আমি এখন ৮। জুতার লেস বাঁধতে পারি। এটা নতুন জুতা, সাদা রং আর অনেকগুলো গোলাপি পেপা-পিগ, লেসটাও গোলাপি। আমি আম্মার সঙ্গে দোকানে গিয়ে কিনেছি, আজকে রাশিদা ফুপির বিয়ে তো, তাই। এখন বিকেল। একটু পরেই আব্বা আসবে, তারপর আমরা যাব। আমি আম্মার ড্রেসিং টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে দেখছি আমার সুন্দর জুতা। আম্মা ঘরে ঢোকার আগেই নেমে যেতে হবে। এখান থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়তে খুব মজা। আমি প্রায়ই করি। দুপুরবেলায় করলে দোতলার চাচি বকা দেয়, সে তখন ঘুমায় তো, সে জন্য।
তমাল আমার ভাই। এখন মে, তারপরে জুন, তারপরে জুলাই মাসে ওর ৭ হবে। আমার নাম তিতলি। এইগুলো আমাদের ডাকনাম, ভালো নামও আছে। আমরা দুপুরে ঘুমাই না। ফ্রিজ থেকে চুপি চুপি বরফ নিয়ে খাই আর বারান্দার মাটিতে ফেলে স্লিপার স্লিপার খেলি। আমরা অনেক হাসি। জোরে হাসলে আম্মা বুঝে যায়, তাই মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি। তমালকেও শিখিয়েছি। মাঝেমধ্যে আমরা ক্রসফায়ার ক্রসফায়ার খেলতাম। এতে অনেক দৌড়াতে হয়, তারপর ঠুস করে গুলি লাগে আর মরে যেতে হয়। মিথ্যামিথ্যি। কিন্তু একদিন আব্বা ডেকে বলেছে, আর ওই খেলা না খেলতে। এটা নাকি ছোটদের খেলা না। এখন তাই অন্য খেলা খেলি।
আয়নার ভেতরে আরেকটা ঘর, সেখানে আরেকটা আমি। সে–ও ড্রেসিং টেবিলে দাঁড়ানো। এটা আমার ঈদের জামা ছিল। আম্মা সেলাই করেছে মেশিনে। মেশিনের নাম সিঙ্গার। আমি বানান পারি। আব্বা বলে সেলাই করার সময় মেশিন খুশিতে গান গায়, তাই ওর নাম সিঙ্গার। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম গান শোনার জন্য। মেশিন না, আম্মা গান গায়। গোলাপি জামা, সাদা লেসের ডিজাইন করা। আগে শুধু দুবার পরেছি। এই জুতাগুলো জামার সঙ্গে মিলিয়ে কিনেছি।
কলবেল বাজছে। নিশ্চয়ই আব্বা এসেছে! আম্মা গোলাপির ওপরে সাদা ফুল ফুল শাড়ি পরেছে। বেড়াতে গেলে আম্মা আর আমি এক রঙের ড্রেস পরি। তমাল আর আব্বা এক রঙের। তমাল পরেছে কালো পাঞ্জাবি সাদা পায়জামা। বারান্দায় আম্মা আর তমাল দরজা খুলতে যাচ্ছে, আমিও ওদের সঙ্গে। পিপহোলে দেখে নিয়ে আম্মা হাত তুলে ইশারা করল—এক, দুই, তিন। তারপর দরজা খুলে দিল। আমরা তিনজন একসঙ্গে কুর্নিশ করতে করতে আব্বাকে বললাম, ‘স্বাগত, জাহাঁপনা!’ সবাই খুব হাসলাম। আম্মার জন্য বেলি ফুলের মালা এনেছে আব্বা আর আমাদের জন্য অনেক লিচু।
আব্বার একটা ইউনিভার্সিটি আছে—ঢাকা ইউনিভার্সিটি। আমি কত গেছি সেখানে! আব্বার ঘরে বড় একটা টেবিল আছে। আমি হোয়াইট বোর্ডে অনেক কিছু লিখেছিলাম—লাল, নীল, কালো আর সবুজ মার্কার দিয়ে। সেখানে সবাই আব্বাকে ‘স্যার’ বলে। রাশিদা ফুপি, শ্যামল চাচু, আবিদ চাচু, মিনু ফুপি আরও অনেকজন। সবাই আব্বার কথা শোনে কারণ আব্বা তো কিং অব দ্য ইউনিভার্স। রাশিদা ফুপি আমাদের বাসায়ও আসে। আমাকে অনেক চকলেট দেয়। আম্মার সঙ্গে জলপাইয়ের আচার খায়, হাসে আর কথা বলে। আজকে ও বউ সাজবে। আমার বউ দেখতে অনেক ভালো লাগে।
