Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2023-07%2Feddb3bf1-efef-4e36-8c20-1a067060fabb%2Fghum_o_mrittu.jpg?w=1200&ar=40%3A21&auto=format%2Ccompress&ogImage=true&mode=crop&overlay=&overlay_position=bottom&overlay_width_pct=1 />

মৃত্যু ও ঘুম

কামরুল আহসান



গল্পটা মায়ের কাছ থেকে শোনা:

আমার মায়ের বাবা-চাচা-ফুফুরা ছিলেন তিন ভাই তিন বোন। মায়ের ফুফুদের আমরা গ্রামের নাম অনুসারে চিনতাম। অর্থাৎ যে গ্রামে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল, মা-খালারা তাঁদের সেই নামে ডাকতেন। গোপালনগরের ফুফু, মাশিকাড়ার ফুফু, মোচাগড়ার ফুফু। গল্পটা এই মোচাগড়ার ফুফুকে নিয়ে।

বাচ্চা হলেই মোচাগড়ার ফুফু খুব অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাতে-পায়ে পানি নেমে যেত। আর খুব কাশতেন। তৃতীয় বাচ্চা হওয়ার পর আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। একদিন মায়ের দাদি তাঁকে নিয়ে রওনা দিলেন মেয়েকে দেখতে। পাঁচ-সাত মাইলের রাস্তা, দুপুরে রওনা দিয়েছেন, তা–ও যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শীতের দিন। মায়ের বয়স তখন ১০-১২। দাদির সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছেন, এই তার আনন্দ। কিন্তু ফুফুর বাড়ি গিয়ে মায়ের মন মরে গেল। ফুফুর শরীর এতটা খারাপ হয়ে গেছে ভাবতে পারেননি। বছরখানেক আগে ফুফু বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন, তখনো কেমন ছুটে বেড়িয়েছেন, আর এখন বিছানা ছেড়েই উঠতে পারেন না। শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছেন। কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে যান। এক ছেলে এক মেয়ের পর তাঁর আরও একটি মেয়ে হয়েছে মাসখানেক হয়। ছেলেটার বয়স সাত-আট, মেয়েটার বয়স পাঁচ-ছয়। মেয়ের অবস্থা দেখে মায়ের দাদি কাঁদলেন কিছুক্ষণ। কোলের মেয়েটাকে দুধ খাওয়ানোর মতো অবস্থাও তখন ফুফুর নেই। মেয়েটাকে এক প্রতিবেশী নিয়ে গেছেন। মেয়েটা কার কাছে থাকে, কীভাবে থাকে—এত কিছু মা আমাকে বলতে পারেননি। অনেক কিছুই মায়ের এখন মনে নেই। তাঁর শুধু মনে আছে, এশার নামাজের পর ছোট মেয়েটাকে একবার মায়ের ফুফুর কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল, মায়ের ফুফু মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে কাঁদছিলেন।

এশার পর ফুফাতো ভাই–বোন দুটিসহ মা, মায়ের দাদি আর মায়ের ফুফা ভাত খেতে বসেছিলেন ফুফুর ঘরেই। তাঁদের একটাই ঘর। মায়ের ফুফার কোনো এক চাচাতো বোন তাদের ভাত বেড়ে খাওয়াচ্ছিলেন। মায়ের মনে আছে, দরজাটা খোলা ছিল, আর বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, মায়ের ভয় লাগছিল। গলা দিয়ে ভাত নামছিল না। ডিমভাজি আর লালশাক ছিল, ভাত না খেয়ে মা নাকি শুধু ডিমভাজিটাই খেয়েছিলেন দাদির জোরাজুরিতে। মায়ের ফুফুও কিছু মুখে দেননি। অনেক সাধাসাধি করে তাকে একটু দুধ খাওয়ানো গেছে কেবল। 

ভাত খাওয়া সেরে মা আর মায়ের দাদি ফুফাতো ভাই–বোন দুটিসহ ফুফুর বিছানাতেই গিয়ে শুয়ে পড়লেন। এদিকে একটা লেপ গায়ে দিয়ে মা আর মায়ের দাদি শুয়েছেন, ওদিকে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়েছেন মায়ের ফুফু, ছেলেমেয়ে দুটি নিয়ে। ফুফা শুলেন নিচে বিছানা করে। ফুফাতো ভাই–বোন দুটি শুয়েছে ফুফুর ওপাশে; ফুফুর এপাশে মায়ের দাদি এবং দাদির পাশে মা। মেয়েটিকে ফুফু বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন। কোলের শিশু কাছে নেই, তাই বড় মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরেই তিনি কাঁদছেন।

মায়ের দাদি মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলছিলেন, ভালা হইয়া যাবি, কান্দিস না? তোর বাপে আইব কাউলকা। তোরে লগে কইরা লইয়া যাম। বাইত গেলেই তুই ভালা অইয়া যাবি। ভালা ডাক্তর-কবিরাজ দেহাম। 

মায়ের ফুফুও কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, হ, বাইত গেলেই আমি ভালা অইয়া যাম। ডাক্তর লাগদ না, দক্ষিণগালার বাতাস খাইলেই আমার শইল ঠিক অইয়া যাইব।

মায়ের ফুফা টিপ্পনী কেটে বলেছিলেন, তোমডার বাইত কি বঙ্গোপসাগরেত্তে বাতাস আইয়েনি? 

ফুফু বলেছিলেন, আমডার বাইত বাতাস আইয়ে বেহেশতত্তে। 

তারপর ফুফু খুকখুক করে কাশতে কাশতেই বাড়ির নানা কথা জিজ্ঞেস করেন, পুকুরপাড়ের জলপাইগাছগুলোতে এইবার কেমন জলপাই আসছে? জোছনার ছাগলটা বড় অইছেনি? মুখলেস কি আগের মতোই শয়তানি করে? মাঝুর কোনো বিয়ার সম্বন্ধ আসছে? নূরু আসছে ঢাকা থাইকা? লতিফ একটা চিঠিপত্র লিখে না তারে। মায়ের পেটের ভাই এমন পর হইয়া যায়! বছর যায়, একটা কোনো খবর নেয় না।

দাদি সান্ত্বনা দেন, লতিফের নতুন চাকরি, নতুন সংসার। বাড়িও তো থাকে না, মাসে মাসে একবার আইয়ে দুই-এক দিনের ছুটিত। তোর কথা জিগায় আইলে। চিডি লেখলেও জিগায়। গেছে হপ্তা চিডিত লেখছে, এইবার আইলে তোরে দেখত আইব।

ফুফু জানতে চান, বিলকিস দেখতে সুন্দরমন্দর অইছেনি?

দাদি বলেন, হ, মার মতোই অইছে দেখতে।

তারপর দাদি একটা গোপন খবর দেন, ফিসফিস করে বললেও মা শুনে ফেলেন, তোর বড় ভাবির ঘরো তো আবার অইব।

ফুফু একটু হাসেন। সারা সন্ধ্যার মধ্যে এই প্রথম মা তার ফুফুকে একটু হাসতে দেখেন। ফুফু খুশি খুশি গলায় বলেন, বাড়িটা ভইরা যাইতাছে ছুইটকায়।

ফুফুর কাশিটা বাড়তে থাকে। দাদি বলেন, থাউক, ঘুমা। কথা কইস না, কথা কইলে কষ্ট হয় তোর।

