এক পাড়ায় ছিল দুই বান্ধবী। তারা এসএসসি পরীক্ষার্থী।দিনমান প্রস্তুতির ক্লান্তি দূর করতে বিকেল বিকেল তারা সাজগোজ করে বেরিয়ে পড়ত।পাড়ার রাস্তা ধরে এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেড়াত। আর নিজেরা নিজেরা কত কথা বলত।
সে পাড়ায় ছিল কিছু তরুণ।
তারা পাড়ার মোড়ে মোড়ে আড্ডাবাজি করত আর দুই বান্ধবীর উদ্দেশ্যে গানের কলি ছুঁড়ে দিত।বান্ধবীরা ঠারে ঠারে তাকাত। একে অপরের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসত। কখনো চিমটি কাটত। হেসে একে অপরের গায়ে হেলে হেলে পড়ত। আর ওড়না ঠিকঠাক করত।তাতে পাড়ার তরুণদের মাঝে হুল্লোড় খেলে যেত। তারা একে অপরের পিঠে কিল-ঘুষি দিত। কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরে গড়িয়ে পড়ত। আর কেউ তরুণীদের দেখিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বলটির ওপর বল প্রয়োগ করত। হাত পেছনে মুচড়ে দিয়ে মাফ চাইয়ে তারপর ছাড়ত। কেউ কেউ দাবি করত বান্ধবীদের অমুক তার দিকে তাকিয়েছে, তমুক ওর দিকে। বন্ধুদের কেউ কেউ তাতে সায় দিত। অন্যরা অস্বীকার করত। বলত, হালায় চাপা মারে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বান্ধবীরা গ্রীবা উঁচু করে ঘরে ফিরত।
তখন এরশাদের কাল।
এসএসসি-এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা এক বিরাট সামাজিক এবং গণ-অংশগ্রহণমূলক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষার আগে আগে কিছু স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অসম্ভব রকম বেড়ে যেত। কারণ সেসব স্কুলগুলোকে ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকেরা পরীক্ষাবান্ধব বলে গণ্য করতেন। সেখানকার মাস্টাররাও ছিলেন ‘ভালো’ এবং ‘হেল্পফুল’। কিছু যে ‘খচ্চর’ মাস্টার থাকতেন না তা নয়, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো রেজাল্ট হোক তা চাইতেন না। সে রকমও ছিল। কিন্তু তাদের ‘সাইজ’ করে দেওয়া হতো।
আমাদের এসএসসি পরীক্ষার্থী দুই বান্ধবীও তাদের শহরের ‘পচা’ স্কুল ছেড়ে পাশের উপজেলার ‘ভালো’ স্কুলে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নাম রেজিস্ট্রেশন করাল। বিকেলে হাঁটতে বেরোলে পাড়ার ছেলেরা তাদের আশ্বস্ত করত, পরীক্ষা নিয়া চিন্তা করবা না। যত সাপ্লাই দেওয়া লাগে আমরা দিব। তোমরা খালি লিখবা। বেশি বেশি পৃষ্ঠা নিবা। খাতা যেন মোটা হয়।
বান্ধবীদের কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরত, কী জানি, স্যারদের কাউরে চিনি না! কেমন হয়!
তরুণরা বলত, আরে ব্যাপার না। আমরা আছি না।
পরীক্ষা শুরুর দিন দুই বান্ধবী তাদের অভিভাবকগণ এবং পাড়ার তরুণ সমাজকে সফরসঙ্গী করে বাস ভরে পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে রওনা দিল। স্কুলে পৌঁছে বান্ধবীরা তাদের অভিভাবক এবং শুভানুধ্যায়ী তরুণ সমাজের দিকে কাতর নয়নে চেয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করল। অভিভাবকরা দুরুদুরু বক্ষে মেয়েদের বিদায় দিয়ে তরুণ সমাজের উদ্দেশ্যে বলল, বাবারা, আমাগো মেয়ে দুইটারে তোমাগো হাতে তুইলা দিলাম। দেখি কে কত বড় পালোয়ান!
পরীক্ষা শুরুর দশ মিনিটের মধ্যে প্রশ্নপত্র হাতে এসে গেল। তরুণরা অভিভাবকদের আশ্বস্ত করল, ওরা যা নিয়া ভিতরে ঢুকছে তাতে তিনটা প্রশ্ন ‘ফুল কমন’। বাকিগুলা আমরা দেখতাছি।
মাঠের মধ্যে বসে প্রশ্ন দেখে দেখে উত্তর খুঁজে দাগিয়ে বইয়ের পাতার পর পাতা ছেঁড়া হতে লাগল। সেই সব উত্তরসম্বলিত ছিন্নপত্র দফায় দফায় ঢুকতে লাগল পরীক্ষাকেন্দ্রে বসা বান্ধবীদের কাছে। অতিবর্ষণে বান্ধবীরা বিহ্বল হয়ে গেল। তাদের প্যাঁচ লেগে গেল, কোন কাগজে কোন প্রশ্নের উত্তর!
ফিরতি পথের বাসে তুমুল পর্যালোচনা সভা।
বান্ধবীদ্বয়ের কাঁদুনি, সময়ের অভাবে ‘ফুল অ্যানসার’ করা যায়নি।পাশের মেয়েটা বদ। খুব ‘ডিস্টার্ব’ করেছে। অথচ একটা কাগজ দেবে বলেও দেয়নি।
স্যারগুলা ভালোই। ‘ডিস্টার্ব’ করে নাই। খালি বলছে, সাবধান! ম্যাজিস্ট্রেট কিন্তু যেকোনো সময় আইতে পারে।
তরুণরাও চটজলদি নিজেদের ‘পারফর্মেন্স অ্যাপ্রাইজাল’ করে নিল। কোন হালায় কাজের না, তাকে শনাক্ত করে যথেষ্ট তিরস্কার করা হলো এবং বলা হলো, তুই কাইলকা আইবি না।
বাসায় ঢোকার আগে অভিভাবকেরা তরুণ সমাজকে তাদের অবদানের জন্য ধন্যবাদ দিলেন। আর বিশেষ করে মনে করিয়ে দিলেন, ইংরেজি পরীক্ষার দিন অমুক, আর অঙ্ক পরীক্ষার দিন তমুক যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকে। বান্ধবীরা দুয়ার দেওয়ার আগে চোখের তারায় কোমল আলো ফুটিয়ে তরুণদের কারও কারও দিকে চেয়ে আলতো করে বলল,থ্যাংকস।
প্রতিটি পরীক্ষার দিন একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল। মাঝে একদিন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পুলিশ নিয়ে দশ মিনিটের জন্য মহড়া দিয়ে শিক্ষক ও পরীক্ষার্থীদের আতঙ্কিত, আর অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ী তরুণ সমাজকে হেনস্থা করে গেলেন। তাতে যে উত্তেজনা আর কোলাহল ছড়াল তা তরুণসমাজের কারও কারও ‘ইমেজ’ বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক হলো।
পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেল। দুই বান্ধবী যৌথভাবে অকৃতকার্য হয়েছে। পাড়ায় শোকের ছায়া।
কিন্তু তাতে দুই বান্ধবীর হৃদ্যতা গাঢ়তর হলো। আগে তারা পাশাপাশি হাঁটতো, এখন হাত ধরাধরি করে হাঁটে।
তারা দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করল এবং তার ফল প্রকাশ হলো। যথারীতি এবারও দুজনে অকৃতকার্য।
এতে তাদের মধ্যে হৃদ্যতা প্রগাঢ়তর হলো। এখন তারা গলা জড়াজড়ি করে হাঁটে।
তারা তৃতীয়বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করল এবং তারও ফল প্রকাশ হলো। কিন্তু এবার বিপর্যয় ঘটল।
বান্ধবীদের একজন ফেল আর আরেকজন পাস করল। তাদের মধ্যকার হৃদ্যতা নিমেষে ভেঙে চুরমার।
ফেল করা তরুণী মায়ের গলা জড়িয়ে একটি আর্তনাদই কেবল করতে পারল, মাগো, আমারে তুমরা এখন কার ঘরে তুলে দিবা? ‘মেট্রিক ফেল’ মেয়ের বিবাহযোগের দুরবস্থা কল্পনা করে মা কণ্টকিত হলেন; এবং উচ্চ স্বরে পাস করা তরুণীকে অভিসম্পাত দিতে লাগলেন। প্রধান অভিযোগ হলো, পাস করা তরুণী ফেল করা তরুণীর খাতা দেখে লিখে পাস করেছে।
পাস করা তরুণী ও তার মা ফেল করা তরুণীর মায়ের এ অভিযোগ সইবেন কেন? তিনি যৌক্তিক প্রশ্ন তুললেন, ফেল করা মেয়ের খাতা দেখে লিখে কী পাস করা যায়?
