে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না, তাঁকে কে স্বাগত জানাবে! আমি ভাবতে ভাবতেই দেখি, মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। পরমুহূর্তেই নিজেকে সংযত করেন। আমি কিছুই বলছি না। কেঁদে–কুটে মা একটু হালকা হোক।

বাঁশঝাড়ের আড়া পাখপাখালির চেঁচামেচিতে সরব হয়ে উঠছে। পুবের চৌয়ারি ঘরে চলছে আমার বাবার বাপের একটানা জিকির। সুফি ঘরানার মানুষ তিনি। বাবার বাপের জিকির চলবে বেলা ওঠার আগপর্যন্ত। তাঁর রোজকার ইবাদত এভাবেই চলে। সকাল ও সন্ধ্যা দুইবেলা। বেলা ওঠা আর বেলা ডোবা। খোদার মুখোমুখি হন তিনি? নাকি নিজেরই মুখোমুখি হওয়া সেটা? দিলের আয়নায় আদমসুরতটার সাক্ষাৎ পেতে চান তিনি!

তখন বাবার বাবা হাত–মুখ ধুয়ে জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসে ছিলেন। ঘরে ঢুকে তাঁর টেবিলে ভাত-তরকারি সাজাচ্ছিলেন মা। বাবার বাপ প্রশ্ন শুরু করলেন। মা যেন তৈরি হয়েই ছিলেন, ‘আমারে কইয়ে যায় নাই।’ মায়ের এ কথায় বাবার বাপ দেশলাই কাঠির মতো ফাত করে জ্বলে উঠলেন। বাবার বাপ ক্রোধে উন্মাদ। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, বাবার বাপ কী অবলীলায় তাঁর সুফিমূর্তি নিজেই ভেঙে খান খান করে দিলেন!

অল্প কদিনেই গ্রামের জীবন বেশ পাল্টে গিয়েছিল। গাঁয়ের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর হলেও ঠিক সময়মতো রেডিও শুনতে হাজির হতো গোঁসাই বাড়ি, খলিফা বাড়ি বা মুহুরি বাড়ির দহলে। আমি নিজেও কয়েকবার দৌড়ে গেছি রেডিও শুনতে। মা চাচ্ছিলেন, আমি যেন না যাই। আমি মাকে বলেছিলাম, এসে তাঁকে যুদ্ধের খবরাখবর জানাব। মা হয়তো বাবার কথা স্মরণ করে আমাকে যেতে দিয়েছিলেন। মা কি ভেবেছেন, বাবার খোঁজও ওতে জানা যাবে? মা এত বোকা! সরল–সোজা মা আমার!

শ…শ…শ! রেডিওর ভেতরও কি যুদ্ধ চলছিল? গিয়ে ভিড় দেখে মনে হলো, লোকজন যেন বয়াতির পালা শুনতে এসেছে। অথচ আগে গান ছাড়া কতজনই বা রেডিওর সংবাদ শুনত? আমিও শুনতাম না। অথচ তখন যেখানে যা পেতাম, কান লাগিয়ে শুনতাম। তার অনেক কিছুই বুঝিনি। এখন বেশ বুঝতে পারি। নিশ্চয়ই লোকজন বলাবলি করছিল, শেখ মুজিবরকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁকে মেরেই ফেলা হবে। সেই খবর শুনে অফিসের বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন ইন্দিরা গান্ধী। যশোর রোডে শরণার্থীদের লম্বা মিছিল। রেডিওতে ওসব নতুন নতুন কথা! কিছু কথা আবার লোকমুখে ফুলে–ফেঁপেও উঠেছিল।

