‘ফিরে আসে নষ্ট মেঘ, ফিরে আসে
উটকো পাগল হাওয়া
ফিরে আসার ভয়ে আমার হয় না
কোথাও যাওয়া।’
লাইন দুটো ইয়াহিয়ার। ইয়াহিয়া খান। তিনি কবি বটে। কবির সঙ্গে আমার পরিচয় ডাব খেতে গিয়ে। কারওয়ান বাজারে। কারওয়ান বাজারের মসজিদের সামনে স্যান্ডেল–জুতার দোকান। তারই বিপরীতে ডাব নিয়ে বসে বিক্রেতারা। জন্ডিসফেরত আমি প্রতি বিকেলে সেখানে ডাব খেতে যাই। একটা ডাব লম্বা সময় ধরে খাই। নড়বড়ে এক বেঞ্চে বসে থাকি। থাকতে থাকতে দেখি, সন্ধ্যা হওয়ার মতো কুৎসিত কিছু আর নেই পৃথিবীতে।
এ রকম ঘোর কুৎসিত সময়ে ইয়াহিয়া খান আমাকে আবিষ্কার করে। ঢোলা প্যান্ট আর লালচে চেক শার্ট—দুটোরই মান্ধাতা আমল! আমাকে বলেন, ‘ভাই, একটা কবিতা শুনবেন?’
কবিতায় আমার কোনো আগ্রহ নেই, কবিতে তো আরও নেই। ফলে পরিচয়পর্ব ওখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু এরপরই লোকটা বলে উঠল, ‘আমি ইয়াহিয়া, ইয়াহিয়া খান!’
এই নাম এখন মিরজাফরের মতোই এই বাংলায়; ফলে আমাকে থমকাতে হয়। কত সালে জন্ম লোকটার? ১৯৭০/৭১ সালে হলেও নাহয় এমন নাম দেওয়া যায়। কিন্তু অত বয়স তো না কবির! ৩৫/৩৬ বছর হবে বড়জোর। আশির দশকে জন্মানো কারও নাম ইয়াহিয়া হয় কীভাবে?
ফলে কবিতা না শুনলেও লোকটাকে পাশে বসতে দিই। আর তখনই দেখি, লোকটার বাম পায়ের বেশ অনেকটা জুড়ে দগদগে ঘা। দেখেই মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই চুলকেছে। রক্তমাখা তরল এখনো চুইয়ে পড়ছে জায়গাটা থেকে। আমার থেকেও বেশি অনুভূতিপ্রবণ কোনো মাছি এরই মধ্যে ঘাটাজুড়ে ভনভন শুরু করে দিয়েছে।
লোকটা বলে, ‘ডাব খাওয়া মানুষ তো এখন নাই-ই! আপনি যে খাইতেছেন, তাতে বোঝা যায় এখনো নরম আছেন আপনি!’
কথাটায় প্রশংসা ছিল, নাকি অন্য কিছু, বোঝা আমার মুশকিল হলো। বললাম, ‘আপনার নাম আসলেই ইয়াহিয়া?’
‘জি। আব্বায় রাখছে। এ নিয়া কত হাসাহাসি হইছে ইস্কুলে! মাস্টাররাই বেশি হাসত। তখন অন্য পোলাপানরাও চান্স পাইত। সে এক মহা হাঙ্গামা!’
লোকটার মুখে হাসি। বললাম, ‘আপনি কি ডাব খেতে চান?’
‘না না। আমি তো গাঁও–গেরামের মানুষ। ডাব, নারকেল প্রতিদিনই খাই। ঢাকায় আইলে এই সব আর খাইতে ইচ্ছা করে না।’
—ঢাকায় কী খেতে ইচ্ছা করে?
ইয়াহিয়া খান এবার অনেকক্ষণ হাসে। তারপর খুব মজার কোনো কথা বলছে, এমনভাবে বলে, ঢাকায় আবার কী খাওনের মতো আছে?
আমার মেজাজটা খারাপ হলো। ঢাকার বাইরে থেকে আসা মানুষের ঢাকা নিয়ে কোনো কটূক্তি সহ্য হয় না। আমি উঠতে ধরলাম। উঠতে উঠতে বললাম, তাইলে না আসলেই তো পারেন ঢাকায়!
—কবিতার জইন্য আসি ভাই। কবিতা খারাপ লিখি না। কিন্তু কেউ ছাপে না, জানেন!
—কেন, ছাপে না কেন?
—নামের কারণে ছাপে না। সম্পাদকেরা কয়, এইটা আবার কী নাম! এতো পাক–জল্লাদের নামে নাম।
—ঠিকই তো বলে। এই নাম চেঞ্জ করেন না ক্যান? কবিরা তো নিজেদের নাম বদলিয়েই নেয় নাকি। আসল নাম আর লেখার নাম দুইটা ভিন্ন ভিন্ন হয়।
—হয় তো! কিন্তু আমি চাই না। আমি চাই আমার এই নামেই লেখা ছাপা হোক, অসুবিধা কী?
—আমার কোনো অসুবিধা নাই। আসি।
—আপনার নাম কী?
—আমার? মোস্তাকিম রাসেল।
—সুন্দর নাম। পরের বার দেখা হইলে আমার কবিতা শুইনেন কিন্তু!
দুই.
আমার কোনো ধারণা ছিল না ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয়বারও দেখা হতে পারে। তাও আবার গুলশানে! সেদিন আমি রুনার জন্য অপেক্ষা করছি। ওর অফিসের পাশে। একটা চায়ের দোকানে। হঠাৎ ইয়াহিয়ার কণ্ঠ, ‘ভাই, কেমন আছেন?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কীই–বা করার থাকে!
