Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla/2021-01/1d75151c-eff9-4e9f-ac28-aebc4618d00f/palo_bangla_og.png />

মগ্নতান

আফসানা বেগম



কে জানে কখনো ওই শহরে ফিরব কি না—কথাটা আরও যতবার ভাবব, ততবার বুকের ঠিক মাঝখান থেকে লম্বা একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসবে, যাকে বলে দীর্ঘশ্বাস। নিশ্বাসের গায়ে শব্দের ছোঁয়া লেগে থাকবে না। কেউ জানবে না। ঠিক যেমন আমি নিজেকেও জানতে দিইনি বহুকাল। বারবার নিজেকে জানিয়েছি, ফিরে যাবার জন্য ওভাবে ছেড়ে আসিনি।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই রংপুর শহরের মেডিকেল কলেজে যোগ দিতে যাব। এ রকম কিছু ঘটবে ভাবিনি কোনো দিন। ভাবিনি যে, সে কথা ঠিক নিশ্চিত হয়েও বলতে পারব না। নাহলে যাবার সম্ভাবনা জানার পর থেকেই কেন মাথায় এত এত দৃশ্যের আনাগোনা শুরু হবে? কেন জানামাত্রই মনে হতে থাকবে, বাড়িতে এসে প্রস্তাব পাবার কথাটা কাউকে বলব না, বরং বলব এটা বাধ্যতামূলক। আমাকে ঠিক তিন দিনের মধ্যে গিয়ে নতুন কাজে যোগ দিতে হবে। তার জন্য অনেক যুক্তিও দেখাব। সেসব আকাশ থেকে পেড়ে আনতে হবে না। আশপাশে সামান্য হাতড়ালেই চলবে। এই যেমন আমি চিরকাল ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চেয়েছি, তার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ হলে সবচেয়ে ভালো। তাদের সেবাই হবে আসল চ্যালেঞ্জ। মেডিকেল কলেজে ভবিষ্যতের জন্য জীবন বাজি রাখা ডাক্তার তৈরি করাও কম দায়িত্বের কাজ নয়। তা ছাড়া ঢাকায় কত কত ডাক্তার সব সময় থাকবে। এখানকার গোছানো পরিবেশ, বাচ্চাদের জন্য ভালো স্কুল, নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা—সোজা কথায় রাজধানীর মতো এত আধুনিক জীবন ছোট শহরে কোথায়! আর তাই তো আমাকে ঢাকা ছেড়ে রংপুরে চলে যেতে হবে। বড়লোক পাড়ায় চেম্বার খুলে বসে হাজার হাজার টাকা ভিজিট গোনা অনেক হয়েছে। ছেলেমেয়ে যে যার মতো দাঁড়িয়ে গেছে, এখন আর এত দরকারই-বা কী। সিমি হুট করে আমার মুখে এসব কথা শুনে বেকুব বনে গেলেও একসময় তাকে আমার যুক্তিগুলো মানতে হবে।

সিমির নিজের চেম্বার অবশ্য চলবে। মেডিকেলের ডিউটিও সে সময়মতো করবে। ছেলেমেয়ে নিজের নিজের পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমি কিছুদিন রংপুরে থাকব আমার মতো। এই আমার মতোটা আসলে কেমন হবে?

একা থাকাটা তেমন নতুন অভিজ্ঞতা হবে না, ইউরোপের কত জায়গায় আমাকে দীর্ঘদিন একা থাকতে হয়েছিল। আর এবার রংপুরে কিছুদিনের অভিজ্ঞতা হবে নাহয়। যাবার প্রস্তুতি নিতে গেলে প্রথমেই যার কথা আমার মনে পড়বে. সে হলো কলেজের বন্ধু রিয়াজ। ওখানে গিয়ে রিয়াজকে খুঁজব সবচেয়ে আগে। এমনিতে সেখানকার কারও সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখিনি। না রিয়াজ আমার ঠিকানা জানে, না আমি তার। ষাট ছুঁই-ছুঁই বয়সে এ-ও ভাবব যে রিয়াজ আদৌ বেঁচে আছে কি না। পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে হুটহাট হার্ট অ্যাটাকে মরে যাওয়া বিচিত্র নয়। তবে বেঁচে থাকলে নিশ্চয় সে রংপুর শহরেই থাকবে। বাবার শত শত বিঘা ফসলি জমি আর ব্যবসা ছেড়ে তার পক্ষে অন্য কোথাও চলে যাওয়া অবান্তর। যে যুগে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল, তখন ছিল চিঠির চল। পরে মেইল এল। আমরা কেউ কারও মেইল ঠিকানা জানতে চেষ্টা করিনি। সত্যি কথা বলতে কী, বলতে হবে আমিই চেষ্টা করিনি। রিয়াজ হয়তো করে থাকতে পারে। তবে রিয়াজের কথা ভাবতে গেলেই আমার মনে পড়বে তার পাঠানো অগুনতি চিঠির কথা, যার উত্তর আমি কখনো দিইনি। কেন দেব? তার চিঠিজুড়ে থাকত শুধু সুরভির কথা। কুশল জিজ্ঞাসার পরেই সে লিখত, ‘তুমি কি আসলেই সুরভির কথা ভুলে গেছ, হাসান?’ আর চিঠি শেষও হতো সুরভির কথা দিয়ে, ‘দেখো হাসান, সুরভি তোমার চিন্তায় দিশেহারা। তুমি কিন্তু আমার চিঠির না হোক, অন্তত তার চিঠির একটা জবাব দিয়ো।’

যাবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে রিয়াজ আর সুরভিকে নিয়ে আমি ভাবতেই থাকব। বিশেষ করে ভাবব রিয়াজের গাদা গাদা চিঠির কথা। সুরভির চিঠিগুলো রিয়াজের মতো লম্বা হতো না। তবে ছোট হোক বা বড়, চিঠিগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সেভাবে বলতে গেলে সেসবের মূল বক্তব্য, যা আমার মুখস্থ, ভাবতে গেলেই তা মনে পড়বে।

বিশেষ করে একটা চিঠির কথা মনে পড়বেই। মনে পড়বে, রিয়াজ চিঠিটা শুরুই করেছিল সুরভির নাম দিয়ে। কোনো রকম কুশল বিনিময়ের ধার ধারেনি। প্রথমেই লিখেছিল, ‘সুরভির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তুমি কি এটা জানার পরেও একবার রংপুরে আসবে না?’ মনে পড়বে, সুরভি নিজেও আমাকে লিখেছিল রিয়াজের ওই চিঠির দিন তিনেক আগে। সেখানে বিয়ের যে তারিখ লেখা ছিল, তা রংপুর থেকে চিঠিটা ঢাকায় আসতে আসতেই উপস্থিত হয়েছিল। এই কথাটা ভাবলে আমি শিউরে উঠব যে সুরভির চিঠি পাওয়ার পরও সে রাতে খামটা খুলিনি। সুরভির চিঠির জন্য তখন আমার না ছিল অপেক্ষা, না দায়। তা ছাড়া, পরদিন পরীক্ষা ছিল।

পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ফিরে এসে ক্লান্ত শরীরে একচোট ঘুম দিয়ে উঠে পোস্টের হলুদ খামটা ছিঁড়েছিলাম। লাইন টানা আস্ত একটা কাগজে কাঁপা কাঁপা অক্ষরে মাত্র দুটো লাইন, ‘১১ এপ্রিল আমার বিয়ে। তার আগপর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।’ খামের ওপরের গোল সিল বরাবর ছেঁড়া হয়েছিল। ছেঁড়া খাম নিয়ে আমি টেবিল ল্যাম্পের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ওই সময়টার কথা ভাবতে গেলে নিশ্চয় মনে পড়বে যে আমার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছিল। যেন বুকটা রংপুরের ধাপ অঞ্চলে আমাদের আড্ডা দেয়ার জায়গার কাছাকাছি ছাপড়ায় বসা কামারের হাপর। আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলে দূর থেকে যে হাপরের নিচে জ্বলন্ত আগুনের শিখা দেখা যেত, হাঁপরের ওঠা-নামায় এই দৃশ্যমান তো এই উধাও। ল্যাম্পপোস্টবিহীন ঘুরঘুটি অন্ধকারে ঝিঁঝিডাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানুষের বসবাসের ওই একটি চিহ্নই লেগে থাকত তখন। নিশ্চয় মনে পড়বে, চিঠি হাতে আমি বুঝতে পারছিলাম ঠিক সেই হাপরটার মতো কে যেন সমানে আমার বুকটাকে সুতো দিয়ে বেঁধে নিয়ে টানছে। কে সে, সুরভি? তা কেন হবে, অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি পরীক্ষায় এক শতে চুরানব্বই পেলেও সুরভিকে ভোলার চেষ্টায় তখন আমি এক শতে এক শ পাই।

তবু মনে পড়বে, বুকে হাপরের চাপসমেত খামের ওপর অস্পষ্ট গোল একটা ছাপ্পর থেকে আমি তারিখটা বুঝে নিতে পেরেছিলাম, ০২-০৪-১৯৮৩। চমকেও যে উঠেছিলাম, তা অবশ্যই মনে পড়বে, কারণ, সেদিন ছিল ১০ এপ্রিল। সেদিন রাত আটটায় সুরভির শেষ চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের নির্জন ঘরে কে জানে কতক্ষণ টেবিল ল্যাম্পের পাশে বসে ছিলাম। রাতের খাবার না খেয়েই একসময় চিত হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর মধ্যরাত পর্যন্ত সুরভির হাতের কেঁপে যাওয়া অক্ষরগুলো আমার চোখের সামনে আনাগোনা করছিল। মাত্র দুটো লাইন, অথচ তারা একবার ডান থেকে বামে যাচ্ছিল, আরেকবার বাম থেকে ডানে। ছোট ঘরটার বায়ুমণ্ডল যেন ক্যানভাস, অন্ধকারের শরীরের ওপরে একবার ওপর থেকে নিচে তো আরেকবার তীর্যক হয়ে বিচ্ছিন্ন শব্দগুলো এলোমেলো চলছিল, ফিরছিল।

আমার ভয়ানক অনাসক্তির কথা নিশ্চয় মনে পড়বে। সকালে নিজেকে বিছানা থেকে পা ঝুলিয়ে রাখা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলাম যখন, সুরভির মুখ তো দূরের কথা, পিঠের নিচে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া দুলাইনের চিঠিটার কথাও একবার মনে পড়েনি। তারপর দাঁত মেজে সোজা ক্লাসে। মনে পড়বে, সেদিন ছিল এগারো তারিখ, ১১ এপ্রিল ১৯৮৩। ক্লাস থেকে হোস্টেলে ফেরার সময়ে মগডালে উঁকি দেওয়া সদ্য ফোটা কৃষ্ণচূড়া দেখে আমার মনে হয়েছিল, এগারো তারিখ কি শুভ হয়? সুরভির জন্য শুভ হোক।

মনে পড়বে, তার পরেও ছয় কি সাত বছর ধরে রিয়াজ তিন থেকে পাঁচ মাসের বিরতিতে আমাকে চিঠি লিখত। নিজের কথা জানাত। লিখত—কী করে বাবার অনেক টাকা ব্যবসায় খাটাতে গিয়ে ভয়ানক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। একই বছরে বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হবার জোগাড়। সুরভির কথাও লিখত। সে গ্রামে চলে গেছে, প্রথম প্রথম মন খারাপ করলেও পরে শ্বশুরবাড়ির সবকিছুর সঙ্গে মানিয়েও নিয়েছে। মনে পড়বে, পড়তে পড়তে ভাবতাম ও রকমটা যে সুরভির ক্ষেত্রে ঘটবে, তা আমি আগেই জানতাম। বেশির ভাগ মেয়েই তা-ই, তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেকোনো পাত্রে ঢালো, সে পাত্রের আকার ধারণ করবে। বেশির ভাগ মেয়েরই যেন নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া নেই। সে কারণেই নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার আফসোস হতো না। আবার কোথাও তো একটা খটকা ছিলই, যে কারণে সুরভির কথায় ভরপুর চিঠির জবাব দিতে আমার বাধত। ও রকম একটা চিঠির উত্তরে সত্যি কথা লিখলে রিয়াজ হয়তো অসন্তুষ্ট হবে, যা আমি জেনেশুনে করতে চাইতাম না। বরং মনে পড়বে যে আমি অপেক্ষা করতাম, প্রতীক্ষায় থাকতাম কবে রিয়াজ কেবল তার নিজের কথা নিয়ে একটা চিঠি লিখবে—যে চিঠির কোথাও সুরভির টিকিটাও থাকবে না। তাহলে বেশ হুট করে আমি একটা জবাব লিখে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারতাম।

