তখন বিকেল। ব্যস্ততম নাগরিক হাঁসফাঁসকে পাশ কাটিয়ে আমরা আমাদের কাছাকাছি যাব বলে ঠিক করি। সোহরাব নামে একজনের আসার কথা ছিল। ঝামেলার কারণে সে আসতে না পারলেও মীম আর মীনাক্ষী নামের দুজনের আসার কথা। তবে অন্তু মাহমুদ নামে একজন আসবে। পৃথিবীর এত এত মীম, মীনাক্ষী, সোহরাব আর অন্তুর মাঝে আমি কেবল এদের চিনি। তৈমুর নামের একজন আমার সাথেই আছে। শ্রী নামের একজন নক দিয়ে জানতে চেয়েছে বের হয়েছি কি না। —আমি বের হয়েছি, শ্রী। আপনারাও বের হন। ভূমিকা এটুকুই। জীবন মূলত ছুটন্ত হায়না। একটা ভাস্কর্য দেখা যাচ্ছে। লোহা-লক্করের। তীব্র গতিশীল। মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন গতির সাথে নিজের জীবনকে গেঁথে দিতে পারলে ভালো হতো। এই যে আরেকটি ভাস্কর্য। পোড়ামাটির। যেন আমি। পুড়ে পুড়ে শক্ত হয়ে যাওয়া একটি অবয়ব, যেটা তৈরি করেছে অন্য কেউ। নিজেকে তৈরির ক্ষমতা ভাস্কর্যগুলোর থাকে না বলেই তারা ভাস্কর্য। পৃথিবীর এই যে প্রায় ৭৫০ কোটি মানুষ, এর মাঝে কত কোটি ভাস্কর্য মানুষের অবয়বে ঘুরে বেড়াচ্ছে? আমার এসব ভাবতে ভালো লাগে। আমার ছবি তুলতে ভালো লাগে। মনের ভেতরে ভেসে ওঠে, একটা কিশোর একটা সাইকেলের টায়ার বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পেটাতে পেটাতে ছুটিয়ে চলেছে। দৌড়ের সাথে সাথে তার পরনের ইংলিশ প্যান্টটা খুলে খুলে যাচ্ছে। সে এক হাতে প্যান্ট ধরে রেখেছে, আরেক হাতের কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছে পরিত্যক্ত টায়ার। ধুলোমাটির পথ ধরে সে ছুটছে ছুটছে…গন্তব্য কোথায়, জানে না। তিনটি সিরামিকের মানুষ। টেবিলের ওপর মগ্ন হয়ে বসে আছে। তাদের পৃথিবীটা স্থবিরতায় মুখর। মুখোমুখি এ রকম নিশ্চল বসে কী গল্প করে তারা? শব্দ-বাক্যের বাইরে মৌনতারও কি কোনো আলাদা অর্থবোধকতা থাকে? তারা কি সেই ভাষায় গল্প করে রোজ? মানুষের বাইরে তাদেরও কি আলাদা পৃথিবী আছে? ছবি দেখি। ছবি তুলি। মন দিয়ে মানুষের মগ্নতা দেখি। মানুষ মূলত মগ্নতা ভালোবাসে! আলোয় উদ্ভাসিত শিল্পকলার এক-একটি রং করা দেয়াল চকচক করতে থাকে। কেউ কেউ নিশ্চয়ই আমাদের মতো এভাবেও ঘুরতে আসে। জীবনকে দেখে যায় কিংবা দেখিয়ে যায়। সব শিল্পের অর্থ খোঁজা বোকামি। জীবনের সবকিছুর অনর্থও থাকে। অনেক বোঝার চাইতে কিছু কিছু না-বোঝার ভেতর দিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। অনেক সময় কেবল দেখে যাওয়াও আনন্দের। তৈমুরকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম—সবটা কি বুঝতে পারছ? ও মুচকি হেসে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অন্য একদিন জেনেছিলাম, তৈমুর আসলে পরিবার থেকে ডিটাচড সেই ছোটবেলা থেকেই। দাদা-দাদির কাছে একটু বড় হবার পর থেকেই এই শহরে চলে এসেছিল মিরন মামার হাত ধরে। মিরন মামাও বছর দুই হলো উধাও। কথিত আছে, আয়মা খালার সর্বশেষ বাচ্চাটা মিরন মামার। আয়মা খালাও মিরন মামাতে মগ্ন হয়েছিল হয়তো। খালার জামাইও নাকি এই খবর জেনেছিল। তার পর থেকেই মিরন মামা উধাও। হয়ত মিরন মামাকে খুন করা হয়েছে। অথবা চোখের সামনে নিজেরই সন্তানের ভিন্ন পরিচয়ে বেড়ে ওঠা মামা নিতে পারে নাই। এই সব জটিল হিসাবে অবশ্য তৈমুরের তেমন আগ্রহ নাই। সে কেবল চুপ হয়ে গিয়েছিল নিজেরই আসন্ন ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায়। ওর