মহকুমা থেকে আমাদের গ্রাম পাঁচ মাইল। তিন মাইল জেলা সড়ক, দুই মাইল এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। তবু কখন আর্মি ঢুকে পড়ে, সে কথাও বলছিল সবাই। মা-ও প্রতিদিন কিছু না কিছু বলেন। গাঁয়ের মহিলারা তাঁকে প্রতিদিন কিছু না কিছু নতুন খবর দিয়ে যায়। আতঙ্ক আর দুঃস্বপ্নের ঘোরপ্যাঁচেও হাল আবাদের আয়োজন চলে। হাট–বাজারও বসে। তবে কেমন ভুতুড়ে। বাজারে ক্রেতার চেয়ে খবরসন্ধানী মানুষের সংখ্যাই বেশি। লোকমুখে শহরের সংবাদ আসত হাটে। নানা কান হয়ে আমাদের কানেও পৌঁছে যেত। শহরে ভারী ভারী আর্মি জিপ দিনে–রাতে সড়ক কাঁপিয়ে ছুটছে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে আস্ত গুলি-রসদ তুলে নিয়ে খালাস হচ্ছে পিটিআই ক্যাম্পাসে। শুধু অস্ত্র নয়, দল বেঁধে মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যাওয়া হতো সেখানে। শুনতে শুনতে মা বলতেন, ‘খোদার গজব পড়ুক জালেমদের উপর।’

দেখতে দেখতে চার মাস পেরিয়ে গেছে। প্রতিবেশী মহিলারা সকাল–বিকেল আসেন। উঠানে বসে গালে হাত দিয়ে কেউ কেউ বিলাপ করেন, ‘কবে দ্যাশ স্বাধীন অব? সব মানুষ মইরে সাফ অইলে অব? মামাডা যে কবে আহে? সুখের দিন পার অইতে দেহা যায় না গো মামি। কষ্টের সুমায়ই ভারী পাত্থর, নড়ে না!’

মা কারও কথায় সাড়া দেন না। মা নির্বিকার পাথর। আজকাল কোনো কথাই বুঝি আর তাঁর মাথায় ঢোকে না। মা যখন টলতে থাকেন, তখন বোঝা যায়, ক্ষুধায় তাঁর শরীরটা কেমন মাটিতে নেতিয়ে পড়ে। এত ক্ষুধা তাঁর পেটে কোথায় লুকিয়ে ছিল? বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতে এসে মা দাসির মতো খেটেছে। কাজের চাপে সকালের খাবার দুপুরে, দুপুরের ঠান্ডা ভাত সন্ধ্যায়। কই, তাঁর কখনো তো নিজের খাবারের প্রতি একবিন্দু নজর ছিল না। বরং খাবারটাই প্রায়সময় ঝামেলা মনে হয়েছে। অথচ এখন দুর্দিনে তাঁর হাভাতেপনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমাদের সামনে মা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তাঁর চোখ–মুখ লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। সন্তানদের মুখে খাবার দিতে পারেন না, নিজের খাই খাই! মা রাগে আপনমনে গরগর করেন! তখন আমাকে সব সামলে যেতে হয়।

বয়সের চেয়ে তাই আমি সাত–তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিশোরী থেকে মায়ের মতো রমণী। মা পরিণত হতেন বৃদ্ধাতে, যিনি কিনা অল্পদিন আগেও অনেক কিছু সামলাতে পারতেন। কত দক্ষ সংসারী ছিলেন মা! সেই মা, শিকড় উপড়ানো চারার মতো দিনে দিনে নেতিয়ে পড়ছিলেন। দুঃসময় মানুষকে কত বদলে দেয়!

যুদ্ধের ঝনঝনানি আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিল। কিন্তু তার ঢেউ বাতাসে প্রলম্বিত হয়ে আছড়ে পড়ত। যুদ্ধের উন্মাদনা আর নিষ্ঠুরতা আমরা বেশ টের পাচ্ছি। আমাকে এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে হচ্ছে। দূর প্রান্তের প্রতিদিনের লড়াই হতাশা আর বিষণ্নতা নিয়ে জানান দেয়। ওসব আমাকে তত দিনে অনেক কথা বুঝতে সমর্থ করে তুলছে। সবার সব কথা আমার বোঝা চাই—নতুন নতুন অনেক কথা, অনেক শব্দ। বুঝতে পারি, মা ও ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে আমাকে অনেক কিছু জানতে হবে। অনেক কঠিন দায়িত্ব আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি তা ধারণ করার জন্যে প্রস্তুত। এতে মা একটু হালকা হতে পারবেন। আমি মায়ের কষ্টটা হালকা করে দিতে চাই। তাঁর হাতটা দিনে দিনে নুলো হয়ে পড়ছে। মা আর পারছেন

