স্কুল মাঠের পাশেই রুহুল মেম্বারের ভিসিআর হল। একেক হাটে একেক ‘বই’ চলে। গরম গরম পোস্টার বাইরে, ভেতরে চলে ঢিসুম ঢিসুম। ছোট বলে আমার তা দেখার সুযোগ হয় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই পোস্টার দেখি শুধু। সেখানেই প্রথম সিন্দবাদকে দেখেছিলাম সরাসরি।
মাথায় পাগড়ি, এক কানে দুল, পরনে আলখাল্লা, সুলেমানি তলোয়ার ঝুলছে কোমরে। যেন ‘ইয়া আল্লাহ, সাহায্য করো’ বলে উঁচিয়ে ধরলেই তলোয়ারটায় জ্বলে উঠবে মন্দনাশা আগুন। তলোয়ার একটা আমারও আছে। পিটুলগাছের ডাল চেঁছে বানিয়েছি। সিগারেট বক্সের ভেতর পাওয়া পাতলা ফয়েল জড়িয়ে দিয়েছি গায়ে। আগুন জ্বলে না বটে, তবে আলো পড়লে ঝিলিক ঠিকই দেয়। তা নিয়েই চলে আমার ‘আলিফ লায়লা’গিরি। এমনিতে কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে কিন্তু সিন্দাবাদের ডায়ালগ দিতে ওস্তাদ। ঘুমের ঘোরেও পাহাড়ে উঠি, সাগরে ছুটি। সেই সিন্দবাদ আজ এখানে!
হলের সামনে ঝুলে আছে জসিম–শাবানা। তার পাশে হলুদ একটা পাতলা কাপড়ের ব্যানার। ‘সিন্দাবাদের পাঁপড় চপ। দুই টাকা পিস।’ সামনে লম্বা একটা চৌকি। মাঝখানে তার স্টোভ জ্বলছে। একমনে চপ বানাচ্ছে লোকটা—পিঁয়াজু, পাঁপড়, বেগুনি ভাজছে।
কী যে স্বাদ তাতে! যে খায়, সে-ই প্রশংসা করে। শুনে মিষ্টি করে হাসে সিন্দাবাদ। সুন্দর করে কথা বলে। গুনগুন করে আলিফ লায়লার সূচনা সংগীত গায়। শুনি আর ভাবি, এটাও কি তবে আলিফ লায়লারই অংশ, পরে দেখাবে টিভিতে?
আলিফ লায়লার দেশে যাওয়ার ইচ্ছা আমার খুব। চাইলে কি সে আমাকে নিয়ে যেতে পারে না? অনুরোধটা করব বলে দাঁড়িয়ে থাকি প্রতিদিন। কিন্তু নিতে যদি রাজি না হয় সে? যদি টাকা চায় অনেক? কী বলে রাজি করাব, ডুবে থাকি চিন্তায়। হাসবে বলে কাউকে বলতেও পারি না। বেয়াড়া ইচ্ছাটা শুধু তড়পায় বুকে।
তড়পানিটা বাড়িয়ে দিয়েই হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেল সিন্দাবাদ। এক হাট যায়, দুই হাট যায়, আসে না সে। আলিফ লায়লার দেশে যাওয়ার কী হবে আমার? অস্থির হয়ে উঠি, উতলা হয়ে উঠি। পরের হাটবারগুলো কাটল পুকুরগাঁয়ে, সেখানেও নাকি সে বসত মাঝেমধ্যে। কিন্তু না, সেখানেও আসে না আর। বাধ্য হয়েই আমাকে যেতে হলো তার গ্রামে। তালগাছঘেরা ছোট্ট সুন্দর গ্রাম তালগাছি। ঢোকার মুখে ইয়া বড় ছাতিমগাছ এক। তার গোড়া থেকে বড় রাস্তার একটা ডাল ঢুকে পড়েছে পাশের বাড়ির উঠানে। ওটাই নাকি সিন্দাবাদের বাড়ি।
ভেতরে ঢোকার সাহস নেই, ছাতিমতলায়ই দাঁড়িয়ে থাকি আমি। পায়চারি করি। পা লেগে গেলে বসি। পাখি আঁকা ছাড়া আঁকতে পারি না কিছু, খাতাভরে সেটাই আঁকি। সেসব পাখির চোখেও সিন্দাবাদের ছায়া পড়ে না।
