Abosar

<img src=https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2023-07%2F49ff4329-a805-4098-b850-04be509d5969%2FAhmed_Khan_ill_1.png?rect=0%2C0%2C1660%2C872&w=1200&ar=40%3A21&auto=format%2Ccompress&ogImage=true&mode=crop&overlay=&overlay_position=bottom&overlay_width_pct=1 />

ঘোগ

আহমেদ খান



বিড়ালটার নাম দেওয়া দরকার, অনেক দিনই ভেবেছে আতাহার।

বাসায় ফিরলেই মিউ মিউ করে পা জড়িয়ে ধরে। খানিকক্ষণ শরীর ঘেঁষে আহ্লাদ করে। তারপর চোখে মায়া টেনে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।

মিথিলা বলে, ঢং। একটু খাওয়ার জন্য এত ন্যাকামি করতে পারে এটা!

কিন্তু আতাহারের মনে হয়, শুধু খাবারের জন্য তো নয়, বরং বিড়ালটা আসলেই তাকে ভালোবাসে। ভালো না বাসলে এমন ছুটে আসে কেউ? এমন জাপটাজাপটি করে?

মিথিলার বিড়ালে অ্যালার্জি। এতটুকুই জানে আতাহার। বিড়ালে অ্যালার্জি হলে কী হয়, জানা নেই তার। শুধু খেয়াল করে, যেদিন মিথিলা তার রুমে আসে, সভয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। বলে, নাই? ফেলে দিছ?

আতাহার জানে সে যদি বলতে পারে, ফেলে দিছি… মিথিলা তাহলে তাকে জাপটে ধরবে। এই জাপটাজাপটি বিড়ালটার থেকে অনেক সুখকর নিশ্চয়। কে জানে, মিথিলা হয়তো আরও কিছু দিয়ে দেবে, যেটা পেতে আতাহারের মাঝেমধ্যেই খুব ইচ্ছা হয়। বদ্ধ রুমের ভেতর বড়জোর ১০ মিনিট চুমু খাওয়া যায়—পরেরটুকুতে যেতে এরপর মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই কাজ করে। আতাহার যেতে পারে না। মিথিলার এক শর্ত—বাকিটা বিয়ের পর। না হলে নাকি বিয়েটা ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে।

তা বিয়ে আতাহারের হয়ে যাওয়ার কোনো বাধা নেই।

মিথিলার বাসায় তাকে নিয়ে জানাজানি হয়েই আছে। এদিকে আতাহারের কেউ নেই দুনিয়ায়, যাকে জানিয়ে কিছু করতে হবে। তবু কী এক কারণে বিয়েটা হচ্ছে না।

বিছানার চাদরে আঙুল ঘোরাতে ঘোরাতে মিথিলা বলে, আজকের ফ্ল্যাট দেখি পুরো ফাঁকা!

আতাহার মিথিলার অন্য আঙুল নিয়ে খেলছিল। চকিতে একটা সম্ভাবনাই যেন জেগে ওঠে তার। বলে, সামনে দুদিন ছুটি না…সব গেছে গ্রামে। বলতে পারো ঈদের ছুটি পেয়ে গেছে।

মিথিলা হাসে। বলে, তোমরা যারা মফস্‌সলের, তারা বছরে সাত-আটটা ঈদ করে ফেল, না?

আতাহার কিছু বলে না। মিথিলা ঢাকারই মেয়ে। ফলে সে যে সময় ‘তোমরা যারা মফস্বলের’ বলে, শুনতে খুব একটা ভালো লাগে না তার। কিন্তু নিজের খারাপ লাগা জানানোর মতো সম্পর্কটা তাদের আর আছে কি না, বুঝতে পারে না! তার মনে হয়, মিথিলার সঙ্গে প্রেমটা আসলে শুধুই প্রেম। একটা সম্পর্কের গাঢ়ত্বে যেতে যে পারস্পরিক বোঝাপড়া দরকার, তা তাদের নেই; কখনো ছিলও না হয়তো। কিন্তু এসবের পরও মিথিলাকে আতাহারের রাজকুমারী মনে হয়…বা মনে হয় গুপ্তধন, যা তার পাওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু পেয়ে গেছে।

যাকে পেয়ে পৃথিবীর সব পাওয়া হয়ে গেছে, এমনকি তার জন্যও বিড়ালটাকে বাসা থেকে তাড়াতে পারে না আতাহার। অথচ প্রতি রাতেই সে পরিকল্পনা করে। একটা বস্তায় ভরে বিড়ালটাকে ফেলে আসবে কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তের দিকে। মাছ কিনতে গিয়ে দেখেছে, ওখানে কয়েকটা বিড়াল দিব্যি আছে। সারা দিন মাছের উচ্ছিষ্ট খেতে পায়…জেল্লাদার শরীর তাদের, ভোটকা ধরনের লেজ। মানে সুখী বিড়াল। আতাহার চায়, তার এই রবাহূত বিড়ালটাও সুখে থাকুক।

ভোরের দিকে মিথিলার ফোন পায় আতাহার। জড়ানো কণ্ঠে বলে, শোনো, তুমি কি আমার সাথে একটু কুমিল্লায় যেতে পারবে?