স্পষ্ট মনে পড়বে, সেই কাজটি রিয়াজ করেছিল আমি এমবিবিএস শেষ করে ইংল্যান্ডে চলে যাবার ঠিক আগের সপ্তাহে। লিখেছিল, অনেক জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হলো বলে শোকে তার বাবা হার্টফেল করেছে। লিখেছিল, তার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব, তাই মাঝেমধ্যে চোখে সরিষার ফুল দেখে। আর শেষে আশা ব্যক্ত করেছিল আমি নিশ্চয় তাকে ভুলে যাইনি, আশার কারণও ব্যাখ্যা করেছিল—এত দিনের এত ঘনিষ্ঠতার কথা ভুলে যাব, আমাকে এতটা আত্মভোলা সে ভাবতে পারে না। সবচেয়ে দরকারি যে বিষয়টা মনে পড়বে, তা হলো সেই চিঠিতে রিয়াজ ঘুণাক্ষরেও সুরভির কথা উল্লেখ করেনি। মনে পড়বে, সামরিক সরকার উৎখাতের গণ-আন্দোলনের অংশ হিসেবে লম্বা হরতালের পরে চিঠিটা আমার হাতে পৌঁছেছিল পুরোপুরি দেড় মাস দেরিতে। চিঠি পেয়ে মনে মনে নিজেকেই দুষছিলাম, রিয়াজকে তার বাবার মৃত্যুর জন্য সমবেদনা সময়মতো জানাতে পারিনি। দ্রুতহাতে তখন চিঠির জবাব লিখেছিলাম তাই। ভাবতে গেলেই পরিষ্কার মনে পড়বে, কেবল শোক জানানো ছাড়াও, তিন দিন বাদে ইংল্যান্ডে চলে যাবার কথা লিখেছিলাম। লিখেছিলাম সিমির কথাও। আপাদমস্তক স্মার্ট, চোখে লেগে থাকার মতো সুন্দরী আর গিজগিজে বুদ্ধির ভারে উজ্বল মেয়েটির সঙ্গে আমার মেডিকেলের সেই প্রথম বর্ষ থেকেই প্রেম। রাজধানীতে বেড়ে ওঠা ও রকম আলট্রা মডার্ন মেয়েটা যে আমার মতো মফস্বলের একটা ছেলের প্রেমে পড়বে, সে রকম কিছু স্বপ্নে ভাবাও যখন আমার জন্য অপরাধের মতো, তখনই সে আমার দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, পরিষ্কার মনে পড়বে যে বহুকাল পরে সমবেদনা জানানোর ছুঁতায় একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর রিয়াজের কাছে চিঠি লেখার একটা সুযোগ যখন হয়েই গিয়েছিল, তখন মনের ভেতরে জমিয়ে রাখা সিমির মতো একতাল লাভার কথা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাতের ধারায় ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছিল। মনে পড়বে, সিমির কথা আদ্যোপান্ত লিখে তার পরই দম নিয়েছিলাম। সিমি আমাকে বেছে নিয়েছিল, কারণ, ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছিলাম আমি। বড় ডাক্তার হব, কে না বুঝতে পেরেছে তখন! আমার টাকার অভাব সেখানে ছিল বাড়তি কারণ। সিমির দয়ার শরীর, তার বাবারও। নাহলে ও রকম বড়লোকের আদুরে কন্যা যাকে খুশি তাকে ধরে এনে রাজত্ব লিখে দিতে বলল, আর তিনি লিখে দিলেন! মনে পড়বে, আমার তখন কী যে হয়ে গেল, হড়হড় করে কেবল সিমির কথাই লিখে গেলাম। পড়ার জন্য স্কলারশিপ পেলেও, ইংল্যান্ডে যাবার টিকিটটা, এমনকি শীতের কাপড় আর বরফে হাঁটার বুট কেনার জন্যও কড়কড়ে পাউন্ড ধরিয়ে দিলেন সিমির বাবা। ঠিক হলো ইংল্যান্ডে যাবার আগেই সিমির সঙ্গে আমার আক্দ হবে। আমি নিজেও তা-ই চাই। না সিমির ওপর আমার বিশ্বাস ছিল, না নিজের। কে জানে সিমি আবার এখানে ডাক্তারি করতে করতে কাউকে জুটিয়ে ফেলে নাকি! ওদিকে একবার সুরভিকে টপকে আমি সিমির সঙ্গে মেতে উঠেছি, ইংল্যান্ডে গিয়ে যদি আবার খোদ সিমিই আমার অতীত হয়ে যায়? হোক তার চেয়ে আক্দ, বন্ধন অনেক সময় স্বস্তি দেয়। মনে পড়বে যে সেই কথাটা চিঠির মধ্যে রিয়াজকে বোঝাতে গিয়ে আমি ঝরঝর করে সুরভির কথা লিখতে লাগলাম। যে সুরভির নাম নিতে অস্বস্তি বোধ করতাম বলে এত দিন রিয়াজের চিঠির উত্তর দিইনি, আমার চিঠির সিংহভাগজুড়ে থাকল সেই সুরভিই।

মনে পড়বে জানতে চেয়েছিলাম, সুরভি রংপুরের গণ্ডগ্রামে গিয়ে টিকতে পারল? হাজার হলেও শহরের সরকারি স্কুল-কলেজে পড়েছে! তারপর পড়াশোনা আর করেনি বুঝি? নাকি করেছে? লিখতে গিয়ে সুরভির প্রতি রাজ্যের কৌতূহল বোধ করে অস্বস্তিতে কেঁপে উঠছিলাম। মনে পড়বে চিঠিতে রিয়াজের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম বহুদিন চিঠির জবাব না দেওয়ার জন্য। তার কারণটা অবশ্য বানান করে লিখতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল, লিখেছিলাম যে সুরভির কথা এত থাকত তার চিঠিতে, তাই তাকে উত্তর দেওয়া যেন সুরভিকেই লেখা। আর এটা লিখে উঠতে পারার পরে সুরভির নামটা লেখা নিয়ে দ্বিধাটুকু আর থাকল না। তাই প্রশ্নগুলো করলাম আরও বিস্তারিত, আরও সহজ করে লিখলাম, আচ্ছা, তুমিই বলো, রিয়াজ, বোর্ডে স্ট্যান্ড করে আমি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি, চোখে দেশের সবচেয়ে বড় ডাক্তার হবার স্বপ্ন, সামনে পরির মতো উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানো সিমির বিচরণ, এসবের মধ্যে সুরভির মতো মফস্বলের সহজ-সরল, বোকাসোকা আর চাকচিক্যবিহীন একটা মেয়েকে আমার পাশে ভাবতে পারো তুমি? তুমি তো আমাকে জানো, আমি প্রতিদিন আগের চেয়েও তীক্ষ্ণ হতে চাই, আমার জ্ঞানের তৃষ্ণা প্রচণ্ড, বেড়ে ওঠার নেশা তীব্র। ছোট শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে যেমন আমার পড়ার মতো আর কোনো বই ছিল না, সুরভির মধ্যেও তেমনি নতুন করে জানার মতো আর কিছু ছিল না। সুরভি আমার কাছে এতটাই প্রাকৃতিক আর এতটাই অনুমেয় হয়ে উঠেছিল যে সে কাছে থাকলে জীবনের প্রতি রহস্যবোধই যেত হারিয়ে। মুখস্থ হয়ে যাওয়া খোলা একটা বই তুমি জোর করে কতবার পড়তে পারবে বলো তো? না না, তুমি যা ভাবছ মোটেই তা নয়, মানে, আমি মোটেও বলছি না যে সুরভি আমার যোগ্য ছিল না। সে তার মতো, আমি আমার। তার গণ্ডি সীমাবদ্ধ, সরকারি কলেজ থেকে পাস করে সে বড়জোর বিএ কি বিকম পড়ার কথা ভাবতে পারে, তা আমি বুঝতাম। কিন্তু ওখানে আটকে থাকলে আমার কিন্তু চলত না। আমি মোটেও সুরভিকে দোষ দিচ্ছি না, রিয়াজ। কেউ হয়তো তাকে পেয়ে অনেক সুখি হতে পারে, কিন্তু সেটা আমি নই। আমার দরকার ছিল মুহুর্মুহু চলমান মেঘ ছুঁয়ে যাওয়া পাহাড় কিংবা সমুদ্রের এলোমেলো ঢেউয়ের মতো পরিবর্তনশীল মানুষ, যে বদলে যেতে যেতে প্রতিমুহূর্তে আমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। প্রতিদিন যাকে আবিষ্কারের নেশায় আমি পাগলের মতো তার পেছনে ছুটতে থাকব। আর আমার আনকোরা আবেগ-অনুভূতিও প্রতিদিন অচেনা ব্যঞ্জনায় চমকে দেবে তাকে।

