জিনা লাবণীকে ফোন করে বলল, মা, তুমি ভিডিও কল দিয়ো না। তোমার সাথে তখন দরকারি কথা বলা যায় না। তুমি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো, কোনো কথা মন দিয়ে শোনো না।
দরকারি কথা আবার কী? শাগুফতা, তুর্যকে দেখার জন্যই আমি ফোন করি।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন দরকারি কথাটা শোনো। সাফিয়া বলছিল, তুমি আর বাবা সারা দিন ঘরে বসে থাকো, বাইরে কোথাও বেরোতে চাও না।
তোমার বাবা মোটেও বাইরে যেতে চায় না। সারা দিন তার ঘরে বসে বইপত্র পড়ে।
কথাটা শোনো মা, সাফিয়ার এক আত্মীয়ের বিয়ে, তোমাদের যেতে হবে।
ওদের সব হাইফাই, বেশি বড়লোক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী। রিটায়ার্ড সরকারি চাকরের দাম নেই। তোমার বাবার সাথে কেউ ভালো করে কথা বলে না। লোকটা গুটিসুটি মেরে থাকে।
ওটা বাবার দোষ। বাবা একসময় বড় অফিসার ছিল। এখনকার পার্টির এই নিয়ম, নিজেকে গিয়ে পরিচিত হতে হয়।
আমাদের দরকার নেই।
মা, সব সময় তোমার দরকারে চলবে না। আমি বলছি, তোমরা যাবে। সাফিয়ার কাছে টাকা পাঠিয়েছি। তোমার জন্য নতুন শাড়ি কিনবে, ব্লাউজ, পেটিকোট বানানোর ব্যবস্থা করে দেবে। সাফিয়া খালি তোমার ছেলের বউ না, ক্লাস ওয়ান থেকে আমার স্কুলবন্ধু। ওর চয়েস ভালো।
তুমি সব সময় আমাকে ধমকাধমকির মধ্যে রাখো।
আর শোনো, বাবার পাজামা-পাঞ্জাবি যা পছন্দ করে কিনে দেবে, বাবাকে তা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে। এত দামি, ব্র্যান্ডের কাপড়, কী দরকার, ঈদ না কিছু না—বাবার ওই সব কথা চলবে না।
সাফিয়াও কয়েক দিন ধরে কেমন আচরণ করছে। শাড়ি, পাঞ্জাবি ঠিক আছে। একদিন নিয়ে গেল দিলশাদ টাওয়ার, জুয়েলারি দোকানে।
সামিন জুয়েলার্সে ঢুকে সাফিয়া বলল, আম্মা হাতের চুড়ি আর গলার চেইন পছন্দ করেন।
কেন?
একজনকে গিফট করব।
আমার পছন্দে কেন? আমরা পুরোনো ফ্যাশনের যুগের মানুষ।
ধরেন, আপনার জন্যই। সেটা মনে করেই পছন্দ করেন।
সাফিয়ার কথাটা কানে নেননি লাবণী। নিজের মেয়ে আর সাফিয়া এক না। জিনা মোটেও সিরিয়াস না; ছেলের বউ, মন রাখার জন্য চোখের সামনে মেলে রাখা চুড়ি, লকেট, কানের দুল থেকে চোখ যেটা যেটা টানল, পছন্দ করে দিলেন।
তারপর হলো কী, তিন দিন আগে বিল্ডিংয়ের নিচে হইচই। তার কান খুব খাড়া, চারতলায় তার রুম থেকেই মনে হলো, এই বিল্ডিংয়ের লোকজন না। তারপর তো তাদের চার তলায়, এবার সাফিয়াদের তলায় দুমদাম। কলবেল বাজছে, কিন্তু শব্দটাও যেন অন্য রকম।
সাফিয়াদের কাছে কত রকমের মানুষ আসে। সাফিয়া, রাইসু কারোই বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই।
কিন্তু ডুপ্লেক্সের ওপর-নিচ দুই দরজা দিয়ে যারা ঢুকল, তাদের দেখে লাবণী চমকেছেন।
ওহ মা, জিনা কেন? জামাই আনিস, ওদের দুই ছেলে-মেয়ে।
হলোটা কী হঠাৎ? কার কী হলো?
