রাজধানী ঢাকার খুব বাজে এক কোণে ডাক্তার তানিমুল তানহার চেম্বার। গলিতে ঢোকার মুখেই গোটা কয়েক কুঁড়ে নিয়ে ছোট একটা বস্তি, উপচানো নর্দমা। নাকে রুমাল চেপে জায়গাটাকে পাশ কাটিয়ে এলেন এনামুল কারিম। কাল রাতে রংপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছেছেন, আজ বিকেল পাঁচটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে অটোয় চড়ে গ্রিন রোডের মূল রাস্তায় থেমেছেন, এই মুহূর্তে সরু সরু গলির ভেতর ঢুকে হাতে লেখা ডাক্তার তানহার ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে ঘেমে গোসল। কারিমকে জানানো হয়েছে বন্ধ্যাত্ব দূর করতে অবিশ্বাস্য সফলতা পাওয়ায় সারা দেশে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ডাক্তার তানহা। কারিম সাহেবের বয়স পঁয়ত্রিশ। তাঁর বিয়ের বয়স দশ হলেও আজ পর্যন্ত সন্তান পাবার কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না।
ওয়েটিং রুমটাও এলাকার মতো অসুন্দর। দেয়ালে যতটা প্লাস্টার আছে, তার চেয়ে বেশি নেই। চেয়ারের গদি ছেঁড়া নয়, তবে রং আন্দাজ করা মুশকিল। একবার চোখ বোলালেই বলে দেওয়া যায় পসার জমাতে পারেননি এমন কোনো ডাক্তারের চেম্বার এটা। ডেস্কে থাকা নেমপ্লেট দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল, না, তিনি ভুল জায়গায় চলে আসেননি। হতে পারে ইনি উদাসীন টাইপের মানুষ, কে কী ভাবল তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই।
কথা বলবেন এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না—না নার্স, না অ্যাটেনডেন্ট। শুধু তেরো কি চৌদ্দ বছরের এক ছেলে, ব্যান্ডেজ করা একটা হাত ঝুলিয়ে বাঁধা।
‘ডাক্তার সাহেব কি আছেন?’ তাকেই জিজ্ঞেস করতে হলো।
‘বেল বাজান।’
ডেস্কের ওপর একটা বেল রয়েছে, এই প্রথম দেখতে পেলেন কারিম। বাজালেন সেটা। আধ মিনিট পর অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বাড়ির ভেতর দিক থেকে সাদা অ্যাপ্রন পরা এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, তাঁর সঙ্গে ঢুকল এক শিশুর কানের পর্দা ফাটানো চিৎকার, বলা বাহুল্য যে চিৎকার তৈরির রক্ত-মাংসের যন্ত্রসহ। আবার বন্ধ করে দিলেন দরজা। ‘সত্যি দুঃখিত’, বললেন তিনি। ‘বাচ্চাটার শরীর ভালো না। অফিস আর ওর কাজে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে আমাকে। বলুন, আপনার কী দরকার বলুন।’
‘আপনিই কি মিসেস তানিমুল তানহা?’
‘জি।’
‘কাল রাতে আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে’, বললেন কারিম।
‘ও, হ্যাঁ’, বললেন মহিলা। ‘আপনি নিজের এবং স্ত্রীর জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন।’ একটা খাতা খুললেন, চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘মিস্টার এবং মিসেস এনামুল কারিম?’
‘জি। আমার স্ত্রী শপিং সেরে চলে আসবেন। আমি প্রথমে দেখাব।’
‘এরপর তুমি যাবে, বাবা’, কিশোর ছেলেটাকে বললেন মিসেস তানহা, প্রায় চেঁচিয়ে। দেরাজ থেকে একটা খালি ফর্ম বের করলেন, এক হাতে কাঁধে আটকে রাখা শিশুর কান্নার বিকট শব্দ শুনতে না পাবার ভান করছেন। ফর্মের এক জায়গায় কারিম সাহেবের পুরো নাম লিখলেন। ‘এই ঝামেলা, মানে ওর কান্নাটা, আপনাকে মাফ করতে হবে।’
একটু হাসার চেষ্টা করলেন কারিম। ‘আমার কানে’, বললেন তিনি, ‘ওটা দুনিয়ার সবচেয়ে মধুর শব্দ।’
মিসেস তানহার মুখে ক্লান্ত হাসি। ‘তাই যদি হয়, তাহলে একদম ঠিক জায়গায় চলে এসেছেন।’
‘আপনার ছেলেমেয়ে কজন?’