না। আমি চাই মায়ের শক্ত–সমর্থ হাত দুটো নিজের মধ্যে ধারণ করতে। সেই মন্ত্র আমার জানা চাই, যা দুঃসময়ে টিকে থাকতে সাহায্য করবে।

শহর ও আশপাশে তুমুল যুদ্ধ চলছে। এই গ্রামে থেকেও তা আন্দাজ করা যায়। টাঙ্গাইল রোড থেকে পাথালিয়া—পথে-পগারে পড়ে আছে অসংখ্য মৃতদেহ। শিয়ালে–শকুনে টেনেহিঁচড়ে খাচ্ছে লাশ। পথের পাশে ঝোপ-জংলায় শিয়াল-শকুনের টানাটানিতে মৃত নারীর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে সন্তানের অর্ধগলিত দেহ। ধর্ষিত যুবতীর কাটা সন্তান কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ভাগাড়ের কীট। পচা লাশের দুর্গন্ধে নাড়ি–ভুঁড়ি উগরানো বমিতে নাকাল হচ্ছে পথচারী। পুরো দেশটাকে বুঝি জাহান্নামের ভাগাড় বানিয়ে ফেলেছে পিশাচেরা!

প্রায়রাতেই লাগাতার গুলি আর কামানের শব্দে গ্রামটা কেঁপে ওঠে। হঠাৎ সবাই ঘুম থেকে ধড়ফড় করে জেগে ওঠে চৌকিতে জড়সড় হয়ে বসি। ছোটরা ভয়ে কাঁপতে থাকে। আমি আর মা সবাইকে মুরগিছানার মতো জড়িয়ে ধরে অপেক্ষা করতে থাকি। মা সুরা পড়তে থাকেন, কখন গোলাগুলি বন্ধ হয়। শেষরাতের মেইল ট্রেনের শব্দেও আমাদের বুক কাঁপে। অথচ আগে ট্রেনের শব্দটা আমাদের ঘুমের মধ্যে ছন্দ তুলে কেমন নাচানাচি করত। বিশেষ করে যখন নানাবাড়িতে থাকতাম, ঝিনাই নদের লোহার ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটে চলা ট্রেনের কী দারুণ ঝমঝমানি! বিশেষ করে রোদে পোড়া দুপুর ও রাতে পৃথিবী খানিকটা অবশ হয়ে গেলে। ভোরে আমরা রেললাইনে গিয়ে সাদা সাদা পাথর কুড়াতাম আর অবাক হতাম। কেমন করে দুটো সরু পাতের ওপর দিয়ে বিশাল ট্রেনটি কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছুটে চলে। এখন ট্রেনের ওই শব্দও বুঝি ধ্বংসলীলার অংশ।

চার মাস পার হলেও বাবার সংবাদ পাওয়া গেল না। তবে সবাই বলছে, যুদ্ধ শেষ হতেও বেশি সময় লাগবে না। বাবা ফিরে এলে আমাদের ভয়ানক দিনগুলোর অবসান হতে পারে নিমেষেই। কিন্তু না ফিরলে অপেক্ষা করবে অনেক জটিল হিসাব-নিকাশ। লোকজনের কথাই সত্যি হলো। বাবা তিন-চার দিন আগে খবর পাঠিয়েছেন। তার মানে, বাবা বেঁচে আছেন! আমরা সবাই যেন আড়মোড়া ভেঙে বর্তে উঠলাম। কিন্তু কদিন যেতেই আবার আশার আলোটি মিলিয়ে গেল।