বোরহানি খুব ভালো আর ঝাল। আমারটা শেষ করে আম্মার থেকেও একটু খেয়েছি। এখানে অনেক মানুষ, আমি শুধু লিজা আন্টি আর সেলিম চাচুকে চিনি। আব্বাকে সবাই চেনে। খাওয়ার সময় কতবার বলল, ‘স্যার, আরেকটু দিই, আরেকটু দিই?’ আমাকেও জিজ্ঞেস করল, কোন ক্লাসে পড়ি। একজন গাল টিপে আদর করল। আমার একটুও ভালো লাগে না, ইচ্ছা করে ওরও গাল টিপে বুঝিয়ে দিই কেমন মজা। কিন্তু লক্ষ্মী মেয়েদের চুপ করে থাকতে হয়।
বউ দেখার সময় খুব মজা হলো। আমাদের সামনে অনেক লোক, সবাই বউ দেখতে চায়। হঠাৎ আসিফ চাচু আর শ্যামল চাচু এসে আব্বাকে বলল, ‘স্যার, আপনারা আসেন আমাদের সঙ্গে।’ আমরা সবার আগে রাশিদা ফুপির কাছে চলে গেলাম। ওকে একদম রাজকন্যার মতন লাগছিল দেখতে। মাথায় টিকলি আর টায়রাও ছিল। আব্বাকে দেখেই ওর সিংহাসন থেকে নেমে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। আমি তো অবাক! বউ কখনো উঠে দাঁড়ায়? তারপর আমাদের ছবি তুলে দিল একটা লোক।
আমরা রিকশায় করে বাসায় ফিরছি। রাত হয়ে গেছে। বেলি ফুলের মালাটা আম্মা চুলে পরেছে, খুব সুন্দর গন্ধ। আমি দাঁড়িয়েছি আব্বার সামনে আর তমাল আম্মার সামনে। আমরা রক-পেপার-সিজারস খেলছি। আব্বা বলল, ‘তমাল-তিতলি, দেখছিস তোরা চাঁদটাও আমাদের সঙ্গে আসতেছে?’ আম্মা শুনে হাসতে হাসতে বলল, ‘আসবে না? চাঁদের ঘাড়ে কয়টা মাথা? মহারাজ চলেছেন মৃগয়ায়।’ বড়দের সব কথা আমি বুঝতে পারি না। চাঁদটা সত্যি সত্যিই চলছে আমাদের সঙ্গে। রিকশার চাকায় শব্দ হচ্ছে আর একটু একটু দোল খাচ্ছে রিকশাটা। আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে আর আমি তার গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি, ঘুম পাচ্ছে। এ রকম আমার খুব মজা লাগে, যেন অচিন দেশে যাচ্ছি…
আমার একটা পেপা-পিগ জুতা খুলে গেছে। আম্মা বলল, খোঁজা যাবে না। আম্মা আমার হাত ধরে আছে শক্ত করে। কোথায় যেন যাচ্ছি আমরা, অনেক অনেক লোক। রাস্তায় আর জায়গা নেই, সব রিকশা–গাড়ি থেমে আছে। দৌড়াতে দৌড়াতে লোকেরা বলছে, ‘টিয়ার গ্যাস, টিয়ার গ্যাস।’ ওই যে নিউমার্কেট, আমি চিনি। সবাই আরও দৌড়াচ্ছে আর বলছে, ‘গুলি করতেছে!’ ঠুস করে শব্দ হলো, কে যেন পড়ে গেছে, মিথ্যামিথ্যি না। আব্বাকে জড়িয়ে ধরেছি আমি আর আম্মা। বেলি ফুলের মালাটা কই? তমাল কাঁদছে আব্বার কোলে। পায়ে খুব ব্যথা করছে। বাসায় কারেন্ট চলে গেলে আব্বা বলে আমরা কিংয়ের বাচ্চা, তাই কোনো ভয় নেই, ফুঁ দিলেই ভূত উড়ে যাবে। চাঁদটা এখনো আছে। আমি মুখ তুলে আব্বার দিকে চাইলাম—
আব্বার খুব কান্না পাচ্ছে, তবু কাঁদছে না…