কিন্ত ফুফুকে তখন কথায় পেয়েছিল। বড় বড় দম ছাড়তে ছাড়তে তিনি একা একাই বলতে লাগলেন, মোর্শেদও তো দেখি শামসুর মতোই উঁচালাম্বা অইছে। সেই দিনের ছুইটকা একেকটায়, দেখতে দেখতে বেডা অইয়া গ্যালগা। দেখলে কইলজাডা জুড়াইয়া যায়গা। এককালে ভাবতাম, মানুষের বেশি টান থাকে বাপ-মার লাইগ্যা, পরে দেখলাম বাপ-মার চাইতেও বেশি টান ভাই-বইনের লাইগ্যা। এহন দেহি, ভাইবোনের পোলামাইয়ার লাইগ্যা আরও বেশি মায়া লাগে। মা গো, মা, কী কয়াম তোমারে, নিজের পোলামাইয়ার চাইতেও আমার বেশি পরান পুড়ে ভাগিনা-ভাতিজির লাইগ্যা? এর কারণ মনে অয়, ইতানডি দূরই দূরই থাহে এর লাইগ্যা। জোছনা, ঘুমাইছস গো, মা, ঘুমাইছস? গায়ো লেপ টাইন্যা দিস। 

দাদির নাক ডাকা শোনা যাচ্ছিল। এমনিতেই দাদি এশার নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে পড়েন, তার ওপর আজ এতটা পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত। মায়ের চোখও ঘুমে ভেঙে পড়ছিল। ফুফুর কথা আর কানে যাচ্ছিল না।

রাত তখন কত হবে? মায়ের মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। ১০টা-১১টা হবে আন্দাজ করছেন। এশার পরপরই দেশ-গ্রামে তখন অনেক রাত, তার ওপর শীতের রাত। 

ঘরে হারিকেন জ্বলছিল। মায়ের ফুফাও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ফুফু হঠাৎ প্রচণ্ড কাশতে লাগলেন। দাদি উঠে বসলেন। ফুফাও উঠে এলেন। মায়েরও কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে। কাশতে কাশতে মায়ের ফুফুর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। ফুফা মগে করে পানি দিলেন। দাদি মগটা মেয়ের মুখে ধরে একটু পানি খাওয়ালেন। পানিটা ফুফু খেতে পারলেন না। হেঁচকি উঠে নাকমুখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল। কাশিটা আরও বেড়ে গেল। মায়ের কথায়, এমন কাশি জীবনেও দেখিনি। পেটের নাড়িভুঁড়ি বার হইয়া যাওনের জোগাড়। আমরা দোয়া-দরুদ পড়তাছি। ডরে কানতাছি। 

কিছুক্ষণ কাশির পর মায়ের ফুফু অবশের মতো শুয়ে পড়লেন। কাশার মতো শক্তিও আর গায়ে নেই। গলা দিয়ে কেমন গড়গড় আওয়াজ বের হচ্ছে। ফুফুর হাত-পাগুলো একেবারে বুকের কাছে ভাঁজ হয়ে গেছে। গুটিয়ে তিনি একটা ছোট শিশুর মতো হয়ে গেছেন। মেয়েটা জেগে উঠেছে, ছেলেটা ঘুমাচ্ছেই। মেয়েটা কাঁদছে। মায়েরও ভয় ভয় লাগছে। হঠাৎ মায়ের ফুফু কেমন একটা চাইট দিয়ে একেবারে নিথর হয়ে গেলেন। আর কোনো রা শব্দ নেই। নাক দিয়ে এতক্ষণ যে ফোঁস ফোঁস শব্দটা বেরোচ্ছিল, সেটিও থেমে গেছে। দাদি মেয়ের গা ধরে নাড়া দিয়ে ডাকলেন। মায়ের ফুফা মায়ের ফুফুর বুকে হাত দিয়ে, নাকের নিচে হাত দিয়ে দেখলেন, তারপর বললেন, শেষ। আর নাই। 

