শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ব্যাংকসংলগ্ন গেটটার সামনেই সাধারণত অবস্থান নেয় তারা। কুসুম আর ল্যাংড়া গফুর। গফুর মিয়া থাকে কাঠের বানানো নিচু একটা ঠেলাগাড়ির ওপর আধশোয়া অবস্থায়। তার বাঁ পায়ে গোদ, বিশাল হাতির পায়ের মতো পা। পায়ের চামড়া ফেটে ফেটে খোদাই করা। সেই ক্ষত থেকে পুঁজ আর কষ ঝরে পড়ে মাঝেমধ্যে। দিনভর তার পায়ের কাছে ভনভন করে মাছি। শাহবাগের বড় নীল মাছিগুলো গফুর মিয়ার পায়ের কষ চেটে কখনো উড়ে গিয়ে বসে পাশের ফলওয়ালা লোকটার ঝুড়িতে সাজানো লাল টকটকে আপেল বা কমলা রঙের মোসাম্বির ওপর, তারপর আবার উড়ে যায় রাস্তার ওপারে ফুলের দোকানের দিকে। যেখানে বসে দিনভর ট্রাক থেকে ফুল নামায় আর ফুলের মালা গাঁথে কুসুমের বয়সী আরও ছেলেমেয়েরা। উড়ন্ত মাছিগুলোর মতো মাঝেমধ্যে কুসুমকেও গাড়ি ঠেলে ঠেলে জায়গা বদল করতে হয়। করতে হয় এপার–ওপার।
সিগন্যাল পড়লে এক ভিড়ব্যস্ত সমস্ত মানুষের সঙ্গে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে কখনো সে ল্যাংড়া গফুরকে ঠেলে নিয়ে চলে যায় ওপারে ফুলের দোকান আর শাহবাগ থানা পেরিয়ে আরও সামনে। পাবলিক লাইব্রেরির উল্টো দিকের রাস্তায় বড় গাছগুলোর নিচে বসে জিরোয়, দুপুর হলে টিনের থালা ভরে ভাত কেনে দুজনের জন্য। সঙ্গে ডাল, বেগুন বা পটোলভাজা। ইনকাম ভালো হলে ডিম। তারপর নিজে তৃপ্তি নিয়ে খায়, গফুরকেও তুলে দেয় মুখে। ফুলের দোকানে কাজ করা ছেলে–ছোকরারাও এসে জোটে তখন। ফুটপাতে পা মেলে বসে তারা তখন রসের কথা বলে।
‘ও কুসুম, তোরে তো আইজকাইল চিনাই যায় না। বড়ই সৌন্দর্য লাগতাছে।’
‘কুসুম রানি, আইজ বিকালের কাম বাদ দে। চল শিশুপার্কের ভিত্রে ঘুরান দেই একটা।’
নতুন কেউ হলে জিজ্ঞেস করে, ‘লুলাডা কেডা? তোর বাপ, না দাদা?’
কুসুম এসব কথার কোনো উত্তর দেয় না। কেউ বেশি বিরক্ত করলে ঝামটা দিয়ে ওঠে, ‘তোর বাপের কী, হারামজাদা?’
নতুন হলে ঝাড়ি খেয়ে চুপ করে যায়। পুরোনো হলে দাঁত কেলিয়ে হি হি করে হাসে। করবী নামের বড় ফুলের দোকানে কাজ করে যে ছেলেটা, সুমন নাম, সে প্রায়ই বলে, ‘কইছি না একদিন আধা রাস্তা পার হইয়া লুলার গাড়িটা রাস্তার উপ্রে ফালায়া দিবি দৌড়। একটা দশমণি টেরাক কি লরির তলে ঠেইলা ফালাইতে পারলেই ব্যস। তুই এক্কেরে ফিরি!’
শুনে ভাতের শেষতম কণা চেটে মুখে পুরে মুখ ঝামটা দেয় কুসুম, ‘তারপর তুই খাওয়াইবি আমারে?’