মনটা চমকালেও খুশি হলেন বেশি।
তিন বছর পর দেখা হওয়ার আনন্দ-উত্তেজনা একটু কমে এলে কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে জিনা বলল, বাংলাদেশের সাথে আনিসদের অফিসের কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। এবার নাকি হঠাৎ ঢাকায় কী কাজ পড়েছে। তিন দিনের কাজ। আমরাও লেজ ধরলাম। আনিসের সাথে ঢাকা আসার ব্যাপারে শাগুফতার আগ্রহ বেশি। ওর নীনাকে দেখবে। নীনার সাথে তার কী কথা আছে, যা নাকি ফোনে বলা যাবে না।
লাবণী বললেন, কই শাগুফতা, ওর কথা শুনি।
নট নাউ নীনা, প্রিটি পার্সোনাল।
শাগুফতার ঘটনা জানার জন্য উদ্গ্রীব, কিন্তু দেখেন, সবাই ব্যস্ত, কাছে তেমন কাউকে পান না। জিনা বারবার বলছে, তিন দিনের বেশি থাকা যাবে না, ছেলে-মেয়ে দুজনের স্কুল খোলা, আনিসের রিপোর্ট নিয়ে আগামী সপ্তাহে কোম্পানির বোর্ডে বসতে হবে।
শাগুফতা বলল, সে ফেল ইন লাভ। একটা সাদা ছেলে, ড্রাগো নাকি নাম বলল। এই না কদিন আগে মেয়েটা জন্মাল। বড় হয়ে গেল কখন? জিনার জন্মই হলো মাত্র সেদিন। লাবণীর আগ্রহ, প্রেমিক ছেলেটিকে দেখবেন। শাগুফতার ফোনের গ্যালারিভর্তি নিশ্চয়ই ছেলেটির ছবি থাকবে। ছবি দেখার কথা বলতে যাবেন, শাগুফতার পরের কথায় মুখটা কালো হয়ে গেল। শাগুফতা বলল, এখানে আসার টেন ডেজ আগে, উই মেড লাভ, ফার্স্ট টাইম। এটা দারুণ এক্সপেরিয়েন্স নীনা!
পুরোনো দিনের মানুষ। কতকাল আগে জন্ম, তাদের সময়ের নিয়মকানুন আর বিদেশের আচার-আচরণে বিস্তর ফারাক থাকবে। কিন্তু এতটা? তা-ও একেবারে নিজেদের ঘরে হামলে পড়বে? মেয়ে, নাতি-নাতনি আসার জন্য আলো-হাসিতে যে ঘর ভরেছিল, তা যেন হঠাৎ নিভে গেল।
সাফিয়া কিনে দিয়েছে লাল রঙের ভারী কাতান শাড়ি। তিনি আজকাল এসব পরেন? জিনা আর সাফিয়া চেপে ধরল, পরতে হবে। বিউটি পারলারেও টেনে নিয়ে গেল। কেমন ভূতের মতো তাকে সাজালেও আয়নার ভেতর দিয়ে নিজেকে দেখতে ভালো লাগছিল যেন। অনেক পুরোনো একটা উজ্জ্বল মুখ উঁকি মারছিল মেকওভারে চাপা দেওয়া রিংকেলভরা মুখের ভেতর দিয়ে। কয় দিনে মনের অন্ধকারটা কেটে যাচ্ছিল। ছেলেমেয়েরা বিদেশে বসবাসের জন্য চলে যায় ধনী দেশের সুবিধাগুলো নেওয়ার জন্য। পাশাপাশি ওদের নিয়মকানুনগুলোও মেনে চলতে হবে তো।
জিনা বলল, মা, এখান থেকে আমরা সরাসরি স্পেক্ট্রায় যাব। বাবাকে নিয়ে আসবে রঞ্জু।