আতাহারের অফিস ছিল, তাতেই–বা কী! ১৫ মিনিটের আগেই তৈরি হয়ে যেতে পারে সে। ফোনে ফোনে একটা গাড়িও ঠিক করে ফেলে রেন্ট-এ-কার থেকে। মিথিলার ছোট খালা মারা গেছে। আইসিইউতে ছিল। প্রস্তুতিও সবার মধ্যে ছিল। মিথিলার পরিবারের সবাই আগেই চলে গেছে। মিথিলাকে যেতে হবে মরামুখ দেখতে।

সকালবেলার এই হঠাৎ ভ্রমণটা খারাপ লাগে না আতাহারের। একচিলতে রোদ, ঘুমভাঙা সড়কের রাত্রিজাগা মানুষ…পাশে সুরভিত মিথিলা। আতাহার ড্রাইভারকে বলে, সাবধানে চালাবেন, ভাই। আমাদের কোনো তাড়া নেই।

মিথিলা তাকায় শুধু। হাসে। তারও আসলে তাড়া নেই। ছোট খালার জানাজা হবে বাদ আসর। খবর পাওয়ামাত্র ছুটে এসেছে এটুকু দেখানোর তাড়ায় ঢিমেতালেই যাওয়া যায় আসলে। মিথিলার হাতটা নিজের তালুবন্দী করে আতাহার। গাড়ির এসিতে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আতাহারের ঘাড়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে মিথিলা। আতাহার বলে, এবার বিয়েটা করে ফেলি!

তুমি তো শুধু বলেই যাচ্ছ, করছ না!

আরে, আমি তো চাই-ই…কেন জানি হচ্ছে না।

মিথিলা এবার তাকায় মাথা তুলে। বলে, তোমার মধ্যে কনফিউশন আছে, তাই করছ না হয়তো।

কী বলো! আমার মধ্যে কী কনফিউশন থাকবে? আমি তো তালগাছ…একপায়ে দাঁড়িয়ে…

আসলে তুমি কোনো কিছু বদলাতে পারো না। এই যে মেসলাইফ ছেড়ে তুমি ফ্যামিলিলাইফে আসবে… নিজের একটা বাসা, নিজের একটা বউ…এত সব নতুন নতুন বিষয় যে তোমার সাথে ঘটবে, এটা তুমি ঠিক মেনে নিতে পারছ না! তুমি তোমার অভ্যস্ত লাইফ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাও না!

কী যে বলো না তুমি!

তুমি ওই বিড়ালকে ফেলতে পারো না কেন জানো? কারণ অফিস থেকে ফিরলে ও তোমাকে ওয়েলকাম করে, অন্তত তুমি তা মনে করো। তুমি এই ওয়েলকামে অভ্যস্ত হয়ে গেছ।

অভ্যাস কতই তো ভাঙি আমি। এই যে আজকে অফিসে যাইনি, তোমার সাথে বেরিয়েছি, এমনকি বিড়ালটাকে খাবারও দিয়ে আসিনি সকালের।

এবং এ নিয়ে তোমার ভেতরে একটা অপরাধবোধও আছে!

কী বলো এসব!

প্রতিবাদ আতাহার করে ঠিকই, কিন্তু মিথিলার বলার পর থেকেই তার মনে হয়, সত্যিই হয়তো সে অপরাধবোধে ভুগছে। রাতের ভাতের সাথে ক্যাটফুটের মিশেল দিয়ে একটা অখাদ্য তৈরি করে সে সকালে। সেটা খুবই আগ্রহ নিয়ে খায় বিড়ালটা। খেয়ে একটু ঘুরতে বেরোয়। পাশের ছাদ-কার্নিশগুলোতে যায়। তারপর ফিরে আসে। আজকে কী করছে কে জানে!

ফিরতে আতাহারের রাত হয়ে যায়।

বাসার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আতাহার অপেক্ষা করে। বিড়ালটা আসে না। তালা খুলে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আতাহার। বিড়ালটা এতক্ষণে ছুটে আসে। কিন্তু আজকে আসছে না। রবিনকে দেখে রাতের দাঁত মাজছে। আতাহার জানতে চায়, বিড়ালটাকে দেখেছে কি না। মুখে ফেনা নিয়ে রবিন গোঁ গোঁ করে যা বলে তার মানে সত্যি কিছু দাঁড়ায় কি না কে জানে!

আতাহার এরপর বেরিয়ে যায়। ভোরের আজান হওয়া পর্যন্ত বিড়ালটাকে খোঁজে, পায় না। সকালবেলা তার ফোনে টেক্সট আসে মিথিলার। তাতে লেখা, ‘তোমার অভ্যাস হয়ে আমি আর থাকতে পারব না, আতাহার। ভালো থেকো।’

মিথিলার কথা আতাহার বুঝে উঠতে পারে না। খুব বেশি বোঝার সুযোগও তার থাকে না। কারণ, সে দেখছে রাস্তার ওই পার থেকে ছুটে আসছে বিড়ালটা। জ্বলজ্বলে চোখ। দৌড়ে এসে আতাহারের পা জড়িয়ে নিজের শরীরটা ঘোরাতে থাকে। আর আতাহারের মনে হয়, বিড়ালটার একটা নাম দেওয়া দরকার, খুব সুন্দর একটা নাম!