মালিহা আজ নিজেই রান্না করেছে। আস্ত রসুন ও পেঁয়াজ দিয়ে গরুর কষা মাংস, ডাল আর পালংশাক। কাটাকুটির কাজটা কেবল বুয়াকে দিয়ে করিয়েছে। শুক্রবার সব সময় ছুটি মেলে না। তবে আজ নির্ভেজাল ছুটির অবসর। রিয়াদ নামাজ শেষ করে এসেই খেতে বসেছে। লাল ঝোলের ওপর আস্ত গোল পেঁয়াজ–রসুন উঁকি দিচ্ছে। গন্ধটাও তেমন। রিয়াদ মুখে দিয়েই আহা-উঁহু শুরু করেছে।
ফার্স্ট ক্লাস, কোথায় শিখলে, সিদ্দিকা কবীর?
মালিহা হাসে। সিক্রেট, নিজেই শিখেছি।
খাবার ঘরের জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। জানালার একটা পাল্লা মৃদু ছন্দে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে এপাশ-ওপাশ করছে। কবজা ঢিলে হওয়া পুরোনো কাঠের খাটের নড়াচড়ার মতো অনেকটা। একটু খেয়াল করে শুনলে কান গরম হয়ে ওঠে।
রিয়াদ খেতে খেতে চুপ হয়ে যায়। শব্দটা যে কানে নিল, সেটা বোঝানোর জন্য সে মালিহার দিকে তাকায়।
মানে কী! মালিহা ঝাঁজিয়ে ওঠে। খাও, অসভ্য!
চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জের আয়শা ম্যানশন নামের দোতলা হলুদ রঙের বাড়িটা দেখলে যে কেউ পুরোনো সরকারি কোয়ার্টার বলে ভুল করতে পারে। প্রশস্ত বারান্দা, ঘরের মাঝে বড় পিলার, মার্বেল পাথরের মোজাইক করা মেঝে—সবকিছুই এককালের আভিজাত্যের স্বাক্ষর। তবে ঘরের দেয়ালে দু–একটা চিড় আর আগাছা ছাওয়া লন বর্তমানের দীনতার প্রতিনিধি। তবু বাড়িটায় আলো-হাওয়ার ছড়াছড়ি চারদিকে। দখিনের বড় জানালা আর বারান্দা দিয়ে আসা ঝলমলে সূর্যের আলোর গায়ে ধুলার রেণু নানা ছন্দে নেচে বেড়ায় সারা দিন।
পুরোনো হলেও খোলামেলা বাড়িটা মালিহার ভীষণ পছন্দ। নতুন অ্যাপার্টমেন্টের সমান ভাড়া হলেও সে রিয়াদকে জোর করেছিল এই বাড়ির তিন রুমের দোতলা ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিতে। জীবনে চাকচিক্যের চেয়েও আলো-হাওয়া অনেক বেশি জরুরি বলে মনে হয়েছিল তার।
এই কারণে হুট করে পানি বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা পুরোনো সুইচবোর্ড আর প্লাগে বিদ্যুতের কানেকশন না আসার মতো উটকো ঝামেলা মেনে নিতে হয়েছে। নড়বড়ে কাঠের জানালা, সেকেলে ছিটকিনি, লোহার গোল কড়া পাল্টানো যায়নি বাড়িওয়ালাকে বলেও।