সুমন হা হা শব্দে হাসে, ‘দুইজনে মিলা খামু। তুই হারাদিন গেন্দা ফুল, বেলি ফুল গাঁথবি, আমি বেচুম।’
নির্বিকার মুখে ভাত–তরকারি–ডাল শেষ করে থালা ধুয়ে ঠেলার পাটাতনের তলে সব বেঁধে আবার ঠেলাটা ঠেলে ঠেলে তাদের নির্দিষ্ট জায়গার দিকে যাত্রা করে কুসুম। ফুলের দোকানের ছেলে–ছোকরাগুলোও তখন কাজে ফিরে যায়। তাদের দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে সুগন্ধি বেলি ফুলের মালা কেনে সুন্দরী নারীরা। তারা ছুটে যায় কে কার আগে গাড়ির জানালায় ভিড় করবে সেই উদ্দেশ্যে।
তো শাহবাগের ভিক্ষুকদের মধ্যে ওদের দুজনের আয়-রোজগার খুব খারাপ না। এদিকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ওদিকে বারডেম—দুই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রোগী আর তাদের স্বজনেরা ফাইলেরিয়াসিসের বুড়োর পায়ের দগদগে ঘা এবং তার সঙ্গী বালিকাটির অবিরাম ছোটাছুটি দেখে যারপরনাই দুঃখিত আর দয়াপরবশ হয়। ডাক্তার দেখিয়ে তড়িঘড়ি পথ পার হওয়ার সময় তারা ওদের থালায় ঝনঝন করে ফেলে পাঁচ টাকার কয়েন কি কখনো আস্ত দশ টাকার নোট। কুসুমের হাতে তখন ধরা থাকে একটা ঝাপসা কালি ওঠা কাগজের প্রেসক্রিপশন, গফুরের চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র, যা দেখিয়ে পথচারীদের মন গলানোর চেষ্টা সে করে যায় সারা দিন।
দিন শেষে পয়সার থালা আর কাঠের ঠেলাগাড়ির পাটাতনে পড়ে থাকা কয়েন নোট মিলিয়ে খুব একটা মন্দ হয় না রোজগার। রাত আটটা বাজলে ঠেলাগাড়ি ঠেলে, পয়সা গুনতে গুনতে রাস্তা পার হয়ে কুসুম চলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। ওটাই তাদের ঠিকানা। উদ্যানের ১ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে উত্তর–পূর্ব দিকে ২০০ গজ হাঁটলে পর ওদের জারুলগাছ। এই গাছের নিচেই তাদের আশ্রয়। গাছটার একটু সামনে একটা সিমেন্টবাঁধাই বেঞ্চ, যেটা তাদের একটুখানি আবরু দেয়।
রাত বাড়লে কমতে থাকে উদ্যানে পথচারী আর প্রেমিক–প্রেমিকাদের চলাচল। শুরু হয় পুলিশ, পতিতা, ইয়াবাখোর আর খদ্দেরদের আনাগোনা। তাদের কেউ কুসুমকে চোখ-ইশারায় ডাকে, কেউ শিস বাজিয়ে। কেউ আবার একেবারে কাছাকাছি চলে আসে। এই সব সময় ল্যাংড়া গফুর তার রক্তজবার মতো দুটি চোখ আর হলুদ দাঁত বের করে চেঁচায়, ‘আরেক পা আগাইছস হারামজাদা, খুন কইরা ফালামু। এই গফুইরা অহনো বাঁইচা আছে কলাম। চাইর খুনের আসামি। আইবি নাকি আয়…।’
পাটাতনের তলা থেকে সে বের করে তার বাঁশের লাঠিটা। মাথার ওপর হাত দিয়ে বনবন করে ঘোরায়। তার মুখে ছোটে অবিরাম গালাগাল। কিশোরী কুসুমের সঙ্গে অভিভাবক পুরুষটাকে দেখে মধুলোভী পুরুষগুলো তখন পালায়। এদিক–ওদিক খুঁজলে পথে শুয়ে থাকা অমন মেয়ে আরও মিলবে, না হলে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সাজগোজ করা মেয়েগুলো তো আছেই।
তারপর ক্রমশ রাত বাড়ে। বড় রাস্তায় রাতে হর্ন বাজিয়ে ঘর্ঘর করে চলে মালবাহী বড় বড় ট্রাক আর লরি। কখনো রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গুঁড়িয়ে বিকট সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলে মৃতদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স। উদ্যানের ভেতরকার বেশির ভাগ হলুদ আলো নিভে যায় একে একে। গাছের তলায় আর দেয়ালের পাশ ঘেঁষে জমে ওঠে কালো অন্ধকার। ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক দেওয়া মেয়েগুলো কাস্টমার পেয়ে চলে যায় খুশিমনে। গাঁজা আর ইয়াবাখোরগুলো ততক্ষণে অচেতন হয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে স্বর্গের পরিদের। তারও পরে জারুলগাছটার নিচে নিজেদের সংসারে তখন ল্যাংড়া গফুরও পুরুষ হয়ে ওঠে।
শাহবাগের ঝাঁপ ফেলা ফুলের দোকানগুলোর সামনে পড়ে থাকে কেবল মরা–পচা পদদলিত ফুলগুলো।