কালো বিড়ালের মতো অন্ধকার ঘরজুড়ে। ভরপেট ভাত খেয়ে একটা ঘুম দেওয়ার কথা ভাবে সুমন শাহরিয়ার। দুপুরে ঘুমানোর সুযোগ সচরাচর হয় না। আজ অবকাশ পাওয়া গেল।
এলাকাটা নির্জন ও গ্রামীণ ধরনের, তবে নগরজীবনের সুবিধা পাওয়া যায়। অবিরাম গাড়ির হর্ন, কালো ধোঁয়া, বাথরুমে জলের হাহাকার—এসব এখনো ছুঁতে পারেনি। শব্দ যা আছে তা ট্রেনের। দুপুরে ঘুমের আমেজের সঙ্গে ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দটা ঘোর তৈরি করে। ঘুমটা নিবিড় হয়ে নেমে আসে।
আজ দুপুরে ঘুমানোর ভাবনাই সার হলো। দীর্ঘ সময় ধরে সাজানো ভাবনায় ফুঁ দিয়ে আড়ালে কেউ হাসছে। হাসিটা সুন্দর নয়, বিদ্ঘুটে। ডোরবেলটা বেরসিকের মতো ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দে বেজে উঠল।
কে আসতে পারে এই অসময়ে?
একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছাড়ে সুমন। দরজা খুলতেই একটা মেয়ে মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘সাদিয়া আছে?’
‘কোন সাদিয়া?’
মেয়েটি তার চিকন ঠোঁট মেলে নরম চোখে তাকায়। মিষ্টি করে হাসে, ‘ভাইয়া, আমি নীতু। সাদিয়ার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে পড়ি।’
‘আচ্ছা। কিন্তু সাদিয়া…’
‘ও কি বাসায় আছে?’
‘হ্যাঁ। আপনি আসুন।’
নীতুকে চেয়ারে বসতে দিয়ে সুমন আড়মোড়া ভাঙে। চেয়ারে বসে নীতু এদিক–ওদিক তাকায়। সুমন জানালার কাছে যায়। হাট করে জানালার কপাট খুলে দেয়। বাইরে রোদ হাসছে। ফাল্গুনের রাতের আঁধারে বড় একা লাগে, কিন্তু এপ্রিলের দুপুরে? কথাটা মনে হতেই সুমন ফিক করে হেসে দেয়।
নীতু বলল, ‘ভাইয়া, আপনি হাসছেন কেন?’
‘না। ও কিছু না।’
প্রথমে সুমন খেয়াল করেনি, মেয়েটি দেখতে কালো। কিন্তু মুখটা ভারি সুন্দর। লাবণ্যময়। চোখ হাসে। চোখহাসা মেয়েরা ভারি দুষ্টু হয়। নীতুকে অবশ্য দুষ্টু মনে হচ্ছে না।
নীতু খানিকটা দ্বিধা মেশানো গলায় বলল, ‘ভাইয়া, সাদিয়া আমার বন্ধু ঠিকই, কিন্তু আমি এসেছি ওর বড় ভাই সুমন শাহরিয়ারকে দেখতে।’
সুমন চোখ সরু করে তাকায়, ‘শাহরিয়ার?’
‘জি। তিনি লেখক। উপন্যাস লেখেন। আমি তার ভক্ত। বইমেলায় অটোগ্রাফও নিয়েছি।’
এমন মিষ্টি মেয়ে আমার লেখার ভক্ত–পাঠক, ভেবে সুমন পুলকিত হয়। জীবনে কত পাঠককে অটোগ্রাফ দিয়েছে, সবাইকে মনেও নেই। নীতুকেও মনে করতে পারে না।
নীতু বলে, ‘গত রাতে সাদিয়ার ভাইটা মারা গেছে।’
‘কী বলছেন?’