বাড়িওয়ালা হামিদ উল্লাহ শহরের পুরোনো খানদানি বংশের লোক। আছদগঞ্জে একসময় তার বাবার আতরের ব্যবসা ছিল। সেই দোকানটা বিক্রি করেছেন দুই দশক আগে। দোকান বিক্রির টাকায় বড় ছেলেকে লন্ডনে পড়তে পাঠিয়েছেন। তার লেজ ধরে ছোট ছেলেও সেখানে গেছে। দুজনের কেউই আর ফেরেনি। দু-চার বছরে একবার এলেও সাত দিনের বেশি কেউ থাকে না। হামিদ চাচা, চাচি আর দারোয়ান ইসলাম—এই তিনজনই বাড়িটাকে আগলে রেখেছে।
খাবার ঘরের দক্ষিণমুখী রং উঠে যাওয়া হালকা নীল জানালার জায়গায় নিজ খরচে থাই অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রেম দেওয়া কাচের বড় স্লাইডিং উইন্ডো লাগানোর কথা ভেবেছে মালিহা। কিন্তু হামিদ উল্লাহকে রাজি করাতে পারেনি।
‘তোঁয়ারা আজিয়া আছ, কালিয়া নাই। বাড়ি ইবার ফিছে টেঁয়া খরস গরি তোঁয়ারার কি লাভ? যেনে চলের হেনে চলক।’
তবে মরচে পড়া কবজার কারণে দখিনের জানালাটাকে তার অনেক সময় জীবন্ত মনে হয়। দিনের নানা সময়ে নানা ছন্দে দুলতে থাকে সে। জানালার এই ক্যাঁচক্যাঁচানি কখনো গান, কখনো করুণ কান্না আবার কখনো হালকা তরল কথার মতো মনে হয় মালিহার। কখনো কখনো বন্ধ থাকলেও বাইরের হালকা বাতাসে অদ্ভুত শব্দ হয় জানালা থেকে। সেই শব্দ অনেকটা অস্ফুট কথার মতো। দেহ থেকে বেরিয়ে মুখের ভেতরে এসেও যেন অনুচ্চারিত থেকে গেছে।
দুপুরের বেয়াড়া বাতাসে দখিনের জানালাটা ঘরময় কান গরম করা শব্দ ছড়িয়ে দিয়ে এখন চুপ হয়ে আছে। জানালার বাইরের আমগাছের ডাল চিরে তেরছা রোদ এসে পড়ছে খাবার ঘরের বেসিনের আয়নায়। আলোর রেখার চারপাশে পাতার নানা তলের ছায়ার কারুকাজ। সেদিকে তাকিয়ে কি এক ভাবনায় ডুবে গিয়ে মালিহা ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করতে থাকে। তার মনে কোহেনের কোনো গান হয়তো গুঞ্জরিত হয়ে একটা ফড়িংয়ের মতো উড়ে বেড়ায়। সে গুনগুন করে ‘অ্যান্ড জেসাস ওয়াজ এ সেইলর হোয়েন হি ওয়াকড আপন দা ওয়াটার/ অ্যান্ড হি স্পেন্ট আ লং টাইম ওয়াচিং ফ্রম হিজ লোনলি উডেন টাওয়ার’—এই কলিগুলো গাইতে থাকে কি না বোঝা যায় না।
ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটার আরাম যেভাবে ভঙ্গ হয় ভেজা মাটি বা পচে ওঠা পাতার স্পর্শে, ঠিক সেভাবে মালিহা রিয়াদের স্পর্শ অনুভব করে তার পেছনে। অভ্যস্ত শরীর থেকে দূরত্ব রচনা করতে গিয়েও সে পারে না। জানালার বাইরে আমগাছটার ডালে একটা কাঠবিড়ালি দুহাতে মুখ ঘষতে ঘষতে একবার যেন এই দিকেই তাকাল। মালিহার কি চোখাচোখি হলো তার সঙ্গে? কাঠের মিনার থেকে স্বয়ং যিশু উঁকি দিয়ে গেল কি?