‘চারজন। এখন পর্যন্ত।’
‘আপনারা খুব ভাগ্যবান।’ দীর্ঘশ্বাস চাপলেন কারিম। ‘বুঝতেই পারছেন, আমাদের কোনো বাচ্চা নেই।’
‘আই অ্যাম সো সরি।’
‘সে জন্যই আপনার ডাক্তার স্বামীর কাছে আসা।’
‘ও।’ বাচ্চার পিঠে হালকা চাপড় মারছেন মহিলা।
‘ডাক্তার দেখাতে আমরা অনেক দূর, সেই রংপুর থেকে আসছি।’
‘রংপুর?’ হতভম্ব দেখাল মিসেস তানহাকে। ‘আপনারা বন্ধ্যাত্বের কারণ জানতে রংপুর থেকে এখানে চলে এসেছেন? মানে?’
‘মানে ওখানেও আপনার স্বামীর খুব নাম ছড়িয়েছে যে।’
মিসেস তানহাকে তারপরও এত বেশি হতচকিত দেখাচ্ছে, কারিম সাহেব বাধ্য হয়ে জানতে চাইলেন, ‘এই একই নামে অন্য কোনো ডাক্তার আছেন নাকি?’
মিসেস তানহা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না, আপনি ঠিকানা ভুল করেননি। দয়া করে আমাকে বলবেন, কার সুপারিশে এখানে এসেছেন?’
‘আমার স্ত্রী বহু মানুষের মুখে ডাক্তার তানহা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছেন…’
‘ও।’ মহিলার ভ্রুর ভাঁজ থেকেই যাচ্ছে। ‘আচ্ছা।’
পেছনে এক কাতর বৃদ্ধা রোগী নিয়ে ডাক্তার তানিমুল তানহা নিজেই এবার বেরিয়ে এলেন ওয়েটিং রুমে। ভদ্রলোক সুদর্শন, দাঁত আর ত্বক ঝকঝক করছে। তবে তাঁর চেহারার বিব্রত একটা ভাব আছে, কে জানে সেটা হয়তো এই পরিবেশের জন্যই।
বৃদ্ধা রোগীকে দরজার বাইরে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফিরে এলেন ডাক্তার সাহেব।
‘তান…’ তাঁর স্ত্রী বললেন
‘হুম?’
‘এই ভদ্রলোক’, বললেন মিসেস, কারিম সাহেবকে দেখিয়ে, ‘আর তাঁর স্ত্রী সেই রংপুর থেকে তোমাকে দেখাতে এসেছেন।’ তানহার কাছে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে নিয়ে কারও রংপুর থেকে ঢাকায় চলে আসাটা একদমই স্বাভাবিক বলে মানতে পারছেন না মহিলা, ভাবছেন কোথাও বড় কোনো ভুল–বোঝাবুঝি হচ্ছে।
‘কী? রংপুর?’ নিজের কালো ভ্রুর কোণ স্পর্শ করলেন ডাক্তার। ‘রংপুর থেকে রোগী এসেছে আমার…আমার কাছে?’
‘আমি শুনেছি সারা দেশ থেকে আপনার কাছে রোগীরা আসে’, বললেন কারিম সাহেব।
‘এ কথা আপনাকে কে বলেছে?’
‘আমার স্ত্রী।’
‘তিনি আমাকে চেনেন?’ জানতে চাইলেন ডাক্তার তানহা।
‘না’, বললেন কারিম। ‘তিনি শুধু আপনার সম্পর্কে শুনেছেন।’
‘কার কাছ থেকে?’
‘সেটা কী করে বলব। মেয়ে-মহিলারা সারাক্ষণ কথা বলছেন।’
‘শুনতে বেশ মিষ্টি লাগল’, ডাক্তার তানহা বললেন। ‘তবে আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন আমি সাধারণ একজন ডাক্তার, প্রতিবেশীদের চিকিৎসা করি। আমি নিজেকে কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করি না, এমন ভানও করি না যে আমার নাম শুনে দূর থেকে কোনো রোগী আমাকে কখনো দেখাতে এসেছে।’
‘তাহলে আমি ক্ষমা চাই’, বললেন কারিম সাহেব। ‘এটা কীভাবে ঘটল আমার জানা নেই।’
‘রংপুর?’