লাবণী ভেবেছিলেন, সোনারগাঁও বা লা মেরিডিয়ানে হবে সাফিয়ার আত্মীয়দের বিয়ের অনুষ্ঠান। স্পেক্ট্রা, তাহলে এত সাজগোজ কেন? এই পার্টি সেন্টারে গেছেন আগে। গায়েহলুদ, জন্মদিনের অনুষ্ঠান—এসব হয়। ভাবতে ভাবতে হলের ভেতর ঢুকে গেছেন। ছোট জায়গায় অনেক মানুষ। ঝলমলে আলো। দৃষ্টি সয়ে এলে দেখলেন, লোকজনের প্রায় সবার মুখ চেনা। মহসিনকেও দেখা গেল নতুন জমকালো পাজামা-পাঞ্জাবি পরনে। লোকজন তাকে ঘিরে ধরল। খুলনার আত্মীয়েরা এখানে কেন? ভাইবোনের সব ছেলেমেয়ে? তার স্কুলের বন্ধু মিলি এখানে এল কোথা থেকে! ২০ বছর ওর খোঁজ জানে না। অথচ সে ছিল তার বেস্ট ফ্রেন্ড।
লাবণীকে নিয়ে বসানো হলো মঞ্চে, সিংহাসনের মতো আসনে। পাশেরটায় মহসিন। চেয়ারের সারি থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ৫০ বছর পার হলে নতুন করে বিয়ে করতে হয়। কাজি কই? একজন বলল, দুলাভাইয়ের মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দাও।
একটু মন খারাপ হয়েছিল, তার ছেলেমেয়ে, স্বামী—সবাই ভুলে গেছে বিবাহবার্ষিকী দিনটির কথা। হঠাৎ করে মেয়ে, জামাই চলে এল; দিনটা চাপা পড়ে গেল আরও বেশি করে।
কতজন এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। খাবারের সময়, সত্যি নতুন বউ তো নয়, এই টেবিল, ওই টেবিলে গিয়ে কথা বলল। জিনা বাবা আর মায়ের কোনো কাছের মানুষকে ডেকে আনা বাদ রাখেনি। জিনিয়া ডালাস থেকে বলেছে, সাফিয়া এখানে বসে জোগাড়যন্ত্র করেছে। লাবণী মোটেই বুঝতে পারেননি।
মহসিনের কী মনে হচ্ছে, কে জানে? তার দিকে তাকিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি।
মহসিনের মুখের দিকে তাকাল মেরিডিয়ানে তাদের স্যুটে এসে। জিনা, সাফিয়া, মিলা, শাগুফতা হোটেলের এ রুমে ওদের রেখে চলে গেল।
আজ নাকি এ রুমে তাদের ফুলসজ্জা।
জিনা কি জানে ওর মা-বাবার ফুলশয্যা হয়েছিল খুলনার হোটেলের রুমে? মহসিনরা বাসভর্তি বরযাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে খুলনা এসেছিল বিয়ে করতে। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বোঝা গেল, এত সোনাদানা নিয়ে রাতের বেলা বউ আর অন্য মেহমানদের বাসযাত্রা করানো ঠিক হবে না। খুলনা শহরে হোটেলের কয়েকটা রুম নেওয়া হলো। একটা ঘরে ফুলটুল সাজিয়ে ফুলসজ্জা।
জিনা জানলেও জানতে পারে হোটেলের ফুলসজ্জার কথা। কিন্তু এটা জানে না, নতুন বউ পাশে রেখে ওর বাবা সারা রাত পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে।
মহসিন বললেন, তুমি দেখেছ বড় স্ক্রিনে তোমার-আমার পুরো জীবনের কত স্টিল আর ভিডিও ছবি দেখাচ্ছিল। আমি সারাক্ষণ ওই পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কখন হয়ে গেল এত সব ঘটনা!