মালিহা রিয়াদ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ছোটখাটো হালকা-পাতলা মেয়েটিকে দেখে বোঝা সম্ভব না তার শক্তির জায়গাটা কোথায়? কিন্তু রিয়াদ জানে লড়াইয়ের জন্য শারীরিক শক্তির চেয়েও প্রয়োজন সাহস। আর সেটা মালিহার ভালো রকমেরই আছে। সে কারণে বউকে সে ভয়ও পায়।
প্রায় ছয় ফুট লম্বা রিয়াদের মধ্যে একটা বন্য ভাব আছে। প্রথম পরিচয়ের পর প্রথম চুম্বনে পৌঁছাতে বড়জোর দুদিন সময় নিয়েছিল সে। সুদর্শন টগবগে রিয়াদকে দেখে যেটাকে প্রেম বলে, শুরুতে তেমন অনুভূতি হয়নি তার। বরং অন্য কারও সিগারেট থেকে আসা ধোঁয়ার মতো অজান্তেই ভালো লাগার অনুভূতিটা ভেতরে টেনে নিয়েছে সে। সেই দিনটির কথা মালিহা ভুলতে পারে না। দুজন কথা বলতে বলতে একসঙ্গে উঠেছে লিফটে। অথচ রিয়াদও কেন তার অফিসের লিফটে উঠল, সেই প্রশ্ন মনে আসেনি তখনো। লিফট চলা শুরু করতেই রিয়াদ সজোরে জাপটে ধরেছিল তাকে। শক্ত হাত, বুক, ঠোঁট সবকিছু দিয়ে যেন পিষে ফেলতে চাইছিল মালিহাকে। যেমন আকস্মিকভাবে ঘটনাটার শুরু ঠিক সেভাবেই শেষ করেছিল রিয়াদ।
হেসে বলেছিল, একটা ট্রিট দিলাম।
মালিহা তখন অবশ। সপাটে চড় দেওয়ার ইচ্ছাটাকে সে জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। আসলে জীবনের প্রথম এই জবরদস্তিটা ভালোই লেগেছিল তার। মনে হয়েছিল, রিয়াদ মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একটা পুরুষ। এমন নিখাদ পুরুষ সে দেখেনি আগে।
ফেব্রুয়ারি মাস প্রায় শেষের দিকে। বসন্তের দূরতম লক্ষণও তবু কোথাও নেই। কেবল দূর থেকে একটা কোকিলের প্রলম্বিত ডাক ঋতু বদলের ক্ষণ ঘোষণা করছে যেন। রিয়াদ চা নিয়ে সেদিকে কান পেতে একবার মালিহাকে দেখে। টেবিল গুছিয়ে সে এখন বাসি পেপারে চোখ বোলাচ্ছে। পাঁচ বছর ধরে সে দেখছে, কোনো না কোনো কাজে মালিহা নিজেকে ব্যস্ত রাখে। হয় পড়া, না হয় ল্যাপটপে লেখালেখির কাজ নয়তো ঘর গোছানোর কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে। কোনো অলস ভাবনায় তাকে ডুবে যেতে দেখেনি কখনো। অথচ কবিতা, সিনেমা বা সাহিত্যের জগতের মধ্যেই বসবাস মালিহার। হয়তো মালিহা ভাবতে ভয় পায়। কিংবা অতীতের কোনো স্মৃতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়। রায়হানের কথা মনে পড়ে তার? মালিহার কাছে শুনতে শুনতে দৃশ্যটা রিয়াদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে একসময়। ‘সুজানের’ সুরে সুরে দুলছে রায়হানের ঝুলন্ত দেহ। মালিহাই বলেছিল তাকে, রায়হান তাকে ‘সুজান’ বলে ডাকত। এ জন্য কোহেন বাজানো যাবে না—এমন অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে এ বাড়িতে। তবু রিয়াদ জানে গানটা নিঃশব্দে মালিহার মনের কোনো গভীরে বেজেই চলেছে। মাঝেমধ্যে সেটা বাইরেও বেরিয়ে আসে। তখন রিয়াদের কিছুই করার থাকে না।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। চিন্তার সূত্রটা ছুটে যায় রিয়াদের।
হ্যালো!
