Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla/2021-01/1d75151c-eff9-4e9f-ac28-aebc4618d00f/palo_bangla_og.png />

পার্সেল

উম্মে ফারহানা



কলবেলের আওয়াজে চমকে ওঠেন নিলুফার।

ভোর থেকেই অপেক্ষা করছেন তিনি। ডেলিভারির লোকেরা কখনোই দশটার আগে আসে না, কিন্তু সকালে ওঠা অভ্যাস তার। আটটার দিকে দুই মেয়ে বের হয়ে গেল, মেয়েদের বাবা ফরহাদ সাহেব সাড়ে আটটা কিংবা নয়টায় বেরোন সাধারণত, আজকে কেন জানি দেরি করছেন।

কিশোরীকালের কথা মনে পড়ে যায়, দিলু রোডের বাড়িটার সামনে উঠান ছিল, পেছন দিকে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কলতলার পাশ দিয়ে লেবুগাছের কাঁটাওয়ালা ডালের খোঁচা সহ্য করে বেরোনো যেত, আব্বার চোখ ফাঁকি দিতে চাইলে। অনেক সময় বেরিয়ে দেখা যেত আব্বা বাইরের ঘরের বদলে টানা বারান্দায় কিংবা উঠানে নাইলনের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছেন, তখন আবার অ্যাবাউট টার্ন। ফরহাদের সামনে পার্সেলটা নেওয়া উচিত হবে কি না, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। কিন্তু ফরহাদ তো আব্বা নয়, কিসের পার্সেল, কে পাঠিয়েছে জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় কি নেই?

আজকেই আসবে এমন কথা বলেননি ভদ্রমহিলা। এখন একটু আফসোস হচ্ছে, অন্য কোনো ঠিকানা দিলেও হতো হয়তো। কিন্তু অন্যের নাম দিলে বুঝে ফেলতেন নিশ্চয়ই। মনে মনে হাসতেন কি? কে জানে!

কাল এ রকম সাড়ে নয়টা-দশটার দিকেই ফোনটা এসেছিল। পুরো নাম ধরে বললেন, ‘আমি কি মিসেস নিলুফার শারমিনের সঙ্গে কথা বলছি?’

‘জি।’

‘আমার নাম সুমনা চৌধুরী, আমি রিপনের স্ত্রী।’

কোনো কথা খুঁজে পাননি নিলুফার, রিপনের স্ত্রী কেন তাঁকে ফোন করতে পারেন, মাথায়ই আসছিল না।

‘রিপনের জিনিসপত্রের মধ্যে আপনার কিছু জিনিস পাওয়া গেছে, সেগুলো ফেরত পাঠাতে চাচ্ছি, ঠিকানাটা কি দেবেন?’

রিপনের কাছে তাঁর কী জিনিস থাকতে পারে সেটা মনে পড়ছে না, বইটই হতে পারে কিংবা ফটো। ২৫ বছর আগে রিপনের সঙ্গে শেষ দেখা। ফরহাদের বাসা থেকে পাকা দেখতে আসার আগের দিন, ১৯৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।

‘ঠিকানাটা বলবেন?’ আবার বলেন ভদ্রমহিলা। তার নম্বর কোথা থেকে পেলেন এই অবান্তর প্রশ্ন না করে রিপনের কী হয়েছিল জানতে চাওয়া যায় বরং।

‘বলছি… নাকি এসএমএস করে দেব?’

‘দিতে পারেন, বেটার।’

কিছুটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেই ফেলেন, ‘আচ্ছা… কবে?’

‘গত বছর, আমি বাসা পাল্টাতে গিয়ে পেলাম, একবার ভেবেছিলাম ফেলে দিই, তারপর মনে হলো আপনাকে জানানো উচিত, আপনি ফেরত নিতে চাইতেও পারেন।’

কিছুটা দমে গেছেন নিলুফার। এক বছরে এমন কারও সঙ্গেই তার যোগাযোগ হয়নি যে রিপনের মৃত্যুর খবর জেনেছে এবং নিলুফারকে জানানো যেতে পারে বলে ভেবেছে। ভদ্রমহিলার তাচ্ছিল্যের সুর শুনে নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। ২৫ বছর ধরে রিপন তার কোনো একটা স্মৃতি জমিয়ে রেখেছে, যত্ন করে, লুকিয়ে, জীবনসঙ্গিনীকে জানতে না দিয়ে; মরে গেছে বলে তাকে এই অপরাধের জন্য তিরস্কার করা যাচ্ছে না, সাজা দেওয়া যাচ্ছে না। তাই বিকল্প হিসেবে তাকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেয়েছেন এই মহিলা—সুমনার জায়গায় তিনি নিজে হলে কী করতেন? একটা অজানা হাহাকার বোধ হয়।

‘আপা, সই করতে হবে’—গৃহকর্মিণী দরজা খুলেছে, বারান্দায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে তিনি। পার্সেলটা নিয়ে স্বাক্ষর করে দেন প্রাপকের ঘরে। একটা অনলাইন শপে কিছু সেলাইয়ের সরঞ্জাম অর্ডার করেছিলেন, সেগুলোই এসেছে।

কিছুটা স্বস্তি পান নিলুফার, ফরহাদ বাসায় না থাকলে হয়তো আশাভঙ্গ হতো। সম্ভবত রিপনের লেখা চিঠিগুলোই ফেরত পাঠাবে সুমনা। আব্বা-আম্মার ভয়ে চিঠিগুলো পড়া শেষ করে নিজের কাছে রাখতে পারতেন না কখনো।

‘আমি বেরোচ্ছি নিলু’ ফরহাদ লিভিং রুম থেকে ডাকেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলে ব্রাউন কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট হাতে অফিসের পোশাকে ফরহাদ সাহেবকে দেখতে পান তিনি।

‘আচ্ছা, সুমনা চৌধুরী নামে কাউকে তো মনে পড়ছে না আমার, চেনো নাকি তুমি? কী যেন একটা পাঠিয়েছে।’

ফরহাদ সাহেবকে বিভ্রান্ত দেখায়।