ইয়াহিয়া বলে, ‘আইজ কিন্তু কবিতা শুনার কথা আপনের!’
—এইখানে কী আপনার?
—জানেন না, এইখানে একটা বড় পত্রিকার অফিস। কবিতা নিয়া আসছি।
—কবিতা নিয়েছে সম্পাদক?
ইয়াহিয়া খান হাসে। হাসিতে বোঝা যায়, সম্পাদকের হৃদয়হরণ সে এখনো করতে পারেনি। কোনোমতে বলেন, ‘শুনবেন কবিতা?’
আমি এড়ানোর জন্য বলি, ‘কবিতা না, আপনি নাহয় গল্প বলেন। আপনার নামের গল্প!’
—নামের তো কোনো গল্প নাই ভাই।
—এই নাম আপনার আব্বা কেন রেখেছেন, কখনো জিজ্ঞেস করেননি?
ইয়াহিয়া তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘না। কোনোদিন জানতে চাই নাই। কিন্তু আমি জানি, কেন রাখছে!’
—কেন?
ইয়াহিয়া কোনো উত্তর দেয় না। একটু আফসোস নিয়ে বলে, ‘কবিতা তাইলে শুনবেন না?’
আমি এবার একটু গুগলি মারি, ‘কবির কবিতা এইভাবে না, পত্রিকায় ছাপুক, একবারে পড়ে নিব।’
ইয়াহিয়া হাসে শুধু। তারপর প্যান্ট তুলে তার সেই পুরোনো ঘাটা চুলকে নেয়।
তিন.
এরপর ইয়াহিয়াকে মনে রাখার আর কোনো দরকার ছিল না আমার জীবনে। মনেও ছিল না আসলে। কিন্তু প্রায় বছর দুয়েক পর আমার অফিসের ঠিকানায় একটা কুরিয়ার এলে ইয়াহিয়া খানকে আবার মনে পড়ল আমার। কুরিয়ারে একটা পত্রিকা। পত্রিকার ভেতর সাহিত্য পাতা। পাতায় অনেকগুলো কবিতার মধ্যে একটা কবিতার নাম ‘ফেরা’। কবির নাম ইয়াহিয়া খান। আর পত্রিকার সঙ্গেই একটা চিঠি। কম্পিউটারে কম্পোজ করা।
‘ভাই,
কেমন আছেন? আপনার দোয়ায় শেষ পর্যন্ত আমার নামেই কবিতা ছাপা হয়েছে। এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের খবর। ইয়াহিয়া খান নামটা নিয়ে কমবেশি সবারই আগ্রহ থাকে; আপনারও আগ্রহ ছিল। সেদিন সেই আগ্রহ মেটাতে পারিনি বলে মার্জনা করবেন। আব্বার দুই স্ত্রী হলেও আমি একমাত্র সন্তান। আব্বা যৌবনে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। যুদ্ধের বছরে পালিয়ে তিনি ভারতে চলে যান। সেখান থেকেই ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ শুরু করেন। দেশ স্বাধীন হলে নিজ গ্রামে ফিরে বড় আম্মার খোঁজ করেন। কিন্তু খুঁজলে কী হবে, কোথাও পাননি তাঁকে! আব্বার জন্য নিশ্চয়ই এটা ছিল অনেক বেদনার। এতটাই যে এর প্রায় দশ বছরেও আব্বা আর সংসার করেননি। অনেক পরে ভাইদের চাপে আব্বা আমার আম্মাকে বিয়ে করেন। সবাই ভেবেছিল, আব্বা সব ভুলে গেছে। কিন্তু জন্মের পর আমার নাম যখন তিনি ইয়াহিয়া খান রাখলেন; সবাই বুঝল বড় আম্মাকে আব্বা আসলে ভুলতে পারেননি।
আমাকে তিনি দুই চোখে দেখতে পারতেন না। আমি আব্বার কোলে যাওয়ার বায়না করলে বারান্দা থেকে ধরে ছুড়ে ফেলে দিতেন উঠানে। বড় হয়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি আমাকে না, আসলে ইয়াহিয়া খানকে ঘৃণা করেন।
সতেরো বছরের মতো বয়স যখন, সে সময় আব্বা আমাকে পুড়িয়ে মারতে চান। খেয়াল করেছেন কি, আমার পায়ে একটা পোড়া ঘা আছে। এই ঘা আমি ওই বয়স থেকে পুষে যাচ্ছি। অনেকে ডাক্তার দেখাতে বলেছে। তবে ডাক্তারের কাছে আমার যাওয়া হয়নি। কখনো কখনো মনে হয়েছে, ঘাটা আমাকে আব্বার কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়েছে, এই ঘা খুব জরুরি। কখনো কখনো মনে হয়, কিছু কিছু ঘা আসলে জরুরিই।
আমার আব্বার মাথা ঠিক নেই বলে তাঁকে পাবনা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক বছর আগেই। ওরা এখন বলে, আমারও মাথা ঠিক নেই। আমি হাসি। কবিরা একটু পাগলা কিসিমের হতেই পারে, তাই না ভাইজান?
ভালো থাকবেন।
ইতি
আপনার ইয়াহিয়া খান।’
চার.
মাঝেমধ্যে আমি এখন পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো দেখি। খুঁজে দেখি ইয়াহিয়া খানের নতুন কোনো কবিতা ছাপা হয়েছে কি না! আমার মনে হয়, ইয়াহিয়া খান অনেক কবিতা লিখবে; এই জীবনে।