রিয়াদ এগিয়ে এসে ফোনটা একরকম ছিনিয়ে নেয়।
কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেবল শোঁ শোঁ শব্দ।
সে মালিহাকে ফোনটা ফিরিয়ে দেয় আবার। সে জানে, মালিহা ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে থাকবে। ধরে থাকতে থাকতে তার চোখ জলে ভরে উঠবে। তারপর বলবে, শুনতে পাচ্ছ সেই সুর, সেই গান।
রিয়াদ অভিনয় করে যায় প্রতিবার। বলে, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।
সে অনেকবার ভেবেছে বলবে, মালিহা নিজেই তার আরেকটা মুঠোফোন থেকে এই নম্বরে কল করে। এই ফোনে সেই নম্বরটা আননোন বলে সেভ করা। কারণ রিয়াদ দেখেছে, প্রতিবার আরেকটা ফোনও মালিহার হাতে কিংবা পাশেই রাখা থাকে। প্রতিবার রিয়াদকে ফোনটা নিতে হয় একবারের জন্য, মিথ্যা বা বিভ্রমের ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য। তারপর ফোনটা আবার মালিহাকে ফিরিয়ে দিয়ে বাকি অংশটুকু শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে সে।
রিয়াদের ইচ্ছে হয় সত্যি কথাটা সে বলে দেয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হবে বলে তার মনে হয় না।
একবার মালিহাই তাকে বলেছিল, তুমি হয়তো ভাবছ, ফোনটা আমিই আমাকে করছি। আর মিউজিক শুনতে না পেয়েও তুমি শোনার ভান করছ। আসলে সেটা তোমার শুনতে পাওয়ার কথা নয়। ওই সুরটা কেবল আমার জন্যই বাজে।
দুপুরের সুরটা কেটে গেছে। স্তব্ধ জানালার বাইরে বিকেলের মরা রোদ লুটিয়ে পড়েছে আমগাছটার নিচে। দারোয়ান ইসলাম নিয়ম করে আঙিনার ফুল গাছে পানি দেওয়া শেষ করেছে কিছুক্ষণ হলো। মালিহা ছাদে দেওয়া কাপড় এনে গুছিয়ে রাখতে রাখতে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুটিনমাফিক কাজটা হয়নি তার। ফোনকলটা সব ভেস্তে দিল। একটা সুরের জায়গায় অন্য একটা সুর চড়ে বসেছে। অথচ রিয়াদ প্রথম দিকে জোর করত বলে, সবকিছু সহজ হয়ে আসছিল। কিন্তু এই কয় বছরে সে বদলে গেছে অনেকটা। আগের মতো বন্য জানোয়ার মনে হয় না তাকে। লিফটের সেই দিনটার পর মালিহা অনেক ভেবেছে। প্রশ্ন করে উত্তর পায়নি, আসলে রায়হানের সমস্যা কোথায় ছিল? যে দূরত্বটাকে অনতিক্রম্য ভেবেছিল রায়হান, কত সহজে সেটা অতিক্রম করে গেল রিয়াদ। এই জবরদস্তির এক শতাংশও যদি রায়হানের থাকত তবে হয়তো মরতে হতো না তাকে। কিন্তু মালিহার কী করার ছিল? নিজেকে অপরাধী ভাবার মতো কোনো সম্পর্কে পৌঁছাতে পারেনি সে। লিফটে ওঠার আগে ওই দিন এসব কথাই বলছিল সে রিয়াদকে।
সেদিন ঘরে এসে স্নানঘরে ঢুকে মালিহা প্রথমবারের মতো নগ্ন হয়ে নিজেকে ভালো করে দেখেছিল। অবাক হয়ে লক্ষ করেছিল, তার হালকা গোলাপি দুই স্তনবৃন্তের পাশে অসংখ্য তিলের মতো কালো কালো বিন্দু। ভালো করে দেখলে মনে হয় কদম ফুল। রায়হানের দিকে তাকিয়ে তার কখনো মনে হয়নি, সে এই ফুলের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য উন্মুখ। কিন্তু রিয়াদকে দেখে মনে হয়েছিল। আর সে কারণে অবশ হয়ে গিয়েছিল সারা শরীর? আসলে প্রেমকে হয়তো মানবিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সে জানে না, এটা নিছক শরীরকে জাগিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ব্যাপার কি না! আর এই সত্য নিজের কাছ থেকে আড়াল করতেই কি নানা মহিমার আশ্রয় নেয় লোকজন?
রিয়াদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। মালিহা আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখে। নিস্তব্ধতার নদীর বুকে দূর থেকে আসা অস্ফুট কোলাহল নিঃসঙ্গ শুশুকের মতো লাফিয়ে ওঠে। রিয়াদ কি কিছু শুনতে চেষ্টা করে? সে মালিহার ডাকে সাড়া দেয় না। হঠাৎ বাতাসে নড়ে ওঠে জানালাটা। মালিহা আশ্চর্য হয়। কোহেনের সুজানের সুর। ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট সেই সুরে ওঠানামা করছে জানালার ক্যাঁচক্যাঁচানি।