রূপকথায় রানির প্রাণভোমরা লুকানো থাকে সমুদ্রের নিচে কোনো রুপার বাক্সে। সেই প্রাণভোমরায় আঘাত করলে বহুদূরে বসে বসে আঙুর খেতে থাকা রানিও চিৎকার করে ওঠে।আমার আম্মা রানি না, তবে সম্ভবত তাঁর প্রাণভোমরা টাইপের কিছু একটা লুকিয়ে আছে কাচের প্লেট বা গ্লাসে। নইলে হাত থেকে গ্লাসটা নিচে পড়লেই ঘরের যেকোনো দূরত্ব পেরিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন কীভাবে?
একটা গ্লাসের দাম কত? ধরলাম ১০০ টাকা। সেই গ্লাস আপনার হাত থেকে পড়ে যেতেই পারে। এটা হ্যারি পটারের দুনিয়া না যে টেবিলের কোনা থেকে গ্লাস পড়ে গেলে ভেসে থাকবে। গ্লাস হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে যেহেতু, ভাঙনেই তার অবসান!
সেই গ্লাস ভাঙার যে প্রতিক্রিয়া আম্মা দেখান, মনে হয় গ্লাস না, ব্রায়ান লারার ৪০০ করার রেকর্ড ভেঙেছে। মনে হয়, তাঁর সব সুখ যেন এই গ্লাসেই, আর আমিই সেই সুখ নষ্টের কারণ। ‘এই তো, ভাঙলা? জানতাম গ্লাসটা তুমিই ভাঙবা। এত সুন্দর গ্লাসটা আমার! এই জন্যই এই সব বের করি না।’
এসব পরিস্থিতিতে মনে হয়, আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার প্লাস্টিকের গ্লাস-প্লেট-বাটি!
এসব ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যাওয়াই সমাধান। আপনি যেহেতু স্পিকার হয়েই গেছেন, মাকে ফ্লোর দিন। হেডফোন কানে মন শান্ত করার গান শুনুন। বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ১০–১৫ মিনিটের লেকচার, বেশি না।
কারণ, আপনি যদি ভাঙা কাচ ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে চান, তাহলে বলবে, ‘হইছে, ভাইঙা এখন কাজ দেখাইতে হবে না। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার সেটের গ্লাসটা!’
সেট! এই সেট জিনিসটা নাইন-টেনেও ভুগিয়েছে! আজীবন সেটের অঙ্ক, সেটের গ্লাস শুনতে শুনতে আমি নিজেই আপসেট!
আবার আপনি যদি বলেন, ‘আচ্ছা, সমস্যা নাই। আরেকটা কিনে দেব।’ তখন ঘটনা ঘটবে ভয়ংকর! ‘খুব টাকা হইছে না? টাকার গরম দেখাচ্ছ? টাকা দিলেই হয়ে গেল? ইমোশনের ভ্যালু আছে তোমার কাছে? একটা দানব পেটে ধরছি আমি! আমার ঘরে এমন দানব হলো ক্যান? মেহমান আসলে এখন কী দেব সামনে? এই রকম সুন্দর গ্লাস আর পাওয়া যাবে?’
আমি হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল দানব, যে গ্লাস-প্লেট আর প্রেমিকার মন ছাড়া কিছু ভাঙতে পারে না! আচ্ছা, গ্লাসের সঙ্গে কিসের ইমোশন? গ্লাসটা বাবা কিনে এনেছিলেন, কষ্টের টাকায় কেনা সংসারের প্রথম গ্লাস, যে গ্লাস কেনার পর নিউমার্কেট থেকে হেঁটে গিয়েছিলেন টিকাটুলি…সেদিন ছিল হরতাল…পুলিশের টিয়ারশেল, তাড়া খেয়ে বাবা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘কই গো, এই নাও, তোমার কাচের গ্লাস…আজ থেকে তোমাকে আর কষ্ট করে মেলাইমাইনের গ্লাসে পানি খেতে হবে না…’ এমন হলেও একটা কথা ছিল। সে ক্ষেত্রে দুঃখে আমিও হয়তো ফেসবুকে স্টোরি দিতাম, ‘মিস ইউ গ্লাস!’
কিন্তু তা হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এত কষ্ট করে গ্লাস আনলেও আম্মা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলত, ‘ভালোই, কিন্তু আর কোনো ডিজাইন পাইলা না?’
আম্মার কথা শুনে মনে হয়, যেন এটাই বাসার একমাত্র গ্লাস। অথচ বাসায় যে পরিমাণ গ্লাস আছে, সেগুলো যদি মাঝেমধ্যে বিনোদনের জন্যও ভাঙি, তারপরও স্টক ফুরানোর কথা না। অধিকাংশ বাসার শোকেসে থাকে কাচের গ্লাস-প্লেট-বাটি। যেন ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখার জিনিস এগুলো! বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কারও কাচের প্লেট! এদিকে সুপারশপগুলো প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অফারে গ্লাস-বাটি প্লেট দিচ্ছে। গ্লাসের অভাব হয় কী করে?
আমার ধারণা, গ্লাস বা বাটি ভাঙলেই মায়েদের মাথায় টুং করে একটা নোটিফিকেশন আসে, ‘ম্যাডাম! হলুদে রং না হওয়া, রিকশাওয়ালার ভাড়া বেশি চাওয়া, পছন্দমতো মাছ না পাওয়াসহ যাবতীয় বিরক্তি এবং ক্ষোভ ঢালার দারুণ এক সুযোগ এসেছে আপনার সামনে। আপনার পুত্র একটি গ্লাস ভেঙেছে। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে রাগ–বিরক্তি ঝাড়ুন। অফারটি সীমিত সময়ের জন্য। ধন্যবাদ।’
নোটিফিকেশন পাওয়ামাত্র তাঁরা রেকর্ড চালু করে দেন। দীর্ঘ গ্লাস ভাঙার ক্যারিয়ারে আমি কখনো এই বক্তৃতার পরিবর্তন দেখিনি। এগুলো কি আগে রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর টিভিতে দেখাত? নাকি রেডিওতে প্রচার করত?
‘শ্রোতা বন্ধুরা, বিজ্ঞাপন তরঙ্গে এখন আপনারা শুনবেন, সন্তান গ্লাস ভাঙলে কীভাবে বকা দেবেন তার নিয়ম। জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছেন কুমিল্লা থেকে অমুক, বগুড়া থেকে তমুক, কক্সবাজার থেকে শামুক আর তুরস্ক থেকে পামুক…’।
নিশ্চয়ই এই টাইপ একটা কমন টেক্সট ছিল কোথাও। নইলে সব মায়ের প্রতিক্রিয়া এক হয় কীভাবে? নাকি গ্লাসেই জিনিসটা লেখা আছে, যেটা আমরা দেখি না, শুধু মায়েরাই দেখেন?
কীভাবে ভাঙলা? হাত-পা কাটছে? দেখো কাচ কত দূর গেছে। পরিষ্কার করো।
কী হইল আম্মা?
কী আর হবে? গ্লাস ভাঙছে।
সেটের গ্লাস ভেঙে গেলে?
কাচের গ্লাস তো ভাঙবেই। পড়ায় মন দাও। পড়ার আওয়াজ পাই না কেন? খালি অন্যদিকে মনোযোগ!