‘আমার হাতে একজন মানুষ খুন হতে যাচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগছে।’ কথাটা বলেই এক টুকরা হাসি দিল মিথি। ওতে রহস্য আছে, আছে গোপনীয়তাও।
আমেরিকা যাচ্ছি। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ করলাম একটু আগে। পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে ৮ নম্বর গেটের সামনে বসে আছি, পাশে মিথি আমার স্ত্রী। মিথির মুখে কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল আমার। মুখের দিকে তাকালাম ওর। হাসিটা এখনো ছেয়ে আছে মুখে। ওটার রেশ কাটার আগেই প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার হাতে মানুষ খুন হতে যাচ্ছে!’
‘হ্যাঁ।’
‘মানে?
‘মানে খুব সোজা। তুমি একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে অয়ন।’
‘না, আমি বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা খুলে বলো।’ মিথির চোখের দিকে তাকাই আমি।
‘তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে কত দিন আগে?’ চোখ সরু হয়ে গেল মিথির।
‘প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা কোরো না, প্লিজ। জবাব দাও আমাকে তোমার হাতে মানুষ খুন হতে যাচ্ছে, মানে কী?’ গলাটা বেশ রূঢ় শোনাল আমার।
‘মোটেও প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছি না আমি। আমার প্রশ্নটার জবাব দাও আগে।’
‘তিন মাস।’
‘মধুরাত হয়েছে আমাদের?’
‘না।’
‘হানিমুন?’
‘না।’
হাসিতে বিদ্রূপ মেশাল মিথি, ‘বিয়ে হয়েছে অথচ বাসর ও হানিমুন কিছুই হয়নি! এটা কি সেরা ট্র্যাজেডি নয়?’
‘জানি না।’
‘আসলে আমি একটা কাগজের ফুল। কাগজের ফুলের সুবাস নেই, সৌন্দর্য আর রূপও নেই। সম্ভবত তোমাকে তাই আকৃষ্ট করতে পারিনি।’ মিথির গলায় অভিমান।
‘কথাটা যখন তুলেই ফেলেছ, তাহলে তোমাকে বলি ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি পরিরা নাকি খুব সুন্দর হয়, হাসলে মুক্তা ঝরে। কবি-সাহিত্যিকেরা নারীর বর্ণনা দিয়েছেন নানাভাবে হরিণমায়া চোখ; পটোলচেরা আঁখি; ফুলের মতো মুখ; দুধে-আলতা বরন ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। কিন্তু একটা কথা কি জানো?’
মাথা এদিক-ওদিক করল মিথি, কিছু বলল না।
‘তোমাকে দেখার পর আমার তা মনে হয়নি।’
‘কী মনে হয়নি?’
‘নারীর রূপ-সৌন্দর্যের বর্ণনা কিছুই হয়নি।’
‘তাই নাকি!’
‘হ্যাঁ। নারী কত সুন্দর হতে পারে, তা তোমাকে না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না।’
‘তাহলে তুমিই বর্ণনা দাও।’ তাচ্ছিল্যের গলায় বলল মিথি।
‘বর্ণনা দিতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে তুমি।’ বলেই ওর চোখের দিকে তাকালাম আমি আবার।
‘দুবাইয়ে আট ঘণ্টার ট্রানজিট আছে। হোটেলে থাকতে হবে আমাদের।’ কথাটা বলে ঠোঁট দুটোতে বিশেষ ভঙ্গিমা করল মিথি।
জানালার পাশেই দুজনের সিট আমাদের। বহুদিনের শখ ছিল এভাবে বসার। সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে মিথির দিকে তাকালাম। ও আমার ডান হাতটা ধরল আলতো করে, ‘বিয়ের সময় তিনবার কবুল বলতে হয়। আমাকে বলতে হয়নি। তোমাকে বলতে হয়েছিল?’
‘না।’
শব্দ করে হাসল মিথি, ‘বিয়ে হয়েছে, কিন্তু পাত্র-পাত্রীর কেউ কবুল বলেনি!’ হাসিটা বাড়িয়ে দিল সে, ‘এ রকম নজির আছে পৃথিবীতে?’