মনে পড়বে, রিয়াজের হাতে আমার চিঠি পৌঁছানোর আগেই আমি কোনো এক তুষারশুভ্র দুপুরে লন্ডনে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। তাকে চিঠি লেখার চার দিন পরে আমি চলে যাব, এ কথা পরিষ্কার জানিয়েছিলাম। লন্ডনের কোনো ঠিকানাও দিইনি তাকে, ঠিকানা জানতামও না তখন। মনে পড়বে, ধরে নিয়েছিলাম, সে আর আমার চিঠির জবাব দেয়নি বা ঢাকার ঠিকানাতে দিলে দিয়েও থাকতে পারে। তবে তিন বছর হাড়ভাঙা খাটুনি খাটার পর ঢাকায় ফিরে তার চিঠির কথা আমার মনে পড়ার কথা ছিল না। কিন্তু মনে পড়বে যে আলস্যে একদিন পুরোনো ড্রয়ার ঘাঁটতে গিয়ে রিয়াজের আগের চিঠিগুলো পেয়ে মনে একরকমের ধাঁধা তৈরি হয়েছিল, আমি চলে যাবার পরে রিয়াজ কি চিঠি লিখেছিল?

স্পষ্ট মনে পড়বে, আমার বিশ্বাস হয়েছিল রিয়াজ চিঠি লিখেছে। সুরভির ব্যাপারে এতগুলো প্রশ্ন আর মন্তব্য দেখার পরেও সে কি না লিখে থাকবে? লিখলে কী লিখেছিল রিয়াজ?

রিয়াজ নিশ্চয় লিখে থাকবে, এই কথাগুলো এত দিন পরিষ্কার করে বলোনি কেন, হাসান? কেন বলোনি যে সুরভির কথা না লিখলেই তুমি আমার চিঠির উত্তর দেবে? আর সুরভির সঙ্গেই-বা তুমি এত অমানবিক হতে পারো কী করে! রিয়াজ লিখবে আমার অসততা আর অবিবেচক হবার কথা। তার প্রাণের বন্ধু আমি এত নীচ হতে পারি, এ কথা লিখতে গেলে তার বুক ফেটে যাবে, তাই তা এড়িয়ে যাবে। রিয়াজ শুধু বিষণ্ণ মনে স্মৃতির স্তূপ ঘেঁটে ঘেঁটে আমাকে মনে করিয়ে দেবে সুরভির সঙ্গে কাটানো আমার বা আমাদের সবচেয়ে সুন্দর দুপুর আর সন্ধ্যাগুলোর কথা।

হাসানের বর্ণনায় ইটের চেয়েও লালরঙা কারমাইকেল কলেজের পুরোনো বিল্ডিঙে আমি নিজেকে দেখতে পাব। উঁচু সিঁড়িগুলো টপকে ওঠার তাড়া বরাবর লেগে থাকবে আমার। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকবে সেই মেয়েটি, আমার প্রতিটা হৃৎকম্পন যার নাম জপ করে। ধুপধাপ করে উঠতে উঠতে শেষ সিঁড়িটাতে হুড়মুড় করে পড়ে যেতে গিয়ে আমি মেয়েটার চটি পরা সরু পা দুটো দেখতে পাব। ফরসা পায়ের ওপর গেরুয়া কোলহাপুরি চটি টাইট হয়ে বসে থাকবে। চটির ফুটোময় কারুকাজের ফাঁকে ফাঁকে লাল টুকটুকে সুতোর বুনন আর সোনালি জরির টানা লাইনের দিকে চোখ আটকে থাকতে থাকতেই আমি নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াব। চটির ওপর গোলাপি সালোয়ার, তার ওপর গোলাপি কামিজ আর দুপাশে ফিনফিনে জর্জেটের গোলাপি ওড়না বাতাসে উড়ে উড়ে দূরে গিয়ে ফিরে এসে তার শরীরে আদর বুলিয়ে দেবে। নিচু হয়ে উঠতে গিয়ে তার ওড়নার কোমল কোণ আমার মাথার চুল ছুঁয়ে যাবে, কানের কাছে তার পরশ লেগে থাকবে। লাজুক মুখে আমি ওপরে তাকাব, দেখব আমার চেয়েও লাজুক মুখে হাসি চাপতে চেষ্টা করছে সুরভি। হাসি চাপতে না পেরে একসময় সে বুকে চেপে রাখা বই-খাতাগুলো সামান্য ওপরে তুলে ধরবে। আমি কেবল তখন তার চোখ দুটোকে হাসতে দেখব। আমি লজ্জা পেলেও সুরভি হাসি থামাবে না। আমি বিব্রত হয়ে হাত বাড়িয়ে দেব, সুরভি বইয়ের ঘেরাটোপের নিচে মুখ লুকিয়ে দুদিকে তাকিয়ে নেবে। কেউ দেখছে না জানলেই হাত বাড়াবে। ওই সরু আঙুলগুলোর দিকে আমি যেন কত হাজার বছর ধরে পৌঁছাতে চাইছিলাম! নাগাল পেতেই ধরে ফেলব। গোলাপি কাপড়ের সঙ্গে লাল মেহেদিরঙা আঙুলগুলো কেমন একটা বৈপরীত্য আনবে, যার প্রভাবে আমার মাথার ভেতরে চিনচিন করতে শুরু করবে। নাকি ছোঁয়ার কারণেই করবে? এই ভাবনার কোনো বিহিত হবে না। সেই যে কলেজ শুরুর দিনগুলো, যখন থেকে সুরভি শীতল করিডরগুলোতে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে, ওড়নার স্পর্শ লেগেছে, আঙুলের ছোঁয়া লেগেছে, আমি জানতাম আমার জ্বর জ্বর লাগবে, একই রকম চিনচিনে ব্যথা মাথার ভেতরে আর বুকের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়বে।