শেষ পিরিয়ডে বিজ্ঞান ক্লাস। বিজ্ঞান স্যার কড়া খুব, পড়া না পারলে ঠাস ঠাস। ভয়ে আমার টাকরা কাঁপে। সঙ্গে যোগ হয়েছে নিখোঁজ সিন্দাবাদের খোঁজ। ফলে সাত পিরিয়ডের পরেই বেরিয়ে আসি। বাতাসে ভাসা মাছের তরকারির গন্ধ শুঁকি। স্কুল ছুটির পর এই গ্রামের ছেলেমেয়েরা ফেরে যখন, তখন আড়াল নিই। তবু হয়তো দেখতে পায়, হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে মেয়েরা। তাদের মধ্যে দুটি মেয়ে সিন্দাবাদের উঠান দিয়ে চলে যায় ভেতরে। ছেলেরা যায় রাস্তা বেয়ে সোজা। তাদেরই একজন এসে একদিন ধাক্কা দিল আমাকে। ‘পতিদিন তোর একেনে কী রে?’ এমনিতেই কথা সরে না মুখে, তাতে ছেলেটা যেন কেহেরমান একদম। আমতা আমতা করি ভয়ে। দেখে আরও জোর পায় সে। ‘ফাতরামির আর জাগা পাসনি, না! যা, ভাগ, আর যেন না দেখি।’
ভাগি। তবে আবারও যাই। আরেকটা ছেলে ধমকাল একদিন। আগেরটার চেয়ে একটু কম বয়সী এটা। ব্যাপারটা তাই বলা গেল। উত্তরে সে ‘বুজচি, তুমি গানজাল চা’র কতা বলচাও। ওই তো সে লোক’ বলে যাকে দেখাল, প্রতিদিনই দেখি আমি তাকে। উঠানটায় হেঁটে বেড়ায়। গরু তোলে, শানি কাটে। ঝগড়া করে, বউ ঠ্যাঙায়। আর কাশতে কাশতে উল্টে দিতে চায় নাড়িভুড়ি। বেঁটে, গোলগাল দেহ, সাধারণ স্বাভাবিক। চুলও ছোট ছোট।
সিন্দাবাদ তাহলে গেল কোথায়? আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে সে অন্য হাটে যায় এখন? পরের দিন থেকে তাই স্কুলে ঢুকি না আর। সোজা গিয়ে দাঁড়াই ওখানে। হাটে যাওয়ার আগেই যেন ধরা যায়। কিন্তু বউঠ্যাঙানো লোকটা ছাড়া দেখি না কাউকে।
লোকটা কি চলে গেল এখান থেকে? নাকি ভেতরেই আছে লুকিয়ে? গিয়ে দেখতে হবে। তা এতই সাহস, এক পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসি দুই পা।
অমনই আগুপিছু করা এক সকাল ছিল সেটাও।
সিন্দাবাদের উঠান চিরে এগিয়ে এল মেয়ে দুটি। দেখেই সিঁটিয়ে দাঁড়ালাম আমি আর ছাতিম। আমাদের বাঁয়ে রেখে এগিয়ে গেল ওরা। বড় রাস্তায় উঠে গেছে, এমন সময় দেখি ফিরে আসছে লম্বা মেয়েটা। দরকারি কিছু ফেলে গেছে হয়তো। কিন্তু না, মেয়েটা চলে এল আমার কাছে সোজা। এসেই বলল, ‘একেনে দাঁড়ায়ে থেকে লাব নেই। চলেন, ক্লাসে যাবেন।’ কী থেকে কী! বুঝতে পারছি না। যাওয়ারও তো গরজ নেই। ওদিকে তার সঙ্গী ডাকছে। টুপ করে সে তখন হাত ধরল আমার। যেন নিয়েই যাবে টেনে।
‘স্কুলি তো তাকায়েও দ্যাকেন না,’ স্বরে তার কুড়মুড়ে অনুযোগ, ‘তালি একেনে এসে দাঁড়ায়ে থাকেন ক্যান?’ চোখে-মুখে নরোম লালের আভা। ঠোঁটের তিলে চিকচিক করছে হাসি। সেসবের মানে না বুঝেই সিন্দাবাদের কথা বলি আমি। এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই যেন কথাটা বলেছি, এমন বুঝে হাসে সে। কিন্তু ভুল বুঝলে তো হবে না, শক্ত করেই তাই বুঝিয়ে দিই—আমি সিন্দাবাদের জন্যই আসি।
এবার কেমন চমকে তাকায় মেয়েটা। হাত ছেড়ে দেয়। তাকিয়ে থাকে মেঘলা মুখে।