‘জি।’
‘শহরে?’
মাথা নাড়লেন কারিম সাহেব। ‘গঙ্গাচড়া।’
‘জায়গাটা রংপুর শহর হলেও ধাঁধার উত্তর মিলত না’, ডাক্তার বললেন। ‘অনেক বছর আগে রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলাম, তবে ওখানে আমি কখনো প্র্যাকটিস করিনি।’
‘আমার স্ত্রী ওখানে ছাত্রী ছিলেন, নার্সিংয়ে’, বললেন কারিম।
‘ও, তাই নাকি?’ ডাক্তার তানহার মনে হলো এখান থেকে একটা সূত্র পাওয়া যেতে পারে। তবে সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ‘কিন্তু তিনি আমাকে চিনতেন না।’
‘না।’
ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকালেন। ‘রহস্য থেকেই যাচ্ছে’, বললেন। ‘এত দূর থেকে এসেছেন…আমি যদি কিছু করতে পারি…’
‘ওঁদের বাচ্চাকাচ্চা নেই’, ডাক্তারের স্ত্রী বললেন। ‘মানে, হচ্ছে না।’
‘এখানে আসার আগে নিশ্চয়ই আপনারা বিশেষজ্ঞ অনেক…’
‘না ’, ডাক্তারকে থামিয়ে দিয়ে বললেন কারিম সাহেব। ‘এমনকি আমরা পারিবারিক ডাক্তারকেও বিষয়টা জানাইনি।’
ডাক্তার এক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর জানতে চাইলেন, ‘জানতে পারি, কেন?’
‘আপনি বরং আমার স্ত্রী এলে প্রশ্নটা তাঁকেই করুন’, বললেন কারিম সাহেব। ‘বহু বছর ধরে তাঁকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। তিনি যে শুধু যাবেন না, তা নয়, আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন আমিও যাতে না যাই।’
‘এর মধ্যে কি ধর্মীয় কোনো?’
‘জি না। তিনি সংস্কারমুক্ত মানুষ।’
ডাক্তার মাথা চুলকাচ্ছেন। ‘অথচ ভদ্রমহিলা আমাকে দেখাতে রাজি হয়েছেন এটা ধরে নিয়ে যে আমি একজন বিশেষজ্ঞ।’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, দেখা যাক। এই ছেলেটা চলে যাবার পর আপনারা আসুন চেম্বারে’, বলে ভেতরে চলে গেলেন ডাক্তার তানহা।
দশ মিনিট পর ছেলেটা চলে যেতে কারিম সাহেবকে চেম্বারে ডেকে নিলেন ডাক্তার। তাঁর ডেস্কে খোলা একটা ডাইরেক্টরি দেখা যাচ্ছে। তিনি সেটার ব্যাখ্যা দিলেন। ‘আমার সঙ্গে সামান্যতম মিল আছে এমন কাউকে পাওয়া যায় কি না খুঁজছি, যিনি আপনাদের মতো কেস নিয়ে কাজ করে সত্যি সত্যি নাম করেছেন।’
‘কপাল খুলল?’