কোনো দিন দুপুরের পরপর ক্লাস শেষ করেই মসজিদের মতো নকশাদার করিডর ধরে ছুটে বেরিয়ে যাব। আমার পেছনে পেছনে একটা পা সামান্য ছোট হওয়াতে একদিকে হেলে খানিকটা খুঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ ধীরে ছুটবে রিয়াজ। সুরভিদের সেকশনের ক্লাস হয়তো কিছু আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমাদের ক্লাসের শিক্ষকের আজ ঘণ্টা পড়ার পরেও এত বেশি করে বোঝাতে হলো কেন, এই নিয়ে রাগ হবে। তাই সুরভিকে দেখতে না পাওয়ার দুশ্চিন্তায় রিয়াজের অসম গতির কথা আমি ভুলে যাব। ছুটতে ছুটতে মাঠের আরেক প্রান্তে মাঝারি বটগাছের নিচে সুরভিকে একজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলতে দেখব। দেখে রাগে আমার গা জ্বলে উঠবে, সুরভি সেকেন্ড ইয়ারের ওই ছেলেটার সঙ্গে ও রকম ক্যালাবে কেন? আবার মনে মনে তাকে ধন্যবাদও দেব, সে-ই তো সুরভিকে আমার জন্য মিনিট কয়েক আটকে রেখেছিল, নইলে ক্লাসের পর বাড়ির রাস্তায় তার হনহন হাঁটা থামত কী করে! ‘সুরভি, বাড়িত যাবার আগে কথা আছে কিন্তু,’ ওঠানামাবিহীন কণ্ঠস্বরে কথাটা বলেই আমি সেকেন্ড ইয়ারের ওই ছেলেটার পাশ থেকে সরে যাব। কে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের ক্যালানো দেখবে! ছেলেটা বিব্রত হয়ে নিজেই সরে যাবে। সুরভি কী ভাবছে তার ধার ধারব না। কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরে বলব, ‘বাড়িত যাওয়ার দরকার নাই মনে হয়!’ আমার রাগ দেখে সুরভি মিটিমিটি হাসবে। সে হাসি অগ্রাহ্য করে বলব, ‘হাঁটো, তাইলে আইজ লালবাগ বাজারত যাই?’ রিয়াজ ততক্ষণে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে আমাদেরকে ধরবে। তিনজন একসঙ্গে লালবাগ বাজারে গিয়ে জিলাপি খেতে থাকব। রিয়াজের হঠাৎ খেয়াল হবে, ‘আচ্ছা, ট্রেনত চড়ি বেড়াইলে ক্যাঙ্কা হয়?’ যেই কথা সেই কাজ। আমরা ছোটাছুটি করতে করতে ট্রেনের দিকে যাব। রিয়াজ যথারীতি হেলেদুলে আমাদেরকে ধরার লক্ষ্য নিয়ে এগোবে। তবে টিকিট কাউন্টারে সে-ই যাবে আগে। পকেটে টাকাও থাকে তার আর ট্রেনে চড়ার বুদ্ধিও তার। ‘শ্যামপুর না পার্বতীপুর?’—টিকিট কাউন্টারে টাকা বাড়িয়ে ধরে আমাদের কাছে জানতে চাইবে। আমি বলব, ‘পার্বতীপুর।’ সুরভি চমকে উঠবে, ‘কী কও? বাড়িত আসমো কোন বেলা? শ্যামপুর শ্যামপুর।’ আমি বলব, ‘ধুর, পার্বতীপুর জংশনটা দেখবার গেইলে কী হয় একনা?’ সুরভি বলবে, ‘অটে দেখার কী আছে, মাথার উপরে খালি একখান ব্রিজ। মাঝখান থেকি বাড়িত আসতে আসতে রাইত। বাড়িত চিন্তা করবে।’ আমি বিরক্ত হয়ে বলব, ‘আচ্ছা আচ্ছা, শ্যামপুর শ্যামপুর। স্টেশন থেকি ওই সুগার মিলের চেহারাটা দেখলেই হইল।’ কায়মনে প্রার্থনা করব ট্রেনে যেন শুধু তিনটা সিট খালি থাকে, শুধু তিনটা। সুরভির পাশে বসার এ রকম সুযোগ আর কী পাব! হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠে তার গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসার পরে হুঁশ হবে, আশপাশে অন্তত আরও গোটা চারেক সিট ফাঁকা। কিন্তু তখন আর কে সরবে, সরার কোনো কারণও তো লাগবে! ট্রেন দুলে দুলে সুরভির উরু আর ঘাড়ের ঢেউ শরীরে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেবে। সুরভি যেন খোলা সমুদ্র, কোনো প্রভাবকে ফুলেফেঁপে আমার শুকনো আর পিপাসার্ত বালু-শরীরে আছড়ে পড়বে। আমি ভিজব, পান করব কিন্তু পিপাসা যাবে না। শ্যামপুরে নেমে রেলস্টেশনের চা অমৃত লাগবে। সুরভি পাশে, তাই কি গলা এমন শুকিয়ে কাঠ! সে যদি না ছোঁয়, আমি কি গলা শুকিয়েই মরে যাব? ফেরার সময়ে উপরি পাওনা ট্রেনের ভিড়। তিল ধারণের জায়গা থাকবে না। হাত সটান ওপরে তুলে দুটো শরীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকবে। মাঝখানে এক চুল আকাশের অভাব। একজনের নিশ্বাস আরেকজনকে বাধ্য হয়ে টানতে হবে। ট্রেনের দুলুনিতে নাকে নাক লেগে যাবে একবার। সুরভি চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসবে। একবার পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে সুরভি টালমাটাল হয়ে আমার শরীরে আছড়ে পড়বে। হুট করে আসা কল্পনাতীত উচ্চতার একটা ঢেউয়ের মতো। ঢেউটা যেন মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে হঠাৎ। দম বন্ধ হবার জোগাড়। উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে সুরভি আমার বুকের ওপর থেকে মুখ সরিয়ে ওড়নায় মুখ চেপে ধরবে। খটকা লাগবে আমার, তার মুখ কি তখন এতটাই সহজবোধ্য যে ঢেকে রাখতে হয়? চোরাচোখে সে দেখে নেবে আশপাশের কেউ দেখে ফেলেছে নাকি। গ্রীষ্মের দুপুরে ওদিকে আমার পিঠের সঙ্গে প্রায় লেগে থাকা রিয়াজের কাছে এদিকের সমুদ্রস্নানের কোনো খবরই থাকবে না।