‘জানি না।’
‘অথচ আমার পাসপোর্টে স্বামীর নাম অয়ন, তোমার পাসপোর্টে স্ত্রীর নাম মিথি।’ হাতের পাসপোর্ট মেলে ধরল সে।
মিথির চেহারায় হাজারো প্রশ্ন-চিহ্ন। এবার আমি নিজেই প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম। বিমান ছেড়েছে। বাইরে তাকালাম। রানওয়েতে গতি বাড়ছে বিমানের।
বিমান উঁচুতে উঠতেই বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল আমার। মা, মাটি ও মানুষকে ছেড়ে আমেরিকায় যাচ্ছি আমি, স্থায়ীভাবে, ভাবতেই ভিজে উঠল দুচোখ।
আমার কাঁধে মাথা রেখেছে মিথি। হেডফোন কানে ঘুমিয়ে পড়েছে এরই মধ্যে। ঘুম এসে গেল আমারও।
ঘুম ভাঙল দুবাইয়ে। প্লেন অলরেডি ল্যান্ড করেছে তখন। নামার পর স্যাটেল বাস নিয়ে গেল হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে এলাম নিচতলার বুফে থেকে।
হোটেল রুমে দুটি বেড, আলাদা। মাঝখানে মাথার পাশে একটা সাইড টেবিল। ডান পাশের বেডে আমি, বাঁয়েরটাতে মিথি। বেডে হেলান দিতে দিতে ও বলল, ‘তোমার বউ বানিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে দিচ্ছ আমাকে। এর জন্য বিয়ে করতে হয়েছে আমাকে।’ মিথি দূরাগত গলায় বলল, ‘কত টাকা নিয়েছ তুমি?’
‘আমি কোনো টাকা নিইনি।’
‘পুরো ৫০ লাখ টাকা তাহলে কে নিয়েছে?’ ঝাঁজাল শোনাল মিথির গলা।
‘আমার ল ইয়ার, যে আমার কাগজপত্র রেডি করে দিয়েছিল।’ অকপটে স্বীকার করলাম।
‘কেন?’
‘আমেরিকায় যেতে যা যা করার সব করে দেবেন তিনি, এ জন্য।’
ভ্রু কোঁচকাল মিথি।
হাই তুললাম আমি, ‘আট ঘণ্টা ট্রানজিটের তিন ঘণ্টা অলরেডি শেষ। বাকি সময়টুকু ঘুমাব। ক্লান্ত লাগছে অনেক।’
মাথা দোলাল মিথি, কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল সেও।
ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের শব্দে। রেডি হয়ে বের হলাম দ্রুত। ট্রানজিটের সব কাজ শেষ করে প্লেনে উঠলাম আমরা। জানালার পাশে সিট নেই এবার। তবে প্লেনের ভেতরটা বেশ প্রশস্ত।
যতই সময় যাচ্ছে, দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হচ্ছে মিথির চেহারায়। জেএফকে এয়ারপোর্টে নেমেই ও যাবে মিশিগানে, আমি ফ্লোরিডায়। ছয় মাস পর দেখা হবে একটি অ্যাটর্নি অফিসে। সেদিন সে ডিভোর্স দেবে আমাকে। ব্যাপারটা মনে হতেই খারাপ লাগছে আমার।
জেএফকে পৌঁছাতে সময় লাগল ১২ ঘণ্টা। দীর্ঘ এই সময়টায় কোনো কথা বলেনি মিথি। কখনো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছে, কখনো কেঁদেছে।
ল্যান্ড করল প্লেন। ইমিগ্রেশন শেষ করে বাইরে বের হলাম আমরা। সঙ্গে সঙ্গে মিথির নাম ধরে কে যেন ডাকতে লাগল। সামনের ডান পাশে মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক, কোট-টাই পরা। মাথায় চুল নেই তেমন। ক্লিন শেভড। তবে বয়স লুকানোর চেষ্টায় সফল হননি তিনি। হাতে একটা ফুলের তোড়া।
আঙুল দিয়ে ইশারা করল মিথি। লোকটাকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার স্বামী। নিতে এসেছেন আমাকে।’
‘চলে যাচ্ছ?’
‘আমি তো তোমার কাগজের বউ। সুতরাং কাগজ নিয়েই থেকো।’
‘আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও।’
‘কোন প্রশ্ন?’
‘ওই যে, তোমার হাতে নাকি একজন মানুষ খুন হতে যাচ্ছে!’
‘যাচ্ছে তো। শোনো মিস্টার, যাকে গুলি করা হয়, সাথে সাথে টের পায় না সে। টের পায় একটু পরে। তুমিও টের পাবে, একটু পরেই।’ কথাটা বলে দু’পা এগিয়ে গেল মিথি। ঘুরে দাঁড়াল আলতো। মুখে দুষ্টুমির হাসি, ‘খুন হওয়ার আগে কেউ জানে না কত যন্ত্রণা এতে, কত বেদনা ভর করে বুকে।’
বুকের বাঁ পাশটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। চিনচিন ব্যথা শুরু হয়েছে সেখানে। ডান হাতটা সেখানে রেখে সামনে তাকাই। মিথি চলে গেছে অনেক দূর, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে স্বামীর বাঁ হাতটা।