আজও আইরিনকে ডাকল তরুণ। না শোনার ভান করে মেয়েটা বেরিয়ে গেল। ভাতের প্লেট ও তরকারির বাটিটা টেবিলে রেখে আইরিন আগে টুকটাক কথা বলত। শরীরের খবরাখবর নিত। এক সপ্তাহ ধরে ও তরুণের ঘরে দাঁড়াতেই চায় না। খাবারটা রেখে বেরিয়ে যায়। ঘণ্টা দুয়েক পর কাজের ছেলেটা প্লেট-বাটি-গ্লাস নিতে আসে। আইরিন জানে, তরুণের অসুখ। অজানা অসুখ। আগে মাঝেমধ্যে জানতে চাইত ওর গায়ে সারাক্ষণ জ্বর থাকে কেন। জানতে চাইত তরুণ কেন দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন কিছুই জিজ্ঞেস করে না। এই সেদিনও আইরিন নিজে থেকে একসঙ্গে অনেক কথা বলত। জোকস বলত। তরুণ হাসার চেষ্টা করত। ইদানীং ও আগের মতো হাসতে পারে না। আসলে মনই চায় না। তরুণ বদলে যাচ্ছে। ওর শরীরে অজানা ব্যাধির বীজ। ভীষণ ছোঁয়াচে অসুখ। এখন আইরিন একেবারেই থাকতে চায় না তরুণের ঘরে। কিন্তু তবু কোনো একটা ছুতায় একবার আসে। তরুণীর মন।
নিশ্চয় আইরিন বাড়ির লোকজনের কাছে শুনেছে, তরুণের আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। ওকে তরুণের ঘরে আসতে মানা করা হয়েছে হয়তো। তরুণকে নিয়ে আইরিনের মনে অনেক স্বপ্ন ডালপালা মেলছিল। এমন সময় মাথায় বাজ পড়ার মতো দুঃসংবাদ। তরুণের দুরারোগ্য অসুখ, যার ওষুধ নেই। আইরিনকে ভালো লাগে তরুণের। এর বেশি কিছু না। নিছক ভালো লাগা। ইউনিভার্সিটিতে পড়া হাসিখুশি তরুণী। কিন্তু ওর ইদানীংকার আচরণে তরুণ কষ্ট পায়। আজ ওর ভেতর রক্তপাত হচ্ছে। আইরিন ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে। ওর রোগটা ছোঁয়াচে। নিহাও আর আসবে না?
ছয় মাস ধরে আয়নায় মুখ দেখে না তরুণ। আজ কী মনে করে দেখেছিল। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। সেই থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে। বুক দুরুদুরু করে। এই বুঝি নিহা এল। এখন রাত দুইটার ওপরে। নিহা আসে একটা থেকে দেড়টার মধ্যে। হেরফের হয় না। তবে আজ? হয়তো ও আর আসবে না। নিহা সব জানতে পারে। হয়তো এটাও জেনে ফেলেছে। একপশলা ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে সন্ধ্যায়। এখনো মাটির সোঁদা গন্ধ। পুরোনো আমলের বাড়ির শেষ দিকের ঘর। বাইরে একটা বাগান, যার প্রায় পুরোটাই খটখটে মাটি। দূরে দূরে নিষ্পত্র গাছ। শুকনো ফুলের কেয়ারি। তবে গরমের দিন তরুণের ঘরটি বেশ ঠান্ডা। এ ঘরেই থাকে তরুণ। বাড়িটা ওর দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের। বাড়ির বাইরের এই ঘরটা তরুণের খুব প্রিয়। জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে। জানালার কাছে সন্ধ্যামালতীর ঝাড়ে অজানা পোকা ডেকে যায়। নিহা আসে না। অস্থির লাগে তরুণের।
ওর মনে যখন মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে, চেনা সৌরভের ঝাপটাটা নাকে এসে লাগল। চেয়ারে জানালার ধারে বসা তরুণ ঘরের ভেতর মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। মুখটা ঘোরাতে দেখল, নিহা। বাইরে অন্ধকার। কিন্তু নিহাকে দেখা যায়; ওর ভেতর থেকে আলোর বিচ্ছুরণ হয়। নিহাকে বাসার আর কেউ দেখে না। জানালার উল্টো দিকে যেখানে ও দাঁড়ানো, জায়গাটা সুরভিতে ম-ম করছে। গন্ধটা পায় কেবল তরুণ।
আজ দেরি হয়ে গেল।
হতেই পারে। আমি তো কিছু বলিনি।
মন খারাপ হয়নি?
না। বরং বহুদিন পর আজ ভালো লাগছে।
আমাকে দেখে?
হ্যাঁ। আমি আজ আয়নায় নিজের মুখ দেখেছি।
কী দেখলে?
আমি বোধ হয় মরে যাব। আমার চোখের নিচে কালি। মুখ ফ্যাকাশে। গাল দুটো আগের চেয়ে আরও ভেঙে গেছে। জ্বরটাও পুরোপুরি যাচ্ছে না।
শেষরাতের হাওয়াটা আসছে। কথা বলতে বলতে নিহা কাশল। জানাল, ওকে ওর দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, ও মানুষের রোগ বয়ে এনেছে। এটা যে-সে রোগ নয়, পৃথিবীর ভাষায় এটা মহামারি। এ রোগে লাখ লাখ লোক মারা যাবে ওই গ্রহে। নিহার দেশে মৃত্যু নেই। মহামারি নেই।
আমাকে তোমার ঘরে থাকতে দেবে না? নিহা অসহায়ের মতো আশ্রয় চায় তরুণের কাছে।
ভেতরে আসো।
চোখের পলকে তরুণ বুঝে নেয়, নিহা এখন ওর ঘরে। সৌরভে ভরে আছে চারদিক। তরুণ ভেতরের দিকের দরজাটা বন্ধ করে দিল। এর আগে ও খেয়াল করল, ঘরের ভেতরটা একঝলক দেখে আইরিন দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। বাইরের গাছটায় কাক ডাকছে। দূরে মোরগের ডাক। একটু পর পাখির কলরব শুরু হবে। তবে এখনো চারদিক অন্ধকার।
তরুণ, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। দম আটকে আসছে।
নিহা, আমিও না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বুকে কেউ একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে।
পুবের আকাশে গোলাপি আভা এখনো ফোটেনি। ফিকে অন্ধকারে দুটো সাদা পাখি উড়ে যাচ্ছে পাশাপাশি। ওরা জানে না ওদের গন্তব্য কোথায়। শুধু জানে সামনে গভীর, গভীরতর অন্ধকার।