‘এখানে একজন ডাক্তার তাসিমুল রয়েছেন, যিনি সাইকিয়াট্রিক অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে চিকিৎসা করে সাফল্য পেয়েছেন। তাঁর নামটা আমার সঙ্গে একটু মেলে।’
‘দূর, না, একদমই মেলে না। আমার স্ত্রী বলেছেন আমাদের ঢাকায় যেতে হবে, দেখা করতে হবে ডাক্তার তা-নি-মু-ল তা-ন-হা-র সঙ্গে। আপনার নাম এবং নম্বর মিলিয়ে কাল আমি ল্যান্ডফোনে কল করেছি। নন্দিতা আসুক, তিনি আরও ভালো বলতে পারবেন…’
‘নন্দিতা?’ বললেন ডাক্তার তানহা, মাথাটা একদিকে কাত করে।
‘কী?’ প্রশ্ন করলেন কারিম সাহেব।
‘নন্দিতা? আপনি বললেন আপনার স্ত্রীর নাম নন্দিতা?’ জানতে চাইলেন ডাক্তার তানহা।
‘আমি তাই বলেছি নাকি?’ কারিম বিব্রত।
‘সে রকমই তো শুনলাম’, বললেন ডাক্তার।
কাঁধ ঝাঁকালেন কারিম। ‘এখানে আমাকে দিয়ে আরেকটা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেওয়া হয়েছে’, বললেন তিনি। ‘তাঁর নামটা গোপন রাখতে হবে।’
‘ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’
‘আপনি কেন, দুনিয়ার কেউ বুঝবে না’, বললেন কারিম, তাঁর চেহারায় হঠাৎ করে ক্লান্তি আর হতাশার ছাপ ফুটল। ‘আপনি যদি জানতেন একজন ডাক্তার দেখানোর জন্য গত দুবছর তাঁর সঙ্গে আমাকে কী লড়াইটাই না লড়তে হয়েছে, বলেছি অন্তত জানতে চেষ্টা করি কেন আমাদের…’ কথা শেষ করতে পারলেন না, পরনের কাপড় খুলতে শুরু করলেন। রীতিমতো লালচে হয়ে উঠেছে তাঁর ফরসা চেহারা।
‘আমি যদি জানতাম?’ ডাক্তার তানহাও খানিকটা অস্থিরতা অনুভব করছেন।
‘তাঁকে আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তিনি যা চাইবেন আমি তাই তাঁকে দেব; অবশেষে ঢাকায় আসতে রাজি করানো গেছে তাঁকে। তবে শর্ত দিয়েছেন তাঁর নাম গোপন রাখতে হবে। এবং তাঁকে শুধু নিয়ে যেতে হবে ডাক্তার তানিমুল তানহার কাছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞাটা রাখতে পারলাম না, মুখ ফসকে নামটা বলে ফেললাম।’
মাথা ঝাঁকালেন ডাক্তার। সিগারেটের ধোঁয়া লাগছে একটা চোখে, পানি বেরোচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে কিছুই করছেন না।
‘কিন্তু ডাক্তারের কাছে কিছু গোপন করা তো উচিত নয়, তাই না?’ কারিম সাহেব নিজের পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছেন।
ডাক্তার সাহেব সাড়া দিলেন না।
‘অনেক বছর আমরা, আমি আর নন্দিতা, সুখী জীবন কাটিয়েছি। শহরটা সুন্দর, ওখানকার মানুষজন কী ভালো, আমাদের বাড়িটা কত বড়—বাবা আমার জন্য রেখে গেছেন। পছন্দ করি এমন একটা পেশায় আছি আমি। টাকা কোনো দিন সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি।’
তাঁর দিকে পেছন ফিরে চৌকো কাচের পর্দার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ডাক্তার, রাস্তার ওপর চোখ।
‘বললে কেউ বিশ্বাস করবে, যত অসুখ-বিসুখই হোক, তাঁকে আমি গত দশ বছরে কখনো কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারিনি! তাঁকে বলেছি, শোনো, ত্রুটি যারই থাকুক, তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু সেটা মেরামত করা যায় কি না দেখতে দোষ কী!’
‘সত্যিই কি কিছু আসে যায় না?’ বললেন ডাক্তার, এখনো কারিম সাহেবের দিকে পেছন ফিরে রয়েছেন।
‘আমি আমার মনের কথা জানি’, বললেন কারিম। ‘একদমই কিছু আসে যায় না। আমি আমার স্ত্রীকে যে রকম ভালোবাসি, তার সীমা হলো সাত খুন মাফ।’
ডাক্তারের আরও কাছে সরে এসে কাচের ভেতর দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালেন কারিম সাহেব, বিস্ময় এবং আনন্দের সঙ্গে দেখলেন তাঁর স্ত্রী নন্দিতা একটা অটোরিকশা থেকে নামছেন। ‘ওই যে আমার স্ত্রী’, বললেন তিনি।
‘আমি জানি’, বললেন ডাক্তার তানহা।
‘আপনি জানেন?’ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালেন কারিম।
‘আপনি কাপড় পরুন, এনামুল কারিম সাহেব’, বললেন ডাক্তার।
‘কাপড় পরব? কিন্তু আপনি আমার পরীক্ষা করেননি।’
‘তার দরকার নেই’, বললেন তানহা। ‘আপনাকে পরীক্ষা না করেও আমি বলে দিতে পারি, ওই মহিলা যত দিন আপনার স্ত্রী থাকবেন, তত দিন আপনার কোনো সন্তান হবে না। আপনি কি সত্যি একজন দক্ষ অভিনেতা, মিস্টার কারিম? নাকি দেখে যেমনটা মনে হয় আপনি আসলেও সে রকম নিরীহ একজন মানুষ?’