মায়ের দাদি বললেন, ও মা! নাই! অহন না কতা কইল! ও মা, মা, কতা ক, কতা ক। 

মায়ের ফুফা দরজা খুলে কাকে কাকে যেন ডাকলেন। কারা কারা যেন ছুটে এল। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি চলল। তবে কান্নাকাটি থেমে গিয়েছিল অল্পতেই। মায়ের দাদি ছাড়া আর কেউ তেমন কাঁদছিল না। মেয়েটাও কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল, মৃত মায়ের পাশেই। অন্যরাও বসে বসে ঢুলছিল। দাদি যে ঠিক বিলাপ করছিলেন তা না, অনেকটা আলাপ করার মতো করেই যেন বলছিলেন, এই কদ্দুর আগে আমার মাইয়াডা সজাগ ছিল, এখন সে ঘুমায়, আর কোনো দিন উঠব না এই ঘুম থাইকা! বাড়ি যাইতে চাইছিল, আর বাড়ি যাওন অইল না। ছোড ভাইরে দেখতে চাইছিল, আর দেখা অইল না। কত নতুন নতুন মানুষ আইব বাইত, আমার মাইয়া দেখব না। জলপই গাছো জলপই অইব, আমার মাইয়া খাইব না। ইঁচা মাছ দিয়া জলপইয়ের চুয়া খাইতে কী যে পছন্দ করত আমার মাইয়া! জীবনডা কী? মরণ কী? চোক্ষের পলকে সব শেষ। 

এত রাতে, এই শীতের রাতে কে আর বসে থাকে? প্রতিবেশীরা একে একে উঠল। যাই গো, আইতাছি গো—বলতে বলতে একে একে সবাই চলে গেল। কেউ কেউ হয়তো তখনো ছিল, মায়ের মনে নেই। তাঁর শুধু মনে আছে, একসময় সবাই আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। আগের মতোই। মায়ের দাদি শুয়েছিলেন মৃত মেয়েকে জড়িয়ে ধরেই। তিনি নাকি বলেছিলেন, কী হইছে, আমার মাইয়া মরছে না তো! এই তো ঘুমায়।

মায়ের আর ঘুম আসছিল না। ভয় লাগছিল তো বটেই, দুঃখও লাগছিল। মৃত্যু কী তা তিনি তখনো বোঝেন না। তা–ও বুঝতে পারছেন তার ফুফুর খারাপ কিছু একটা হয়েছে। আবার ফুফু যে কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে এখন আরামে ঘুমাচ্ছেন, তাতেও ভালো লাগছিল। 

বাড়িটা নির্জন, মানুষজন বেশি নেই, তাই সামান্য পাতা নড়ার শব্দ শুনলেও গা কেমন ছমছম করে। এর মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, একজন মৃত মানুষ ঘরে নিয়ে! মায়ের মনে পড়ছিল বাড়ির কথা, কেন এলেন? আর এলেনই যদি তাঁর ছোট বোনটাকেও কেন সঙ্গে করে নিয়ে এলেন না? কখন সকাল হবে? তিনি দাদিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন, হঠাৎ খেয়াল করলেন, দাদি তার লেপের তলা থেকে সরে গিয়ে মেয়ের কাঁথার নিচে গিয়ে শুয়েছেন এবং এক হাতে মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন; এবং ঘুমিয়ে পড়েছেন, নাক ডাকছেন। মা উঠে বসে দেখেন, ওপাশে ফুফাতো ভাই-বোন দুটিও আরামে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা মাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। নিচে ফুফা ঘুমাচ্ছেন কি না, মা বুঝতে পারছেন না। বসে থাকতে থাকতে মা-ও একসময় কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, খেয়াল নেই। 

এ ঘটনার পর মায়ের জীবন থেকে চলে গেছে ৫০ বছরের বেশি সময়। কিন্তু তারপরও সে রাতের কথা তিনি ভুলতে পারেন না। রাতে ঘুম না এলে হঠাৎ হঠাৎ নাকি তাঁর সে রাতের কথা মনে পড়ে। একজন মৃত মানুষ নিয়ে ঘরের সবাই ঘুমিয়ে আছে। মৃত্যুর কথা ভাবলে মায়ের ভয় হয়; কিন্তু ওই রাতটার কথা মনে হলে তাঁর মনে হয়, মৃত্যু বুঝি ঘুমেরই মতো।