রোমেল প্রথমে ভেবেছিল, ঘড়িটা ঠিক নেই।
রাতে আচমকা ঘুম ভাঙার পর সরু চোখে সে দেয়ালঘড়িতে তাকায়। তিনটা সতেরো। ঘড়িটা হয়তো ঠিকঠাকই চলছে। তবু মনে হয়, এটা কীভাবে সম্ভব?
মা বললেন, ‘খোকা, উঠে আয়।’
ধাতস্থ হয়ে সে মাকে অনুসরণ করে।
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই মাঘশীতের হাওয়ায় গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু মায়ের ফিসফিস করে বলা কথায় রোমেলের ভেতরসুদ্ধ কেঁপে যায়। নিজের কানকেও বিশ্বাস হয় না। সে স্ট্যাচুর মতো নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।
মা গলাটা খাদে নামিয়ে বলেন, ‘নবনীর পেটে বাচ্চা। তিন মাস পেরিয়েছে। কী করি, বল তো? তোর বাবা হার্টের রোগী। সে এখনো কিছু জানে না।’
ছোট বোন নবনী কেবল কলেজে পড়ছে। এখনো বিয়ে হয়নি। ওর পেটে কীভাবে…!
কয়েক মুহূর্ত কথাহীন থমকে থাকে। ধাতস্থ হয়ে রোমেল বলে, ‘এসব কী বলছ, মা?’
মা নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করেন।
‘ও কারও নাম বলেছে?’
মা দুপাশে মাথা দোলান।
দূরের রাস্তায় একটা গাড়ি রাতের নৈঃশব্দ্য চুরমার করে ছুটে যায়।
‘কীভাবে ঘটল?’
মা ফুঁপিয়ে ওঠেন, ’মানুষকে মুখ দেখাব কী করে, খোকা? আল্লাহ গো!’
ভেতরে খুব অস্বস্তি হয় রোমেলের। মাথায় কিছু কাজ করে না।
খুট করে একটা শব্দ হয়। নবনী হয়তো জেগেই ছিল। বারান্দা থেকে ঘরের দিকে যেতেই সে রোমেলের হাত চেপে ধরে আর্তচিৎকার দেয়, ’দাদা!’
কী বলবে রোমেল, কী বলা উচিত; বুঝতে পারে না। সে নবনীর মাথায় হাত রাখে, ’রাত হয়েছে। যা, শুয়ে পড়।’
নবনী তবু দাঁড়িয়ে থাকে। রোমেল ঘরে এসে কম্বলটা মাথার ওপর চাপিয়ে শুয়ে পড়ে। মরার মতো ঝিম মেরে পড়ে থেকেও ঘুম আসে না।
পরদিন হাসপাতাল আর ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করে কাটে। ভাগ্যিস, ভাই-ভাবি কিছুদিন বাসায় নেই। বড় বোন এখনো কিছু জানে না। কিন্তু এসব কথা কি আর চাপা থাকে?
সারা দুপুর রোমেলের কিছু খাওয়া হয়নি। পেটের চেয়েও বেশি যন্ত্রণা মাথায়। কী যে হয়! কোনো বিপদ হবে না তো!
দুই–একটা হাসপাতাল সরাসরি না করে দিয়েছে। তারা কিছুতেই অ্যাবরশন করবে না। দুই–একজন রাজি হয়েছে, কিন্তু অনেক টাকা চায়।
ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসতে থাকে। পেটে কিছু দানাপানি দেওয়া দরকার। জগতের বেশির ভাগ মানুষের চিন্তাই পেট নিয়ে। পেট না থাকলে জীবনটা হয়তো সুন্দর হতো।
রোমেল এক বন্ধুকে ফোন করে। সে পরিচিত ক্লিনিকের খোঁজ দেয়। সব শুনে ডাক্তার বলেন, ‘আগামীকাল দুপুরে আসুন।’
একটা যাহোক ব্যবস্থা তো করা গেল, ভেবে সন্ধ্যায় রোমেল ঘরের পথে পা বাড়ায়। নানা কথা মনে আসে। এ রকমই এক সন্ধ্যায়, ওরা তিন বন্ধু সাতরাস্তা থেকে মগবাজারের পথে হেঁটে যায়। পথের পাশে ভিখিরি, গাঞ্জাখোর ও পথচারী। আচমকাই ওর মনে হয়, দুনিয়ায় ভিখিরিরাই সবচেয়ে ভালো আছে। শুধু পেট নিয়ে ওদের যত দুশ্চিন্তা। পেটই ওদের জীবন, হয়তো ঈশ্বরও।
এক ভিখিরি মহিলাকে দেখতে পায় রোমেল। ওর দুটো সন্তান ফুটপাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কোলের শিশুটি দুধ ছাড়েনি। স্বামী লাপাত্তা। সে আবারও গর্ভবতী। কাছে যেতেই বলে, ‘এক শ টাকা দে।’ রোমেল উল্টা জিজ্ঞেস করে, ‘কার ওটা?’