কারিম সাহেব পিছু হটলেন। ‘কী ঘটছে বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি ঠিকানা ভুল করেননি, একদম ঠিক ডাক্তারের কাছে এসেছেন।’ ডাক্তারের ঠোঁটে অনুশোচনার ম্লান হাসি। ‘আপনাকে যখন বললাম আমি বিশেষজ্ঞ নই, আমার ভুল হয়েছিল। আপনাদের বিশেষ এই কেসে আমি অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ, একজন মানুষ যতটুকু হতে পারে তার চেয়ে কম নয়।’
ওয়েটিং রুম থেকে নন্দিতার গলা ভেসে এল। ‘ডাক্তার সাহেব কি আছেন?’
‘আছেন’, চেম্বার থেকে জবাব দিলেন ডাক্তার তানহা। ‘আই অ্যাম রেডি ফর অ্যানিথিং।’
চেম্বারে ঢুকলেন নন্দিতা, তাঁর পিছু নিয়ে ঢুকলেন মিসেস তানহাও, কোলের বাচ্চাটা এখনো হয়রান করছে তাঁকে। ‘ডাক্তার সাহেব এখনই দেখবেন আপনাকে।’
নন্দিদা দেখতে সুন্দর, ছোটখাটো, সবার ওপর কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছেন, ডাক্তারের ওপর স্থির হলো দৃষ্টি। ‘এত তাড়াতাড়ি কারিমকে দেখা হয়ে গেল তোমার?’
‘ওকে দেখার তো কিছু নেই’, টান টান সুরে বললেন ডাক্তার। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ‘আমি বুঝতে পারছি স্বামীর কাছে তুমি সৎ হতে পারোনি।’
মাথা ঝাঁকালেন নন্দিতা।
‘বুঝতেই পারছেন, পরস্পরকে আমরা চিনি’, কারিম সাহেবকে বললেন ডাক্তার তানহা।
জিবের ডগা দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন কারিম। ‘বুঝতে পারছি।’
‘তুমি এখন তোমার স্বামীর প্রতি পুরোপুরি সৎ হতে রাজি আছ?’ জানতে চাইলেন ডাক্তার। ‘তুমি চাও সেই সততা অর্জনে আমি তোমাকে সাহায্য করি?’
মৃদু গলায় নন্দিতা বললেন, ‘ডাক্তার যা ভালো বলে মনে করেন।’
চোখ বুজলেন তানহা। ‘ডাক্তার মনে করেন’, বললেন তিনি, ‘মিস্টার কারিমের জানা উচিত যে তাঁর স্ত্রী নার্সিংয়ের ছাত্রী থাকার সময় আমার দ্বারা প্রেগন্যান্ট হয়েছিলেন। অ্যাবরশনের ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু সার্জেনের ভুলে পেশেন্ট চিরকালের জন্য বন্ধ্যা হয়ে যান।’
কারিম সাহেব কিছু বলছেন না। বোধগম্য কিছু বলার জন্য আরও সময় নেবেন তিনি।
‘এই মুহূর্তে পৌঁছাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তোমাকে’, নন্দিতাকে বললেন ডাক্তার তানহা।
‘হ্যাঁ’, শব্দটা ফাঁপা শোনাল।
‘প্রতিশোধ মিষ্টি লাগছে?’
‘এটা প্রতিশোধ নয়।’ কাচের দেয়াল দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালেন নন্দিতা।
‘তা না হলে তুমি এত কষ্ট করতে গেলে কেন?’ জানতে চাইলেন তানহা।
‘কারণ, আমরা যখন যা কিছু করেছি সেসব কেন ভালোর জন্য করেছি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, এটা তুমি সব সময় আমার চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারো যেন জলবৎ তরলং।’