ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা নামের স্মৃতিচারণামূলক বইয়ে নিজের স্বভাব নিয়ে সরস স্বীকারোক্তি করেছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। এই রসরাজকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি লেখেন কখন?’
শিবরাম অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠি। তা, ঘুম তো একটা বড় পরিশ্রমসাধ্য কাজ। তাই প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগে, তাই আবার খানিকটা ঘুমাই।’
—তারপর শেষমেশ ওঠেন কখন?
—ওই বেলা ১১টা বেজে যায়।
—উঠে?
—উঠে বাথরুম–টাথরুম সারি। চা পান করি, কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখি, স্নান করি। এই করতে করতে দুপুর। দুপুরে খাওয়ার পর তো ঘুমাতেই হয়। ঘুমাই।
—তারপর?
—উঠতে উঠতে বিকেল গড়িয়ে যায়। আবার একটু চা পান করি। আবার একটু বেরোই। আর বেরোলে তো রাবড়ির দোকানে যেতেই হবে। কারণ, রাবড়িই তো পৃথিবীর চরমাশ্চর্য, দিনে একবার রাবড়ি না খেলে কি চলে? রাবড়ি-টাবড়ি খেয়ে আবার ফিরে আসি। একটু বই-টই দেখি। খাই। আর খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি।
—তাহলে লেখেন কখন?
—কেন পরের দিন!
পরের দিন বা পরের বছরের জন্য শিবরামের অপেক্ষা যেন আমাদের মজ্জায় এবং রক্তের সাজসজ্জায়ও ঢুকে গেছে। নতুন বছরে নিত্যনতুন পণ করি আমরা।
‘মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য’—‘হৈমন্তী’ গল্পে উচ্চারিত এই অবিস্মরণীয় উক্তি বারবার মনে পড়ে নতুন বছরের প্রাক্কালে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়ালজুড়ে তখন শতসহস্র ব্যক্তির রেজলুশন—নতুন বছরে নানান ধরনের পণের পসরা। বলাবাহুল্য, বছর ঘুরতে ঘুরতেই পণের হাট কিন্তু ভেঙে যায়। নতুন বছরে আবারো পুরোনো পণের উপস্থিতি, নতুন বোতলে পুরোনো মদের মতো। শিবরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, “নতুন বছর নতুন বছর” বলে খুব হইচই করার কিস্যু নেই। যখনই কোনো নতুন বছর এসেছে, এক বছরের বেশি টেকেনি…।’ নববর্ষ নিয়ে উন্মাদনার অন্তঃসারশূন্যতা শিবরামের মতো আর কে বুঝতে পেরেছেন!
অবশ্য নববর্ষকে ঘিরে হইচই কিন্তু থেমে নেই। ৯ বছর আগে লন্ডনের টেমস নদীসংলগ্ন বিশ্বখ্যাত বিগব্যানের সামনে ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করে নিতে লাখো মানুষের উন্মাদনা দেখেছিলাম। বিচিত্রবর্ণা পানীয় নিয়ে ধাক্কাধাক্কি, রাতভর নারী-পুরুষের হুল্লোড়, এমনকি পানীয় গ্লাসের চুরমার হয়ে যাওয়ার ঘটনাও সেখানে ঘটে। যে বছরকে নিয়ে এত উন্মাদনা, সেই বছর মহাকালের গর্ভে বিলীন হওয়ার আগেই পরবর্তী বছরকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের পালা শুরু হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নববর্ষ শুরু হয় জানুয়ারির ১ তারিখে। তবে ডিসেম্বর মাসেই শুরু হয়ে যায় নতুন বছরকে বরণের প্রস্তুতি। বিদায়ী বছরের জন্য কারও আবেগ-অনুভূতি তখন কাজ করে না। বিদায়ী বছর যেন রূপকথার সেই দুয়োরানি।
নতুন বছর আসতে না আসতেই তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস এবং বিদায় নেওয়ার আগমুহূর্তে উদাসীনতা—এটি মানবচরিত্রের অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য। বিষয়টিকে প্রাত্যহিক জীবনের উদাহরণসমেত পরিষ্কার করা যাক। ক্ষমতাবান ব্যক্তি সব সময় স্তাবক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন। কিন্তু যখন তাঁর বিদায়ের সময় আসে এবং নতুন ক্ষমতাবানের পদধ্বনি শোনা যায়, তখন স্তাবকের দল লেহনের জন্য নতুন পদই বেছে নেয়। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ছে। গল্পটির সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত।