এই চুপ হয়ে যাওয়াটাকে কেউ কেউ ওর শৈল্পিক মগ্নতা বলে। অবশ্য দিনে দিনে ও নিজেও অন্যদের বলা এই কথাটাকে এখন বিশ্বাস করে। সাবজেক্ট অতিক্রম করে কখনো কখনো দূরের অবজেক্ট দেখতেই বেশি ভালো লাগে। দূরের ক্যানভাসে একটা মুখ দেখা যাচ্ছে। ঝাপসা। এটাই কি মিরন মামা? যা কিছু অস্পষ্ট, তা বহুমাত্রিক। কল্পনা সেখানে একেকজনের একেক রকমভাবে খেলা করে। মিরন মামার হাতের আঙুলে এখন একটা প্রজাপতি খেলা করছে। স্বপ্নবাজ মানুষের আঙুলে বুঝি প্রজাপতি খেলা করে? আমি আঙুলে বসা প্রজাপতিটির কথা ভাবি। সুতোয় বাঁধা প্রজাপতিটির কথা ভাবি। অথবা তারাবাতি—ওপরে তাকিয়ে দেখি, আয়মা খালার মতো তারাবাতি হয়ে ফুটে আছে পিতলের ফুল। আয়মা খালার কথা বলতে গিয়ে শান্তা মিসের কথাও মনে পড়ল। ভূগোল পড়াতেন। গম্ভীর প্রকৃতির শান্ত একজন মানুষ। কিন্তু কে বলবে ভেতরে ভেতরে সমুদ্রের উত্তালতা নিয়ে ঘুরে বেড়ান! শান্তা মিসই শোভনকে প্রথম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। তারপর একটানা ৬৭টি পোস্টে লাইক আর কমেন্ট করেন। যে শোভনের দিনে মোট নোটিফিকেশনের সংখ্যা হাতে গুনে বলে দেওয়া যেত, সেই শোভন ফেসবুক ওপেন করে ৭২টি নোটিফিকেশন দেখে তো থ! দিনে দিনে শান্তা মিসের সাথে শোভনের ভারচুয়ালি একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়। শান্তা মিসও ধীরে ধীরে নিজের সবটা মেলে ধরতে শুরু করেন। একদিন লেকের ধারের বটগাছটার নিচে বসে দুজনই দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। শান্তা মিসই দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে বলেছিলেন, ‘আগুনের ধর্ম জানো?’ শোভনের উত্তরের অপেক্ষা না করে প্রাজ্ঞ শিক্ষকের মতো বলেছিলেন, ‘আগুন ধ্বংস যেমন করে, তেমনি সৃষ্টিও করে। ঘরের আগুনে পুড়তে পুড়তে যেটুকু অবশিষ্ট থাকি, সেটাকে তোমার কাছে নিয়ে আসি আরেকবার পোড়াবার জন্য। ঘরেরটা ধ্বংস করে; তোমারটা সৃষ্টি করে।’ এত জটিল কথা অবশ্য শোভন বোঝে নাই। সে শান্তা মিসের চুলগুলো কানের ওপর তুলে দিতে দিতে দিতে বলেছিল, ‘তুমি নিজেই একটা আগুন।’ তখন দূর থেকে, সেই উঠতি দুপুরে, কেউ যেন গাইছিল, ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না…’ তারা এক অন্য ভূগোলের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। একদিন শান্তা মিসই তার নিজস্ব বাগান খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই নাও রাজ্যপাট—শাসন করো।’ তারপর অনেক দিনই তাদের আর কোনো খবর আমার রাখা হয় নাই। কয়েক বছর পর শান্তা মিসের সঙ্গে হঠাৎ বসুন্ধরায় দেখা। স্বামী-সন্তান নিয়ে শপিংয়ে এসেছেন। ছোট ছেলেটাকে দেখতে অবিকল শোভনের মতো। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম, স্পেস এক বিস্ময়কর ঘটনা মানুষের জীবনে। পৃথিবীতে কত গান, কত আলো, কত সুর, অসুর—কনট্রাস্ট কালারের যে জীবন, তার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমাদের ভালো লাগে। মানুষকে হাসায় মানুষ। মানুষকে কাঁদায়ও মানুষ। মানুষ এক আশ্চর্য নিমগাছ। যে জীবন আমাদের ভালো লাগে, আমরা মূলত সেই জীবনের কথা বলতেই ভালোবাসি। শ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি। ও মগ্ন হয়ে এক-একটা শিল্পকর্ম দেখছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওর মৌনতা আমাকে ছুঁয়ে যায়। এই সব সুন্দরের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার মুগ্ধতা বাড়ে। আমার আরও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, জীবন সুন্দর। মনে হয়, মগ্নতা সুন্দর। শ্রীর শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, ও সত্যিই মানুষ, নাকি পোড়ামাটির কোলাজ। মানুষের সহজতার দিকে তাকিয়ে আমারও খুব সহজ হতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীকে তখন সরল-সুন্দরের দেশ বলে মনে হয়। আমরা আরেকটু এগিয়ে যাই। আমাদের সাথে অন্তু মাহমুদ নামের একজন এসে যুক্ত হয়। আমরা ছবি তুলি। তখনো আমরা পৃথিবীর এই সব আমুদে দিনের গল্প নিয়ে ভাবিত হই না। আমরা ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকি। ঘটনার ভেতরে থাকা মানুষ কখনো ঘটনার বাইরে দেখতে পারে না। দোয়েল কিংবা ফড়িং কি তা পারে? তৈমুর নামে যে মানুষটাকে আমি চিনি—সরল-সুন্দরের দেশ থেকে সে অকস্মাৎ পৃথিবীতে এসে পড়েছে মানুষকে ভালোবাসার অপার্থিব ক্ষমতা নিয়ে। তার মুখের দিকে চেয়ে থাকি। আমার জিজ্ঞাসা তৈরি হয়, মুখোশ কি কখনো কাঁদে? এ রকম জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি ওই চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার উত্তর পেতে ইচ্ছে করে না। জীবন আসলে তৈমুরের হাসির মতো সুন্দর। ধীরে ধীরে গ্যালারি থেকে আমরা বের হয়ে আসি। আমাদের মনে তখন অপার প্রশান্তি। আমাদের জীবনে তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বের হয়েই প্রদর্শনীর ব্যানারে চোখ পড়ে। নানান আলোয় উদ্ভাসিত! অজস্র আলোর মিশ্রণ। অনেক রঙের আলো এসে একই ক্যানভাসে কেমন মিলেমিশে গেছে! একই ক্যানভাসে অনেকগুলো রং অথচ তাদের প্রত্যেকেরই ধর্ম আলাদা! আমার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না। মুগ্ধ হয়ে কেবল দৃশ্য দেখি। দৃশ্যবস্তুর ওপর আলোর প্রভাব দেখি। আমার কেবল দেখে যেতে ভালো লাগে। এই সব মুগ্ধতা নিয়ে আরও দু-কদম সামনে আগাই। আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। আকাশের কাছাকাছি এক চিলেকোঠায় গিয়ে বসি। দেখি অন্ধকার ইতি-উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আকাশের কাছাকাছি সেই চিলেকোঠা থেকে আকাশকে খুব কাছের মনে হয়। অনেক অনেক তারা দেখা যায়। নিচের শহর আর শহরের বাহারি আলো দেখা যায়। অজস্র ব্যক্তিগত গল্প এসে আমাদের আচ্ছন্ন করতে থাকে। আমরা হাসি। শিঙাড়া আর কফি খাই। আড্ডা দিই। একবার আমাদের মাঝে উঁকি দেন নির্মল হালদার, একবার জয় গোস্বামী। শহীদুল জহিরও এসেছিলেন তাঁর ‘ডলু নদীর হাওয়া’ নিয়ে। কয়েক পশলা কবিতাবৃষ্টিও হলো। আমি শ্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে একটা আঁকানো গোলাপ চুরি করে এনেছিলাম গ্যালারি থেকে। শ্রীর জন্য। ওর মগ্নতার কি আমি প্রেমে পড়েছি? হঠাৎ একটা ফোন আসে। বাড়ি ফেরার। আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শ্রী ফিরে যাচ্ছে। ওর মগ্নতামাখানো হাসি চিলেকোঠার এই ছাদটাকে এখনো আবিষ্ট করে রেখেছে। মনে মনে চুরি করে আনা ফুল ওকে আর দেওয়া হলো না। ওই ফুলটার জন্য আমার মায়া হচ্ছে। আমি আমার মনের ভেতরের সেই ফুলটার দিকে তাকিয়ে আছি। যে জীবন রবিগানের, যে জীবন আড়বাঁশির, নগরের ইট-কাঠে তার খুব হাঁসফাঁস লাগে।