তারপর বহুদিন অব্দি ট্রেনে করে রংপুর টু শ্যামপুর আপ-ডাউনের স্মৃতি নিয়ে আমি আর সুরভি মত্ত থাকব। সেই কথা মনে করে কয়েক ফুট দূর থেকে চোখের দিকে চোখ পড়লেও আমরা আকস্মিক আছড়ানো ঢেউয়ে ভিজে যাবার স্মৃতি হাতড়ে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠব। নাছোড়বান্দা কাঁপুনির দিনের কোনো এক মুহূর্তে সুরভি ক্ষীণ স্বরে বলে বসবে, ‘একদিন ট্রেনত উঠি এইপাকে না গিয়া ওই পাকে গেইলে হয় না?’ আমি চমকে জানতে চাইব, ‘ওই পাকে মানে?’

‘এই মনে করো, সোজা বুড়িমারি গেনু। তারপর বর্ডার পার হয়া চ্যাংড়াবান্ধাত? কতজন না পালে যায়া বিয়াও করে!’

আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে তখন কল্পনায় বাতাসের ওপরে ঘর সাজাব। সে ঘর অন্য দেশে, অজানা পাড়ায়, যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। নতুন নামে ভিন্ন পরিচয়ে যুগল জীবন শুরু করার তুখোড় উত্তেজনায় আমাদের চোখ চঞ্চল হবে। এ যেন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো এক গোপন পথ আবিষ্কার, যা যেখানে থাকার সেখানেই ছিল, শুধু আগে আমরা জানতে পারিনি। এরপর মাসের পর মাস কল্পনার ঘরে আমরা ঢুকব-বেরোব, যুগল জীবন যাপন করব কিন্তু তাকে বাস্তবে পাওয়ার সাহস অর্জন দিনকে দিন দুরাশা হয়ে উঠবে। শুধু হঠাৎ কোনো দিন স্টেশন ছেড়ে যাওয়া দ্রুতগামী ট্রেন দেখলে বুকের ভেতরে হু হু করে উঠবে। কু ঝিক ঝিক শব্দটা মিলিয়ে গেলে বাতাসে ভাসা ঘরটা হাওয়ারই থেকে যাবে।

এবার রংপুর গিয়ে প্রথমে রিয়াজদের বাড়ি, ধাপের দিকে যাব। থাকবে কি কোনো ধানখেত এখনো সেখানে? জানি, থাকবে না। বাক্সের মতো খোপ খোপ বাড়ি থাকবে শুধু। সেই বাড়িগুলো থেকে রিয়াজদের বাড়ি খুঁজে বের করা কি খুব কঠিন হবে? সোজা রাস্তার বদলে অনেক প্যাঁচের অলিগলি থাকবে কি? কিন্তু রিয়াজদের বিশাল উঠোনওয়ালা বাড়িটা আর গেটের মুখে লেবু ফুলের গন্ধ ছড়ানো প্রায় বৃক্ষ হয়ে ওঠা লেবুগাছটা? ওই গাছটার দিকে তাকালে আবারও সুরভিই আমাকে দখল করে নেবে। এমন একটা দিনে প্রবেশ করব যে দিনটা পৃথিবীতে চিরকাল অপরিবর্তিত আর অনির্বাণ। যেদিন রিয়াজ ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলবে, ‘বাড়িত না কাইও নাই! তোরা ভিতরবাড়িত আসবি?’ রিয়াজের ইঙ্গিতটা স্পষ্ট থাকবে। আমি সুরভির হাত ধরে গেট পেরোতে চাইব কিন্তু কে যেন পেছন থেকে টেনে ধরবে তাকে। সে আর কেউ নয়, লেবু গাছ! কাঁটার বাহারে জর্জেটের ওড়না সামান্য টানেই ঝাঁঝরা। তাতে কার কী যায়-আসে! একটা খাঁ খাঁ করা ঘরে ঢুকে দরজাটা আজীবনের জন্য আটকে দিতে ইচ্ছে করবে। আর বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে সুরভির ছাকনির মতো ওড়নার ফুটো গোনা যাবে। গুনতে গুনতে ঘাড়ের পেছন দিক থেকে সামনে ঝুলে থাকা ওড়নাটাকে দুদিকে ধরে হ্যাঁচকা টানে সুরভিকে বুকের ওপরে আছাড় খাওয়ানো যাবে। তারপর থুতনিতে আলতো করে হাত রেখে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখা মুখটাকে আলোর দিকে তুলে ধরতে হবে। বদ্ধ ঘরে তখন আলো কোথায়? অথচ যেন সব আলো—আমি আলো, সুরভি আলো, আমাদের শরীর থেকে ঠিকরে বেরোবে আলো।

