সেই পুরোনো দিনের ঈদ আর নেই যেন। আজকাল অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। ‘ঈদ’ এখন ‘ইদ’, ‘সেহেরী’ এখন ‘সাহ্রি’। সাহ্রি খেতে অনেকেই দলেবলে রাত তিনটা-চারটায় হইহুল্লোড় করে বের হয়। গভীর রাতে রেস্টুরেন্টের লোকজনও দিব্যি প্রস্তুত। তবে ঈদে বাড়ি যাওয়াটা বেড়েছে বলা যায়। আজকাল সবাই যেন একটু বেশি বেশি বাড়ি যায় কিংবা বেড়াতে যায়। যাবে না কেন? নতুন নতুন ট্রেন এসেছে, বাস এসেছে। দোতলা বাসও আছে, প্রাইভেট প্লেনও আছে, বাড়ি যাবে না কেন? যারা বাসে বা প্রাইভেট কার বা ভাড়া গাড়িতে যাবে, তাদের জন্য আছে দুই কিলোমিটার বা তিন কিলোমিটার দীর্ঘ…ফ্রি ট্রাফিক (‘জ্যাম’ শব্দটি আর উচ্চারণ করলাম না)।
কেউ যাবে খুলনায়, কেউ বরিশাল, কেউ চট্টগ্রাম…কেউ সাতক্ষীরা…দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে সবাই।
যারা পয়সাওয়ালা, তারা যায় বিদেশে। ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ…হনুলুলু…
কিন্তু রাজিব নামের এক তরুণ ঠিক করেছে, সে দেশে বা বিদেশে যাবে না ঈদ করতে। সে যাবে, কোথায় যাবে, আমরা এ মুহূর্তে ভাবতেও পারছি না। হ্যাঁ, সে যাবে ৫০ বছর ভবিষ্যতে। ৫০ বছর পরে ঈদ কেমন হয় জানতে, যাকে বলে সরেজমিন দেখতে। কিন্তু কীভাবে? কল্পনায়? আইনস্টাইন অবশ্য বলেছেন, জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা জরুরি। কাজেই কল্পনাকে হালকাভাবে দেখলে চলবে না। তবে না, সেই তরুণ কল্পনায় যাচ্ছে না। বাস্তবেই সে যাচ্ছে টাইম মেশিনে চড়ে।
বলাই বাহুল্য, করোনার সময়টায় এই তুর্কি তরুণ দারুণ এক কাজ করেছে; সে একটা টাইম মেশিন বানিয়ে ফেলেছে। অসম্ভবকে কীভাবে সম্ভব করেছে এই তরুণ? সে বিতর্কে বরং না যাই। কারণ, এটা সব সম্ভবের দেশ। বরং এই তরুণ ৫০ বছর পরের ঈদ কেমন দেখে আসে, সেটা দেখা যাক না।
৫০ বছর পরের ঈদ! রাজিব তার বাসায় ঢুকল। সবাই তখন নাশতার টেবিলে সেমাই খাচ্ছে। রাজিব ভেতরে-ভেতরে নিজেকে সতর্ক করল…‘আমি ৫০ বছর পরের রাজিব। সময়কে সুইং বাই করেছি আমার কোয়ান্টাম টাইম মেশিন দিয়ে, এখানে সময় দুই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এই বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই ৫০ বছর পরের বাবা, মা, ভাই, বোন। তারা জানে না আমি আসলে অতীত থেকে এসেছি।’ রাজিব খুব আশ্চর্য হলো, এদের কারও হাতে ফোন নেই। বাসায় টিভি নেই। একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টরে বাজছে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’। বিদ্রোহী কবি নজরুল তাহলে ৫০ বছর পরও দিব্যি আছেন!
‘কিরে, কই ছিলি। খেতে বস।’ ৫০ বছর পরের মা বলেন।
‘অ্যাঁ…হ্যাঁ বসছি।’
‘আমার মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি,’ ভাবে রাজিব। ‘আমি ভুল করে ৫০ বছর ভবিষ্যতে না গিয়ে ৫০ বছর অতীতে চলে এসেছি। এখানে এখনো মুঠোফোন আসেনি, টিভি আসেনি। সেই মান্ধাতার আমলের তিন ব্র্যান্ডের ট্রানজিস্টরই চলছে। খুব সম্ভবত আমার কোয়ান্টাম টাইম মেশিনে ম্যালফাংশন হয়েছে!’
‘তুমি ভালো করেই জানো অতীতে যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘কে? কে কথা বলল?’
‘আমি রাজিব। এই সময়ের রাজিব ৫০ বছর পরের রাজিব। তুমি হঠাৎ চলে আসায় আমাকে একটি অতিরিক্ত মাত্রায় ঢুকে পড়তে হয়েছে। সেটা তোমার হঠাৎ আসার জন্যই হয়েছে। যে কারণে আমাকে দেখতে পাচ্ছ না।’
এসব কথাবার্তা মনে মনে হচ্ছিল, ফলে টেবিলে বসা অন্যরা বুঝতে পারছিল না।
‘কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? ৫০ বছর পর তো প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষে থাকার কথা। আমি সেই সময়ের ঈদ দেখতে এসেছি।’
৫০ বছর পরের রাজিব যেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘ঠিকই বলেছ। আমরা চরম উৎকর্ষেই ছিলাম। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যখন আমাদের চিন্তার জায়গাটা নিয়ে নিল…জানত, মানুষের ব্রেন একটা নিউট্রাল নেটওয়ার্ক। কাজেই ওখানে ঢুকে পড়া ওদের জন্য কোনো ব্যাপার নয়। তখন একদল মানুষ ভাবল, আর না, অনেক হয়েছে। রাতারাতি তারা সব ধরনের প্রযুক্তি ত্যাগ করল।’
‘বলো কী?’
‘ঠিক তা-ই।’
‘ওই আমিশ সম্প্রদায়ের মতো?’
‘একদম ঠিক বলেছ।’
‘আচ্ছা, ঠিক করে বলো তো…তোমরা কি ভালো আছ?’
‘বেশ ভালো আছি। এই যে ঈদ করছি, সেমাই খাচ্ছি, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ” শুনছি…একটু পর দল বেঁধে বাসায় বাসায় বেড়াতে যাব। কোনো ট্রাফিক হবে না। কারণ, আমরা গাড়িও ব্যবহার করি না।’
‘দারুণ দারুণ…কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’
‘মানে, তোমরা যখন সিদ্ধান্ত নিলে সব ত্যাগ করবে, তখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যাপারটা ঘটতে দিল?’
‘না, দেয়নি তো।’
‘তাহলে…?’
‘তুমি খেয়াল করোনি। আমি বলেছিলাম, একদল মানুষ প্রযুক্তি মানতে চাইল না। সেই দলের দায়িত্ব নিল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স…তারা যেমনটা চায় আরকি…এই যেমন এখন আমরা।’
‘আর অন্য দলটা?’
এ প্রশ্নের উত্তর রাজিব ফেরার পথে পেল। তার কোয়ান্টাম টাইম মেশিন ইন্টারগ্যালাকটিক জ্যামে পড়ল। রাজিবের বুঝতে বাকি রইল না, অন্য দলটা যার যার ব্যক্তিগত শত শত টাইম মেশিন নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে অনন্ত নক্ষত্রবীথিজুড়ে, তাদের ঈদ উদ্যাপনের সময়!