২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক দিনে একজন গরুগম্ভীর স্বরে ভবিষ্যদ্বাণী করল, ‘এবার ৩১ ডিসেম্বরে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বরফ পড়বে…!’
‘কেন? কেন?’
‘নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক কোনো বড় বিপর্যয়?’
‘আমাদের দেশেও পড়বে?’
‘বরফ সব দেশেই পড়বে…তবে হুইস্কি বা রেডওয়াইনের গ্লাসে…।’ ভবিষ্যদ্বাণী শেষ করল লোকটা।
৩১ ডিসেম্বর পার হয়ে অবশেষে সত্যি সত্যিই নতুন বছর শুরু হয়ে গেছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে রাস্তার ধারে এক চায়ের দোকানে বেশ আড্ডা হচ্ছিল। সব চায়ের দোকানেই এমন আড্ডা হয়, এটা আমাদের চিরন্তন ‘সড়ক-সংস্কৃতি’। বলা হয়ে থাকে এসব চা বিক্রেতা দিনে তিন-চার শ কাপ চা বানায়, কিন্তু এক কাপ ভালো চা বানাতে পারে না। সে যা–ই হোক, সেই রকম বিষ–চা খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল।
‘আচ্ছা, পুরান বছরের মশাগুলা কি নতুন বছরেও থাকবে?’ একজনের প্রশ্ন।
‘থাকবে মানে? মেট্রোরেল চালু হয়েছে, উত্তরার সব মশা এখন মিরপুরে আসা শুরু করছে, টের পাচ্ছেন না?’ আরেকজন নাক গলাল আড্ডায়।
‘তাহলে এই নতুন বছরে আমরা পেলামটা কি?’
‘কেন আমাদের দেশপ্রেমিক নেতা-নেত্রীদের নতুন নতুন সব আশ্বাস…।’ আরেকজন বলল।
চায়ের টংয়ের পাশেই একটা ডাস্টবিন। একজন বয়স্ক মানুষকে দেখা গেল ডাস্টবিন ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু খুঁজছেন।
‘কী খুঁজেন ভাই?’
‘সত্যি, নতুন বছরের প্রথম দিনেই ডাস্টবিন ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। নতুন বছরের প্রথম দিনে ভালো কিছু করা উচিত, ভালো কোনো কাজ।’ চা খেতে খেতে একজনের কথা।
‘ঠিক ঠিক, এটা একদমই বিষদৃশ্য!’
‘আমি আসলে গত বছরের ক্যালেন্ডারটা খুঁজছি। গতকালই ফেলেছিলাম এখানে।’ ডাস্টবিন ঘেঁটে চলা লোকটা বলল।
‘সে কি! বছর চলে গেছে, এখন পুরানো ক্যালেন্ডার দিয়ে হবেটা কি?’
‘আরে ভাই আমার বছরটা যেভাবে শুরু হলো…তাতে মনে হচ্ছে এবারও পুরান সমস্যাগুলোই ফের রিপিট হবে। তাই ভাবছি নতুন ক্যালেন্ডারের দরকার কি? পুরান ক্যালেন্ডারটাই বরং থাকুক…।’ তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে ডাস্টবিন ঘাঁটতে থাকেন।
কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত পুরোনো ক্যালেন্ডারটা তিনি পেলেন না, তবে একটা চেরাগ পেলেন। পুরোনো জং ধরা চেরাগ। কী মনে করে চেরাগটা নিয়েই বাড়ি ফিরলেন তিনি। ঘরে ফিরে চেরাগটা ঘষেমেজে পরিষ্কার করতে গিয়ে ঘষা লেগে ভুস ভুস করে ঘন সবুজ রঙের ধোঁয়া বের হতে লাগল। তারপর সেই ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে এল বিশাল সবুজ রঙয়ের একটা দৈত্য।
‘মুহাহাহাহা (অট্টহাসি)…হুকুম করুন মালিক, কী চাই আপনার?’
‘অ্যাঁ…তুমি তাহলে সেই ইচ্ছাপূরণ দৈত্য?’
‘হ্যাঁ, মালিক।’
‘তিনটা বর দেবে আমাকে?’
‘জি না মালিক, একটা।’
‘কী বলো, গল্প-উপন্যাসে তো দেখেছি তিনটা করে বর দেয়।’
‘মালিক, সেই দিন আর নেই।’
‘বেশ তাহলে আর কি, আমার পুরান বছরের ক্যালেন্ডারটাই এনে দাও।’
‘মুহাহাহাহা… কী বলেন মালিক! ভালো কিছু চান, বিএমডব্লু গাড়ি এনে দিই একটা?’
‘না।’
‘তাহলে গুলশান-বারিধারায় একটা ফ্ল্যাট?’
‘না।’
‘তাহলে আপনাদের মেট্রোরেলের একটা বার্ষিক ফ্রি টিকিট করে দিই?’
‘না।’
‘করোনার নতুন যে ভাইরাসটা আসছে সেটার ভ্যাকসিন?’
‘না না না…।’
‘মুহাহাহাহা… মালিক, মনে হচ্ছে আপনার মাথা নষ্ট। আচ্ছা যা হোক, এই নেন আপনার গত বছরের ক্যালেন্ডার।’
‘ধন্যবাদ। সে কি, এটা তো মনে হচ্ছে ফটোস্ট্যাট কপি মানে ফটোকপি! আসল ক্যালেন্ডারটা কই?’
‘জি মালিক, আপনার আসলটা থেকে এখন সবাই ফটোকপি করে যার যার বাসায় নিয়ে ফিরছে! মনে হচ্ছে সবাই আপনার মতোই ভাবছে, বছরটা নতুন হলেও সমস্যাগুলো আগের বছরের মতোই থাকবে। মুহাহাহাহা…যাই…!!’
সত্যি কথা বলতে কি, নতুন যে বছরটা এসেছে, সেটা পুরোনো হতে লাগে মাত্র ৫ দিন। তারপর সদ্য এই পুরোনো বছরটাকে টেনে নিতে হয় ৩৬০ দিন ধরে, আরেকটা নতুন বছরের কাছে…যে মাত্র ৫ দিনে পুরোনো হওয়ার অপেক্ষায় আছে …এই তো আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সদের জীবন!