‘মানে সুমন শাহরিয়ার।’
তেরছা চোখে সুমন নীতুর মুখে তাকায়। নীতুর চোখ ভিজে উঠেছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে।
কী বলছে মেয়েটা? সুমন বিস্ফারিত চোখে নীতুকে দেখতে থাকে।
নীতু খানিক দম নেয়। তার কথা থেমে গেছে। সে ভেতরে ভেতরে কথা সাজায়। তার কথা আটকে থাকে। কথা মুখ বাড়ায়, ‘জানেন ভাইয়া, সাইলেন্টলি আই অ্যাম ইন লাভ উইথ হিম…’
কোনো সুন্দরী তরুণী এত কাছে এসে যদি তার গোপন প্রেমের কথা বলে, লজ্জা না পেয়ে উপায় থাকে না।
সুমন লাজুক ভঙ্গিতে হাসে। হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
নীতুর ঠোঁট ভারী। চোখ ভেজা, ঠোঁট কাঁপছে।
সুমন শাহরিয়ার নীতুকে প্রাণপণ বোঝাতে চেষ্টা করে, আমিই সুমন শাহরিয়ার।
নীতু ভ্রুক্ষেপই করে না। সুমনের কোনো কথা শুনতেও পায় না।
‘সাদিয়া কী করছে? একটু ডাকুন না, প্লিজ। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।’
কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে, সুমন টের পায়। তার একটা ছোট বোন আছে বটে, ওর নাম সাদিয়া নয়, কুমকুম রহমান। তাহলে সাদিয়াটা কে?
নীতু কি ভুল ঠিকানায় এসে ডোরবেল বাজিয়েছে?
সুমন বলল, ‘সাদিয়া গোসলে ঢুকেছে। আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।’
…বাইরে মানুষের ভিড় ও গুঞ্জন শোনা যায়।
সুমন দরজা খোলে। বাড়ির সামনে মানুষের জটলা।
‘এত ভিড় কেন?’
একজন বলল, ‘এত ভালো ছেলে। গত রাতে মারা গেছে।’
সুমন এবার আকাশ থেকে পড়ে। এখানে কেউ মারা গেছে, অথচ সে জানতে পারল না?
প্রতিবেশী এক মহিলা রিকশায় যাচ্ছিলেন, ভিড় দেখে থামলেন। শুধালেন, ‘কী হয়েছে?’
‘সুমন শাহরিয়ার মারা গেছে।’
‘কোন সুমন শাহরিয়ার? ডাক্তার?’
‘না, ওই যে তরুণ ছেলেটা, গল্প লিখত।’
চশমা ছাড়া সুমন ভালো দেখে না। তবু ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা পা ফেলে মোড়ের পত্রিকার দোকানে যায় সে। একটা দৈনিক পত্রিকা কেনে। ভেতরের পাতায় খুঁজে পায় নিজেকে। তার মৃত্যুর খবর, ছবিও ছাপা হয়েছে।
একদমই বিশ্বাস হয় না সুমনের। জলজ্যান্ত সে বেঁচে আছে, অথচ পত্রিকায় একি অদ্ভুত খবর!
পত্রিকা হাতে বাড়ির সামনে আসে সুমন। দেখে, মানুষের জটলা কমেনি। সে প্রবলভাবে চিৎকার করে, ‘দেখুন, আমিই সুমন শাহরিয়ার। আমি বেঁচে আছি। আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করুন…’
সুমনের কথা কেউ শুনতে পায় না।
হঠাৎ ভিড়ের ফিসফিসানি ও কানাঘুষা তার কানে আসে, ‘আহা, ছেলেটা বড় ভালো ছিল।’
সুমন দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢোকে। ঘরময় তাকায়। নীতু নেই।
সে ভেতরের ঘরে যায়। বারান্দায় যায়। বাথরুমে নক করে। কোথাও দেখতে পায় না নীতুকে, যেন এখানে ছিলও না সে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সুমন। না, বাইরেও কেউ নেই।
এতক্ষণ মানুষের জটলা ও হট্টগোল ছিল, কিছুই নেই।
এ কি বিভ্রম? কোথাও কি ভুল ছিল?
সুমন আড়চোখে বাইরে তাকায়। খেয়াল করে, জানালার ওপাশে একটা কাঁঠালপাতা নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে।