Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla/2021-01/1d75151c-eff9-4e9f-ac28-aebc4618d00f/palo_bangla_og.png />

তরক্ষু

ধ্রুব এষ



বিষ্ণুপদর দুপুরে ঘুম পায়। শুক্রবার ছাড়া আর সব বারে। ভাতঘুম না।

বিষ্ণুপদ সকালে এবং রাতে ভাত খায়। দুপুরে রুটি এবং সবজি কিছু খায়। রুটি-সবজি ঘুম বলা যায় তাহলে।

দুঃখের বিষয়, বিষ্ণুপদ ঘুমাতে পারে না। ক্লাস থাকে। ছেলেপুলেদের পড়াতে পড়াতে দুই চোখে টেনে ঘুম আসে তার। রুটি-সবজি ঘুম। অথচ সেই ঘুম তার কপালে লেখা নাই।

বিষ্ণুপদ থাকে টাউনের বাসস্ট্যান্ড রোডে। ইব্রাহিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওয়ান, টু, থ্রির গণিতের ক্লাস নেয়। থ্রির ক্লাসটা পড়ে ঠিক তার রুটি-সবজি ঘুমের সময়টায়। ক্লাস শেষ হয়, ঘুমও কেটে যায়।

আজ অবশ্য সেই সমস্যা হয়নি। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে আগে। হেড মাওলানা স্যারের শাশুড়ি মারা গেছেন, সে জন্য নয়, স্কুলে আজ অতি বিশেষ একজন মানুষ এসেছিলেন। ঢাকায় বসবাস করেন, এলাকার কবি। আবার বিরাট সরকারি কর্মকর্তা। হিল্লি-দিল্লি নানা দেশ ঘুরেছেন। স্কুলে আজ তার শুভ পদার্পণ ঘটেছিল। মাঠে ম্যারাপ বাধা হয়েছিল। কবি কিছু কথা বলেছেন এবং দশ-এগারোটা কবিতা পড়েছেন মাইকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিজউদ্দিন স্যার জ্বালাময়ী ভাষায় বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হইলেন বিশ্বকবি, আর আমাদের কবি, আমাদের কবি হইলেন বিশ্ববিখ্যাত কবি।’

তুমুল করতালি পড়েছে এবং কিছু কাক কা কা করে উড়েছে। বিষ্ণুপদ কবিতা অত বোঝে না। তবে কবি মানুষটার উছিলায় স্কুল ছুটি হয়ে গেছে বলে মানুষটার ওপর কিছু সন্তুষ্ট সে। বক্তৃতা কবিতায় অবশ্য গেছে দুই ঘণ্টা। ভালো দেখায় না বলে বিষ্ণুপদ উঠে পড়েনি। না হলে বিশ্ববিখ্যাত কবির দুটো কবিতা শুনেই তার হপ স্টপ অ্যান্ড জাম্প দিতে ইচ্ছে করছিল। জাম্প দিয়ে যদি স্কুল বাউন্ডারির বাইরে চলে যেতে পারত।এখন বাজে তিনটা আঠারো। বিষ্ণুপদ হেঁটে ঘাটের দিকে যাচ্ছে। দুপুরের খাবার এখনো খায়নি। ঝোলায় আছে। সুতপা ঘুম থেকে ওঠে ছয়টায়। স্নান করে জলখাবার বানায়। ভাত রান্না করে। বিষ্ণুপদ ওঠে আরও কিছু পরে। ভাত খেয়ে ঝোলায় টিফিনবক্স নিয়ে রওনা দেয় স্কুলের উদ্দেশে। সিদ্ধ আটার তিনটা রুটি আর সবজি। দুপুরের খাবার বিষ্ণুপদর। বিশ্ববিখ্যাত কবির আগমন উপলক্ষে স্কুলের সকল শিক্ষক এবং ছাত্রকে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলকাটা বাজারের যদু ময়রার দোকানের একটা করে রসগোল্লা আর নিমকি। খেয়েছে। সে জন্য এখনো তেমন ক্ষুধা বোধ হচ্ছে না বিষ্ণুপদর। ঘাটে বসে খেয়ে নেবে। ঘাটে হোটেল আছে, দোকানপাট আছে। চেনা মানুষজন। সম্মান করে তাকে। আদাব-সালাম দেয়।

আশ্বিন মাসের দুপুর। নীল ছিল এবং কিছু মেঘ ছিল। বিষ্ণুপদ যখন মাত্র ঘাটের হেরিংবোন রাস্তায় পড়েছে, কিছু মেঘ হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে উঠে কালো মোষের দল হয়ে গেল। আকাশ দখল করে ফেলল নিমেষে। বেমক্কা অন্ধকার হয়ে এল চারধার। বিষ্ণুপদ পা চালাল। আশ্বিনের বৃষ্টি, বিশ্বাস নাই, নেমে পড়তে পারে এক্ষুনি। এই অবস্থায় পড়বে ভাবে নাই এবং ছাতা সঙ্গে আনে নাই, আরও দ্রুত পা চালাল সে। লাল ইটের হেরিংবোন রাস্তা। অদ্ভুত এক রং ধরে আছে এখন। দুই ধারে ধানক্ষেত। এখনো সবুজ। তবে ধানে দুধ এসে গেছে।’এই বিষ্ণু! এই পদো!’বিষ্ণুপদ খুবই চমকাল।নাকি নিশির ডাক?আর একবার যদি ডাকে!ডাকল, ‘এই পদো! এই বিষ্ণু!’বিষ্ণুপদ ঘুরে কপিলকে দেখল। কপিল তরক্ষু। কত বছর পর? বদলেছে কতটা? বোঝাপড়ার আগেই কপিল তরক্ষু হাসল, ‘কী রে শালা?’বিষ্ণুপদ বলল, ‘তুই!’‘তুই কি নেকড়ে মনে করেছিলি?’‘আরে না। নেকড় কেন মনে করতে যাব?’‘হতে পারি না? হা-হা-হা!’

বিষ্ণুপদ জন্মেছে টাউনে এবং টাউনেই পড়ালেখা করেছে। রাজগোবিন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় এবং সরকারি কলেজে। বারো-তেরো বছর আগের কাহিনি সেসব। ইন্টারে মানবিকের ছাত্র ছিল তারা উনআশিজন।

কপিল তরক্ষু এইট থেকে পড়ে তাদের সঙ্গে। সেটা এক ঘটনা।তারা সবে উঠেছে এইটে। সহিদুল, মৃদুল, অমিয়শঙ্কর, রুমেনরা এ সেকশন, বিষ্ণুপদ, নাসের, মান্না, অঞ্জনরা বি সেকশনে পড়েছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি হবে, বেজায় শীত এবং কুয়াশার এক দিনে, এইট বি সেকশনের ছেলেরা এক বিচিত্র মূর্তিকে দেখল তাদের ক্লাসে। মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল এক ছেলে। স্কুল ইউনিফর্ম পরে আসে নাই, জ্যাকেট টাইট প্যান্ট আর কেডস পরে আছে। চোখের মণির রং কী রকম ছেলেটার। এমন আজব চোখের মণির রং টাউনের ছেলেরা কেউ কখনো দেখেনি। অদ্ভুত নীল। অমিয়শঙ্কর পরে চারুকলায় পড়েছে, এখন আর্টিস্ট, অনেক দিন পর কপিল তরক্ষুর চোখের মণির রং বলেছিল সে, আইস ব্লু। বরফ নীল। দূরের বরফ যেমন নীল রঙের দেখায়।

বি সেকশনের ক্লাস টিচার ছিলেন হক স্যার। রোল কলের আগেই ধরলেন।’এই জংলি, ইউ! ইউ স্ট্যান্ড আপ।’লাস্ট বেঞ্চে একা বসেছিল সে। উঠে দাঁড়াল।’হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?’‘মাই নেইম ইজ কপিল তরক্ষু, স্যার।’‘হোয়াট? থুক্কু!’‘সরি স্যার। মাই নেইম ইজ কপিল তরক্ষু।’‘কপিল তরক্ষু! আই সি! ইজ ইট ইয়োর টাইটেল?’‘আই ডোন্ট নো স্যার। মাই ফুল নেইম ইজ কপিল তরক্ষু। দ্যাটস আই নো।’‘আই সি। সিট ডাউন। সিট ডাউন, বয়।’সে বসল। কপিল তরক্ষু।তরক্ষু আবার কী রকম নাম?তবে সে স্মার্ট। প্রাণবন্ত, মিশুক। এক দিনেই একজন হয়ে গেল সকলের। তার বাবা রশিদ মামুদ। ফরেস্টের রেঞ্জার, বুড়ি গোয়ালিনী রেঞ্জ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন টাউনে। বুড়ি গোয়ালিনী ফরেস্ট রেঞ্জ। বিষ্ণুপদরা খুবই আশ্চর্য হয়েছিল। একটা জায়গার নাম বুড়ি গোয়ালিনী, একটা নদীর নাম বুড়ি গোয়ালিনী। তার থেকেও অবশ্য অনেক অনেক আশ্চর্যের ছিল কপিল তরক্ষু। সহিদুল এখন থাকে ঢাকায়, বিরাট বড় লেখক হয়েছে। সে দারুন কথাটা বলত, ‘তোর কান্ডকারখানা দেখলে আমি অষ্টম আশ্চর্য হয়ে যাই তরক্ষু।’আজব একটা ছেলে।

২.সত্যি কথা কোনটা? মিথ্যা কথা কোনটা? সহজ একটা সত্যি কথা হলো এইট নাইনের বয়স থেকে আদপে মানবিক হতে শুরু করে মানবশিশুরা। ছেলেরা মেয়েরা। মন বদলায়, শরীর বদলায়। রক্ত চনমন করে, বুক রিমঝিম করে। কিছু কিছুর অবশ্য এর আগেই হয়ে যায়, এঁচোড় পাকা বলে যাদেরকে। সিক্স-সেভেন থেকেই মৃদুল-শামীমরা প্রেমকুমার হয়ে গিয়েছিল। মৃদুল আবার টোল খুলেছিল, ‘কোনো মেয়েকে যদি পছন্দ হয়ে যায়, চোখ মারবি তার দিকে তাকিয়ে। হয়ে যাবে।’ এইট থেকে সহিদুল, রাজীব, মুস্তফা, মৃদুলের ভাবশিষ্য হলো। রাজীব প্রেম করত জননেতা আবদুল খালেকের মেয়ে শিরিনার সঙ্গে। জনান্তিকে বিষ্ণুপদরা শিরিনাকে বলত, ‘হল্যান্ডের গাই।’ মুম্বাইয়ের তৎকালীন সেক্সবম্ব কেটি মির্জার বুকের অর্ধেক ছবি তারা তখন দেখে ফেলেছে পত্রপত্রিকায়। ‘কেটি মির্জা’-ও বলত শিরিনাকে। মুস্তফা প্রেম করত না, পড়ত। আজ পাপড়ি, কাল রুলি, পরশু আসমা, তরশু কচির। সহিদুল বরাবর ভালো ছাত্র, বিতার্কিক এবং কবি। টাউনের লোকাল পত্রিকা আছে। পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়। এইটে স্নিগ্ধার প্রেমে পড়েছিল, নাইনে উঠে বিরাট সর্বনাশ করল সে। তত দিনে অবশ্য আজবভাবে তার মহাবন্ধু হয়ে গেছে কপিল তরক্ষু। যদিও কপিল তরক্ষু ভালো ছাত্র না। দৌড়ে ফার্স্ট হয়, লং জাম্পে ফার্স্ট হয়। পড়াশোনায় মধ্যম মানের। বিষ্ণুপদদের মতো মানবিক নিয়েছে। বিষ্ণুপদর সঙ্গেও তার কিছু পরিমাণ বন্ধুতা হয়েছে। বিষ্ণুপদ আর সহিদুল আগে থেকেই বন্ধু।

নাইনে পড়ে বড় হয়ে গেছে, স্কুল ছুটির পরও কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে বসে থাকে তারা তিনজন। নানা পদের কথা বলে কপিল তরক্ষু, অষ্টমাশ্চর্য হয় সহিদুল। বিষ্ণুপদও হয়। আমাজনে গেছে কপিল, ইস্টার দ্বীপ, মাচ্চুপিচু গেছে। একা না অবশ্য, বাবার সঙ্গে গেছে। তাতে কী? সহিদুল, বিষ্ণুপদরা শুধু বইপত্রে পড়েছে ওই সব।

কপিল তরক্ষুর বাবা রশিদ মামুদ ভদ্রলোকের নেশা একটাই। জার্মান ভাষায় সেটাকে বলে ভান্ডারলুস্ট, ইংলিশ ভাষায় বলে ওয়ান্ডার লাস্ট এবং বাংলা ভাষায় ভ্রমণের নেশা। সেই নেশা কপিল তরক্ষুরও হয়েছে। বড় হয়ে গ্লোবট্রটার হবে সে। ভূপর্যটক। আর ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করবে। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি কী, সেটা বিষ্ণুপদদের কাছে স্পষ্ট নয় তখনো। কপিল তরক্ষু বলেছিল, সে জংলি জন্তু জানোয়ারের ছবি তুলবে। নেকড়েদের ছবি তুলবে। জংলি জানোয়ার কি শুধু নেকড়ে?আরেকটা কথা। রশিদ মামুদের চোখের মণিও তার ছেলের মতো অস্বাভাবিক রঙের। আইস ব্লু না, বাদামি না, উজ্জ্বল হলুদ কী রকম। আবার গভীর। কপিল তরক্ষুর বন্ধুরা অবশ্য এ নিয়ে কিছু চিন্তিত হয় না। কত রঙের চোখের মণি হয় মানুষের।

৩.নাইনের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার পর তারা ঠিক করল যে দলেবলে পিকনিকে যাবে। স্কুলের পিকনিক না, নিজেদের পিকনিক। রশিদ মামুদ বললেন, ‘তবে নেকড়ের বনে যেতে পারো, বয়েজ।’ রশিদ মানুষ লম্বা এবং মজবুত শরীরের মানুষ। গোঁফওয়ালা। কিন্তু নেকড়ের বন আবার কোথায়?

নদীর পাড়ে টাউন বিষ্ণুপদদের। দূরে নীল পাহাড়ের সারি দেখা যায়। নদী পার হয়ে যেতে হয় পাহাড়ে। রশিদ মামুদ ছেলেদের শোনালেন আড়াই-তিন শ বছর আগের ইতিহাস। নদীর ওই পাড়ে আগে ছিল জঙ্গল। নেকড়েদের বন। যে যার মতো চরে বেড়াত নেকড়েরা। পাহাড় পর্যন্ত ছিল তাদের রাজত্ব। পাহাড়ে নেকড়ে দেবতা থাকতেন। মুশকিল করল আবাদি মানুষজন। দূরের এই সব মানুষ আবাদ শুরু করল নেকেড়েদের জঙ্গল কেটে সাফ করে। রুষ্ট হলেন নেকেড়েদের দেবতা। নেকড়েরা মেরে ফেলল কিছু আবাদি মানুষকে। আবাদি মানুষেরা ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিল নেকড়েদের তেরো শ একর জঙ্গল পুড়িয়ে আবাদ করে। নেকড়ে দেবতার কথা এখনো পাহাড়ের উপত্যকায় গেলে শোনা যায়। মানুষজন বলে। নেকড়েদের বন আবার একদিন নেকেড়েদের হবে। এসব বানানো গালগল্প হতে পারে। নেকড়ে দেবতার কাহিনিও লোককাহিনি হতেই পারে। কিন্তু নেকড়ের বন ছিল সত্যি। রশিদ মামুদ বললেন, পাহাড়ের উপত্যকায় এখন একটা ছোট বন আছে ‘নেকড়ের বন’ বলে। ছেলেরা যদি সেখানে পিকনিক করতে চায় তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। ক্লাস নাইনের সতেরো পণ্ডিত, দস্যু বনহুর সিরিজ, কুয়াশা সিরিজ, দস্যু বাহরাম সিরিজ গিলে বসে আছে। চাঁদের পাহাড়, মিসমিদের কবচ, যকের ধন, ট্রেজার আইল্যান্ড, আরও কত বই তার সঙ্গে। এমন প্রস্তাবে তারা কী করবে?

রশিদ মামুদ ষোলোজনের যাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন। নেকড়ের বন তার রেঞ্জে পড়ে। একজন যে বাদ পড়ল, সে সহিদুল। জ্বরে পড়ে যেতে পারল না।

ফরেস্টের কাঠের স্পিডবোটে করে দুবারে নদী পার হলো ছেলেরা। রশিদ মামুদ জুলমত ভাই এবং টোলা ভাইকে ছেলেদের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। এরা ফরেস্ট গার্ড। দুজনই পালোয়ান। ফুঁ দিলে বাতাসের আগে উড়ে যাবেন। তবে সেটা কোনো সমস্যা না।

ওই পাড়ে গ্রাম। মানুষের ঘরদোর। গরুর গাড়ি ছাড়া কিছু চলে না। ঘোড়া আছে বড়োলোক দু-একজন মানুষের। গরুর গাড়ি ভাড়া করার প্রস্তাব দিল টোলা ভাই। নাকচ করে দিল ছেলেরা। তারা হেঁটে যাবে যত দূর পারে। পিকনিকের হাঁড়ি কড়াই তাঁবু ইত্যাদিসহ জুলমত ভাই এবং টোলা ভাই রওনা দিলেন একটা গরুর গাড়ি করে। ছেলেরা হইহই করে ছুটল।

৪.তারা যখন প্রথম নেকড়ের বন দেখল, সহিদুল বড় হয়ে লিখেছে, পার্পল রঙের ওয়াশ ছিল আকাশে। অজস্র জারুল ফুলের স্নিগ্ধ পার্পল রং। মনে হচ্ছিল সব ফুল ফুটে আছে আকাশে। অথচ জারুল ফুলের সময় না সেটা।

লম্বা সবুজ ঘাস, পার্পল রঙের অসংখ্য জারুল গাছ, প্রাচীন আরও অনেক বড় বড় গাছ, এবং কিছু ছোট-বড় টিলা, এই হলো এখনকার নেকড়ের বন। ফরিদ, রুমেন, শামীমের তত্ত্বাবধানে জুলমত ভাই বাবুর্চি হলেন, টোলা ভাইকে তার অ্যাসিসট্যান্ট মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হলো। তাতে কিছু বেজার হলেন টোলা ভাই। দেখে কে অত! মান্না, নাসেরও থাকল ফরিদদের সঙ্গে। অন্যরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নেকড়ের বন অভিযানে নামল। মৃদুল, মুস্তফা, রাজীব, তুষার একদল। অমিয়শঙ্কর, অঞ্জন, কাওসার একদল। বিষ্ণুপদ এবং কপিল তরক্ষু একদল। এই সময় শীত পড়ে না, রশিদ মামুদের পরামর্শে তা-ও কিছু গরম কাপড় তারা এনেছে সঙ্গে। সেসব পরতে হলো নেকড়ের বনের আরেকটু ভেতরে ঢুকতেই। তারা আশ্চর্য হয়ে দেখল নেকড়ের বনের এখানে-ওখানে কুয়াশা। ঠান্ডাও খুব! কনকনে খুব। বিষ্ণুপদ এবং কপিল ছোট একটা টিলা পার হলো এবং অন্যদের চোখের আড়াল হলো।বিষ্ণুপদ খুবই আশ্চর্য। অথচ কপিল তরক্ষুকে তার মনে হলো বিকারহীন।

কে জানে, কত দেশ ঘুরেছে, এমন দৃশ্য কপিল তরক্ষু আরও দেখেছে নিশ্চয়। বিষ্ণুপদ দেখেনি। একটা টিলার মাথায় একটা ঘর দেখল তারা। কাঠের বানানো। অর্ধেক ডুবে আছে কুয়াশায়। প্রাচীন উঁচু একজন গাছও আছেন সঙ্গে।

‘লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি’ পড়েছে বিষ্ণুপদ। বাংলা অনুবাদ। তার মনে হলো এই ঘরটা প্রেইরিতে। ঘাসের জঙ্গলে। কাঠের এই ঘরে কেউ থাকে?কপিল তরক্ষু বলল, ‘আয় দেখি।’কম উঁচু টিলা না। কিছু সবুজ, কিছু পাথুরে। ওঠার রাস্তা খুঁজে বের করল কপিল। তারা উঠল। কাঠের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ।কপিল তরক্ষু চেঁচিয়ে উঠল, ‘আহোয়?’কথাটার মানে বিষ্ণুপদ জানে, এনিবডি হেয়ার? কেউ কি এখানে আছ?নেই মনে হয়। তারা ঘরের বারান্দায় উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝল কেউ আছে ঘরে। চাপা ফিসফাস, না গর্জন, না কী—তারা বুঝতে পারল না। ঘাসের বনে কুঁই কুঁই করল কোনো জানোয়ার। নাকি ঘরেই? কপিল তরক্ষু না থাকলে হয়ে যাচ্ছিল। বিষ্ণুপদ জোর দৌড় দিত। কপিল তরক্ষু আবার নিচু গলায় বলল, ‘আহোয়?’

সঙ্গে সঙ্গে চুপ ফিসফাস কুইকুই। কাঠের ঘরের দরজা খুলে গেল এবং তারা একজন মহিলাকে দেখল। সাদা টপস, অলিভ ট্রাউজারস পরে আছেন। রোদ পড়া কুয়াশার মতো স্নিগ্ধ। চোখের মণির রং সবুজ। তাদেরকে দেখে মৃদু গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বললেন মহিলা। বিষ্ণুপদ মাথামুণ্ডু একটা শব্দও ধরতে পারল না। কপিল তরক্ষু মনে হয় পারল এবং সে-ও দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলল। বিষ্ণুপদ তার কথাও বুঝল না। কপিল তরক্ষু বলল, ‘এই বিষ্ণু, এই পদো, কফি খাবি?’বিষ্ণুপদ বিব্রত হয়ে বলল, ‘না।’মহিলা তাদের কিছু চেরিফল দিলেন। তারা টিলা থেকে নামল। বিষ্ণুপদ একটা হাঁপ ছেড়ে বলল, ‘সাংঘাতিক সুন্দর মহিলা।’কপিল তরক্ষু বলল, ‘হুঁ।’‘তার সঙ্গে কী ভাষায় কথা বললি তুই?’‘তরক্ষু ভাষায়।’ বলে কপিল তরক্ষু হা হা করে হাসল।আজব নেকড়ের বন দেখে তারা সন্ধ্যার কিছু পর ফিরল টাউনে। ফের স্পিডবোটে ওঠার আগে কপিল তরক্ষু একটা কথা বলল বিষ্ণুপদকে ‘নেকড়েরা যদি একদিন নদীপার হয়ে টাউনে চলে আসে…'’নেকড়ে! কোথায়?’‘এমনি বললাম।’‘নেকড়েরা কি সাঁতার কাটতে পারে।’‘মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর সব প্রাণীই জন্মসাঁতারু, পদো, বিষ্ণু।’বিষ্ণুপদ এটা জানত না।’সত্যি?’‘শুধু মানুষকে সাঁতার শিখে নিতে হয়।’ কপিল তরক্ষু বলল।বিষ্ণুপদ বলল, ‘তুই কি মানুষ?’কপিল তরক্ষু বলল, ‘আমি জন্মসাঁতারু। হা হা হা!’

মাস দেড়েক পর আবার ঈদের ছুটি পড়ল। ঈদুল আজহা। ছুটির পর অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেল ছেলেদের। পাহাড় থেকে শীত তেড়ে এল টাউনে। আর এক বছর পর তারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেলবে এবং কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে। সহিদুল ফার্স্ট ডিভিশন পাবে অবশ্যই। স্ট্যান্ডও করতে পারে বোর্ডে। বিষ্ণুপদ আশা করে সে হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন পাবে। কপিল তরক্ষু কিছুই আশা করে না।

নদীর পাড়ে কিছু কাটা গাছ আছে। চোরাই কাঠ। রশিদ মামুদ ধরেছেন। কদিন পর এসব গাছ নিলাম হয়ে যাবে। পৃথিবীর সব গাছ চেনে কপিল তরক্ষু। ডালপালা নেই টুকরো-টাকরা গাছ। এটা সিবিট, এটা কড়ই, এটা আয়রন উড। আয়রন উডের টুকরোটায় বসে সহিদুল সর্বনাশের কথাটা বলল। স্নিগ্ধার সঙ্গে তার প্রেম ভেঙে গেছে, আভার সঙ্গে প্রেম হয়েছে।আভার সঙ্গে! হতবুদ্ধি হয়ে গেল এবং ভয় পেয়ে গেল কৃষ্ণপদ। আভা পাঠান। আমজাদ পাঠানের একমাত্র মেয়ে। ষণ্ডা মার্কা দুটো ভাই আছে তার। জ্যাকব পাঠান এবং জাকেরিন পাঠান। ষণ্ডা মার্কা কী, এরা ষণ্ডাই। এরা যদি কিছু শোনে!কপিল তরক্ষু উড়িয়ে দিল, ‘কিচ্ছু হবে না। তুই কি আভাকে বিয়ে করবি?’সহিদুল বলল, ‘চ্যালেঞ্জ।’কপিল তরক্ষু বলল, ‘আভার সঙ্গে প্রেম যদি ভেঙে যায়?’‘মচকাবে কিন্তু ভাঙবে না।’ সহিদুল বলল।কপিল তরক্ষু বলল, ‘শাবাশ! এই বিষ্ণু, এই পদো, বল শাবাশ।’আর শাবাশ!ধরা পড়ল সহিদুল।

পাঠান মঞ্জিল মড়ার টিলা রোডে। সবুজ রঙের এল প্যাটার্নের বিল্ডিং। বোগেনভেলিয়ার ঝাড় ছাদ থেকে নেমেছে। সারা রাত ধরে প্রেমপত্র লিখেছে, ভোররাতে সেটা আভাকে পাস করতে গিয়েছিল সহিদুল। বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ে রেখে আসবে। ওত পেতে ছিল জ্যাকব পাঠান। ধরে চড়-থাপ্পর মেরেছে এবং কান ধরে দশবার ওঠবোস করিয়েছে সহিদুলকে। ভোররাতের ঘটনা বলে কিছু জানাজানি হয়নি টাউনে। অপমান কি তাতে ভুলে যাবে সহিদুল? আর কেউ কিছু না জানুক, আভার সামনে ঘটনা ঘটেছে। বোনকে ডেকে এনেছিল জ্যাকব।’এটা খুবই বাজে কাজ করেছে।’ কপিল তরক্ষু বলল।’আমি আত্মহত্যা করব।’ প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল সহিদুল।কপিল বলল, ‘ভালো কথা। কীভাবে আত্মহত্যা করবি, ভেবেছিস? বিষ খাবি, নাকি গলায় দড়ি দিবি? ইঁদুর মারার ওষুধ কিনে ভুলেও খাবি না। পেট খারাপ হবে, আর কিছু হবে না। যদি গলায় দড়ি দিস, বলিস। দড়ি আমি সাপ্লাই দিতে পারব।’‘তোকে কিছু দিতে হবে না।’‘রাগ করিস কেন? এই পদো, এই বিষ্ণু, তুই বল, দড়ি ছিঁড়ে যদি পড়ে যায় সহিদুল, সেটা কি কম অপমানের হবে? কান ধরার থেকে কম অপমানের হবে?’

তাদের নিরালা ছোটমোট টাউন। বড় কিছু ঘটনা আকছার ঘটে না। দুদিন পর একটা ঘটল। মেথর পট্টির ধেনোর কাস্টমার জ্যাকব। মেথর পট্টি থেকে দুলতে দুলতে উঠে লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড টহল দিয়ে ফেরে। মড়ার টিলা রোডে যখন ঢুকেছে, লোডশেডিং ছিল। তবে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল আকাশে। মাতাল জ্যাকব বুঝতে পারেনি কিছু। জমাট একটা অন্ধকার লাফ দিয়ে পড়ল এবং আঁচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে চলে গেল জ্যাকব পাঠানকে। হাসপাতালের ডাক্তার সালেক উদ্দিন এমবিবিএস বললেন নিশ্চয় হিংস্র কোনো জন্তু আক্রমণ করেছিল। কিন্তু টাউনে হিংস্র জন্তু! এক গোরস্থানের শেয়াল হতে পারে। কিন্তু তারা কি এতটাই হিংস্র? ব্যান্ডেজ করে বেশ কিছুদিন মিশরের মমি হয়ে থাকতে হলো জ্যাকব পাঠানকে। লোকাল পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলো, ‘শহরে হিংস্র জন্তুর আবির্ভাব।’ কিন্তু সেই হিংস্র জন্তুর আর কিছুতে হদিস মিলল না।কপিল তরক্ষু বলল, ‘নেকড়ে!’বিষ্ণুপদ বলল, ‘কী?’‘নেকড়ের বনের একটা নেকড়ে। জ্যাকব পাঠান সহিদুলকে অপমান করেছে বলে খেপেছে।’ কপিল তরক্ষু নির্বিকার বলল।সহিদুল বলল, ‘হ্যাঁ, তোর কথাবার্তা শুনলেও আমি অষ্টম আশ্চর্য হয়ে যাই।’

তারা এসএসসি দিল। কলেজে উঠল। আশ্চর্য উড়ন্ত দিন যায় শুধু।কলেজের পেছনে ধানখেত। যত দূর চোখ যায়। কার্তিকে সোনালি রঙ ধরে ধানে। ধানগাছও সোনালি হয়ে যায়। হাওয়ায় ঝমঝম করে বাজে ধানখেত। ফিঙের দল, ফড়িং ওড়াউড়ি করে। সিগারেট ধরেছে তারা। ধানখেতের আলে বসে খায়। স্টার, ক্যাপস্ট্যান। যদি পায় তবে পাতার বিড়িও। কপিল জোগাড় করে কোত্থেকে কোত্থেকে।

কী মনে হতো তখন? ধানখেতের আলেই দিন কেটে যাবে? নাকি দিন কাটার ভাবনা তখনো পায়নি। কখন দিন যায়, কখন রাত যায়, কে তখন হিসাব করে রাখে আর! আজব এক বয়স।

৫.জ্যাকব পাঠান, জ্যাকেরিন পাঠান বদলায়নি। জ্যাকব আবার ষণ্ডামি ধরেছে। মেথরপট্টির ধেনোও চালাচ্ছে। গলাগলি করে দুই ভাই খায়। ঘরে ফেরে টাউনের রাত টহল দিয়ে।

ধানখেতের আলে সেদিন সন্ধ্যা নামছিল, আর চাঁদ। পাতার বিড়ি জোগাড় হয়েছে। তারা টানছিল। দেখতে দেখতে আকাশে তারার হাট বসে গেল। ঝোপঝাড়ে জোনাকি মেয়েরা জ্বলতে-নিভতে শুরু করে দিল। মাগরিবের আজান হলো দূরের মসজিদে। ডানার শব্দে আকাশ ভরে দিয়ে উড়ে গেল কিছু সরালী। কপিল তরক্ষু বলল, ‘তোরা আর অনেক দিন আমাকে দেখবি না।’মানে কী এর? কোথায় যাবে সে?ঘুরে বেড়াবে। রশিদ মামুদ রিটায়ার করেছেন। বাপ-ছেলে এখন দুনিয়া ঘুরবে।’তোরা কবে যাবি?’ সহিদুল বলল।’কাল ভোরে।’‘কী! তুই আমাদের কিছু বলিসনি!’‘এই তো বললাম।’‘পরীক্ষা দিবি না?’‘না।’‘আর মাত্র তিন মাস ছিল পরীক্ষার।’‘পড়াশোনা আমাকে দিয়ে হবে না। যদি পড়ি কোথাও, নাহয় ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়ব। তোর আর আভার ছবি তুলব। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি। হা! হা! হা!’সেই কপিল! কপিল তরক্ষু। এত দিন পর!আজব! ইন্টারনেট ফেসবুকের এই যুগেও তাদের মধ্যে আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি।আজব!সত্যি এ কপিল তরক্ষু!

তারা অধিকাংশই বিবাহিত এখন। সহিদুল বিয়ে করেছে আভাকেই। ফুটফুটে দুটো মেয়ে তাদের হয়েছে। টাউনে এলে জ্যাকব মামা আর জ্যাকেরিন মামার ঘাড়ে চড়ে বেড়ায় তারা। বিষ্ণুপদও বিয়ে করেছে। তবে প্রেম-ট্রেম তার হয়নি। বরাবরের হ্যাড্ডি-লাজুক সে। ভয়ে কারোর প্রেমে কখনো পড়েনি। বলতে পারবে না, কিছু না। জিতেন চাঁদসীর মেয়ে সুতপা। বিলু পিসি ঘটকালি করেছে। ভালো করেছে। সুতপাকে নিয়ে যথেষ্ট সুখী বিষ্ণুপদ। বাচ্চাকাচ্চা তাদের এখনো হয়নি। নিয়ে নিতে হবে। বিনু পিসি বালবিধবা। পিতৃমাতৃহীন বিষ্ণুপদর সব। পিসি বলতে পিসি, মা বলতে মা। বিনু পিসি কয়েকবারই মুখঝামটা দিয়ে সুতপাকে বলেছেন, ‘ও মুখপুড়ির মুখপুড়ি, নাতি-নাতকুরের মুখ দেখা অন্তত একখান!’

হলুদ একটা হুডি পরে আছে কপিল তরক্ষু। মাথা ঢাকা না। জিনসের প্যান্ট, কেডস পরে আছে। বদলেছে কতটা? খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ রেখেছে। হাসিমুখে দেখছে বিষ্ণুপদকে। বয়স হলেও সেই একই চোখ-মুখ। হতচকিত বিস্মিত বিষ্ণুপদ প্রথম যে কথাটা বলল, ‘তুই কি বিয়ে করেছিস?’‘কীহ্! বিয়ে? হা হা হা! হা হা হা!’কপিল তরক্ষুর হাসি বুঝি আকাশের মেঘে উড়ে গেল। মেঘ ডাকল নাকি ডাকল না? কপিল তরক্ষু বিষ্ণুপদকে জাপটে ধরে বলল, ‘শালা বিষ্ণু, শালা পদো, বিষ্ণুপদ হতে পারলি না আর। হা! হা! হা! বিয়ে করেছি কিনা? হা! হা! হা! নারে আমি বিয়ে করি নাই। তবে আমার একটা মেয়ে আছে।’‘কী?’সহিদুল এখন এখানে থাকলে অষ্টম আশ্চর্য হতো নিশ্চয়। নাকি হতো না? এ যে কপিল তরক্ষু।’ছবি দেখবি? এই দেখ।’স্মার্টফোনে ছোট্ট একটা একটা মেয়ের ছবি দেখাল কপিল তরক্ষু। দুনিয়ার মায়া চোখে মেয়েটার। বিচিত্র একটা অনুভূতি হলো বিষ্ণুপদর। তার মনে হলো স্মার্টফোনের বাচ্চা মেয়েটাকে সে আগে কোথাও দেখেছে। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব। মেয়েটার চোখের মণি গাঢ় বাদামি।কপিল তরক্ষু বলল, আজ ভোরে সে টাউনে নেমেছে। নেকড়ের বন দেখতে চলে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত এই উদ্দেশ্য ছিল যে চমকে দেবে বিষ্ণুপদকে।

উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। বিষ্ণুপদ চমকেছে। ভীষণ চমকেছে।

৬.হাঁটা দিল তারা। নদী পার হবে। রশিদ মামুদ চাচা মারা গেছেন। তারা বাপ-ছেলে অনেক দেশ ঘুরেছে। ইনকা দেবতার মন্দির, জাটিংগা পাহাড়, অরোরা বোররিয়ালিস দেখেছে। কপিল বলল। বিষ্ণুপদ শুনল। এত দিনের গল্প, সহজে ফুরায়?

হঠাৎ তারা দেখল, নদীর ঘাটে তারা। হঠাৎ বৃষ্টি নামল আকাশ উজাড় করে। শোর উঠল আশপাশের দোকানপাট থেকে, ‘বাবু! ও বাবু! ও বাবু। বাবু!’

লাফ দিয়ে বিষ্ণুপদ তারা মিয়ার চায়ের দোকানে উঠল। সঙ্গে কপিল তরক্ষু। তারা মিয়া বলল, ‘আদাব বাবু। ভিজেন-ভুজেন নাই আল্লায় দিলে।’‘না তারা মিয়া।’ বিষ্ণুপদ হাসল।তারা মিয়া বলল, ‘বয়েন। ক্ষণে কমার না এই আইতন। কুটুমরে চিনলাম না?’দোকানে আর কাস্টমার নেই। তারা বসেছে দোকানের একমাত্র বেঞ্চটায়। কুটুম মানে তারা মিয়া কপিল তরক্ষুর কথা বলছে। বিষ্ণুপদ বলল, ‘আমার বন্ধু। রশিদ মামুদ চাচার কথা কি মনে আছে তারা মিয়া? ফরেস্টের রেঞ্জার? তার ছেলে।’‘অ। কুটুমের বাপেরে আমি চিনতাম। তাইন কেমন আছেন?’কপিল তরক্ষু বলল, ‘মারা গেছেন।’‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বিলাইর মতো হইলদা চোখ ছিল মানুষটার।’

আইতনের উতোরচাপানে দুপুরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। তারা মিয়া কুপি জ্বালাল। টিনের একটা বাক্সের আড়াল দিয়ে রাখল। কুপি তবুও শিখা কম্পমান থাকল। জুত করে তারা বসেছে। এতক্ষণে পেটের নাড়িভুঁড়ি সব জ্বলে উঠল বিষ্ণুপদর। ক্ষুধা। কপিল তরক্ষু কি দুপুরে কিছু খেয়েছে? তিনটা রুটিতে কিছু হবে দুজনের? তারা মিয়ার দোকানে সস্তা আটার বিস্কুট আছে। বিস্বাদ, চিবানো যাবে না। বিষ্ণুপদ বলল, ‘দুপুরে খেয়েছিস?’কপিল বলল, ‘সকাল থেকে খাইনি।’‘ক্ষুধা লাগেনি?’‘লাগেনি মানে! লিভারে উনত্রিশটা চিকবাম্প লাফাচ্ছে। আটার বিস্কুট খাবি?’‘আরে না! অল্প খাবার আছে সঙ্গে। ভাগ করে খেয়ে নিই আয়।’‘কী খাবার?’‘রুটি আর সবজি।’‘সুতপা বানিয়ে দেয়। হা! হা! হা! তুমি শালা টিফিনবক্স ঝোলায় নিয়ে এত দূর আনাগোনা করো! ভালো! দেখি, বের কর।’ঝোলা থেকে টিফিনবক্স বের করল বিষ্ণুপদ। তারা মিয়াকে বলল, ‘দুটো প্লেট দাও তো তারা মিয়া।’‘জি বাবু। জি।’তারা মিয়া দুটো প্লেট দিল। কলাই করা প্লেট। বহুযুগ আগের।টিফিনবক্স খুলে খুবই বোকা হতে হলো বিষ্ণুপদকে। এত রুটি কেন দিয়েছে সুতপা? ছয়টা রুটি। সবজিও তৎপরিমাণ। ভুলে দুইবার দিয়ে ফেলেছে সুতপা? তা-ই হবে। ভালো হয়েছে। কিন্তু এ রকম একটা ভুল সুতপার হওয়ার কথা না। কপিল তরক্ষু সঙ্গে না থাকলে এখন সুতপাকে কল দিত বিষ্ণুপদ।কল দিল সুতপাই, ‘বাবু মশাইয়ের মাস্টারি শেষ হয় নাই?’‘সেই কখন।’‘সেই কখন! বাবু মশাই এখন তাহলে কোথায়?’‘ঘাটে আটকা পড়েছি বৃষ্টিতে।’‘বৃষ্টি! ঘাটে! টাউনে তো ঝকঝকে রোদ। বাবু মশাই বানিয়ে কথা বলছেন কেন?’‘বানিয়ে কথা বলছি না। তুমি বৃষ্টির শব্দ পাচ্ছ না?’‘পাচ্ছি।’ বলে সুতপা হাসল।বিষ্ণুপদ বলল, ‘বিশ্বাস না করলে—।’‘কী?’‘আমার সঙ্গে একজন আছে। আশ্চর্য হয়ে যাবে দেখলে।’‘আমি শুধু আপনাকে দেখেই আশ্চর্য হতে চাই বাবু মশাই। আচ্ছা মানলাম ঘাটে বৃষ্টি। সে কি ধরবে না? ধরামাত্রই আপোনি নিজ গৃহে ফেরত আসিয়া পড়েন বাবু মশাই। হি হি হি। অ, রুটি খেয়েছেন?’‘এখন খাচ্ছি। এত রুটি—।’‘এত রুটি মানে? এত রুটি মানে? আমি কি নয়টা রুটি দিয়েছি? না ছয়টা রুটি দিয়েছি বাবু মশাইকে?’‘ছয়টা।’‘ছয়টা। হি হি হি। বাবু মশাই গাঁজা টেনেছেন। রেকর্ড আছে কিন্তু। তিনটা রুটিকে আপনি এখন ছয়টা রুটি দেখছেন তাহলে? ভালো। খুব ভালো। তিনটা রুটি খেয়ে ফেলেন আর তিনটা রুটি বৃষ্টিকে দিয়ে দেন। হি হি হি। ঘরে আসো আমার সোয়াচান পাখি, তিনটা-ছয়টার হিসাব আমি তোমাকে বোঝাচ্ছি। রাখি।’‘আরে শোনো—।’লাইন কেটে দিয়েছে সুতপা।কিছু হলো?কী করা আর।’বউ খবর নিল?’ কপিল তরক্ষু বলল।’হুঁ।’‘শি ইজ কেয়ারিং।’তা সত্যি। তিন সত্যি।রুটি সবজি শেষ করে বিষ্ণুপদ চা দিতে বলল তারা মিয়াকে। তারা মিয়ার বিখ্যাত ঝোলাগুড়ের চা। কপিল চুমুক দিয়ে বলল, ‘অমৃত। আরও দুই কাপ খাব।’বিষ্ণুপদ বলল, ‘তারা মিয়া, আরও তিন কাপ।’ সে-ও আরেক কাপ খাবে। তারা মিয়া বেজায় খুশি হলো। আকর্ণ দন্তরাজি শো করে বলল, ‘তারা মিয়ার ছা, মাইনষে একবার খাইলে আরেকবার ছায়।’

আইতন ধরছে না। ধরার নাম নাই। চায়ের কাপের চুমুক দিতে দিতেই ঘুমের ঢুলুনিতে ধরল বিষ্ণুপদকে। রুটি-সবজি ঘুম। আজব। এত ঘুম! তারা মিয়া আরও তিন কাপ চা দিল কি না দেখল না বিষ্ণুপদ, কপিল তরক্ষু কী বলছে শুনল না, ঘুমিয়ে পড়ল সে।

টাউনে ওদিকে রোদের দুপুর ফুরাল। বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামল। উঠানে দাঁড়িয়ে আশ্বিনের পূর্ণিমার মস্ত চাঁদ দেখল সুতপা। তুলসীতলার সন্ধ্যাবাতি দিয়ে কল দিল আবার বিষ্ণুপদকে। ফোন বন্ধ। নির্ঘাৎ সুতপা যা ভেবেছে, বাবু মশাই গঞ্জিকা সেবন করেছেন। বাবু মশাই! আসুক বাবাজি!

৭.’এই বিষ্ণু, এই পদো।’‘এই পদো, এই বিষ্ণু।’‘এই বিষ্ণু—।’বিষ্ণুপদ তাকাল এবং অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখল না। সে কোথায় আছে, তা-ও বুঝল না। কপিল তরক্ষু কি তাকে ডাকছিল? কপিল তরক্ষু কোথায়?’—এই পদো।’ কপিল তরক্ষু ডাকল।বিষ্ণুপদ বলল, ‘আমরা কোথায়?’কপিল তরক্ষু বলল, ‘ঘাটের দোকানে। তারা মিয়ার দোকান।’‘অ।’এতক্ষণে সব মনে পড়ল এবং বিষ্ণুপদর ঘুম কেটে গেল। ছি! ছি! ছি! এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে? কতক্ষণ ঘুমিয়েছে? কপিল তরক্ষুকে দেখা যাচ্ছে না কেন? এত অন্ধকার!’বৃষ্টি কখন ধরল?’ বিষ্ণুপদ বলল।’অনেকক্ষণ আগে।বিষ্ণুপদ বলল, ‘ছি! ছি! তুই আমাকে ডাকলি না কেন?’‘নেকড়ের বনের কথা মনে আছে তোর?’কী কথার মধ্যে কী কথা! বিষ্ণুপদ বলল, ‘আছে। কেন?’‘মহিলাকে মনে আছে?’‘আছে।’ চকিতে একটা কথা মনে পড়ল বিষ্ণুপদর। কপিল তরক্ষুর মেয়ের ছবি দেখে কেন এত চেনা মনে হয়েছিল তার। নেকড়ের বনের সেই মহিলার মতো মুখের ডৌল কপিল তরক্ষুর মেয়েটার। নাকি—?কপিল বলল, ‘আমার মা।’বিষ্ণুপদ বলল, ‘কী?’‘পিকনিক না, নেকড়ের বনে সেবার আমি আমার মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বাবা সে জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।’‘রশিদ মামুদ চাচা—।’‘নেকড়ে দেবতা।’ বলে কি কপিল তরক্ষু হাসল? বিষ্ণুপদ ভাবল, ছেলেমানুষি। স্বভাবমতো মজা করছে কপিল তরক্ষু। রশিদ মামুদ চাচাকে অবশ্য নেকড়ে দেবতা বলাই যায়। যে রকম ছিলেন দেখতে। কিন্তু নেকড়ের বনের সেই অপরূপা মহিলা? সত্যি কি মা কপিল তরক্ষুর? দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলেছিল তারা।দুর!বিষ্ণুপদ বলল, ‘এত অন্ধকার।’কপিল তরক্ষু বলল, ‘রাত হয়ে গেছে। বৃষ্টি ধরতেই তারা মিয়া দোকানের ঝাঁপ ফেলে চলে গেছে। চাইনিজ একটা টিপতালা দিয়ে গেছে। বের হওয়ার সময় ঝাপের শিকল আটকে মেরে দিতে হবে।’এত ঘটনা ঘটে গেছে! ছি! ছি! বিষ্ণুপদ বলল, ‘চল বের হই।’বিষ্ণুপদর পকেটে মোবাইল ফোন আছে। টর্চ আছে ফোনে। বিষ্ণুপদর মনেও পড়ল না। কপিল তরক্ষুরও কি তার স্মার্টফোনের কথা মনে পড়ল না? অন্ধকারে ঝাপ উঠিয়ে তারা মিয়ার দোকান ছাড়ল। ঝাপের শিকল আটকে টিপতালা মেরে দিল কপিল তরক্ষু। বাইরেও অন্ধকার। যম অন্ধকার। ঘাটে এমন আর কখনো দেখেনি বিষ্ণুপদ। খেয়া-পারাপার নিশ্চয় বন্ধ হয়ে গেছে। তারা যদি নৌকা না পায়। বিপদ হয়ে যাবে। তারা মিয়ার দোকানের ঝাপ পরে বন্ধ করতে পারত কপিল তরক্ষু। নেকড়ে দেবতার ছেলে। তার মা তাহলে নেকড়ে দেবী। সে নেকড়ে। হা! হা! হা! বদলায়নি কপিল তরক্ষু।ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।কপিল তরক্ষু বলল, ‘আমার হাত ধর।’অন্ধের মতো বিষ্ণুপদ হাত ধরল কপিল তরক্ষু। কী এটা? না, কিছু না। কপিল তরক্ষু বলল, ‘সাবধানে। ঘাটে একটা ডিঙি বাঁধা আছে দেখেছি। নিয়ে যাব।’‘কার ডিঙি?’ বিষ্ণুপদ বলল।’নেকড়ে দেবতার।’ বলে কপিল তরক্ষু হাসল।অভ্যাস আছে এমন জল-কাদায় হেঁটে। অন্ধকারেও নিরাপদে তারা ডিঙিতে অবতরণ করতে পারল। এখনো তার হাত ধরে আছে কপিল তরক্ষু, বিষ্ণুপদর হঠাৎ মনে হলো রোমশ, কপিল তরক্ষুর হাত কি কিছু বেশি রোমশ? দুর!কপিল তরক্ষু বলল, ‘বস।’হাত ছেড়ে দিল।বিষ্ণুপদ বসল ডিঙিতে। কার ডিঙি এটা? পাড়ের কারও হবে। ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া যাবে সকালে। অন্ধকারে চোখ সয়নি এখনো। আশ্বিন মাসে নদীর পানি ক্রমে নিচে নেমে যেতে থাকে। নদী মনে হয় ছোট হয়ে যায়।

নেকড়ে দেবী মা তাহলে কপিল তরক্ষুর! আশ্চর্য, প্রায় চার বছর তো তারা ছিল একসঙ্গে, পড়েছে, ঘুরেছে-ফিরেছে, একবারও কখনো তার মায়ের কথা কিছু বলেনি কপিল তরক্ষু। রশিদ মামুদ চাচাও কিছু বলেননি। সহিদুল বা বিষ্ণুপদ বা বন্ধুদের আর কেউ, তারাও কপিল তরক্ষুর মা সম্পর্কে কখনো কোনো কৌতূহল দেখায়নি। কেন? কপিল তরক্ষু ভুলিয়ে রেখেছিল তাদের। কপিল তরক্ষু টাউনের কোনো মেয়ের প্রেমেও পড়েনি কখনো। পড়লে বলত। দূর! এসব কী ভাবছে বিষ্ণুপদ?বইঠা টান দিল কপিল তরক্ষু। আশপাশে কিসের এত ছপছপ! ডিঙির সঙ্গে কারা সাঁতার কাটছে নদীতে। বিষ্ণুপদ বলল, ‘কপিল।’কপিল তরক্ষু বলল, ‘বল।’‘কী হয়েছে?’‘নেকড়েরা তাদের বন ফিরে পেয়েছে।’না-মানুষি গলা হয়ে গেছে কপিল তরক্ষুর। মানুষের মতো না। ফ্যাঁসফেঁসে কী রকম। বিষ্ণুপদ বলল, ‘কী? কী হয়েছে?’‘নদী পার হয়ে টাউনে যাচ্ছে নেকড়েরা।’‘সাঁতার কেটে যাচ্ছে?’‘হুঁ।’হুঁ করল কপিল তরক্ষু? নাকি ফ্যাঁস করে উঠল?কিছু মেঘ সরল আকাশের। কিছু জোছনা চরাচরে পড়ল। নদীতে কী? কারা সাঁতার কাঁটছে? অসংখ্য জানোয়ার। অসংখ্য নেকড়ে? জোছনা তাদের চোখের মণিতে জ্বলছে। আইস ব্লু, সবুজ, গাঢ় বাদামি, উজ্জ্বল হলুদ চোখের মণি তাদের।কপিল তরক্ষু বইঠা টানছে, কপিল তরক্ষু কি সত্যি—?না। ক্রমশ আর একটা কিছু হয়ে যাচ্ছে কপিল তরক্ষু।বিষ্ণুপদ আতংকিত হলো?না।

মেঘ আরও একটু সরল। চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে জোছনা। বিষ্ণুপদ তার হাত দুটো দেখল। এত রোমশ! আঙুল, নখের গড়নও বদলাচ্ছে। পায়ের গড়ন, শরীরের গড়ন, দ্রুত বদলাচ্ছে। আজব কিছু দৃশ্য মনে পড়ছে কবেকার। তারা দৌড়াচ্ছে, তারা শিকার করছে, তারা ঘুমিয়ে আছে ঘাসের জঙ্গলে। তারা কারা? বিষ্ণুপদ দাঁড়াল ডিঙিতে। ঘুরে ওপার দেখল। ঘাট ঘরদোর সব উধাও ওপারের। নক্ষত্রের আকাশের সঙ্গে লেপ্টে আছে জঙ্গল। নেকড়ের বন। বিষ্ণুপদ সে নেই আর এখন। তরক্ষু সে-ও।

চাঁদ দেখল এবং ডেকে উঠল সে, ‘হু-উ-উ-! হু-উ-উ-উ-উ-উ…!’