সেই সকালে ঘরে ঢোকা আর সন্ধ্যানাগাদ বাইরে বেরোনো, কে জানবে তাহলে দিনটা কেমন যায়? দরজায় খাবার নিয়ে কতবার রিয়াজের গলা শোনা যাবে। কার খিদে থাকবে, আমার? নাকি সুরভির? আমাদের তখন শুধু পেট নয়, সমস্ত শরীর ভরা, মন ভরা। নিজেকে নতুন করে জানা, শরীরের পরতগুলোর ভাঁজ মেলে নিয়ে মসৃণতায় বিস্মিত হওয়া। সন্ধ্যায় বেরিয়ে আসব অন্য আমি, অন্য সুরভি—ওই ঘরে সকাল সকাল ঢুকে যাওয়া দুজন নির্দোষ মানুষ নয় মোটেও। এক দিনে পৃথিবীর সমস্ত রহস্যের কূলকিনারা করে ফেলা, হাজার ঢেউয়ের শত ঝড়ঝাপ্টায় ওলটপালটে জাপ্টাজাপ্টি ভ্রমণ শেষে বিজয়ীর ভঙ্গিতে তীরে ফেরা আমরা তখন দরজা খুলে নতুন পৃথিবীতে পা রাখব। ধীর আর শব্দহীন। নিস্তব্ধ পৃথিবীর কেউ যেন আমাদের পদক্ষেপের কথা জানতে না পারে। চাঁদের অজান্তে তার গায়ে নিঃশব্দে পা রাখা মানুষগুলোর মতো। সুরভিকে ফিরতি রিকশায় উঠিয়ে শিস দিতে দিতে রিয়াজের ঘাড়ে হাত রাখব। একদিকে হেলে দাঁড়ানো রিয়াজ টলে উঠবে সামান্য। তাকে ধরে ফেলে বুক চিতিয়ে বলব, ‘বুঝলি, দোস্ত, সারা দিনমান বুকের সাথে আটকি রাখছিলাম। এই চেংড়ি আর কোনোদিন ভুলবার পারবে আমার কথা?’ নিজের ফুলে ওঠা বুকের মাঝখানটাতে আমার হাত রাখব। রিয়াজ মিটিমিটি হেসে দুদিকে মাথা নাড়বে। আমিও হেসে বলব, ‘সে কয়, কোনো দিন ছাড়ি যাবান নন তো? আমি কই, আশ্চর্য কথা, ছাড়ি যাইম কোন দুঃখে?’

এই পর্যন্ত ভাবতে গেলেই আমার হাসি পাবে। কোনো দুঃখে না, আরও বেশি সুখের জন্য ছেড়েছিলাম সুরভিকে। সুখে ছাড়ব না, তা তো বলিনি! সুখ আর সুখ, এই যেমন সিমিকে বুকের ওপর পাওয়ার সুখ, সেই সুখের সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হবে? আচ্ছা, একটা লেবুগাছ বৃক্ষ হয়ে গেলে কত দিন বাঁচে? কিন্তু বাড়িটার গেটের পাশে গাছটা যদি সত্যিই থেকে থাকে, তাহলে সবুজাভ সাদা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রিয়াজের কি কিছু মনে পড়ে যাবে? জানতে চাইবে, ‘আচ্ছা, সত্যি করি কও তো, মেডিকেলে ভর্তির পরেও এক-দেড় বছর যে বাপ-মায়ের সাথে দেখা করতে রংপুর আসলেই সুরভিক নিয়া অ্যাটেকার একটা ঘরত ঢুকি যাইতা, তখনো কি ভালোবাসেন নাই তাক?’ ‘বাসি নাই। বাসি নাই। বাসি নাই।’

শরীর আর মনের ভালোবাসা যে সব সময় এক নয়, এই ছাপ্পান্ন বছর বয়সেও কি রিয়াজকে সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে? মেডিকেলে পড়ার সময়ে বাপ-মা ছিল বলেই না ছুটিছাটায় রংপুরে আসা। বুঝতাম, সুরভি জানতে পারলেই ছুটে আসবে। বরাবর কি শুধু আমিই তাকে ডাকব? তা নয়। সুরভি নিজের তাগিদেই আসবে। আর তখন আমিই-বা না করব কেন! আসুক সুরভি, বুকের ওপর লেপ্টে থাকুক। দরজার বাইরে রিয়াজ পাহারায় থাক। দিন শেষে উঁচু চৌকাঠের ওপারে নতুন পৃথিবীতে সুরভি পা রাখুক, চাঁদে হেঁটে বেড়ানো নভোচারীর মতো।

‘তাইলে, তখন খালি অভিনয় করনেন উয়ার সঙ্গে?’

‘এই রকম ভাবতেছ ক্যান? তখন হামার যা হইছে তা মোরো ভাল্লাগছে আর সুরভিরও। কিন্তু সব সময় কি সেইটাই ভাল্লাগতে হবে? সেইটা ছাড়ো, আমি যে তখন সিমির সাথে আছি, বুঝতেছ না?’

রংপুরে মা-বাবাকে দেখতে গেলে সিমির মন খারাপ হয়ে যাবে। তবু আমাকে যেতে হবে আমি জানতাম। কোনো কোনো দিন ফোনের এনডাবিøউডি কলে সিমির সঙ্গে সামান্য আলাপ হবে, বেশি কথা বলা যাবে না, বিল প্রচুর। প্রতিদিনই নতুন পরিচয়ের মতো কেমন আছ, ভালো আছি বলতে বলতেই অনেক সেকেন্ড পার। কথা কোনো দিন গভীরে পৌঁছাবে না। শুধু ফোন রাখার পরে দিনভর সিমির ছোট্ট প্রশ্ন আকুতির মতো অবিরাম বেজে যাবে, ‘তুমি কবে আসবে?’

ভাগ্যিস বড় ভাই মা-বাবাকে আমেরিকা নিয়ে যাবে। তাই সে-ই শেষ আসা আমার। বিদায়, সুরভি। বিদায়, রিয়াজ। তারা কি জানবে আর আসব না? বোকা সুরভিটা বরং খুশি। এখন থেকে আর রিয়াজদের বাড়িতে চোরের মতো ঢুকতে হবে না, বন্ধ দরজার বাইরে তালা ঝুলিয়ে রিয়াজকে পাহারায়ও থাকতে হবে না। আমাদের নিজেদের বাড়িই তো পড়েই থাকবে, তালা মারা। চ্যাংড়াবান্ধা পার হয়ে নতুন পরিচয়ও নিতে হবে না সংসার করলে। সামান্য অপেক্ষা শুধু। ডাক্তার হয়ে সুরভির টানে রংপুরেই তো ফিরব!

ফিরব বটে। তবে তেত্রিশ বছর পর। এত দিনে রিয়াজ হয়তো অনেক বুড়ো হয়ে যাবে। দাড়িও রাখবে। খুঁড়িয়ে হাঁটার গতিটা আরও কমে আসবে। খেত থেকে তুলে আনা তামাক শুকিয়ে বানানো পুরিয়া পানের মধ্যে ভরে খেতে খেতে তার দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে স্থায়ী লালচে কালো দাগ পড়বে। মোড়ের চায়ের দোকানে বসে আধভাঙা দাঁতগুলো বিস্তৃত করে সে সমবয়সী আরও কয়েকজনের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠবে। পান চিবিয়ে জিবের নিচে পিক জমিয়ে অস্পষ্ট উচ্চারণে বলবে, ‘হামার এক পাও তো কব্বরে চলি গেইছে, মিয়ারা!’