দুই তরুণীর বিবাদে প্রথমে দুই মা এবং একে একে পরিবারের বাকি সদস্যরা যুক্ত হলো।
দীর্ঘদিনের এত ঘনিষ্ঠ দুই বান্ধবীর ঝগড়া পরস্পরের কত না গা শিউরে ওঠা গভীর, গোপন কথা ফাঁস করে দিল!
শুনে পাড়ার মুরুব্বিদের জিভে দাঁত পড়ল।পাড়ার বউ-ঝিরা আঁচলে মুখ ঢেকে খুশির ঝিলিক চেপে ‘ছি-ছি’ করল;
আর তরুণ সমাজের কেউ কেউ গা ঢাকা দিল।
দুই পরিবারের সদস্যদের বাদানুবাদে পাড়ার কাক-পক্ষী সব উড়ে পালাল, আর দুই বাড়ির ছাদজুড়ে বসল পাড়ার যত ইঁচড়ে পাকা ফাজিল পোলাপান। উঁচু গ্যালারি থেকে তারা দুই পরিবারের ঝগড়া প্রাণভরে উপভোগ করতে লাগল। কখনো কোনো পরিবার যদি প্রতিপক্ষের কোনো প্রাণঘাতী বাক্যবাণে বিশেষ অসুবিধা বোধ করে এবং এড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে শোরগোল করতে চায়, তো ছাদের পোলাপান রেহাই দেয় না। মনে করিয়ে দেয়, এই যে, আপনাগো না এই কইছে।
কী বিপদ!
ফাজিল দর্শকরা দুই পরিবারের জন্যই বিস্তর অসুবিধা তৈরি করতে থাকলে ঝগড়ারত পক্ষগুলার মধ্যে এক অভূতপূর্ব ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা ‘ফাজিল পুলাপান মজা দেখস’ বলে কাক-পক্ষী তাড়ানোর মতো ‘হেইস হেইস’ করে আর ঢিল ছুঁড়ে তাদের ছাদছাড়া করে। ফাজিল পোলাপানের আমোদ তাতে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
দিনশেষে ঝগড়ার উত্তাপ মিইয়ে এলে দুই বাড়ির পুরুষরা তাদের নারীদের শাসন করে যার যার ঘরে ঢোকায়। স্নায়ুক্ষয়ী লড়াইয়ের ক্লান্তিতে দুই বাড়ি থেকেই দাবানল শেষে বনপোড়া কয়লার ধিকিধিকি আগুনের মতো মৃদু মৃদু ফোঁসফাঁস উঠতে থাকল আরও কিছুক্ষণ। কেবল ফেল করা মেয়ের বাড়িতে বিলাপ আর অভিশাপের করুণ সুর বেজে চলল গভীর রাত অব্দি।
এখন বোধ হয় আর এসএসসি পাস-ফেল নিয়ে এসব কিছুই হয় না!
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]