Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2020-10%2Fedbfa11f-fb22-447a-828c-2bd3c753246a%2FMasuk_Art_07_10_2020.png?rect=0%2C0%2C1254%2C658&w=1200&ar=40%3A21&auto=format%2Ccompress&ogImage=true&mode=crop&overlay=&overlay_position=bottom&overlay_width_pct=1 />

মিথিলার সঙ্গে চার দিন

আহমেদ খান



তিন দিন ধরে মিথিলা আমার সঙ্গে থাকছে।

এই তিন দিনে সে কথা বলেছে তিনটে—খিদা লাগছে। বাথরুমে যাব। ঘুমাব।

তার যে ঘুমের দরকার আছে, সেটা তাকে দেখলেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। একটা ময়লা সাদাটে টি–শার্ট, রুক্ষ চুল, আর চোখের নিচে কালি। মিথিলাকে আর যা-ই হোক, রাজকুমারী লাগে না এসবে। তবু আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি শুধু শুধু।

আমার মনে হয় মিথিলা ড্রাগ নেয়। ড্রাগ না নিলে চেহারায় এমন স্থায়ী বেদনা পুঞ্জিভূত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ কথা আমি তাকে বলতে পারিনি। আমিও তাকে গত তিন দিনে তিনটে কথার তিনটে উত্তরই দিয়েছি—খাও। যাও। ঘুমাও।

মিথিলাকে ‘তুমি’ করে কেন বলছি, তা–ও অবশ্য অজানা। মিথিলা আমার পূর্বপরিচিত নয়। অফিস থেকে ফিরছিলাম। রিকশাভাড়া দিয়ে কুকুরদের জন্য নিয়ে আসা রুটিগুলোর প্যাকেট খুলছিলাম। মিথিলা তখন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে বলে, একটা রুটি দিবেন?

তারপর থেকেই মিথিলা আছে আমার কাছে। আমার দুই বেড এক ড্রইংয়ের ফ্ল্যাটে। একা।

অফিসে যাওয়ার সময় আমি বাইরে থেকে তালা মেরে যাই। কিন্তু কেন? জানি না অথবা জানি। হয়তো আশঙ্কা করি, ড্রাগ নেওয়ার পাশাপাশি মিথিলা চোরও। বাসা ফাঁকা পেয়ে সে ঘরের সবকিছু বের করে নিয়ে যাবে। কে জানে, হয়তো তার গ্যাং আছে, হয়তো বয়ফ্রেন্ড। হয়তো চুরি-ডাকাতিই তাদের কাজ।

কিন্তু মিথিলাকে আমি চলে যেতেও বলতে পারি না। কেন পারি না, তা জানি না। অথবা হয়তো জানিও।

মিথিলা যখন আমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, বারান্দার গাছগুলোর সঙ্গে সঙ্গে তাকেও আমার কেমন যেন অনড় কিছু মনে হয়। মিথিলার ক্ষীণ শরীরের ভেতর দিয়ে সূর্য যেন বেরিয়ে আসতে চায়। আমার ঘরে সেই আলোক ঝরনাধারা। আমাকে গুঞ্জরিত করে।

চতুর্থ দিন মিথিলা নতুন কথা বলে। বলে, সে চলে যাবে।

কথাটা নতুনই ঠেকে। কারণ এই কয় দিনে মনে হয়েছিল, তার থাকার কোনো জায়গা নেই। খাওয়ার তো নেই-ই। এবং মনে হয়েছিল, আমার ওপরই সে নির্ভরশীল।

কোথায় যাবে?

দেশে?

গ্রামে?

আমাকে গ্রামের মেয়ে মনে হয়?

প্রবাসী তুমি?

মিথিলা হাসে। প্রথমবারই মনে হয়। সে হাসলে যে তার মুখে একটা আলতো টোলের মতো পড়ে, এটা তো প্রথমই দেখলাম। তাকে যেতে দিতে ইচ্ছা হয় না আমার। কেন হয় না, জানি না। হয়তো জানিও।

মিথিলা আমার বাথরুমে বৃষ্টির শব্দ তুলে গোসল করে। আমি ঘরের ভেতর থেকে তার গুনগুনানোর শব্দও শুনি। একটা লাতিন গান মনে হয়। আগে কখনো শুনিনি। জানি, কখনো আর শুনবও না।

মিথিলা আমার শার্ট পরে বের হয়। পরনে পুরোনো ঢোলা সালোয়ারই। চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শ্যাম্পু করেছে হয়তো, ঘ্রাণ আসছে।

আমি বললাম, নাস্তা খেয়ে যাও। পরোটা করেছি। আর ভাজি।

মিথিলা বলল, মিষ্টি নাই কোনো?

আমার এক বন্ধু ছিল। ড্রাগ নিত। ও শুধু মিষ্টি মিষ্টি করত। আমি মিথিলার আঙুল–কবজি ভালো করে দেখি। সুই ফোটানোর কোনো দাগ নেই। এখন তো সবাই ইয়াবা খায়। সুই ফোটানোর অবশ্য দরকারও নেই।

মিথিলা আরাম করে নাস্তা খায়। সোফায় বসে। পা টানটান। পায়ে একটা নুপুরও দেখা যায়। নুপুর, অথচ বাজে না। কিন্তু আমার ভেতর কেমন যেন বাজনা।

‘কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে যেয়ো না।’

মিথিলা তাকায় না পর্যন্ত। পানি খায়। বলে, সিগারেট আছে?

বলছিলাম ড্রাগ নেয়। মিথিলা সিগারেট জ্বালায়। আমিও জ্বালাই। আমার শার্টটা ফুঁড়ে মিথিলা বেরিয়ে আসতে চায়। সিগারেট টানে। আমি মিথিলাকে টানার চেষ্টা করি। হাত বাড়াতে পারি না, মনে মনে।

মিথিলা কেশে ওঠে ধোঁয়ার ভেতর। তারপরই হেসে ওঠে—কত দিন বুক ভরে কাশি না!

ইচ্ছা করে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরি। চুইংগামের মতো চিবাই। মিথিলার গালে মৃদু টোল।

ঝুঁকে সিগারেট গুঁজে দেয় মিথিলা। আমি আমার শার্টের ভেতর ঢুকে যেতে চাই। কেন চাই? জানি না। হয়তো জানিও।

মিথিলা বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, যাচ্ছি!

আমি বলি, থেকেও যেতে পার।

মিথিলা হাসে। কেন?

আমি উত্তর কই পাব?

মিথিলা চলে যায়। যাওয়ার আগে আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে। চুমু খায়। বলে, তুমি খুব ভালো।

কেন বলে? জানি না। কারণ আমি এটুকু নিশ্চিত জানি, আমি ভালো না।

আমি বলি, কোন দেশে যাবে তুমি?

মিথিলা হাসে। বলে, আমাদের যদি কোনো দেশ থাকে, সেই দেশে।

তবে আমার ধারণা, শেষের ব্যাপারটা সত্যি সত্যি ঘটেনি। মিথিলা আমাকে জড়িয়ে ধরেনি, চুমুও খায়নি। আমি যে ভালো নই, এই কাল্পনিক ঘটনাও নিশ্চয়ই তার একটি প্রমাণ।