মহিলাটি নির্বিকারভাবে বলে, ‘তোর বাপের।’
‘মুখ সামলে কথা বল বেটি’ বলতে গিয়েও তিন বন্ধু হা হা করে হেসে উঠে পালিয়ে বাঁচে।
কিন্তু অবিবাহিত ছোট বোনের পেটে বাচ্চা আসায় সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। সারা বাড়িতে কেউ কারও চোখের দিকে তাকায় না। ভয় ও ভাবনায় সিটিয়ে থাকে। একসময় সামলে নেয়। নবনীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। তবে লজ্জা ও দ্বিধা কাটিয়ে বোনকে শুধাতে পারেনি ওটা কার?
জীবনের যে কত মানে, পেট না থাকলে হয়তো জানাই হতো না। ভালো করে বাঁচার আশায় মানুষ চাকরি ও ব্যবসা করে। এসবের মধ্যস্থতা করে পেট। জলতরঙ্গের মতো মানবজীবনের মাঝখানে সে বিগ বস হয়ে বসে আছে।
ভরদুপুরে অপারেশন থিয়েটারের সামনে কয়েকজন মানুষ উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। কী হয়, কী হতে পারে ভেবে সবার মুখ শুকনা। বুকের বাতাস থেমে আছে। চোখমুখে লজ্জা ও আতঙ্ক।
এমন সময় শাঁ করে করিম চৌধুরীর মুখটা মনে আসে রোমেলের। করিম ওদের হাউস টিউটর। সে নবনীকে পড়ায়। মুহূর্তেই সে মাকে শুধায়, ‘এটা করিমের কাজ নয় তো?’
মা অপরাধীর ভঙ্গিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন।
‘আরিব্বাস! শত্রু তাহলে ঘরেই?’ মনে মনে সে খুব বকে করিমকে। আর বোনটা জিংড়েমারা এতটুকু ছুড়ি। কী পেলি তুই ওই বিবাহিত মাস্টারের কাছে? মাস্টার, তোরই–বা কী রুচি? তা নয় হলো, কিন্তু বাজারে কত কী পাওয়া যায়, কোনো একটা জিনিস ব্যবহার করতে পারলি না? পেট খসাতে গিয়ে হাসপাতালে কত যে লুকোচুরি ও ফিসফাসের মধ্যে ঢুকে যেতে হয়েছে। ভাবে সে; যেন আমরা চোর, ধরা পড়ার পর আপসে মিটিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা করছি। টানাটানির সংসার থেকে এতগুলো টাকাও খসে যাচ্ছে।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর, দরজা খুলে ডাক্তার বেরিয়ে আসেন।
‘রোগীর পেটে তো কোনো বাচ্চা নেই।’ মুখের সাদা কাপড় সরিয়ে ডাক্তার বলেন, ’একটা বড় টিউমার পাওয়া গেছে।’
বুকের ওপর থেকে পাষাণভারটি নেমে যায়। বাবা ছল ছল চোখে তাকিয়ে থাকেন। মা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলে নীরবে কী যেন বলেন, বোঝা যায় না।
ছোট বোন অস্ত্রোপচারকক্ষের পর্দা সরিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে আসে।