দুই দিনের উপবাস চলছিল। আমি মায়ের মতো অত বেশি দম ধরে থাকতে পারি না। এক সকালে জেদ ধরলাম নানাবাড়িতে যাওয়ার। আমাকে কিছু জোগাড় করতে হবে। মা ভয়ে শিউরে উঠলেন। তাঁর বাম চোখ লাফাতে লাগল। মা আমাকে কিছুতেই যেতে দেবেন না। আমার জেদ চেপে বসল। এত দিনে আমার মনটা চটি সাবানের মতো শক্ত, খসখসে হয়ে গেছে। কোনোকিছুরই ডর–ভয় আমার নেই। মায়ের মাথা কোটা সত্ত্বেও আশ্বিনের এক সকালে আমি রওনা দিলাম। সঙ্গে এক প্রতিবেশী মহিলা ছিলেন। তাঁর বাবার বাড়িও ওইদিকে। উনিও যাবেন কিছু পাওয়ার আশায়।

নানাবাড়ি প্রায় পাঁচ মাইল। দিগন্তবিস্তৃত বিলের মাঝখান দিয়ে কাঁচা সড়ক। এখানে–সেখানে কাদা-পানি-কচুরিপানায় একাকার। কোথাও কোথাও প্রায় কোমরপানি। এত দূর পথ হাঁটা, তার ওপর বিল পার হওয়ার শক্তি আমার নেই। ক্ষুধায় আতঙ্কে প্রতিটি দিন পার করতে করতে অল্প কয়েক দিনেই আমার জীবনী শক্তি ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু সেদিন আমি কোনোকিছুকেই তোয়াক্কা করলাম না। পা দুটো ছেঁচড়ে টেনে হলেও আমি থামব না। চোখের পলকে আমরা বড় রাস্তা পার হলাম। তারপর শরণার্থীর মতো হাঁটতে হাঁটতে সেই রেললাইন পার হলাম, যেখানে আমি শেষবার এসে পাথর কুড়িয়েছি। এবার কুড়াতে এসেছি বেঁচে থাকার রসদ।

পরদিন সকালে দুজন বস্তা কাঁখে বড় রাস্তা পেরিয়ে গ্রামে ঢুকছি। ভাবলেশহীন আমাদের রাস্তাহাঁটা। গুলি-কামান ছুটে এলেও আর থামব না। বড় রাস্তা পেরিয়ে অনেকটা পথ ফাঁকা। তারপর গাঁয়ের বসতি। বড় রাস্তার পাশে বলে মিলিটারি আতঙ্কে অনেক বাড়ি ফাঁকা। কোনো কোনো বাড়িতে মানুষজন থাকলেও চোখে পড়ে না। ফাঁকা রাস্তায় আমরা ধুঁকে ধুঁকে এগোচ্ছি। মনে হয় বিরান মরুভূমি। মাইল পার হলেও জনমানুষের চিহ্ন নেই।

একসময় ক্লান্তি আমাকে পথ এগোতে দেয় না। একটু পরপর জিরাতে হলো। যেতে যেতে সামনে আবার বিল। বিলের পাড়ে এসে আমার চোখে আগুনের ফুলকি ছুটছে। বিলটা বুঝি এবার আর পার হওয়া যাবে না। মাঝপথে গিয়েই বস্তাসহ ডুবে মরব। আমরা বাঘমারা বিলকেও হারিয়ে দিলাম। পুলসিরাত পার হয়ে বাড়ি পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল। শব্দ শুনে মা বের হলেন। বিজয়িনী কিশোরীকে মা বুকে চেপে ধরলেন!

আমরা কেউই সময়কে আটকে রাখতে পারি না,শত্রু বা মিত্র কেউই না। তুমুল লড়াই চলছে। দুদিন ধরে যুদ্ধবিমানের আনাগোনা বেড়ে গেছে। দিনে–রাতে আকাশজুড়ে বিকট চিত্কার। মনে হচ্ছে, লাগাতার বিদ্যুৎ চমকে আকাশটা বিদীর্ণ হচ্ছে শেষ দিনের মতো। ক্ষণে ক্ষণে বর্শার ফলার মতো গেঁথে যাচ্ছে পৃথিবীতে।

হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে আমরা ঘুম থেকে একরাতে চিত্কার দিয়ে উঠি। আমার মনে হয়েছিল একটা যুদ্ধবিমান বুঝি মাথার ওপরই আছড়ে পড়ল! এই আমরা সবাই শেষ! এই সব ক্ষুধা, টিকে থাকা, খবর শোনা আর অপেক্ষা—সব শেষ হতে চলছে। আসলে ওটা সব শেষের পথেই এগোচ্ছিল। পরদিন সকালে জানলাম, শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান ঘাঁটিতে ফেলা হয়েছিল মিত্রবাহিনীর ৫০০ পাউন্ডের বোমা। মিগ টোয়েনটি–ওয়ান থেকে ছোড়া ওই বোমার আঘাতে শুধু হেডকোয়ার্টার কম্পাউন্ড নয়, ওদের মনোবলেও ফাটল ধরেছে।

পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে দ্রুত। রাত পোহালেই নতুন নতুন খবর। আমরা দারুণ আশাবাদী হতে থাকলাম। হয়তো বিজয়ীর বেশেই বাবা ফিরে আসবেন। মায়ের চোখমুখ দেখে বোঝা গেল, সেই স্বপ্নেই তিনি বিভোর। তাঁর শুকনা খসখসে মুখটায় কেমন সুখের আমেজ! জয় বা পরাজয়ের ভিন্ন দুটি আবহ সৃষ্টি করার এতই প্রচণ্ড ক্ষমতা যে সেই আবহ দিয়ে আমরা মৃত্যুকূপেও নিমেষে নিজেদের বদলে ফেলি!

সব চোখে চোখে রাখছিলাম। কোন কোন এলাকা শত্রুমুক্ত হয়েছে, সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে! দুদিন যেতে না–যেতে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাদের চরম পরাজয় ঘটল। পরে বুঝেছি, যুদ্ধের সূত্রে এর অর্থ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা। কী দামামাই না বাজিয়েছিল এত দিন! আমরা আনন্দে উত্ফুল্ল হয়ে উঠলাম। ১১ নম্বর সেক্টর ও কাদেরিয়া বাহিনী এখন বিজয়ীর বেশে রাজধানীমুখী। খবর এল, দেশজুড়ে পাকিস্তানি আর্মিরা নেড়িকুত্তার মতো আত্মসমর্পণ করছে। আমি কল্পনা করলাম, তাদের হায়েনাচোখ মাটিতে ঢুকে যেতে চাইছে। ভয়ে আত্মগোপন করছে রাজাকার-আলবদররা। কেউ কেউ পলাতক শেয়ালের মতো মারা পড়ছে জনতার হাতে।

নিয়াজির আত্মসমর্পণের খবর এল। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়িমুখে ছুটলাম। মাকে খবরটা এখনই জানাতে হবে। শুনেই মা খুশিতে আত্মহারা হলেন। মা যেন নিয়াজিকে চেনেন!

মাঘ মাসের হাড়কাঁপানো এক পড়ন্ত বিকেল। মুহূর্তে দু–চার গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ল, মুক্তিযোদ্ধারা আসছেন। দলে দলে লোক রাস্তার পাশে জড়ো হয়েছে তাঁদের দেখতে। সবার চোখেমুখে আনন্দ-উত্তেজনা উপচে পড়ছে। যদিও অনাগত দিনগুলোর ছবি সবার কাছেই অস্পষ্ট, এমনকি ভাবনারও অতীত।

আমি মাকে কিছু না বলেই দিলাম ভোঁ–দৌড়!

ইটভাটার চিমনি থেকে গলগল করে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হয় আকাশটাকে ধোঁয়ার জালে আটকে ফেলবে। বাড়িতে যাওয়ার একটা তীব্র ছটফটানি আমাকে পেয়ে বসল। ধূসর জিপ দুটো দেখতে দেখতে আমি রিকশায় উঠে বসলাম। সিটের ফাঁকা জায়গাটায় মায়ের মতো করে হাতরালাম। আহ্, বাবা আমাকে কতবার শহরে নিয়ে এসেছিলেন!