অফিসের বস দুপুরে খাওয়ার পর নিয়মিত সহকর্মীদের কৌতুক শোনান। একদিনের ঘটনা। কর্মীদের তিনি একের পর এক ‘স্বরচিত’ কৌতুক শোনাচ্ছিলেন। কর্মীরাও বসকে খুশি করার জন্য হাসছিলেন হো হো করে। শুধু হাসছিলেন না একজন। তখন পাশ থেকে আরেক কর্মী জানতে চাইলেন, ‘কী ব্যাপার, আপনি হাসছেন না কেন? বসের কৌতুক বলে কথা। আমার এত মাথাব্যথা, তারপরও দেখেন না আমি কেমন দাঁত কেলিয়ে হাসছি।’ আগের মতোই বিরস মুখে ওই কর্মীর জবাব, ‘আমি কাল চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। আমার অত হাসাহাসি না করলেও চলবে।’ নিজের পছন্দমতো চাকরি পরিবর্তনের মতো যদি বছর পরিবর্তনের সুযোগ থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই নতুন বছর নিয়ে এমন কৃত্রিম উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ত।
কৃত্রিমই হোক আর আসলই হোক, নতুন বছর নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মাথাও ভারী হয়ে উঠেছিল, মানে নতুন বছর নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন তাঁরাও। এমন কিছু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যা নিয়ে মহাদার্শনিক প্লেটো কথা বলেননি। নতুন বছরের আগমন নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আরম্ভই হলো যেকোনো কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ বর্তমান যুগের মানুষ এক অর্থে প্লেটোরই অনুসারী। তাই তারা বছরের আরম্ভ নিয়েই মাথা ঘামায়। বছরের শেষ নিয়ে তাদের তত মাথাব্যথা নেই বলেই পরের বছরের আরম্ভ নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নতুনের পিয়াসীদের জন্য সুখবর শুনিয়েছেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স। তাঁর কথা ছিল, ‘সব সময় একটি নতুন বছরের জন্য একটি নতুন হৃদয় দরকার।’ নতুন বছর মানেই নতুন হৃদয়। একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় টি এস এলিয়টের কণ্ঠেও। এই কবির উপলব্ধি, ‘নতুন দিনের বাণী নতুন দিনের কণ্ঠের জন্য অপেক্ষমাণ। শেষ করতে হলে শুরু করতে হয়। কোনো কিছু শেষ করা মানে নতুন কিছু শুরু করা।’ এলিয়টের কথার বঙ্গীয় সংস্করণ আবার পাওয়া যায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতায়, ‘নতুন কিছু করো/ একটা নতুন কিছু করো।’
নতুন বছর নিয়ে আশাবাদী হতে বলেছেন এমারসন। তাঁর ভাষায়, ‘আজ বছরের একটি দিন। আপনি এটি ভালোভাবে ও নির্মলভাবে শুরু করুন। পুরোনো বাজে অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারলে সামনে এগিয়ে যাবেন।’ এই বাজে অভ্যাস রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বৎসরের আবর্জনা’। ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’ করোনাজর্জরিত বিশ্বের নববর্ষে এর চেয়ে শুভ কামনা আর কী হতে পারে? নতুন বছর নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মেলা মেলা স্মরণীয় উক্তি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে থেকে একটি শত্রু–মিত্র সবার জন্য কপি পেস্ট করে দেওয়া যাক।
‘বন্ধু হও শত্রু হও
যেখানে যে কেহ রও
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।’
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম রেজলুশনের কথা। রেজল্যুশনে অতীতের ভুলের জন্য আক্ষেপ থাকে। এক নববর্ষের আগে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, ‘জীবনে আমি তিনটি ভুল করেছি। প্রথম হলো বিয়ে করে, দ্বিতীয় হলো বেশি বয়সে বিয়ে করা এবং তৃতীয় হলো বউ–ছেলেদের সঙ্গে না থাকা।’ দিব্যি কেটে কখনো কিছু হয়? যা হওয়ার তা এমনিতেই হয়। সারা বছর কেমন যাবে—এ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা বোকামির নামান্তর। শুধু ভালো বা শুধু মন্দ নয়। ভালো-মন্দেই জীবন কাটে সবার। এ বছরও তা–ই কাটবে, ভবিষ্যতের বছরগুলোতেও তা–ই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন বছরের স্থায়িত্ব এক বছরের বেশি নয়। তাই মোক্ষম কথাটি শোনার জন্য আবার রবীন্দ্রনাথের কাছেই হাত পাততে হবে।
‘মনেরে আজ কহ যে
ভালো-মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।’