আমাকে দেখে চমকে উঠবে রিয়াজ, ‘তোমাক তো দেখি এক্কেরে আগের লাকানই দেখা যায়, হাসান! ক্যাঙ্কা করি এদান থাকনেন?’ আমি হেসে বলব, ‘কী যে কও, আগের নাকান থাকে নাকি কিছু?’ তারপর আমি কি তার কাছে সুরভির ঠিকানা চাইব? নাকি নিজেই সে বলবে, ‘হাঁটো দেখি, সুরভিক একনা দেখি আসি? যাবু নাকি?’

‘তোমার কথা কি জানা আছে কিছু? আমাক দেখলে চিনবে অ্যাদ্দিন পর?’

‘কী যে কও, মাস-ছয় মাস পর দেখা হইছে, তোমাক নিয়া কত কথা জিজ্ঞাস করছে। অবশ্য এলা বেচারির অবস্থা খারাপ। স্বামী মলছে চাইর বছর। স্বামীর ভাইয়েরা সম্পত্তি দেয় না। শ্বশুরবাড়ি ছাড়ি রংপুরত বাপের ভিটাত আসি উঠছে। খুব অসুবিধা।’ ‘কও কী, তা হইলে তো যাওয়াই নাগে!’ ভুরু কুঁচকে বলব আমি।

তারপর পরের ছুটির দিনে সকাল সকাল রিয়াজের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ব। সুরভিকে দেখতে হবে আমার, আর নিজেকেও দেখাতে হবে। আহা, কতবার সুরভি আমাকে দেখতে চেয়েছিল! আহা, কত দিন সে আমার চিঠির প্রতীক্ষায় ছিল! তাকে না দেখলে চলবে?

সুরভিদের বাড়িটা এখন আর চেনা যাবে না। সরু গলির মাঝখানে কোথাও একটা ট্যাপ খাওয়া টিনের গেট, ভেতরে ছোট্ট উঠোনের চারদিকে গাদাগাদি ঘর। প্লাস্টারবিহীন উলঙ্গ ইটের দেয়ালঘেরা একটা ঘরের সামনে একচিলতে বারান্দা। দিনের বেলায়ও আবছায়া আর স্যাঁতসেঁতে। সকালে বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে বাতাসে মাটির গন্ধ মাখা। বারান্দার পাশের কাদা বাঁচিয়ে আমরা ওপরে পা রাখব। মোজাইকের কুচি কুচি পাথর না-ফেলা ছাইরঙা সিমেন্টের মেঝে, ঝাড়ু দেওয়ার দাগের মতো আবোলতাবোল খোদাই তার গায়ে। শোয়ানো দুটো সিঁড়ির ওপরে পাটের মোটা পাপোশ, একদিকে বৃষ্টিতে ভেজা। পাশ থেকে দড়ি বেরিয়ে থাকা, রংও বিগত। রিয়াজ সঙ্গে না থাকলে বাড়িটা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। ‘বাহে, সুরভি, বাড়িত আছ নাকি? দেখ তোমাক দেখতে কে আলছে!’ রিয়াজের কণ্ঠস্বরে দুই পাল্লার রংবিহীন কাঠের দরজাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে যাবে। ধুতে ধুতে নরম হওয়া ছাপা শাড়িতে সুরভি ক্লান্ত চোখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। শাড়ির বুকের কাছে তরকারির হলুদ ছোপ আর কোনো ঋতুতে লাগা লিচুর দাগ গলার নিচে ভাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে সুরভির হাত ব্যস্ত হবে। তারপর আঁচল টেনে ওঠাবে মাথায়। তাতে করে ব্লাউজের বহুল ব্যবহারের চিহ্ন লুকিয়ে যাবে। সুরভির চোখে উত্তাপ-উত্তেজনা খেলবে না কোনো। প্রায়ই দেখা হয়, এ রকম মানুষের দিকে তাকানোর মতো নিরাবেগ আর নিঃসঙ্কোচে সে আমাকে দেখবে। শেষ দেখা সুরভির হাজার কথা বলা চোখে পাথর বসানো থাকবে। কৌতূহলের পরিবর্তে আমার আফসোস হবে তখন।

ভেতরে গেলে বসার জায়গা দিতে গিয়ে সুরভি বিব্রত হবে। বাইরের পরে ঘরের ভেতরে ততোধিক দৈন্য দশায় মন খারাপ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। সুরভির সত্যি খুব কষ্ট। একচিলতে জমির সামান্য আয়ে সংসার চলবে না। ছেলেটা কারমাইকেল কলেজে পড়বে। বেতনটা কোনোরকম দিতে পারলেও যাতায়াতের জন্য সাইকেল কেনার টাকাটা সুরভি কিছুতেই জোগাড় করতে পারবে না। জানাবে, রিয়াজ কত সময় সাহায্য করেছে, রিয়াজের নিজের অবস্থাও তো ভালো না। তাই তার কাছে আর চাওয়া চলে না। নির্লিপ্ত কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ জরুরি কিছু মনে পড়ে যাবার মতো করে সুরভি জানতে চাইবে, ‘তোমরা কি এলা অনেক বড় ডাক্তার হইছেন?’

কী বলব গোছাতে গিয়ে আমার কেন যেন কথা হারিয়ে যাবে। আমাকে তোতলাতে দেখেও সুরভি তা অগ্রাহ্য করবে। বলবে, ‘ছেলেটা ডিগ্রি পড়তেছে। পড়াশোনায় তোমারে মতো ভালো। সাইকেল দিতে পারতেছি না দেখি রইদ-বিষ্টির মধ্যে হাঁটি কলেজ যাইতে কষ্ট পায়। তোমরা কি ওক একটা সাইকেল কিনি দিমেন?’ জানি না কেন, এরপর আমি আর সামনে দাঁড়ানো সুরভির মুখ দেখতে পাব না। শুধু আমার নিজেকে দেখতে পাব। যেন চারদিকে আয়না। আয়না নাকি প্রতারণা করে না—যা সামনে থাকে, তা-ই ফুটিয়ে তোলে। অথচ প্রতিফলনে ইস্ত্রি করা পরিপাটি শার্ট-প্যান্টের সঙ্গে মিলিয়ে পরা আমার চকচকে জুতো আর বেল্ট—সব ঠিক থাকলেও আমার মুখ থাকবে না। নিজের অবয়ব হারিয়ে আমি তাকে খুঁজে ফিরব যেন কতকাল। জানি না কোন ভঙ্গি অদেখা মুখটাতে মানাবে। সেই ভঙ্গিটা আমি পাগলের মতো খুঁজে ফিরব। খুঁজতেই থাকব।

১২-১৫ মে, ২০২০