তোমার মেয়ের কাণ্ড, ডালাসে বসে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সে তোমার এই ভিডিও বানানো আর এখানকার এত সব কিছুর আয়োজন করেছে। তোমার ছেলে আর ছেলের বউ তো জানতই না যে বাবা-মায়ের বিয়ের ৫০ বছর হলো।
তুমি আছই সব সময় একে দিয়ে ওকে ঠেস মারার জন্য।
লাবণী অবাক হয়ে তাকালেন স্বামীর মুখের দিকে। এই মানুষের স্বভাব বদলাবে না। স্ত্রীর পক্ষে কোনো দিন কথা বলবে না।
স্যুটকেসে রাতে পড়ার জামা, ওষুধপত্র রেখে গেছে।
বিছানায় এসে শুলেন দুজনে।
আজ রাতেও নাক ডেকে ঘুমাবে লোকটা? মনে হলো, খুলনার ফুলসজ্জার রাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। মন স্থির করতে পারছে না। খুলনায় বিয়ের রাতে পাশে শোয়া মানুষটাকে মোটেও চিনত না। সম্বন্ধ করে বিয়ে। কিন্তু ৫০ বছর পর যে মানুষটি এখন পাশে, তার সব কথা জানে সে।
তখন দুজনের নতুন কোনো কথা তৈরি হয়নি। তেমন কেউ গার্জিয়ান ছিল না, আগের সারা দিনরাত্রি বাসে করে ঢাকা থেকে এসেছে, সত্যি সত্যি হয়তো মহসিন ক্লান্ত ছিল। অজান্তে ঘুমিয়ে গেছে।
কিন্তু আজ লাবণী মহসিনকে ঘুমিয়ে পড়তে দেবেন না। লোকটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার সব দায়িত্ব এড়িয়ে গেল!
ডিমলাইট জ্বলছে ঘরে, আবছা আলো, পাশাপাশি শুয়ে লাবণী বললেন, তোমাকে একটা কথা বলব বলব করেও কোনো দিন বলা হয়নি।
মহসিন যেন বললেন, কী কথা!
৫০ বছরের সম্পর্ক, মুখে না বললেও মহসিনের কথা বুঝতে পারে।
তোমার সেই প্রেমিকা না কে, শ্রেয়া, তার কথা একমুহূর্তের জন্যও তুমি ভোলোনি। শ্রেয়ার কথা তুমিই আমাকে বলেছিলে। একবারও ভাবোনি, আরেকটা মেয়ের কথা শুনতে আমার কেমন লাগবে!
লাবণী জানেন, এ কথার কোনো জবাব মহসিন দেবে না।
তুমি অন্য দু–একজনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছ। আমি কিছুটা জানি, সেটাও তুমি জানো। তোমাকে দু–একবার বলেছি, তুমি মুখ বুজে থাকো।
লাবণী খেয়াল রাখলেন, মহসিনের শরীরটা নড়েচড়ে ওঠে কি না। এই লোকের সাথে এক বিছানায় ঘুমানো মুশকিল। ঘুমের ভেতর পুরো বিছানা দাপিয়ে বেড়ায়। কিন্তু এখন মহসিন লাশের মতো অসাড়।
চোখ কি ভিজে আসছে? এই ভেজা চোখের কথা মহসিন পাশে থেকেও কখনো কি জানতে পারবে? হয়তো ঘুমের ভান করে বা নীরব থেকে তার সব প্রশ্ন এড়িয়ে যাবে। সারা জীবন তাই-ই করেছে।
লাবণী বললেন, বিয়ের আগে একজনের সাথে আমারও শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। কথাটা বলব বলব করেও তোমাকে কখনো বলা হয়নি।
লাবণী পাশ ফিরে শুলেন। অপেক্ষায় থাকলেন, মহসিন হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নেয় কি না।